Patro Nirbachan – পাত্র নির্বাচন

(ছোটগল্প) 
পাত্র নির্বাচন – হরবিলাস সরকার

 ফেসবুকে আলাপ হয়েছিল পীযূষ, পায়েলের। ভালোলাগা ভালবাসায় পরিণত হয়। দুটি মন এবার কাছাকাছি আসতে চায়। সুদূর সুন্দরবন থেকে পলাশী। সৌভাগ্যবশতঃ পলাশীতেই পায়েলের মামার বাড়ি। সেকথা সে পীযুষকে জানিয়েছে। পীযূষ আমন্ত্রণ জানায় পায়েলকে, এসো, এই ফাল্গুনের কোনো এক শুভলগ্নে আমাদের চার হাত এক হোক। তুমিও নিশ্চয়ই তাই চাও। সামনাসামনি কথা হবে।

এক ভোরের ট্রেন ধরে সত্যিই পায়েল চলে এলো। বিকেলে মামাবাড়ি থেকে পলাশীর আমবাগান। সেখানেই অপেক্ষা করছিল পীযূষ। ইতিহাসের ছাত্রী পায়েল। বি.এ অনার্স ক্লাসে ‘স্মৃতিবিজড়িত মামার বাড়ির দেশ’, আরও ভালো করে বললে – ‘বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেশ’ সম্বন্ধে সে ভাল করেই পড়াশোনা করেছে। এই প্রথম দুজন দুজনের একেবারে কাছাকাছি। কেউ কারও থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। মোবাইলের পর্দায় যেমন দেখেছে, কাছে থেকেও পায়েলের সেই সৌন্দর্য। পায়েলও পিযুষের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ। তার উপর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা সহ শিক্ষক পদে যোগদান করেছে। এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? এমনটা ভেবে নিয়ে পায়েল শুধোয়, পীযুষ, তুমি আমাকে পাকা কথার জন্য ডেকেছো। পাকা কথা কি তোমার-আমার মধ্যেই হবে? হ্যাঁ পায়েল, আমার মা-বাবার তেমনই ইচ্ছা। আজকের আধুনিক যুগে ছেলেমেয়েরা নিজেরাই নিজেদের জীবনসাথী বেছে নেবে, এমনটাই হওয়া উচিত। তুমি কী বলো?

কথাগুলো পায়েলের বেশ ভালো লাগে। তবু ভাবতে থাকে, এ যে মীরজাফরের দেশ, বিশ্বাসঘাতকতার দেশ। পীযুষ যাই বলুক, ওর বাইরেটা আমি দেখেছি, ভেতরটা দেখিনি। যেখানে ভালোলাগা-ভালোবাসার সম্পর্ক, সেখানে বাইরের চাকচিক্যই প্রস্ফুটিত হয়, ভেতরের মলিনতা প্রচ্ছন্ন রাখার প্রচেষ্টাই থাকে। মা-বাবা সে কারণেই বুঝি বলে, ভালোবাসার বিয়ে বেশি ভাঙে। দেখাশোনার বিয়ে তুলনায় কম ভাঙে। পীযুষ জিজ্ঞেস করে, পায়েল, কিছু বলছো না কেন? পায়েল আসলে একটু যাচাই করে নিতে চায়। তাই বলে, পীযুষ, আমি তো তোমার আমন্ত্রণ পেয়ে বেড়াতে এসেছি। আমাকে কিছুটা সময় দাও। বিয়েটা একটু দেরিতে হলে ক্ষতি কী? আভিজাত্য পরিবারের একমাত্র সন্তান আমি। আমাদের বড়সড়ো একটা বাড়ি আছে। দামি গাড়ি আছে। বাবার বড় ব্যবসা আছে। পাঁচ বিঘার উপর ফলের বাগান। দশ বিঘের উপর মাছের ভেরী আছে। লক্ষ্মীটি, আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি, বাবার প্রপার্টির দেখভালের দায়িত্ব তোমাকেও সামলাতে হয়। ভাবছো, তুমি চলে এলে সেসব কে সামলাবে? আমি অমানবিক নই। তোমার মা-বাবা, মানে আমারও মা-বাবা। তাদের উপর তোমার যতটুকু দরদ, আমারও ততটুকুই দরদ। বুঝেছি পীযুষ, তোমার ভেতরে আছে প্রকৃত মানুষ। কিন্তু একটা কথা তোমাকে না বললেই নয়। এই যে আমি আমার সম্বন্ধে এত কথা বললাম, তুমি সেসব যাচাই করে দেখবে না? পীযূষ হাসে। মনে মনে বলে, যার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, তার আবার কী যাচাই করবো?তারপর মুখ ফুটে বলে, না পায়েল, তোমাকে দেখেই আমি বুঝতে পারছি। তুমি মিথ্যে বলোনি। তাছাড়া বড় কথা হলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। না পীযুষ, আমার ভেতরে যদি কিছু দুর্বলতা থাকে, যদি কিছু লুকোচুরি থাকে, সবটাই জেনে নেওয়া উচিত। তবেই হৃদয়ের বন্ধন দৃঢ় হবে।

পীযূষ ভ্রু কুঁচকে মুচকি হাসিতে বোঝাতে চায় – ওসবে দরকার নেই। এই হাসিটা পায়েলের ভালো লাগে না। তাকে ভাবিয়ে তুলেছে – পীযূষ নিজেকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাখতে চায় কেন?  আমি তো চাই একজন খোলা মনের মানুষ। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ঘুরপাক খায় পায়েলের মন। উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এমন পাত্রকে হাতছাড়া করবো!

 পরদিন বিকেলে হাজারদুয়ারী প্যালেস। ভাগিরথীর পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর বসে দু’জনের কত কথা হয়! গোধূলির আকাশ আবির রঙে রঞ্জিত হয়। পাখিরা নীড়ে ফিরতে শুরু করল যখন, পায়েল বলল, পীযুষ এবার তো আমাদেরও ফিরতে হবে। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলি বলি করে বলা হয়নি। অপ্রিয় হলেও বলে নেওয়াটাই ভালো। জানো তো, তোমার সাথে আলাপ হওয়ার আগে, একটা ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। অবশ্য অল্প দিনেই ভেঙে গিয়েছিল। এতে তোমার আপত্তি নেই তো? পীযূষ মনে মনে ভাবে, ক্ষতি কী? এক-আধটু বদনাম কার না থাকে? কী ভাবছো পীযূষ? বলো। হ্যাঁ, না, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি জানি, যৌবন বর্ষার বেগবতী নদীর মতো। বড় চঞ্চল। তাছাড়া তোমার সৌন্দর্যের কাছে ওসব অতি তুচ্ছ। সত্যি, কোনো এক শিল্পী যেন তাঁর তুলি দিয়ে তোমাকে নিখুঁতভাবে এঁকেছেন। বাঃ বাংলার শিক্ষক কিনা, সাহিত্যের এমন ভাষা তোমার মুখে আশা করতেই পারি। মনে মনে পায়েল বলে, এর কাছে চরিত্র নয়,   সৌন্দর্যটাই বড়। আমাকে না আমার শরীরকে ভালবাসে? শকুন অনেক উপরে উঠলেও নজর ভাগাড়ের দিকেই থাকে। এর ব্যাপারে কি মামা বা মামীকে জানাবো? না, আর একটু দেখি বা বুঝি।

পরদিন মতিঝিল। পড়ন্ত বেলায় অশ্বখুরাকৃতি ঝিলের পাড়ে বসে পায়েল যেন হারিয়ে গেল ইতিহাসের সেই নির্মম প্রহরে। কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় তার চোখে জল এলো। তবু পীযূষ দিব্যি খোশমেজাজেই আছে। না, আজ পায়েল সব মিথ্যাকেই উপড়ে ফেলবে। সত্য যতই কঠিন হোক, সেই কঠিনেরেই সে ভালবাসবে। বলল, পীযূষ, আজ এক কঠিন সত্য আমি বলবো। হয়তো তারপর তুমি আমাকে ঘৃণা করবে। আমি দিনমজুরের মেয়ে। অতি কষ্টে অনার্সটা পাশ করেছি। টাকার অভাবে বি.এড করতে পারিনি। কাল অবধি যা বলেছি, সব মিথ্যে।

পীযুষের অন্তর আকাশে ঝড় উঠলো। কিন্তু তুমি আমাকে মিথ্যে বললে কেন? বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি। ছলনার আশ্রয় নিয়ে তোমার মন পেতে চেয়েছিলাম। অনেক ভেবে দেখলাম, আমি তোমার যোগ্য পাত্রী নই। পীযূষ চিন্তান্বিত হয়ে পড়ে। ভিখারির মেয়ে। বি.এড ডিগ্রীটা থাকলেও হ’তো। এম.এল.একে ধরে শিক্ষিকার চাকরিটা জোটানো যেত। তা যখন হবার নয়, আমার পাশে দাঁড়াবে কী করে? কিন্তু ওর রূপ যে আমার মনকে পাগল করে তুলেছে। পৈশাচিক মন অমনি বলে উঠল, লক্ষ্মীটি আমি শুধু তোমাকে চাই। অন্য কিছু নয়। পায়েল এবার নিশ্চিত হয়, এ ছেলে আসলে আমাকে নয়, আমার শরীরকে চায়। বলে,  পিযুষ, আমার আসল পরিচয় জেনেও তুমি আমাকে তোমার হৃদয়ে স্থান দিতে চাইছো? পায়েল, আজ নয়, কাল দেখাবো। লেখা আছে হৃদয়ে তোমার নাম। সে নাম কখনো মুছে যাবে না। পায়েল এমন কথায় অন্য কিছু ভাবছে। তবে কি পীযূষ আমাকে সত্যিই ভালবাসে? বড় উদার মনের মানুষ ! নিষ্কলঙ্ক! জীবনে কোনো মলিনতা থাকলে নিশ্চয়ই প্রকাশ করে ফেলতো। ছি! কীসব আকথা-কুকথা বলে পরীক্ষা করতে চাইলাম। আমার লজ্জা করছে। ইচ্ছে করছে, বলে দিই, পীযূষ, আমি গরীবের মেয়ে, সত্য।  কিন্তু যা বলেছি, ওসব আমার জীবনে কিচ্ছুটি ঘটেনি। থাক্, আজ নয়। কালই যা বলার বলবো। প্রয়োজনে ক্ষমা চেয়ে নেবো। জিজ্ঞেস করে, পীযূষ, কাল আমরা কোথায় যাচ্ছি? বলা যাবে না। ওটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ থাকল। কেন বলল না ? পায়েলের সন্দেহটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মামা-মামীকে তাহলে আমি কী বলে আসবো? না, পীযূষের ব্যাপারে মামীকে আজই আমি জানাবো। আর গলদ কিছু থাকলে কালই চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতেই পায়েল ফিরে এলো। মামীকে সব কথা জানালো। অনেক রাতে মামা আজ বাড়ি ফিরেছে হরিপদকে সঙ্গে নিয়ে। খাওয়া-দাওয়ার পর পায়েলকে ডেকে বলল, মা রে, সব কথাই শুনলাম তোর মামীর কাছে। বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওই পীযূষ ছেলেটা ভালো নয়। ওর ব্যাপারে হরিপদ সব জানে। ওদেরই পাশের গায়ের ছেলে। পরে মামী একান্তে পীযূষের ব্যাপারে খুলে বলল পায়েলকে। আরও বলল, হরিপদর মায়ের খুব পছন্দ তোকে। ছেলেটা খুব ভালো রে। সুখী হতিস্ মা। এখন তোর ইচ্ছা। মামী, হরিপদদার কথা আমার মা-বাবাও বলেছে। ভালো ছেলে, সে আমিও জানি। কিন্তু সিদ্ধান্তে আসতে আমাকে একটু সময় দাও মামী। ওর সাথে কথা বলেছিস? না, সকালে বলবো।

সারারাত পায়েল ঘুমায়নি। ভেবেছে, মামা-মামী কি ইচ্ছে করে পীযূষের বদনাম করছে, যাতে আমি হরিপদকে …….। ভালোর তো শেষ নেই। সবাই আরও ভালোটাই চায়। পীযূষকে আমি নিজে চিনতে-জানতে চাই। তারপর সিদ্ধান্ত নেবো। আশাকরি সেটা কালই হবে।

সকালে হরিপদর সঙ্গে কথা বলল পায়েল। দুপুরে ঘুমালো। তারপর যথাসময়ে বেরিয়ে পড়ল। পলাশীর আমবাগানের কাছাকাছি একটা পোড়ো বাড়ি। পায়েল চমকে উঠল। পীযূষ, এখানে কেন? সারাটা জীবন যার সঙ্গে কাটাবে, তার সঙ্গেই তো আছো, ভয় কীসের?

ফাল্গুন শেষের আজ বিকেলে পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে। সূর্য আড়ালে চলে গেল এইমাত্র। পায়েল বলে, দেখাও পীযূষ সেই নাম, যে নাম তোমার হৃদয়ে লেখা আছে। পীযূষ তার স্বরূপ উন্মোচন করতেই পায়েল চিৎকার করে উঠল। ছি! পীযূষ, তুমি এত অসভ্য! সমাজের কলঙ্ক তুমি,  ছাড়ো। ছাড়ো, নাহলে ফল ভালো হবে না। তোমার রূপের মোহে বড়ই পাগল হয়েছি আমি। বেকার জীবনে গোবিন্দপুরের হেডমাস্টারের মেয়ে ‘দীপা’কে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। পাঁচ দিন পর ওর বাবা ওকে ভাড়াবাড়ি থেকে ফেরত নিয়ে এসেছিল। আর তোমাকে জীবনসঙ্গী নাইবা করলাম, একটা দিনের জন্য, অন্ততঃ একটা বেলার জন্য তো পেতে পারি। এমন সময় ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক যুবক বীর বিক্রমে এগিয়ে আসে। পীযুষ আচমকা পায়েলকে ছেড়ে দেয়। কী হল পীযূষ? তোমার ভেতরের মানুষটাকে চিনে ফেললাম, তাই না? সামনে কাকে দেখছো? মীরজাফরের দেশে মীর মদন, মোহনলালেরাও থাকে। ও হরিপদ,  তোমাদেরই পাশের গ্রাম ‘গোবিন্দপুরে’ র ছেলে। আমার  মামীর দিক থেকে দূর সম্পর্কের আত্মীয়।  লোহা পেটানো হাত। এক ঘুষিতে তোমার হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিতে পারে। পীযূষ এক লাফে পাঁচিল টপকে ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল মাড়িয়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগল।

patro nirbachan

হরিপদ বলে, পায়েল এত বড় ঝুঁকি নিয়ে এখানে না এলেই পারতে। জীবন সংশয় হতে পারত। যাইহোক, চলো এবার, তোমাকে তোমার মামার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমিও চলে যাবো। তার আগে কথা দাও, জীবনে-মরণে এমন করে তুমি আমার পাশে থাকবে। না পায়েল, আমি বি.এ পাস করেছি, সত্য। কিন্তু আমি একজন মিস্ত্রি। না হরিপদ, আমি তোমার মাঝে খুঁজে পেয়েছি সত্যিকারের মানুষ।

  অস্তবেলায় পাখিরা নিড়ে ফিরছে। পায়েল, হরিপদ গুটি গুটি পায়ে পথ চলতে থাকে।

 

………………………………………………………