Bhuter Biye – ভূতের বিয়ে

(রূপকধর্মী ছোটগল্প)

ভূতের বিয়ে

                                 – শুক্লা সরকার

এক গ্রামে এক স্বর্ণকার ছিল। সে সুন্দর সুন্দর গহনা তৈরি করত। তার পরিবারে মা-বাবা ও একটি ছেলে ছিল। স্বর্ণকারের স্ত্রী জ্বরে ভুগে মারা গেছে। ছেলেটি শহরের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ে। সে প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে গল্প শুনতে ভালোবাসতো। ঠাকুমার কাছে সে এখন প্রায়ই বায়না করে। একদিন সে ঠাকুমাকে পীড়াপীড়ি করল, “তুমি আজকে ভূতের story বলোনা ! তোমাকে বলতেই হবে।” ঠাকুমা বলল, “চুপ! চুপ! রাতেরবেলায় তাদের নাম নিতে নাই। তাছাড়া story আমি জানিনা।” ”আরে ঠাকুমা, story মানে তো গল্প। তুমি দেখছি কিছুই জানো না। আমাদের স্কুলের দিদিভাইরা বলে – সকলেই ভালো করে story শিখে আসবে । যার storyটা বেশি ভালো হবে, তাকে বেশি নাম্বার দেব।” ঠাকুমা তখন বলল, “ওঃ এই ব্যাপার! তবে মন দিয়ে শোন্। অনেক অনেক কাল আগের কথা। নিশ্চিন্তপুর নামে এক সুন্দর গ্রাম ছিল। সেখানে এক জমিদার ছিল। তাঁর মস্ত বাড়ি, বড় দীঘি, মস্ত এক বাগান ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে সেই জমিদার, জমিদার-গিন্নি, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, তাদের সকলের অকালমৃত্যু হয়েছিল। ” ঠাকুমা, কী হয়েছিল তাদের?” “শোনা যায় লোকমুখে, এক ঘন বৃষ্টির রাতে প্রকাণ্ড এক বাজ পড়েছিল। সবাই ঘুমিয়েছিল। ওই অবস্থাতেই সব শেষ।

 

ভূতের বিয়ে

 

কিন্তু সকালে গিয়ে কেউ আর মৃতদেহগুলি দেখতে পায়নি। ভয়ে সকলেই ফিরে এল। সেই থেকে আর কেউ কোনোদিন সেখানে যেত না। বাড়িটা হয়ে উঠল ভূতের বাড়ি। বুড়ো-বুড়িরা বলাবলি করে – অনেক কাল পরে ওই গ্রামের একটি বামুনের ছেলে ওই ভূতের দীঘিতে মাছ ধরতে গিয়েছিল। তার ছিপে গাঁথা একটি বড় মাছ সে কিছুতেই পাড়ে তুলতে পারছিল না। তখন হঠাৎ কোথা থেকে একটি বুড়ি-মেয়ে এসে তার লম্বা হাত দিয়ে মাছটাকে তুলে দেয়। আর ছেলেটিকে বলে – শোন্ বাছা। এতদিন ব্রাহ্মণ ছাড়া আমার প্রিয় নাতির সঙ্গে এক সুন্দরী কন্যা ‘পেতনি’র শুভ বিবাহটা দিতে পারছিলাম না। তোকে পেয়ে ভালই হল। তুই আমার নাতির সঙ্গে পেতনির বিয়েটা দিয়ে দিবি। ছেলেটি বলল, ‘বুড়িমা, আমার কোন মন্ত্র জানা নেই। তবে বই পড়ে পারবো। কিন্তু বই যে আমার নেই।’ ‘একটু দাঁড়া,’ এই বলে বুড়ি তখন যাদুবলে হাত পেতে দুটি মোহর এনে ছেলেটিকে দিয়ে বলল, ‘এই নে, তোর দক্ষিণা। মন্ত্রের বই যেখান থেকে পারিস্, জোগাড় করে এনে কালই ওদের বিয়ে দিয়ে দিবি।’ মোহর পেয়ে ছেলেটি খুশি হয়ে বলল, ‘বেশ, তাই হবে।’ বাড়ি এসে সে বাবার কাছে মোহর দুটি দিয়ে বলল, ‘তোমার মন্ত্রের বইটা কাল একটু নেব।’ মোহর দুটি মোগল আমলের। বাবা বেশ চিনে ফেলল। ‘কোথায় পেলি এই মোহর?’ সবকিছু ছেলের কাছে শুনে নিল বাবা। লোভ সামলাতে না পেরে রাতেরবেলায় বাবা মনস্থ করল – ভোর হতেই সে কাউকে না জানিয়ে নামাবলিটা গায়ে জড়িয়ে ওই দীঘির কাছে যাবে। তারপর বুড়ি আর মোহরের সন্ধান করে আরও মোহর হাতিয়ে নেবে। সেই মতোই ঠিক ভোরবেলায় ওই দীঘির ধারে গিয়ে হাজির হয়ে ‘বুড়িমা, বুড়িমা’, বলে জোর গলায় হাঁক দিতে লাগল। হাঁক শোনামাত্রই খোনা গলায় কে যেন বলে উঠল, ‘কী চাই তোর? এখানে কীজন্য এসেছিস?’ ‘এখানে এসো বুড়িমা, বলছি।’ ভূতেরা মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। আর নামাবলিকে ভয় পায়। তাই একটু দূরে থেকেই বলল, ‘তোর পিছনে আমি।’ পিছন ঘুরে বুড়িমাকে দেখে বাবা বুঝতে পারে – এ তো মানুষ নয়, ভূত। তখন সে জোরে জোরে রামনাম জপ করতে লাগলো। নিমেষে বুড়িমা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বাবাও সেই সুযোগে বাড়ির দিকে দৌড় দিল।
হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে ছেলের মাকে ডেকে বলল, ‘এক গ্লাস জল দাও তো।’ গিন্নির হাতের জল খেয়ে, একটু সুস্থ হয়ে বলল, ‘আজ ভোরে আমি কোথায় গিয়েছিলাম, জানো? দীঘির পাড়ে। গিয়ে দেখলাম – বিশাল আকৃতির ওই বুড়ি। তার দাঁতগুলো মূলের মতো। শুন্যে তার পা। পরনে সাদা শাড়ি। ছেলের মুখে শুনে মোহরের লোভে পড়ে আমি তো জানটা হারাতেই বসেছিলাম গো। ভাগ্যিস ঘাড়টা মটকে দেয়নি। নামাবলিটা আমাকে রক্ষা করেছে। থাক্ এখন ওসব কথা। আমাদের খোকা কোথায়? ও যেন দীঘির পাড়ে না যায়।’
এদিকে ছেলে লুকিয়ে বাবার সব কথা শুনেও মন্ত্রের বই নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সোজা দীঘির ধারে চলে গেল। গিয়ে দেখল – দীঘির পাশে বাগানটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। যেন স্বর্গের উদ্যানের চেয়েও সুন্দর এই বাগান। পরীরা বাদ্য বাজাচ্ছে। পাখিরা মধুর সুরে গান গাইছে। ফুল দিয়ে ছাদনাতলা সাজানো হয়েছে। বর ও কনেকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে দুটি পিঁড়িতে বসানো হয়েছে।

 

ভূতের বিয়ে

 

ছাদনাতলার অদূরে ভোজন কক্ষ। সেখানে কাঁচা মাছের বিশাল স্তুপ। এই কাঁচা মাছ ভূতেদের প্রিয়, তাই ওগুলো আজকের প্রীতিভোজের আহার। এমন সময় বুড়িমাও সুন্দর করে সেজে এসে বলল, ‘ওরে এসেছিস? জানি, তুই সব শুনেই নির্ভয়ে এসেছিস। সত্যিই এখানে তোর কোন ভয় নেই। তুই যে সৎ, নির্লোভ। ওরে ছেলে, দেখে নে,তোদের মানুষদের মতো করে সাজানো হয়েছে কিনা।’ ‘হ্যাঁ বুড়িমা, খুব ভালো হয়েছে।’ ‘বেশ। তবে এবার তুই মন্ত্র পড়্। ছেলেটি তখন বই খুলে মন্ত্র পাঠ শুরু করল। ‘ওং নমঃ’ কথাটা খুব জোরে জোরে বলতে লাগলো। বুড়ি খুব খুশি। শত হলেও ব্রাহ্মণ দিয়ে বিয়ে দিচ্ছে। নাতিও ভীষণ খুশি।

 

ভূতের বিয়ে

 

বিয়ের শেষে বুড়ি আরও দুটি মোহর দিয়ে বলল, ‘নে রে ছেলে। এ দুটোও দক্ষিণা স্বরূপ দিলাম।’ এরপর একটি প্যাকেট দিয়ে বলল, ‘এতে অনেক মিষ্টি আছে। বাড়িতে গিয়ে সকলে মিলে খাবি। আমাদের ভোজের খাবার তো তোরা খাবি না। তাই ওগুলো দিলাম না।’ আর একটি গোলাকার বড় পাতা দিয়ে বলল, ‘এর উপরে উঠে বস্। এই পাতাই তোকে তোর বাড়ি পৌঁছে দেবে।’ ছেলেটি নব দম্পতিকে আশীর্বাদ করল। তারপর বুড়িমাকে নমস্কার জানিয়ে পাতায় উঠে বসল। পাতাটা ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠতে লাগলো এবং দ্রুত বাড়ি পৌঁছে দিল ছেলেটিকে। সঙ্গে সঙ্গে পাতাটাও অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছেলে এবার মন্ত্রের বই আর মোহর দুটি বাবাকে দিল। বাবার দেখে তো বিস্ময়ের সীমা নেই। এরপর সেই মোহর ব্যবসার কাজে লাগাবে বলে বিদেশের এক বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কলকাতায় যোগাযোগ করা হল। মোহরগুলো তাকে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ পাওয়া গেল। সেই অর্থে ব্যবসা দিনে দিনে ফুলে-ফেঁপে উঠলো। ছেলেটি হয়ে উঠল বিশ্বের এক অতি ধনী ব্যবসায়ী।”
ঠাকুমার মুখে এমন গল্প শুনে নাতির আনন্দের সীমা রইল না। কৌতূহলেরও সীমা নেই। মনে মনে ভাবল – ‘ঐ জমিদার বাড়ির সকলেই তবে ভূত হয়েছে। ওরা থাকে ওদের দীঘির পাড়ে নির্জন বাগানে।’

 

নীতিকথাঃযে ব্যক্তি সৎ এবং সাহসী, সে কখনো বিপাকে পড়ে না। আর লোভী, ভীতু ব্যক্তি সবসময় জীবনে চলার পথে পাঁকে পড়ে।
…………………………………………………….