Chadmabeshee Bhikshuk – ছদ্মবেশী ভিক্ষুক

(রম্যরচনা)
ছদ্মবেশী ভিক্ষুক – হরবিলাস সরকার

 জেলার সদর হাসপাতালের প্রথম গেটের পাশে একটা পাকুড় গাছ। কিছুদিন ধরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ভিক্ষুক মাটিতে দু’হাতে ভর দিয়ে, ব্যাঙ যেমন লাফিয়ে চলে, তেমন করে লাফাতে লাফাতে ওই গাছের গোড়ায় এসে বসে। শত তালি দেওয়া পুঁটলি থেকে একটা মরচে ধরা থালা বের করে সামনে রাখে। তার ছেঁড়া, মলিন পোশাক। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। মাথার চুল গুলো উসকোখুসকো।

ছদ্মবেশী ভিক্ষুক

দুঃখ-ব্যথায় কাতর হয়ে ভিক্ষুক দু’হাত বাড়িয়ে দরদি কন্ঠে ভিক্ষা চায়, মাগো, বাবাগো, দাদা আমার, দিদি আমার, এই অক্ষমকে ভিক্ষা দাও। বাতের ব্যথায় পঙ্গু আমি। ওষুধ-পথ্য কেনার সামর্থ্য নাই। কাজ-কাম করার সামর্থ্য নাই। তোমাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, এই অক্ষমকে কিছু সাহায্য দাও। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করবেন।

ভিক্ষুকের করুণ আবেদনে মানুষ সাড়া না দিয়ে পারে না। দু’টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা থালায় পড়তে থাকে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত যা পড়ে, কম কিছু নয়। চারশো,পাঁচশো টাকা, কোনদিন তারও বেশি হয়। সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই ভিক্ষুক চলে যায়। দিন তার ভালোভাবেই কাটতে থাকে।

কিছুদিন পর একদিন ওই স্থানে ক্রাচে ভর দিয়ে আর এক ভিক্ষুকের আগমন ঘটল। সেও যুবক বয়সি। খানিকটা তফাতে সামনে থালা পেতে সেও করুণ সুরে ভিক্ষা মাগে। ও দাদাভাই, ভাইজান, ও দিদিভাই, বহিনজি, মাসিমণি, মামনি, আম্মিজান, বাবামশাই, বাপজান, এই অধম বড়ো অসহায়। আমার দু’টো পা-ই অসাড়। বল-শক্তি নাই। কাজ-কাম করতে পারিনাকো। তোমরা আমাকে দয়া করো। আল্লা তোমাদের মেহেরবানি করবে।

ছদ্মবেশী ভিক্ষুক

এমন করুণ আবেদনে এই ভিক্ষুকের থালাতেও ভিক্ষা পড়তে থাকল। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল। আগে ভিক্ষা একটা থালায় পড়ছিল, এখন তা ভাগ হয়ে দু’টো থালাতে পড়তে লাগলো। কেউ দিচ্ছে এ থালায়, কেউ দিচ্ছে ও থালায়।

সমস্যা আরও ঘোরালো হয়ে উঠল বিকেলের পড়ন্ত বেলায়। এক বয়স্ক দম্পতি রোজ এই পথ ধরে হাঁটতে বেরোন। আর ভিক্ষুকের থালায় দশটি করে টাকা দিয়ে যান। কিন্তু আজ এসে দেখছেন দু’জন ভিক্ষুককে। অক্ষম, অপারগ মানুষকে বঞ্চিত করবেন না। এদেরকে দিলে ঈশ্বরের পরম কৃপা লাভ হবে, এই বাসনা নিয়েই আগের ভিক্ষুকের থালায় দশ টাকার একটা কয়েন দিয়ে বললেন, দু’জনে ভাগ করে নাও। আগের ভিক্ষুক মুখটা ভার করে দু’টাকার একটা কয়েন পরের ভিক্ষুকের থালায় ছুড়ে দিল।

পরের ভিক্ষুক তীক্ষ্ণ নজরে তা লক্ষ্য করছিল। রাগ সামলাতে না পেরে চিৎকার করে বলে উঠল, কী রে ফটকে, পাঁচ টাকার কয়েন না দিয়ে দু’টাকার কয়েন দিলি যে? শালো, তুই জোচ্চুরি করছিস? আগের ভিক্ষুক ভিক্ষে ভাগ হয়ে যাওয়ায় এমনিতেই মনে মনে ভীষণ চটেছিল। এবার তার ভেতরের আগুনে যেন ঘি পড়ল। ব্যস, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। লালা, তোর দাঁত ভেঙে দেবো। এই জায়গায় তুই বসলি কেনে? আমার হকের পাওনায় ভাগ বসাতে এসেছিস?

  • ফালতু কথা বুলবি না, ফটকে। এইটা তোর বাপের জায়গা লয়।
  • লালা, বাপ তুলবি না। খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।
  • এই, তুই কী করবি রে? মারবো শালোকে এক লাথ।
  • তবে রে, এই বলে লালা এক লাফে উঠে ফটকেকে জোরে লাথি মারলো। ফটকে উল্টে পড়ে গেল। এক লাফে ফটকেও উঠে এবার লালাকে এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর শুরু হল মল্লযুদ্ধ। একবার লালা ফটকেকে নিচে ফেলে কিল, চর, ঘুষি মারে। একবার ফটকে লালাকে নিচে ফেলে কিল, চর, ঘুষি মারে।

ছদ্মবেশী ভিক্ষুক

অদূরে চায়ের দোকানদার বসে বসে এই কীর্তি দেখছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি ছুটে এসে সে দু’জনকে ছাড়িয়ে দিলে দু’জন দু’জনের হাতে আপন আপন জিনিস তুলে নিয়ে দ্রুত চম্পট দিল। দোকানদার বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, বাপরে বাপ, কী সাংঘাতিক! এরা তো কেউ অক্ষম নয়। একেবারে তরতাজা যুবক। আবার একে-অপরের নাম জানে! নিশ্চয়ই চেনা-জানা। একই গ্রামে বা পাশাপাশি গ্রামে বাড়ি হবে। এমন ভিক্ষুক আমি বাপের জন্মে দেখিনি।

দম্পতি হতবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

……………………………………………………….

Leave a Comment