দেশসেবক হবার উদগ্র বাসনা

একদিন দেশের সেবার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জীবন উৎসর্গ করেছিলেন,দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তাঁর যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন।তারও অনেক আগে রাজা রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আমরা জানি।ইতিহাসে অনেক নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কাহিনী স্মরণীয় হয়ে আছে।পৌরানিক যুগে পঞ্চপান্ডবদের সেবাধর্মের কথাও আমরা জানি।

   যদিও প্রতিটি সমাজেই তার বিপরীত চিত্রও ছিল।আমরা জানি এদেশ জবরদখল করে ইংরেজ শাসকদের ধন-সম্পদ লুন্ঠন আর নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা,রাজ-রাজাদের সাম্রাজ্য বিস্তার আর নরহত্যার কথা,সিংহাসন লাভের জন্য দুর্যোধন-দুঃশাসনদের বর্বর পৈশাচিক নির্যাতন আর হত্যালীলার ঘটনা।কিন্তু এখনতো রাজার শাসন নেই,বিদেশী শাসকও নেই,আছে গনতন্ত্রের ধ্বজাধারী দেশীয় শাসক।জানি শাসকের রঙ বদলায় তবু শোষণ,নির্যাতনের রূপ বদলায় না।তাই দিন আসে,দিন যায়;অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে আসে।বিজ্ঞানের যুগান্তকারী বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছেতারই অবদানে বাইরে বিজ্ঞাপণের ঝকঝকে আলো,ভেতরে অন্ধকার।বাইরের চাকচিক্য ভেতরের কদর্যতাকে ঢেকে দেয়,বোঝার উপায় নেই।

         আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ছোঁয়ায়,দেশের সম্পদ বেড়েছে,তবু কেন এত দারিদ্র?আসলে ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে,মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ঘরে সেই সম্পদ মজুত হয়েছে।পূঁজির-সমাজ বিকাশের অমোঘ নিয়মেই তা হয়েছে।বিশ্বজুড়ে শিল্পে মন্দা,ফলে কর্মসংস্থানের পথ সংকুচিত হয়েছে।বেকার ছেয়ে গেছে দেশে।আশার আলো মরীচিকার মতো মিলিয়ে যায়।তাই যেন-তেন-প্রকারেণ বাঁচো।বিবেক-মনুষ্যত্ব-মানবিকতা ওসব দূরে সরিয়ে রাখো।কলুষিত মনগুলো অবলীলায় বিচরণ করে বেড়ায় আদিম স্তরে।প্রেম-ভালোবাসা মরে যায় মিলন-মোহনায় পৌঁছানোর আগেই।বিরহ আসে না।ছলনা,প্রতারণা,প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে,জীবন পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।আর এসবই আশীর্বাদ হয়ে ওঠে শাসকের জীবনে।দুর্ভোগ বাড়লেই ত্রাতা সেজে দয়ার পাত্র নিয়ে দরজায় দরজায় হাজির হলেই মানুষের মনগুলো সহজেই বশ করা যায়।উচ্ছিষ্ট ছিটালে কাকের অভাব হয় না।এই মহামন্ত্র মনিবের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়ে।নুন খাই যার,গুন গাই তাঁর।দুর্দিনেই এটুকুই অনেক।ঠিক যেন পুতুল নাচের পুতুল।অলক্ষ্যে থেকে জড় পুতুলগুলোকে যেমন খুশি নাচানো যায়,আর এই খেলাই চলছে এখন দেশজুড়ে।এরই নাম উন্নয়ন।

         সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের ফানুসটা চোখে পড়ল,আর দুর্যোধন-দুঃশাসনরা সিংহাসন লাভের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠল।অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র,গান্ধারী অন্ধ সেজে পুত্রদের প্রশংসায় পঞ্চমূখ।দুর্যোধন-দুঃশাসনের চ্যালাদের এই সময় যে দেশ সেবক হয়ে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ।তবু ভয়ও হয়।উচ্ছিষ্ট ছিটালেও যদি কাক না আসে,জড় পুতুলগুলো যদি না নাচে।অতএব,বি.ডি.অ,এস.ডি.ও, অফিসগুলো কবজা করে নাও,বিরোধিরা কেউ যেন মনোনয়ন জমা দিতে না পারে।কথা যা কাজও তাই।এরই নাম গনতন্ত্র।

     যাই হোক,এই চ্যালারা তো গিরগিটি,রঙ বদল করেছে সূযোগ বুঝে।নীতি,আদর্শ ওসব চুলোয় যাক্করে-কম্মে খেতে হবে,নিজের আখের গুছিয়ে নিতে হবে।তো হঠাৎ এদের অনেকের দেশ সেবক হবার উদগ্র বাসনা জেগে উঠল কেন?এতদিন তো তোলাবাজি,রাহাজানি,সিন্ডিকেট,দালালি ইত্যাদি কতকিছুই চলছিল।নাঃ ওসব তো থাকবেই।এর উপর পঞ্চায়েতে মেম্বার হতে পারলে আরও বেশ কিছু কামানো যাবে।পঞ্চায়েতে এখন অঢেল টাকা আসে।একদিকে কাঁচা টাকার হাতছানি,অন্যদিকে ক্ষমতা লাভ,আবার জনতার আসরে দেবতা হয়ে ওঠা,এতদিনে এই সুযোগ এসে গেল,তার সদব্যবহারে মহাযজ্ঞের আয়োজনও স্বাড়ম্বরে চলতে থাকল।

     এই তো আমাদের সমাজ।আমরা কোনদিকে এগোচ্ছি,সামনে না পেছনে?জোর যার মুলুক তার,আর কতদিন এই প্রথা চলবে?

     যদি দেশের সেবা করতেই হয়,মানুষের সেবা করতেই হয়,তবে নিঃস্বার্থভাবে,বিনা পারিশ্রমিকে করে দেখাও,তবেই তুমি মহান।যারা আজও সুন্দর ভূবন গড়ার স্বপ্ন দেখে তাঁদের তা গড়তে দাও।মিথ্যার রাজকীয় বেশ একদিন ঠিকই উন্মুক্ত হবে।সত্য আজ দীনভাবাপন্ন,তবু সত্যের জয় অনিবার্য।গ্যালিলিওর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল,সত্য মরেনি।মিথ্যার প্রদীপ দাউ দাউ করে জ্বলে হঠাৎ নিভে যায়,সত্যের প্রদীপ নিভতে নিভতে জ্বলে ওঠে।মনে রেখো,সৌরকররাশি চিরদিন কুজ্ঝাটিকাজালে আচ্ছন্ন থাকতে পারে না।