Shriheen Path – শ্রীহীন পথ

(বাস্তব-অঙ্গনে রূপক-আশ্রিত ছোটগল্প)

শ্রীহীন পথ

– হরবিলাস সরকার

আশ্বিনের অকালবর্ষণে রাস্তাগুলোর শরীর ক্ষয়ে ক্ষয়ে হাড়গোড় বেরিয়ে পড়েছে। তাঁর অন্তহীন দুঃখ-ব্যথা। নিম্নচাপের বৃষ্টি, ক্ষান্ত নেই। প্রতিদিনের পথচারী ‘পথিক’ বর্ষাতি পরে স্কুটিতে চড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে রওনা হল গ্রামীণ পিচ-রাস্তা ধরে। কিছুদূর যাবার পর গাড়িটা অতর্কিতে এক ঝটকায় উল্টে গেল। পথিকের আঘাত লাগল পায়ে, হাতে। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। যত রাগ সে উগরে দিল পথের উপরই, “পথ রে! কেন তোর এই বেহাল দশা ? আমার আঘাত লাগল, রক্ত ঝরল, সব তোরই জন্য।”

বেদনার্ত পথ উত্তর দিল, “বন্ধু পথিক, তোমার ব্যথা আমি অনুভব করছি। আমি দুঃখিত, ক্ষমাপ্রার্থী। তবে তুমি আমাকে দোষ দিওনা।”

“তবে কাকে দোষ দেব? কেউ তো আর আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়নি। আমার গাড়িটা কি এমনি এমনি উল্টে গেল? ওরও বোধ হয় বুকের পাঁজরটা ভেঙে গেল।”

পথ এবার অভিমান করে বলল, “তোমাকে আমি না বন্ধু বলেছি! এই তার প্রতিদান? তোমরা মানুষেরা শুধু বাইরেটাই দেখে  বিচার কর, ভেতরটা দেখ না। যদি শুনতে চাও, কিছু কথা বলতে পারি তোমাকে। যুগ যুগ ধরে আমি কত ঘটনার সাক্ষী। বলতে গেলে সে অনেক বড় গল্প হবে।”

“ঠিক আছে, এত করে যখন বলছো, বলো, তোমার প্রাণ খুলে বলো,” এই বলে পথিক ধীরে ধীরে উঠল। গাড়িটাকেও তুলে দাঁড় করালো। ঝোপ থেকে বনতুলসী তুলে এনে ডগা ছিঁড়ে কপালে রস লাগালো। তারপর রাস্তার ধারে একটা চারদিক খোলা নির্জন ছাউনি দেখে এগিয়ে গেল। তার নিচে পুরানো ইট সাজিয়ে পায়ের মতো করে বানিয়ে তার উপর একটা কাঠের তক্তা পাতা আছে। সেখানেই বসে পড়ল পথিক।

shriheen path

পথ এবার বলতে লাগল, “এই যে তুমি যেখানে বসে পড়লে, ওটা দীননাথের চায়ের দোকান। ক’দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে বলে খদ্দের না আসায় দোকান খুলছে না। খোলা বলতে – দোকানদারি করছে না, এটা বোঝাতে চাইছি। ও বেচারা থাকলে বলতে পারতো, আমার এই হতশ্রী দশার কারণ কী। মাত্র ছ’মাস আগে আমার জীর্ণ বুকের উপর যখন নতুন চাদর পরানো হয়, দীননাথ বেশ জোরালো প্রতিবাদ করেছিল। অর্থপিশাচ ঠিকাদারকে বলেছিল, “কী করছেন দাদা! একেবারে নিম্নমানের পিচ-পাথরের চাদর পরাচ্ছেন? ভেতরে রাবিশ ভরে উপরটা চকচকে করছেন। এই রাস্তা ক’দিন টিকবে?”

পথিক এসব শুনে কিছুটা বিতর্কের ঢঙে বলল,“আচ্ছা, চাআলার কথা অনুসারে বোঝা গেল – খুব বাজে উপাদান দিয়ে রাস্তা বানিয়ে , রোলারের চাকার পেষণে তা মসৃণ, চকচকে করা হয়েছিল। তারপর তত্ত্বাবধায়ক, ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্শনে এসেছিল। সুন্দর একখানা শংসাপত্রও লিখেছিল। অফিসের আধিকারিকবাবুটিও চটজলদি বিল পাস করে দিল। এমনটা হতে পারে ? গলদ  থাকলে বিল পাস হওয়া সম্ভব কি? পথ, তুমি ভুল বলছো। ঐ দীননাথ চাআলা তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে।”

পথের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। তবুও বলল,“বন্ধু পথিক, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? চাআলাইবা আমাকে ভুল বোঝাবে কেন? ওর কী স্বার্থ আছে? বন্ধুগো,শোনো তাহলে। অনেকটা সময় তো বিশ্রাম নিলে, এতক্ষণে ব্যথাটা নিশ্চয় একটু কমেছে। এবার এগিয়ে চলো। ওই যে দেখছো – অনেকটা ফাঁকা জায়গা, ওখানে বেশ মোটাসোটা ‘শিশু’দের দুই সদস্য ছিল। ওদের ধড়, মুণ্ডু নেই, নিচের অংশটা পড়ে আছে। ওখানে গিয়ে একটু দাঁড়ালেই প্রমাণটা তুমি পেয়ে যাবে।”

পথিক ভাবতে ভাবতে গাড়িতে করে ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল পথকে, “কই, এখানে তো কোনো ধড়-মুণ্ডুহীন দেহ নেই। তুমি যে দুই শিশুর কাটা দেহের কথা বললে, আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। আর শিশুদের ধড়-মুণ্ডুহীন দেহ কি কথা বলতে পারে? কী প্রমান পাবো আমি? তুমি কি আমার সাথে ছেলেখেলা করছ?”

“ছি! ছি! আমি তোমার সাথে ছেলেখেলা করতে যাব কেন? তুমি বুঝতে ভুল করেছ। দুই শিশু-সদস্য বলতে আমি দুই ‘শিশুগাছে’র কথা বলেছি। ওরা এখানে ছিল। প্রায় দুই যুগ ধরে সূর্যের প্রখর রোদে ওরা ছায়া দিত। ওরা অক্সিজেন দিত, কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে খেয়ে নিত। তাছাড়া রাস্তার পরিবেশের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছিল। এইতো, গেল রাতে দুষ্ট লোকেরা ওদেরকে কেটে নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু ওদের গোড়া মাটির মধ্যে পড়ে আছে। এখনও ওদের হৃদযন্ত্র শেষবারের মতো ধুকপুক করছে। মরার আগে ওরা নিশ্চয়ই মিথ্যে বলবে না। দাঁড়াও, আমি জিজ্ঞেস করছি, ‘বলো শিশু, তোমাদের এই অবস্থা কারা, কেনই বা করল? আর আমার জীর্ণদশার ব্যাপারেও তোমরা সবটাই জানো। তাও বলো এই পথিককে’।”

shriheen path

এতদিনের সখা সাড়া না দিয়ে কি পারে?আড়ষ্ট ক্ষীন গলায় দুই মৃতপ্রায় ‘শিশু’র একটি বলতে লাগলো, “শোনো তবে পথিক, বেশি কথা তো বলতে পারবোনা। সংক্ষেপে বলি। রাত তখন গভীর। হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। বর্ষাতি পরিহিত কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা দুই ব্যক্তি বাইক হাঁকিয়ে আমাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। একজন ফোনে আস্তে করে কথা বলছিল। কয়েক মুহূর্তকাল পরেই একটা ক্রেনযুক্ত মালবাহী গাড়ি এসে আলো নিভিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

shriheen path

জনা চারেক লোক গাছ কাটার যন্ত্রপাতি নিয়ে নেমে পড়ল। ওদের একজন সম্ভবত এ কাজে আজই নতুন এসেছে। সে বাইক-ওয়ালাদের জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা, অসুবিধার কোন কারণ নেই তো?’ ওপাশ থেকে একজন সঙ্গে সঙ্গে দম্ভ প্রকাশ করে উত্তর দিল, ‘তোরা নির্ভাবনায় কাট্। থানা নাক গলাবে না।  ব্লকের বড়কর্তার সঙ্গে চুক্তি আছে। তাছাড়া  এলাকাটা আমাদের হাতের মুঠোয়, আমাদের কথাতেই প্রশাসন চলে রে। আমাদের সামনে এসে কেউ দাঁড়ানোর সাহস করে না।’ এরপর ওই ভাড়াটে লোকগুলো আমাদের দুই ‘শিশু’র একজনকে কাটতে শুরু করলে বাইক-ওয়ালারা চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল – গুঁড়িগুলো জায়গা মতো পৌঁছে দিতে। এভাবে প্রায়ই ওই লোভী, নিজের আখের গুছানো মানুষেরা রাস্তার দু’ধারের আমাদের কত যে সদস্যদের এবং অন্যান্য প্রজাতির সদস্যদের কেটে নিয়ে গেছে বা যাচ্ছে, তার হিসেব নেই। এবার বলি রাস্তার কথা। এই রাস্তা তো মোটামুটি বছর পাঁচেক অন্তর দায়সারাভাবে মেরামত করা হয়। এবারও যখন তৈরি হল, আমাদের ছায়াতেই ঠিকাদার ব্যাটা ডেরা বানিয়েছিল। শুরুতেই সে হেড মিস্ত্রিকে পরামর্শ দিয়েছিল – যত কম খরচে কাজটা সেরে ফেলা যায়, তার জন্য পরিকল্পনা করতে। মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিল, ‘অনেক টাকা ঢালতে হয়েছে কাজটা পেতে। ইঞ্জিনিয়ার, তত্ত্বাবধায়ক, এলাকার মাথাদের মুখ বন্ধ করতে আরও অনেকটাই ঢালতে হবে’।”

পথ এবার বলল, “শুনলে পথিক? এবার বিশ্বাস করলে তো – কেন আমার এই হতদশা?” পথিক মনে মনে ভাবল – মরণকালে কোন জীবই মিথ্যা বলে না। এরপর মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ বন্ধু, বিশ্বাস করলাম।”

পথ তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে পথিকের সাথে এগোতে লাগলো। উল্টো দিক থেকে একটা মাটি বোঝাই ট্রাক্টর আসছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল পথ, “ও ভাই ট্রাক্টর, থামো।” ট্রাক্টর থেমে গেল। পথিকও দাঁড়িয়ে পড়ল। পথ ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা মালিকের মাটি বইছো, জানি। কিন্তু এভাবে মাটি ফেলতে ফেলতে যাচ্ছো, তাতে আমার শ্রী যে বিশ্রী হচ্ছে, আর সাধারণ যাত্রীদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে, তা ভেবেছ কি?” “ওসব ভাবনা আমাদের নয়, মালিকের,” কর্কশ গলায় এমন বিশ্রী উত্তর দিয়ে চালক ইঞ্জিনের গিয়ার বাড়িয়ে কেটে পড়ল। পথিকও আর সময় নষ্ট করতে চাইলো না। কিন্তু পথ যে তাকে বলতে চায় আরও কিছু কথা। পেছন থেকে ডাক দিল, “দাঁড়াও পথিক। দেখ চেয়ে, দুষ্ট লোকেদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। তোমাদের মত সাধারণ মানুষেরও কতটা জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। চাষিরা আমার দু’ধারের নয়ানজুলিতে পাট পঁচালো। আমার ফুটপথ দখল করে আঁশ ছাড়ালো, সেই আঁশ রোদেও শুকালো। আর এখন পাটকাঠিগুলোকে আঁটি বেঁধে সারে সারে  দাঁড় করিয়ে রেখেছে আমার দু’পাশ বরাবর। তোমাদের চলার পথটা দেখ – কেমন সরু হয়ে গেছে! আর একটু সামনে এবার তাকিয়ে দেখ – বালির স্তুপ, তারপরে পাথরের স্তুপ। ঐ যে, ঘরবাড়ি তৈরি করার জন্য আমার বুকের উপর বালি, সিমেন্ট, পাথর মেখে মশলা বানানো চলছে।”

পথিক এবার সায় দিল, “হ্যাঁ বন্ধু, সত্যিই তোমার শ্রী যেমন নষ্ট হচ্ছে, আমাদের যাতায়াতেও অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু সুবিধাভোগী মানুষ, পরের ক্ষতি হয় হোক, সবসময় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কথাই ভাবে।” “পথিক ভাই, এই অসুবিধা তো তোমার মতো মানুষের নিত্যদিনের। এবার দেখ – আমার প্রতিবেশী ঘোষদের কী জঘন্য কাজ! গরু-মোষ আর ওদের বাছুরগুলোকে  বেঁধে রেখেছে আমার বুকের উপর। পায়খানা-বাথরুমও আমার বুকের উপর। অবলা প্রাণীগুলোর আর দোষ কী, বলো? ওদের প্রভুরা না বুঝলে, ওরা বুঝবে কেমন করে?”

srijanee.com

আর খানিকটা এগোতেই পথিক হঠাৎ নিজে থেকেই থেমে গেল। অজানা উৎকন্ঠায় ভেতর থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এল, “কীসের জটলা? কেন ওই মানুষগুলো কান্নাকাটি করছে?” পথ দুঃখে কাতর হয়ে বলল, “আহা!রে, দুর্ঘটনা ঘটেছে। বছর চল্লিশের একটি লোক, সাইকেলে বাড়ি ফিরছিল। চাকা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কাছাকাছিই বাড়ি। ওকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বাড়ির লোকেরা যে ভীষণ মুশকিলে পড়েছে। আজ তেমন গাড়িও চলছে না। দুটো-একটা যা চলছে, ওরা আমার এই শ্রীহীন বুকের উপর দিয়ে বেশি দূরে যেতে চাইছে না।”

পথিক লক্ষ্য করল – পথের দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। পথিকও রুমালে চোখ মুছে নিল। অবশেষে নিজের স্কুটিটা ঘুরিয়ে নিয়ে ওর পেছনেই যুবককে বসালো আরেক জনের সাহায্য নিয়ে। তারপর দ্রুত রওনা হল হাসপাতালের দিকে। পিঞ্জরে সীমাহীন বেদনা নিয়ে পথ পলকহীন চোখে চেয়ে রইল।

………………………..………..………..…………………………….