বোধোদয়

  – হরবিলাস সরকার (শিক্ষক)

কামরায় এক ভিখারি উঠল । তার একটা পা কাটা । ক্রাচে ভর দিয়ে সে এগিয়ে আসতে লাগল । আর গাইতে লাগল করুন সুরে গান । পাষান হৃদয়ও বিগলিত হয়ে উঠল । এক টাকা,দু টাকা,পাঁচ টাকা,দশ টাকাও তার হাতে পড়তে লাগল । গান যখন শেষ হল,ততক্ষনে সে আমার সামনে এসে পড়েছে । তার দুঃখে আমিও কাতর না হয়ে পারলাম না । পথে – ঘাটে কত না ভিখারির সাথেই তো দেখা হয় । জানি না, আজ কেন কৌতুহল জাগল মনে ! তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার পরিবারে কে কে আছে ?’ এমন প্রশ্ন কেউ বুঝি আগে কখনও করেনি । তাই সে আমার মুখ পানে বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকল । তারপর সে আমাকে একান্ত আপনজন মনে করে বলতে লাগল, ‘ছিল দাদা,এখন কেউ নেই । বারো বছরের ছেইলেটা বিনে চিকিৎসায় ক্যানসারে মইরে গেল ! ওর মা বিনে দোষে চুরির দায়ে জেল খাটতিছে । ভিটে – মাটি ছিল,আজ আর নেই । পথে পথে এখন দিন কাটে । সবই আমার ভাগ্য !’ ‘ভাগ্য কেন বলছো, এতো তোমার দুর্ভাগ্য’ – এই বলে পাঁচটা টাকা দিলাম তার হাতে । সে আমার জন্য প্রার্থনা করল, ‘ভগবান আপনার মঙ্গল করুন ।’ আমি বললাম, ‘ভগবানের কাছে আমার মঙ্গল কামনা করছো,তিনি তো তোমারই মঙ্গল করতে পারলেন না ।’ লোকটি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থাকল । মনে হল,একরাশ অন্ধকার এসে তার বুকের ব্যথাটা আরও বাড়িয়ে দিল । দীর্ঘ নিঃঃশ্বাস তরঙ্গ তুলে বয়ে গেল । তার পর উধর্বপানে তাকিয়ে সে বলল, ‘আমার ভগবান আছে মানুষের মধ্যে,আপনারাই আমার ভগবান । ট্রেনে হকারি করতাম দাদাগো, তিনি থাকলে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা-টা কাটা যাবে কেন ! নির্দোষী জেল খাটে কেন ! অকালে ছেইলেটাই চলে যাবে কেন ! তিনি থাকলে গরিব কেন আরও গরিব হয় ! বড়োলোক কেন আরও বড়োলোক হয় !’ আবার সেই করুন সুর । ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে চলা । তার চলার শেষ নেই,কোন গন্তব্য নেই ।