Aagachhar Chash – আগাছার চাষ

 

Aagachhar Chash - আগাছার চাষ
(ছোট গল্প) – আগাছার চাষ

নরেনবাবু একদিন ছাত্রদের পড়াতেন – “জমিতে ভালো ফসল পেতে হলে মাঝে মাঝে নিড়ানি দিতে হয়,আগাছা তুলে ফেলতে হয়।”  বাস্তবে সেসব বোঝানোর জন্য ছাত্রদের জমির আলেও নিয়ে যেতেন। চোখের সামনে তুলে এনে বলতেন, “এই যে দেখছো,এগুলো ‘আগাছা’, ‘জঙ্গল’ও বলে। এরা ফসলের ক্ষতি করে। এদের যত্ন করতে হয় না, আপনা-আপনিই বাড়ে। দ্রুত বাড়ে। এক সময় সমস্ত জমিতে আধিপত্য বিস্তার করে। এসবই এদের বৈশিষ্ট্য।”

সেই স্বনামধন্য শিক্ষক এখন আর বেঁচে নেই। জানা গেছে – জীবনের শেষের দিনগুলোতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।

মুমূর্ষু পুঁজিবাদের অস্তিত্ব রক্ষায় দিনকাল তখন থেকেই বদলাতে শুরু করেছিল। জীবনের অভ্যাস, মননের চিন্তাধারার পরিবর্তন এসেছিল। তারপর ছোট বড় সবার হাতে হাতে এসেছে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। উন্মুক্ত প্রকৃতি ছেড়ে ছাত্রদের ভিড় জমছে বদ্ধ ক্লাবঘরে। হাতে তারা মদের বোতল তুলে নিয়েছে। জড়িয়ে পড়ছে অকাজ-কুকাজে। শিক্ষকদের গালাগালি করছে, এমনকি তাঁদের গায়ে হাত তুলছে। মা-বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব নরেনবাবুকে নির্বাক করে তুলেছিল।

অতিষ্ঠ হয়ে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা পথে নামলেন। তাঁরা জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইলেন। এমন সময় নরেনবাবুর ছাত্র  রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রিপ্রাপক ব্রজভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বেচ্ছায় চাকরির বাসনা পরিত্যাগ করে রাজনীতির আসরে নেমে পড়লেন। তিনিই এই দুর্দিনে মানুষের কান্ডারি। স্বপ্ন তাঁর অনেক। আগাছা নির্মূল করবেন। সুন্দর সমাজ গড়বেন। মানুষ ভাবতে শুরু করল –  প্রগতির পূজারি নরেনবাবুর যথার্থ উত্তরসূরি এই ব্রজভূষণ।

শুরুটা ব্রজভূষণের ভালোই হল। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। হাজার চমক, প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিধানসভার ভোটে জিতলেন। বসলেন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে। মানুষের বুকভরা আশা এবার যে তাঁকে পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু করবেন কী করে?

সারা পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক খরা চলছে। আমাদের দেশ তথা রাজ্যের অবস্থা আরও শোচনীয়। বেকারে ভরে গেছে রাজ্যটা। তেমন কোনো বড়সড় কলকারখানা নেই। গড়েও উঠছে না। ছোটখাটো যেগুলো আছে সেগুলোও টিকে থাকতে পারছে না। শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে। তার উপর উন্নত প্রযুক্তি আসায় আরও ব্যাপক মানুষের কাজ চলে যাচ্ছে। এভাবে বেকারের তালিকা ক্রমশ: দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ অবস্থায় কর্মহীন মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তি হবে কী করে? খেতে না পেলে তারা রাজপথে বিক্ষোভে সামিল হবে। আবার এই মানুষগুলোকে ভোটে জেতার জন্য হাতেও রাখতে হবে। তা নাহলে বিরোধীরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে, ইন্ধন যোগাবে শাসকের বিরুদ্ধে। এসব সমস্যা ব্রজভূষণকে চিন্তিত করে তুলেছে।

উপায় অবশেষে বের করলেন ব্রজবাবু। নরেনবাবুর শিক্ষাটা তাঁর বেশ মনে আছে।  তবে বিজ্ঞানসম্মত সেই চিন্তাকে ব্রজবাবু কাজে লাগাবেন অন্যভাবে। ভাবছেন – এখন তো আর ভালোর যুগ নয়, ভালো কিছু করাও যাবে না। আর তা করতে গেলে ক্ষমতা রক্ষা করা তো দূরের কথা, দলটাই মুছে যাবে। তা তো হতে দেওয়া যাবে না। ক্ষমতাও তিনি কোনো মতেই হাতছাড়া করবেন না। এ অবস্থায় তিনি মনে মনে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, আগাছাই তাঁর জীবনে সুদিন স্থায়িত্ব করতে পারে।

এমনটা ভেবেই ব্রজবাবু শুরু করলেন আগাছার চাষ। মাটিও উর্বর। অতএব, দেরি না করে নেমে পড়লেন জমিতে। গোটা রাজ্যে কতগুলো ক্লাব আছে তার তালিকা তৈরি করলেন। কতগুলো পুজো মণ্ডপ আছে তারও তালিকা তৈরি করলেন। অলিগলি, আনাচ-কানাচে কত সংখ্যক মদের ঠেক বসে তারও খবর নিলেন। জেলের ভেতর-বাইরে কত সংখ্যক দুষ্কৃতী আছে, কত সংখ্যক সমাজবিরোধী আর চোরাকারবারী আছে ,সকলের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করলেন। সুফলও পেতে লাগলেন।

এভাবে জনসংযোগের পর ব্রজবাবু একদিন সুখ-নিদ্রা উপভোগ করছেন। মৃত নরেনবাবু সশরীরে এসে বললেন, “ব্রজভূষণ,এ তুই কী করছিস্?  সমাজটাকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছিস্? তোকে আমি এই শিক্ষা দিয়েছি?” “স্যার, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি যা কিছু করছি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যই করছি।” “ তুই তো ফসলের ক্ষতি করে আগাছারই চাষ করছিস্। তবে কী করে সমাজ এগোবে?”

“এখানেই আপনার ভুল স্যার। আজকের সমাজ এভাবেই এগোবে।”  “এগোচ্ছে বটে, তবে সামনের দিকে নয়, পেছন দিকে।” “ তা যদি বলেন স্যার, তাহলে আমি বলব – দোষের কী? গোলাকার পৃথিবীর তলে নদীতে জোয়ার-ভাঁটা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই জল এগিয়ে চলে। কোনটা সামনে, কোনটাই বা পেছনে?”  “এ তুই আমাকে কী শেখাচ্ছিস্ ব্রজ?  তুই আমার ছাত্র, বলতে আমার মাথা হেট হয়ে যায়।” “ কী যে বলেন স্যার! লোকে কত প্রশংসা করছে দিনরাত। গর্ব করে বলছে – নরেনবাবুর ছাত্র ব্রজভূষণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে। কম কথা?” “ অন্যায়, অধর্ম করে ভোটে জিতেছিস্। এর মধ্যে গৌরবের কী আছে?” “ স্যার, কালের নিরিখে সবকিছু বিচার করতে হয়। আগের যা ভালো, তা আজ মন্দ। আপনার চোখে যা মন্দ, তা আজ আমার কাছে অত্যন্ত ভালো। তা আমার ভাগ্যকে বদলে দিয়েছে স্যার। তা না হলে কোনদিনই এই শীর্ষ আসনে বসতে পারতাম না । টোটকাটা অবশ্য আপনার কাছেই শিখেছিলাম। পার্থক্য শুধু – আপনি যা নির্মূল করতে চেয়েছিলেন, আমি তারই প্রতিপালন করছি।”

ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নটা কেটে যায়। ব্রজভূষণ আপন মনে বলতে থাকেন, “ না, না। ভুল আমি করিনি, করছি না। সকাল হলেই শুরু হয় আবার জনসংযোগের পালা।

দেখতে দেখতে আশ্বিনের শারদ উৎসব এসে গেল। ক্লাবে ক্লাবে অনুদানের টাকা চলে গেল। ওদিকে চলছে জোর কদমে চাঁদা আদায়ও। আকাশে-বাতাসে এখন আর আগমনীর সুর ভেসে বেড়ায় না। পরিবর্তে ডিজে বাজে আর রঙ-বাহারি গানের তালে তালে শরীর দোলে। সঙ্গে থাকে দেদার মদের ব্যবস্থাও। যুবক-যুবতীদের নেশার আমেজে খুশির মেজাজ। ওদের মুখে শুধুই ব্রজভূষণের জয়ধ্বনি।

নরেনবাবু আবারও স্বপ্নে দেখা দিলেন। “ব্রজভূষণ,এ কী সংস্কৃতির জন্ম দিলি রাজ্য জুড়ে?” “ স্যার, মা দুর্গা এখন এমন অর্ঘ্যেই তুষ্ট হন।”  “মিথ্যে কথা। তুই আসলে মনুষ্যেতর অবস্থানে নেমে এসেছিস্। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এই অবস্থানে নামিয়ে আনতে চাইছিস্। এভাবে তুই তোর হীন স্বার্থকে চরিতার্থ করছিস্ ।”  “স্যার, এতে ওদের উপকারই হচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো এক-আধটু ফুর্তি করলে ভালোই থাকবে।” “না, ওদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যত খুশি অপকর্ম ওদের দিয়ে করানো যাবে। এটাই তো তুই চেয়েছিলি। দেশ, সমাজের কথা ভাবলিনা একবারও?”  “না স্যার, ভেবেছি। কাউকে আমরা আর না খেয়ে মরতে দিই না। দেখুন না, খাওয়া-পরা দিয়ে কেমন সুন্দর বাঁচিয়ে রেখেছি। যুবকদের ভাতা দিচ্ছি। যুবতীদের বিয়ের খরচ দিচ্ছি। ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীদের ভাণ্ডারে  টাকা দিচ্ছি। গৃহহীনদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিচ্ছি। চাষিদের ফসলের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি। কী দিচ্ছি না, বলুন তো?”  “এ তো দান-খয়রাতি। এই তোদের উন্নয়ন? মনে রাখিস – পশুরাও খেয়ে-দেয়ে বেঁচে থাকে।”

নরেনবাবু বিদায় নিলেন। বিবেক এসে বলল, “ নরেনবাবু তো ঠিকই বলে গেলেন ব্রজভূষণ। কী করবি? তোর ভুল কি তুই শুধরে নিবি?” “তা কী করে সম্ভব ? রাজসিংহাসন যে হাতছাড়া হয়ে যাবে।” “তা যদি যায় যাক্। ভালো কিছু করে যেতে পারলে তোর নাম যে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।”ভেতরের দানব এবার হুংকার ছেড়ে বলল, “ভুল করিস্ না ব্রজ। তুই বিবেকের পা ধুয়ে জল খাবি? তোর খ্যাতি, প্রতিপত্তির কী হবে রে নির্বোধ ?”

ঘুম ভাঙ্গে। ব্রজভূষণ ভাবে, “ এ কী স্বপ্ন দেখলাম। না, না। ইতিহাসে নাম লেখানো দরকার নেই। আমার রাজসিংহাসন টিকে থাকুক। সেটাই আমি চাই।”

দৃষ্টি তাঁর পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের দিকে। শুরু করে দিলেন দলকে আরো শক্তিশালী করার কাজ। রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন মন্ত্রী, নেতা ও উচ্চপদস্থ আমলাদের নিয়ে। ব্রজভূষন বার্তা দিলেন, “আমাদের জনমুখী প্রকল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। চাই টাকা। সে টাকার সংস্থান আমাদেরকেই করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বললেন, “ বর্তমান বর্ষে ইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মিলে অন্ততঃ পঁচিশ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হবে। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে চাকরির বিনিময়ে একটা মোটা অংকের ডোনেশন নেয়া যেতে পারে। আবার এদেরকেই যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দলের অনুগত সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। আমার মতো অন্যান্য মন্ত্রীরাও যদি এরূপ চিন্তা ভাবনা করেন, তাতে নির্বাচনের খরচের টাকাটাও আসবে, দলও শক্তিশালী হবে। তবে এ কাজ অতি সাবধানে করতে হবে,যাতে কাক-পক্ষীও টের না পায়। এখন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি পেলেই হয়।” মুখ্যমন্ত্রী ব্রজভূষণ বললেন, “ উত্তম প্রস্তাব।  এমন মৌলিক চিন্তাভাবনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। একই সাথে বলছি – পাঠ্যপুস্তক, সিলেবাস এমনভাবে তৈরি করুন যাতে ছেলেমেয়েরা আমাদের ভাবাদর্শে চালিত হয়। আবগারি বিভাগীয় মন্ত্রী বললেন, “প্রশংসাটা আমার একটু বেশি পাওয়া উচিত। কেননা, আমি ইতিমধ্যে কয়েক কোটি যুব-মনের যন্ত্রণা নিরসন করতে সক্ষম হয়েছি। ওরা উত্তেজক পানীয় পান করছে,নাচ-গান করছে, খোশ মেজাজে গল্প-গুজব করছে, মধুর প্রেমালাপ করছে। যেন এক মহা শান্তির বাসভূমি,বৃন্দাবন।” মুখ্যমন্ত্রী এবার বললেন,  “আপনারা সকলেই মহান। শিল্পমন্ত্রীও ভালো কাজ করেছেন। চপ শিল্প, ঘুগনি শিল্প, কাশ ফুলের বালিশ-লেপ-তোষক শিল্প, এছাড়াও নানান শিল্প গড়ে তুলেছেন। বেকার যুবক-যুবতীরা আর বিদ্রোহ করবে না। সকলেই এখন স্বকার। আবারও বলছি, আপনারা সকলেই আরও উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যান। মাঠে নেমে পড়ুন। দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে কড়া নাড়ুন।”

                    কয়েক বছর পর


অমাবস্যার রাত যতই দীর্ঘ হোক্, অন্ধকার যতই কালো হোক্, ভোরের সূর্যোদয় রুধার সাধ্য আছে কার? নিষ্ঠুর নিপীড়নে মৃত বিবেক জেগে উঠতে চাইছে। ব্রজভূষণ নিশ্চিন্তে আর ঘুমোতে পারছেন না। কিন্তু কোনো মূল্যেই সিংহাসন ছাড়তে নারাজ। দেখতে দেখতে বিধানসভা নির্বাচন চলে এলো। তৈরি  ব্রজভূষণের সৈনিকেরাও। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। গুলি, বোমা মজুত।

ভোরের নিদ্রাচ্ছন্নতার মধ্যে আবার দেখা দিলেন নরেনবাবু। “ব্রজভূষণ, তোর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। পাপ আর রাখবি কোথায়? শুনতে পাচ্ছিস্ – চারদিকে করুন কান্নার ধ্বনি ? চেয়ে দ্যাখ্, কত মায়ের কোল খালি হয়েছে! কত মা-বোনের বস্ত্র হরণ হয়েছে! কত বধূ বিধবা হয়েছে !তুই আকাশকে কালো মেঘে ঢেকে দিয়েছিস্। তুই বাতাসকে বিষাক্ত করেছিস্ ।  উর্বর জমিকে বন্ধ্যা করে আগাছার চাষ করেছিস্। এবার তোর বিচার হবে মানুষের বিচারশালায়।”

ব্রজভূষন দু’চোখ খুললেন। অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে কাতর চোখে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন অমিত তেজে ভরা সূর্যের দিকে।

……………………………………………………….