জীবন-মরুর পথে – Jeeban Marur Pathe

জীবনের মধ্যাহ্নবেলায় শেষ সম্বল ‘ভিটেমাটিটুকু’ ঋণের দায়ে মথুরাপুরের দণ্ড-মুণ্ড কর্তা এবং বিধায়ক ‘ময়ূরেশ্বর পালে’র হস্তগত হয়ে গেল। নিঃস্ব ‘সনাতন’ নিরুপায় হয়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। দিন কয়েক পথে পথে খোলা আকাশের নিচে কাটল। তারপর দিন কয়েক করে মাসি, পিসি, দুই কাকার বাড়ি ঘুরে ঘুরে কাটালো। দারিদ্র্যের হাতছানি সবার ঘরেই। কে ক’দিন আশ্রয় দিতে পারে? আবার সেই অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। শেষে আপন দিদি, বছর দশেকের বড়, ছোটবেলায় মা হারা ছোট্ট ভাইকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, কত আদর করেছে, তার বাড়ি এসে উঠল। সেও অপারগ হয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলে দিল, “ওরে হতভাগা, এভাবে ঘুরে ঘুরে তোর দিন কাটবে ভেবেছিস? আমারও তো সংসার আছে। ফুটপথে কাপড়ের দোকান, কীইবা বেচাকেনা হয়! মানুষেরা এখন অনলাইনে জিনিস কিনছে। আমাদের মতো ছোট দোকানদারগুলো মার খাচ্ছে। চিন্তায় চিন্তায় তোর জামাইবাবুর দেহে রোগ বাসা বেঁধেছে। তুই আমাকে ভুল বুঝিসনা ভাই। একটা টোটো ভাড়া নিয়ে চালাতে তো পারিস্। নাহয় কোনো দোকানের কাজে লেগে পড়্।”

সনাতন দিদির মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, মনে মনে বলে, “দিদিরে, যার কোনো ঠিকানা নেই, তাকে কে দেবে টোটো, কে দেবে কাজ?”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। দিদি ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল রাতের খাবার তৈরি করতে। সনাতন কী করবে, কোথায় যাবে, বুঝে উঠতে পারে না। যে ক’টা টাকা পকেটে ছিল, বাস আর ট্রেনের ভাড়া  গুনতেই শেষ হয়ে গেছে। অকুল, অথৈ সমুদ্রে আঁকড়ে ধরার জন্য খড়কুটোটিও নেই। সে এখন বড়ই নিরুপায়।

রাত বাড়তে থাকল। দিদির হাতের তৈরি রুটি আর আলু-ভাজা খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সারারাত ঘুম আসেনি চোখে। নানা দুশ্চিন্তার প্রহরগুলো যেন দীর্ঘ সময় নিয়ে কাটতে লাগল। পূর্বদিকে যখন আলোর রেখা ফুটে উঠল, তখন দ্রুত প্রাতঃকাজ সেরে তৈরি হয়ে নিল। পাখিরা নতুন ঊষার খবর পেয়ে কিচিরমিচির শুরু করেছে। সূর্য দিগন্তের উপরে উঠতে আর বেশি দেরি নেই। বেরোতে হবে। কোথায় যাবে, এখনো ঠিক করতে পারেনি। তবু যে যেতেই হবে। জিনিসপত্র বলতে একটা গামছা, সুন্দর করে ভাজ করে ছেঁড়া কাপড়ের ব্যাগটায় ভরে নিয়েছে। সেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বারান্দায় দিদির অপেক্ষায় বসে রইল।  দুঃখের স্মৃতিটা ভেসে উঠেছে। ‘পাঁচ বছর বয়স তখন। দুরারোগ্য ব্যাধির ছোবলে বিনা চিকিৎসায় মা চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। দিদি অশ্রুসজল চোখে ছোট্ট ভাইকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল।’ আজ সেই একই রক্তের আদরের ভাই বুক ভরা ব্যথা নিয়ে মায়া কাটিয়ে চলে যাবে। আর হয়তো কোনদিন ফিরবে না। তাই শেষবারের মতো দিদিকে একবার দেখে যাবে। তার আশীর্বাদ নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়বে সনাতন।

সারারাত পাশের ঘরে দিদিও বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে, টের পেয়েছিল সনাতন। হেমন্তের বিদায় লগ্নে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। দুর্বল শরীর ও মন তা মানিয়ে নিতে পারেনি। ঘন ঘন কাশি আর বুকের যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। মাঝে মাঝে গুমড়ে গুমড়ে কান্নার অস্পষ্ট  আওয়াজও ভেসে আসছিল। ভোরের নাতিশীতোষ্ণ বাতাস হয়তো কিছুটা শান্তি দিয়েছে, তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সূর্য ওঠার আগেই সে ওঠে, সে নিয়ম আজ বাতিল হয়েছে। কিন্তু আর যে সময় নেই। সনাতন দিদিকে ডেকে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইল না। “ভালো থাকিস্ দিদি,” এই বলে অন্তরে প্রণাম নিবেদন করে বেরিয়ে পড়ল নিরুদ্দেশের পথে।

বেলা মাথার উপরে। দীর্ঘ সময় হেঁটে হেঁটে সনাতন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পথের জলের কল থেকে  জল খেয়ে খিদে মেটাতে চাইলো। পেট শুনলো না। অদূরে এক রেলস্টেশনে পৌঁছে খিদের জ্বালায় ভিক্ষা করতে লাগলো। ক’দিন এভাবে স্টেশনেই কাটিয়ে দিল। ভিক্ষা করতে করতে একদিন স্টেশনেই পরিচয় হলো এক সাধুবাবার সঙ্গে। তিনি তাঁর আশ্রমে নিয়ে এলেন সনাতনকে। সেখানে বেশ কয়েকজন সেবক-সেবিকার মতো তারও থাকবার একটা বন্দোবস্ত হলো। দু’বেলা প্রসাদেরও ব্যবস্থা হল।

আশ্রমে থেকেও সারাদিন ঘুরে ঘুরে সনাতন ভিক্ষা করে। আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী সেবকদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভিক্ষা করতে হয়। সেবিকাদের কঠোরভাবে বাইরে বেরনো নিষেধ। এমনকি ভেতরে সেবকদের সঙ্গেও মেলামেশা বারণ। ঠাকুরের সেবাই তাদের একমাত্র ব্রত। যাইহোক, সনাতনের সুবিধা হয়েছে। সাধুর বেশে হরিনাম শুনিয়ে আশ্রমের নামে কিংবা ঠাকুরের নামে ভিক্ষা চাইলে কেউই বঞ্চিত করে না। মানুষের দানের অন্নে তৈরি হয় প্রসাদ। প্রতিদিন এই প্রসাদেই অগণিত দীন-দুঃখীর খিদে নিবৃত্তি হয়। তাদের আশীর্বাদ লাভ করে সনাতন।

মহা শান্তিতে দিন কাটছিল। লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে একঘুমে শীতের রাত কেটে যাচ্ছিল। একদিন রাতে সেই শান্তির ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখল – পুলিশ তাকে ধাওয়া করছে। এমন দুঃস্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল। শরীর কাঁপতে লাগল। বাতিটা জ্বালিয়ে দেয়াল ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে দেখল – রাত দুই প্রহর অতিক্রান্ত। এমন সময় আশ্রমের ভেতর পরপর দুটো গাড়ি ঢোকার আওয়াজ কানে এলো। গাড়ির আলো নেভানো ছিল। সনাতন ভাবল – তবে কি পুলিশের গাড়ি? স্বপ্ন কি তাহলে সত্যি হল? কিন্তু আমি তো কোন অন্যায়  করিনি। ভাবতে ভাবতে ক্ষণিক পরে ভয় কৌতূহলে পরিনত হল। জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল। অন্ধকারেও বুঝতে পারল –  বেশ দামি গাড়ি, রঙিন কাচ লাগানো। দুটো গাড়ি থেকে জনা চারেক শীতবস্ত্রাবৃত লোক নেমে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের দিকে চলে গেল।

সনাতন নিশ্চিত হল, “এরা পুলিশের লোক নয়। বেশ বিত্তশালী গোছের মানুষেরাই হবেন। মন্দিরের পাশের ঘরে সাধুবাবা থাকেন। তাঁর কাছেই হয়তো কোনো দরকারে এসেছেন।” এমনটা ভেবে সে ফের লেপ-কম্বলের ভেতর ঢুকে গেল। তবে ঘুম এলো না চোখে। দুঃস্বপ্নের ঘোর আর এত রাতে লোকের আনাগোনা তার মনটাকে অশান্ত করে তুলল। ঘন্টাখানিক পর গাড়ি দুটোর ইঞ্জিন চালুর শব্দ শোনা গেল। বোঝা গেল, লোকগুলো চলে যাচ্ছে।

পরদিন রাতে একই সময়ে আবারও দুঃস্বপ্ন। তবে আজ পুলিশ নয়, সাধুবাবা ধারালো এক খাঁড়া নিয়ে তাকে তাড়া করছে। ঘুম ভেঙে গেল। উঠে জড়সড় হয়ে বসলো। আজও সেই গাড়ির আওয়াজ। তবে অন্য গাড়ি, অন্য লোক। কিন্তু একই দিকে যাত্রা। আজ প্রায় ঘন্টা দুয়েকের উপর থেকে তারা চলে গেল।

এরপর পরপর আরও তিন দিন জাগ্রত থেকে একই দৃশ্য দেখল সনাতন। পঞ্চম দিন। আজ অমাবস্যা। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। নিশুতির প্রহরে দুটো গাড়ি আলো জ্বেলে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। চার-পাঁচজন হবে, নেমে  এগিয়ে গেল একই দিকে। আজকে মনের কৌতূহলটা এত বেশি যে, তার নিরসন না হলে সনাতনের কিছুতেই ঘুম আসবে না চোখে। বহুদিনের এক সেবক ভাইয়ের মুখে শুনেছে – সাধুবাবা মানুষের কল্যাণে ধরায় এসেছেন। সকল কামনা-বাসনা মুক্ত এই মহাপুরুষ আসলে ঈশ্বরের দূত। তবে রাতের অন্ধকারে যারা আসে, তাদের সাথে বাবাজির সম্পর্ক কী? নিত্য নতুন নতুন লোক কারা? আবার একই গাড়ি, একই লোকও আসে। সকাল থেকে রাত এক প্রহর পর্যন্ত কত লোক আসে। কত ভক্ত, দীন-দুঃখী, কত মহাজন, কত বিত্তবান আসে। মাঝেমধ্যে নেতা-মন্ত্রীও আসেন। বিদেশি পর্যটকরাও আসে। তারা আসে ভক্তির টানে, দান-ধ্যান করতে। কিন্তু তাই বলে এত রাতে যারা আসে, তারা কেন আসে? আসার উদ্দেশ্যটা জানবার অদম্য ইচ্ছেয় সনাতনের ভেতরের কৌতূহল বহুগুণ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল।

কিছুক্ষণ সাত-সতেরো ভাবনা-চিন্তার পর সনাতন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল।  মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছে সাধুবাবার ঘর লক্ষ্য করল। নাঃ, ঘরে তো আলো জ্বলছে না। লোকজনের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু পাশের অতিথিশালা থেকে ফিসফিসানি কথা ভেসে আসছে। জানালার একটি সরু ছিদ্র দিয়ে আলোর রেখা বেরিয়ে আসছে। দরজার কাছে গিয়ে কান পাতল। কথাগুলো বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, “ঠাকুরের কৃপায় আর আপনাদের সহযোগিতায় আমার আশ্রম ভালই চলছে।” “মহারাজজি, আমাদের কাছে খবর আছে –  এক নিঃসন্তান মাড়োয়ারি ধনী ব্যবসায়ী সম্প্রতি আশ্রমকে পাঁচ কোটি টাকা দান করেছেন। তাছাড়া আপনার মধুচক্রের ব্যবসাটা রমরমিয়ে চলছে। পয়সাওয়ালা খদ্দেরও আসছে।” ‘মধুচক্র’ কথাটা শুনে সনাতন চমকে উঠলো। দরজার বাঁ দিকের জানালাটার ছিটকানি লাগানো ছিল না। নিঃশব্দে আঙ্গুলের স্পর্শ পড়তেই পাল্লাটা সামান্য সরে গেল। সনাতন দেখলো – সুট-কোট পরা পাঁচজন অতিথিকে নিয়ে বাবাজি মদ্যপান করছেন আর কথাবার্তা বলছেন। “আপনারা নেতা, মন্ত্রী, কেউ গোয়েন্দা, কেউ পুলিশের লোক। খবর তো আপনাদের কাছে থাকবেই।” “সমুদ্রতীরে আপনার হোটেলের ব্যবসাও রমরমিয়ে  চলছে, সেই খবরও আছে।” “আমার যাবতীয় ব্যবসাই ভালো চলছে। আর তাতে তো আপনাদেরও ভালো।” “মন্দ বলেননি। তবে কাশ্মীরে যে  অট্টালিকা নির্মাণ করছেন, তার উদ্বোধনে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকবে তো?” “কী যে বলেন আপনারা! পেট পুরে খাওয়াবো। কিন্তু অট্টালিকায় বসে নয়, কোনো হোটেলে তার ব্যবস্থা করব। বুঝতেই তো পারছেন, সাংবাদিকগুলোর শকুনের চোখ,” এই বলে  গেরুয়া পাঞ্জাবির ঝুল পকেট থেকে পাঁচ-পাঁচটা বড় নোটের বান্ডিল বের করে টেবিলে রাখলেন বাবাজি।

টাকা হাতে নিয়ে সকলে উঠে দাঁড়াতেই সনাতন স্তম্ভিত হয়ে গেল। দ্রুত ফিরে এলো নিজের ঘরে। বিচিত্র পৃথিবীকে সে চিনেছে অনেক আগেই। তবে ছদ্মবেশের অন্তরালে এমন অমানবিকতা আর অর্থ পিশাচের ভয়ঙ্কর রূপ সে কানে শুনলেও এই প্রথম নিজ-চোখে দেখার সৌভাগ্য লাভ করল।

ষষ্ঠদিন গভীর রাতে একইভাবে আলো নিভিয়ে গাড়ি ঢুকলো। সনাতন আজও চুপিচুপি গিয়ে অতিথিশালার জানালায় কান পাতলো। “নাঃ,ভেতরে কেউ নেই। তবে গাড়ি থেকে নেমে যে দু’জন এল, ওরা কোথায় গেল?” অতিথিশালার পশ্চিম দিকে কিছুটা এগিয়ে এক বিশাল হলঘর। সনাতন শুনেছে – প্রতিবছর ওখানে বসন্ত উৎসবে নাচ-গান হয়, প্রচুর লোকের সমাগম হয়। সেখানে পৌঁছে গতকালের মতোই জানালার ফাঁক দিয়ে সনাতন দু’চোখের দৃষ্টি ফেলল। দেখলো – রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সামনে নিস্প্রভ একটি বাতি জ্বলছে। তার নিচে ওই লোক দু’জনের সঙ্গে সাধুবাবা রসিয়ে কথাবার্তা বলছেন। মদ্যপানের প্রস্তুতিও চলছে। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত এই হলঘরটির সঙ্গে সংযুক্ত বেশ কতগুলি ছোট ছোট ঘর। ওই ঘরগুলোতে আশ্রমের সেবিকারা আলাদা আলাদা থাকে। মদের গ্লাসে বার দু’য়েক চুমুক দিয়ে সাধুবাবা উঠে কোণের একটি ঘরের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লেন। বেরিয়ে এলো এক সেবিকা। অস্পষ্ট আলোয় তার মুখ ভালো দেখা যাচ্ছিল না। তবে চুলগুলো উশকো-খুশকো বোঝা গেল। পরনের শাড়িটাও অগোছালো মনে হল।

“তুমি এখানে দাঁড়াও,” সেবিকাকে একথা বলে অতিথি দু’জনের কাছে ফিরে এলেন বাবাজি। মুচকি হেসে চুপি চুপি বললেন, “একেবারে নতুন, টাটকা, অপূর্ব সুন্দরী।  সদ্য বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল। ভালোবাসার বিয়ে। গতকালই ছিল ফুলশয্যার রাত। কিন্তু তার আগেই একটা বিষাদের খবর ওর কানে আসে। ওর স্বামী দুশ্চরিত্র, পরকীয়ায় জড়িত। তাই মনের দুঃখে আত্মহত্যা করবে বলে জাতীয় সড়কের উপর ছুটে এসেছিল। আমি কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।  ভাগ্যের খেলায় ছুটে এসে পড়ল আমারই গাড়ির সামনে। তারপর ওর মুখেই ওর দুর্ভাগ্যের কথা শুনলাম। সে দুর্ভাগ্য নিমেষেই সৌভাগ্যে পরিনত হয়ে গেল।  কেমন তরতাজা! সেকারণেই দর একটু বেশি। ঘন্টা প্রতি কুড়ি হাজার। দু’জনেই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে মদের গ্লাসে চুমুক দিল। তারপর পকেট থেকে থোক থোক টাকা বের করে সাধুবাবার হাতে দিয়ে বলল, “এর উপরে যদি লাগে, ফুর্তিটা মিটুক, হিসেব করে দেবো।”

সনাতন বুঝলো – এ তাহলে মধুচক্রের আসর। আর ঐ লোক দু’জন অনেক উঁচু শ্রেণির খদ্দের।

সাধুবাবা হলঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই মেয়েটি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না। ছুটে এসে লুটিয়ে পড়লো সাধুবাবার পায়ে। “আপনাকে আমি বাবাজি বলে ডেকেছিলাম। ভগবানের আসনে বসিয়েছিলাম। আমার পিতৃতুল্য। এক কথায় বিশ্বাস করে আপনার সাথে চলে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, ঠাকুরের চরণে নিজেকে নিবেদিত করব। কাল রাতভর আমি সেই প্রার্থনাই করেছি। কিন্তু আজ রাতে একটু আগে আপনি আমার নারীত্ব লুণ্ঠন করেছেন। বুঝেছি, এখন আমাকে এই পাপ-কাজে লিপ্ত করাতে চাইছেন। দয়া করে এসব করবেন না। আপনি আমাকে মুক্তি দিন।”

সনাতন শিউরে উঠল। “এ তো আমার অতি চেনা কন্ঠ। আমার শ্রীময়ীর কণ্ঠ। হ্যাঁ, ওই তো এক চিলতে আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। মুখখানা এবার বেশ ফুটে উঠেছে। সত্যিই তো আমার শ্রীময়ী। নাঃ, আমার বলে দাবি করছি কেন? আজ আর ও আমার নেই। বড় ঘরের মেয়ে বলে এই নিঃস্ব, হতভাগা সনাতনকে একদিন প্রত্যাখ্যান করেছিল। সনাতন প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসে শেষে বুকভরা ব্যথা নিয়ে তার ভালোবাসা দামোদরের জলে বিসর্জন দিয়েছিল। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে, কোন্ অপরাধে ওর এই পরিণতি ঘনিয়ে এল?” বিবেক এসে উত্তর দিল, “অপরাধ যাই হোক না কেন, সনাতন, তুই কি চুপ করে বসে চেয়ে চেয়ে দেখবি? পারবি সহ্য করতে? তুই না একদিন ভালবেসেছিলি, এই তার উপহার? ”

আবারও চোখের জলে সাধুবাবাকে কাতর আবেদন করল শ্রীময়ী, “আপনি আমাকে মুক্তি দিন, না হয় একটু বিষ এনে দিন। ……….।”

সাধুবাবা বোঝাতে লাগলেন, “এখানে তুমি তোমার সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য যা লাগে, তার সবকিছুই পাবে। স্বামীর ঘরে থাকলে যেমন সোহাগ-আহ্লাদ  পেতে, এখানে তার চেয়েও বেশি পাবে। তাহলে অসুবিধা কোথায়? তোমার তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনকে আমি নতুন করে গড়তে চাইছি। ঈশ্বর তো এমন করেই চাইছেন। তোমার মতো অনেকেই এখানে আছে। অবশ্য কেউ কেউ প্রথম প্রথম তোমার মতই কান্নাকাটি করেছে। পরে তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। তারা এখন ঈশ্বরের কৃপায় এখানে আমার অনুগত হয়ে আছে। …….।”

মেয়েটি অত্যন্ত অসহায়ভাবে ঊর্ধ্ব নয়নে করজোড়ে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে করুণ আর্তনাদ করে উঠল। তার দু’চোখের অশ্রু প্লাবন হয়ে বইতে লাগলো। লোক দু’জন শেষ বারের মতো গ্লাসে চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একজন মেয়েটিকে পাজা কোলে তুলে নিল। তারপর দু’জন মহোল্লাসে শ্রীময়ীর ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। সাধুবাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে পা বাড়ালেন।

সনাতন এখন কী করবে? বিবেক এবার ভয়ঙ্কর রূপ ধরে সামনে এসে দাঁড়াল। বলতে লাগল, “সনাতন, এই অধর্ম নিজের চোখে দেখেও চুপ করে থাকবি?” সনাতন উত্তর দিল, “ধর্ম তো এখন নিজেকেই নিজে রক্ষা করতে পারছে না। জগত সংসারে সে ভালো কিছু আর দিতে পারছে না, বরং সে এখন প্রতিক্রিয়াশীল। তাহলে আমি কী করতে পারি?” “তোর ভুল ধারণা। ভণ্ড, অর্থপীশাচ যদি ধার্মিক সাজে, তার জন্য ধর্ম দায়ী নয়। তুই চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দকে স্মরণ কর্। তোর ভুল ভাঙবে। ধর্ম চিরকাল জীবের মঙ্গল কামনা করে এসেছে, আজও করে, ভবিষ্যতেও করবে।” “কিন্তু এই ভণ্ড, অর্থপীশাচের শাস্তি কী হবে?” “ওর শাস্তি ও পাবে। ঈশ্বরের শক্তি তো তোর মধ্যেও আছে। তুই তোর কর্তব্য পালন কর্।”

সনাতন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে অন্ধকার ঠেলে বুক চিতিয়ে ভণ্ড সাধুর পথ আটকে দাঁড়ালো। “আপনি সত্যের পূজারি, ঈশ্বরের দূত সেজে এই অপকর্ম করছেন? আপনার মুখোশ আজ খুলে গেছে। অন্যায়ের বিচার হবে। তার আগে আমাকে ঐ অসহায় মেয়েটিকে রক্ষা করতে হবে। “হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে শক্তি দাও, সাহস দাও,” এই বলে সনাতন প্রাণপণে দৌড় দিল শ্রীময়ীর ঘরের দিকে।

ভণ্ড সাধু তড়িঘড়ি তার কোমরে গোজা রিভলবার বের করে একটা গুলি ছুঁড়ে দিল। গুলিটা হাঁটু ঘেষে সামান্য মাংস ছিঁড়ে চলে গেল। সনাতন অসহ্য যন্ত্রণা সয়েও দরজা পর্যন্ত পৌঁছালো। ‘শ্রীময়ী’, ‘শ্রীময়ী’ বলে চিৎকার করে উঠল। আর পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ভেতরে তখন নরপশুদের খিদে নিবৃত্তি হচ্ছে। শ্রীময়ীর করুন আর্তনাদ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে চার দেয়ালের মধ্যে অনুরণিত হতে লাগলো।

সাধু নিজের হাতে সনাতনের মৃত্যু নিশ্চিত করল না। বরং অচৈতন্য দেহটাকে ঠাকুরের পায়ের কাছে টেনে নিয়ে গেল এবং চুরির অভিযোগ জানিয়ে থানার বড়বাবুকে ফোন করল। তারপর ঠাকুরের গায়ের মূল্যবান স্বর্ণালঙ্কার খুলে সনাতনের হাতে ধরিয়ে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই থানার বড়বাবু এলেন জনা কয়েক কনস্টেবল নিয়ে। সাধুবাবা বিবৃতি দিলেন, “স্যার, ছেলেটি আশ্রমের সদ্য নিযুক্ত সেবক ‘সনাতন’। ঠাকুরের গায়ের অলংকার চুরি করে পালানোর চেষ্টা করছিল। অন্ততঃ পঁচিশ ভরি হবে। কিন্তু দুঃখের কথা হল, ও যে সনাতন, ওকে অন্ধকারে আশ্রমের নৈশ প্রহরী চিনতে পারেনি।  ভেবেছিল, বাইরের কোনো পাকা চোর। সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে। তাই গুলিটা চালিয়ে দিয়েছিল।”

হাতে-নাতে চুরির প্রমাণ পেয়ে বড়বাবু সনাতনকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন পুলিশ হাসপাতালে। চিকিৎসায় সনাতনের জ্ঞান ফিরে এল। পরদিন আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে দশ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিলেন। সনাতন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে পারল না। তার দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে গেল।

জেলের ভেতরে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে রাতের খাবার খেয়ে গা এলিয়ে দেয় মেঝের উপর। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না। জীবনে এমন পরিণতি আসবে তা কখনো ভাবতে পারেনি। ঈশ্বরের উপর তার অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে। অনুতাপ করে বলে, “হে ঈশ্বর, চোখের সামনে সবকিছুই দেখলে। অপরাধী অর্থ আর ছলনার বলে তোমার কৃপা লাভ করল।  আর নিরাপরাধী সনাতন বড় অসহায় বলে শাস্তি তাকে দিলে। তবে কি এই সত্যি যে, তুমি   আজ পাপীর রক্ষা কর্তা? তাই যদি হবে, দুঃখ আরও না হয় দিতে। চুরি অপবাদ দিয়ে কেন এই নরকের পথে ঠেলে দিলে?  আমি যে বিবেকের কথা ফেলতে পারিনি। শ্রীময়ী আমাকে দূরে ঠেলে দিলেও আমি যে ওর কোনো ক্ষতি চাইতে পারিনি। তাই ওকে রক্ষা করতে ছুটে গিয়েছিলাম। তার জন্য এই তোমার প্রতিদান!………!” প্রতি রাতে এমন করেই সনাতন নালিশ করে। ঈশ্বর শুনুক বা না শুনুক তবু সে নালিশ করে।

জেল হয়েছে, এ খবর শুনেও তার আপন দিদি দেখতে আসেনি। ভাইয়ের কুকীর্তির  কলঙ্ক তার গায়ে লাগার ভয়। শুধু তাই নয়, মনে মনে ভাইকে ত্যাগ করেছে। সনাতনও চায় না, তার আপনজনের গায়ে কালি লাগুক। এতেই যে তার পরম শান্তি।

একদিন সকালে এক অতি নির্মম খবর বাতাসে ভেসে এল। খবরটা বেশ ফলাও করে কাগজে ছাপা হয়েছে, “রাধাকৃষ্ণ আশ্রমে ‘শ্রীময়ী’ নামে এক সেবিকা তার নিজের ঘরে আত্মহত্যা করেছে। সনাতনের পাথর-চাপা দুঃখ-ব্যথা আজ আবার জেগে উঠল। পাষাণ হৃদয় বিগলিত হল। চোখের জল দরদর বেগে ঝরে পড়তে লাগল।

ক’দিন পর একজন সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিহিত লোক এলেন জেলের ভেতরে। সনাতনের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি। কাঁধে তাঁর ব্যাগ, চোখ-মুখে বুদ্ধিদীপ্ত নির্মল হাসি। সনাতন ভয়ে ভয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে আবার থমকে দাঁড়াল। লোকটি হাত তুলে ডাকল, “এসো, আমার কাছে এসো। ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী। তোমার সাথে গল্প করতে এসেছি। জেলের  কর্তাবাবু আমাকে অনুমতি দিয়েছেন।”

সনাতন অবাক হল। দুঃখের জীবনে এমন করে তো কেউ বলেনি। তবে সাধুবাবাও সুখের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, মুখে অন্ন জুটিয়েছিল। তার স্বরূপ আমি চিনতে পারিনি। এঁনাকে বিশ্বাস করে না জানি আবার কোন্ বিপদের মুখোমুখি হতে হবে! পরক্ষণেই আবার ভাবল, “বিপদের আর কীবা বাকি আছে? মরেই তো গেছি। মরার মরনের ভয় কী!” লোকটির কাছে আসতেই তিনি পিঠে হাত বুলিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “সনাতন, তুমি তো মহারাজ নবরত্ন গোস্বামীর ‘রাধাকৃষ্ণ আশ্রমে’র সেবক ছিলে, তাই না?” সনাতন বিস্ময়ে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু গলায় বলল, “সাধুবাবার নাম ‘নবরত্ন গোস্বামী’, আমার জানা ছিল না। আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম। কিন্তু আপনার পরিচয় কী, কেনইবা এসেছেন, জানতে পারলাম না।” “জানবে, সব জানবে। তার আগে তুমি বলো। আজ থেকে ১৫-১৬ বছর আগে একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সনাতন কীর্তনীয়া’ নামে এক যুবক দর্শনে এম.এ পাস করেও একটা ভালো চাকরি জুটাতে পারেনি। দেনা শোধ করতে না পারায় শান্তিপুরের তার পৈতৃক বাড়িটা বিধায়ক ময়ূরেশ্বর পাল  হস্তগত করেন। ভিটে হারানোর শোক সামলাতে না পেরে যুবকের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। একমাত্র দিদি, ‘ভাইয়ের জেল হয়েছে’ শুনেও একবারের জন্য দেখতে আসেনি। শ্রীময়ীকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল। বিনিময়ে গরিব যুবককে শ্রীময়ী দূরে ঠেলে দিয়েছিল। যদিও ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে শ্রীময়ীর সুখ হয়নি। ঠাঁই হয়েছিল নবরত্ন গোস্বামী ওরফে এক সাধুবাবার আশ্রমে, আসলে এক নরক সাম্রাজ্যে। ভণ্ড সাধুবাবার কুকীর্তি ধরে ফেলা আর শ্রীময়ীকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাবার কারণেই আজ যুবককে জেল খাটতে  হচ্ছে। কে সে?”  “সে আর কেউ নয়, আমি। কিন্তু আপনি এত কিছু জানলেন কী করে?” “জানি তো, আরও অনেক কিছুই জানি। তোমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সবকিছুই জানি। আমি শ্রীময়ীর কথাও জানি।”

সনাতন এবার বিমর্ষ হয়ে পড়ল। ফেলে আসা দিনগুলো, কত স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। চোখ দুটো মুছে নিয়ে বলতে লাগল, “শ্রীময়ী একদিন হৃদয়ের বন্ধনে জড়িয়েছিল, আবার একদিন সেই বন্ধন ছিন্ন করে চলেও গিয়েছিল। যে চলে যায়,  তাকে কি আর আটকে রাখা যায়?” “তা অবশ্য ঠিক বলেছো। আসলে কী জানো,তোমাকে ভালবাসলেও তোমার দারিদ্র আর বেকারত্বকে সে ঘৃণা করেছে। তার যে অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল। যদিও  ঐশ্বর্য থাকে সুখ দিতে পারেনি। কেননা, ঐশ্বর্য প্রেম বিলায় না, তা শুধু ভোগের লিপ্সায় আচ্ছন্ন করে। প্রেম ঈশ্বরের দান। ঐশ্বর্য, আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনার মধ্যে প্রেমের পরশ ঘটে না। থাক্ এসব কথা। এবারে কাজের কথায় আসি। আমি যদি তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি, তুমি করবে? তুমি আবার নতুন করে সুখের ঘর বাঁধতে পারবে।”

লোকটি যেন সনাতনের হৃদয়ের আপনজন হয়ে উঠল। তাঁর সামনে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল। দুঃখময় জীবনের কথাগুলো আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো। “আমার জীবনের আশারা মরে গেছে। স্বপ্নরা মরীচিকায় মিলিয়ে গেছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমার দু’বছরের জেল হয়েছে। তাছাড়া নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি না, সে যে ভারী অন্যায়। হৃদয়ের ভালোবাসা আমি আমার জীর্ণ কুটিরে একজনের জন্যই যতনে রেখেছিলাম। সে নেই। তবু অন্য কাউকে তা দিতে পারিনা।” লোকটি মনে মনে বললেন, “তুমি আমার পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছো।” তারপর সান্ত্বনা দিলেন, “কেঁদো না। জেল থেকে শীঘ্রই তুমি মুক্তি পাবে। তোমাকে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।” “আপনি এসব কী বলছেন? রসিকতা করে আমার দুঃখ আরও বাড়িয়ে দেবেন না। আপনাকে কাছে পেয়ে শত দুঃখের মধ্যেও একটু আগে মনটা আমার শান্তিতে ভরে উঠেছিল। এখন আবার ………।”

লোকটি দিব্য-দৃষ্টি মেলে যুবকের আপাদমস্তক দর্শন করলেন। এরপর সনাতনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,“পাগল ছেলে। জানি, আঘাতে আঘাতে, প্রতারণা,ছলনায় তোমার মনটা এখন বড়ই অশান্ত। অবিশ্বাস তোমার ভেতরে জন্মানোই স্বাভাবিক।”

মুহূর্তে লোকটির উপর সনাতনের বিশ্বাসভক্তি আরও বেড়ে গেল। স্মৃতির পাতাগুলোও আপনা থেকে উল্টে যেতে  থাকলো। মনে পড়ছে হারানো চাকরির কথাটা। লোকটিকে বলতে লাগল, “জানেন, আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে, একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার সুখের ঘর বাঁধবো। কিন্তু একটা বছর যেতে না যেতেই অফিসে একের পর এক আধুনিক কম্পিউটার, উন্নত প্রযুক্তির মেশিন এসে বসতে লাগল। লোক ছাঁটাই হতে লাগল। ছাঁটাইয়ের তালিকায় আমার নামও উঠল। অবশেষে যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই ফিরে এলাম। লোকমুখে আগে শুনতাম, “ধর্ম  মানুষকে আর পথ দেখাতে পারেনা। সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।” তা যদি সত্য হয়, আমি তো নিজের চোখে দেখলাম, “বিজ্ঞানও তার প্রভূত অগ্রগতি সত্ত্বেও প্রগতির পথ আর দেখাতে পারছে না। সেও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে।”

লোকটি আবেগে দুটো হাত দিয়ে সনাতনের মাথার পেছনটা আলতো করে ধরে চোখে চোখ রেখে বলতে লাগল, “আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। জমিতে ট্রাক্টর আসায় এক ধাক্কায় অগণিত মজুর-চাষী কাজ হারিয়ে ফেলল। পরমাণুর বিপুল শক্তিকে বিধ্বংসী বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা হল। আজকে উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থ চুরি হয়ে যাচ্ছে। আবার ধর্মকে অবলম্বন করে একশ্রেণির মানুষ বহুকাল থেকেই অসৎ উদ্দেশ্য সাধন করছে। কিন্তু তাই বলে এমন ভাবনা ঠিক নয় যে, ধর্ম বা বিজ্ঞান প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে। অন্যায়, অধর্ম ক্ষণস্থায়ী। ঈশ্বরের বিচারশালায় পাপীরা রেহাই পায় না।” “আপনার কথা যদি সত্যি হবে, তাহলে তো বলতে হয় ঈশ্বর অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। আর সকল মানুষ যদি ঈশ্বরের সন্তান হয়, তবে আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানীরাও ঈশ্বরের সন্তান, যাঁরা পৃথিবীতে ধ্বংসের বীজমন্ত্র দিয়ে গেছেন।”

“না সনাতন, মন দিয়ে শোনো। বিজ্ঞান হলো বিশেষ জ্ঞান। সেই জ্ঞান থেকেই আসে শক্তি। শক্তির দুটো রূপ আছে। একটি শুভ রূপ, যাকে আমরা বলি ঐশ্বরিক শক্তি। ঈশ্বরের নিরন্তর সাধনার পথেই সেই শুভ শক্তির সন্ধান মেলে। আরেকটি অশুভ রূপ, যা শয়তানকে তুষ্ট করে লাভ হয়, ঈশ্বরের মহান সৃষ্টিকে যা দিয়ে নিমেষে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। তবে অমোঘ সত্য যে, যদি কোনো পাষণ্ড অশুভ শক্তির সাধনা করে, ঈশ্বরের বিচারে তার শাস্তি অনিবার্য। মনে রেখো, ঈশ্বর তাঁর সন্তানের মাধ্যমে শুভ শক্তিকে জগতের কল্যাণে ব্যবহার করেন। আর  শয়তান, বিপথে চালিত হওয়া কুসন্তানের মাধ্যমে, অশুভ শক্তিকে ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করে। জয় হয় শুভশক্তিরই।” এই বলে লোকটি বিদায় নিলেন।

সনাতন অন্তরের অনুপ্রেরণায় পরম করুণাময় ঈশ্বরের কথা ভাবতে ভাবতে ধ্যানস্থ হয়ে পড়ল। এমন সময় কর্তব্যরত অফিসার এসে ধমক দিলেন, “এই, তুই এখানে কী করছিস্? তোর ঘর ছেড়ে এখানে এসেছিস কার নির্দেশে?” “স্যার, একজন লোক এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।” “লোক! কোনো লোক তো তোর সাথে দেখা করতে আসেনি। কী যা তা বলছিস! তোর মতলব তো ভালো নয়। শাস্তি কিন্তু বেড়ে যাবে, বুঝলি?”

নির্বিকার সনাতন ভাবতে লাগল, “কে এসেছিলেন তবে? কেউ জানলো না, দেখল না? নিশ্চিদ্র প্রহরা টপকে কোনো মানুষের আসা কি সম্ভব? কেনইবা আসবেন? এত সময় ধরে এত কথা আমাকে বলে গেলেন, এতক্ষন কারও চোখে পড়ল না! আমিও তো তাঁকে কত কথা বললাম। সব আমার দিব্যি মনে আছে। নাঃ, আমি তো কোন স্বপ্ন দেখিনি। আমার সামনা-সামনি বসেছিলেন। তাহলে কে এসেছিলেন? একি! আমার দেহ-মনে এত শান্তি অনুভূত হচ্ছে কেন? আমি ভয় পাচ্ছি না কেন? ………?”

মুহূর্তকাল পরেই অফিসার এবার ঊর্ধ্বর্শ্বাসে ছুটে এসে বললেন, “সনাতন, এইমাত্র খবর এলো, তোর বেকসুর খালাস। তুই নির্দোষ, আর রাধাকৃষ্ণ আশ্রমের সাধুবাবা অর্থাৎ নবরত্ন বাবাজি দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে গেছে। শুনলাম – আশ্রমের এক সেবিকা ‘শ্রীময়ী’ আত্মহত্যার চিঠিতে সব বিবরণ লিখে রেখে গেছে। সেই চিঠির সূত্র ধরেই তুই সুবিচার পেয়েছিস।

সনাতন গুটিগুটি পায়ে জেলখানার মূল দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। “শ্রীময়ী মৃত্যুকে বরণ করে নিল, আর আমাকে মুক্ত করে দিয়ে গেল! কেন? এই কি প্রায়শ্চিত্ত? এই কি প্রতিদান? আর একটু আগে কে এসেছিলেন? ঈশ্বর কি এই অধমের জন্য তাঁর দূত পাঠিয়েছিলেন! ঈশ্বরের এত অকৃপণ দান আমার উপর! কিন্তু হে করুনাময়, হে জগদীশ্বর, আমি এখন কোথায় যাবো? কোথায় একটু আশ্রয় পাবো? বলে দাও আমার ঠিকানা।”

জীবন-মরুর পথে

মূল দরজা খুলে দিলে সনাতন বাইরে বেরিয়ে এলো। একটা গাড়ি আগেই এসে দাঁড়িয়েছিল। দরজা খুলে নিচে নামলেন এক মহাপুরুষ। গলায় উত্তরীয় এবং রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে চন্দনের তিলক। তাঁর এক হাতে গীতা, অন্য হাতে ফুলের মালা। সেই মালা আনন্দে পরিয়ে দিলেন সনাতনের গলায়। হাতে অর্পণ করলেন গীতা। তারপর দু’হাতে ধরে তুলে নিলেন গাড়িতে। স্বর্গীয় সুখের অনুভবে সনাতনের দু’চোখের ধারা বইতে লাগল। মাথায় তুলে নিল মহাপুরুষের চরণ-ধূলা। গাড়ি চলতে থাকল ‘সেবাশ্রম সংঘে’র উদ্দেশ্যে।

……………………………………………………….