T M C  Polytricks

(রম্যরচনা – কল্পনাপ্রসূত)   
T M C  Polytricks  – হরবিলাস সরকার

 

বাবার সাথে মেয়ে ছেলে দেখতে এসেছে। ছেলে সামনে এসে বসলো। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, তুমি কীসের ব্যবসা কর? ছেলে উত্তরে বলল, T M C  Polytricks. রাজনীতি! তুমি যে বলেছিলে ব্যবসা কর? হ্যাঁ ব্যবসাই তো। তবে যে বললে ‘Politics’?  Politics নয়, Polytricks. এটা অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং লাভজনক ব্যবসা।

বাবা আশ্বস্ত হলেন। যাক্ বাবা, আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। তা তোমার ব্যবসাটা কী ধরনের, একটু বুঝিয়ে বলতো। শুনুন তাহলে। T M C  Polytricks অর্থাৎ Trading of Multiform corrupted Polytricks. মানে হল ‘বহুনৈপুণ্যের নীতিহীন নানারকমের ব্যবসা। কোনো পুঁজি লাগে না। Muscle power, ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং কৌশল এই ব্যবসার মূলধন।

কিন্তু বাবা, corrupted কথাটা ব্যবহার করছ কেন? ভালো প্রশ্ন করেছেন। আসলে কী জানেন, এ ব্যবসায় কোন নীতি থাকলে চলে না। ডাহা লোকসান ছাড়া আর কিছুই হয় না। তাই corrupted অর্থাৎ নীতিহীন কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে। এই কথাটাই এ ব্যবসার মূলমন্ত্র। সে যাইহোক, বিশাল লাভজনক ব্যবসা স্যার। এই রে,’স্যার’ বলে ফেললাম, মনে কিছু করবেন না। তবে আপনি তো শিক্ষক। অতএব, স্যার বলাই যায়, তাই না?

পাত্রী এবার নিজে জানতে চাইল, আচ্ছা সে তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু ব্যবসাটা কীসের, তা বুঝতে পারলাম না। যদি বুঝিয়ে বলেন।

নিশ্চয়।

এমনসময় টনি, পাশের বাড়ির বিচ্ছু ছেলে, ছুটে এসে খবর দিল, দাদা, থানার বড়বাবু আসছেন। ঠিক আছে, আসতে দে।

মেয়ের বাবা কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলেন, অতটুকু ছেলে তোমাকে দাদা বলে সম্বোধন করল? এখানে ছোট-বড় সবার কাছেই আমি দাদা। আপনিও ‘দাদা’ বলে ডাকতে পারেন। কী বললে? না, গণ্যমান্য সবাই বলে কিনা। এটা আসলে সম্পর্কের দাদা নয়,  লোকের দেওয়া উপাধি।

বড়বাবু দরজায় এসে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন, দাদা আসবো? হ্যাঁ, আসুন। নির্ভয়ে আসুন। এনারা আমার আপনজন। ঠিক আছে। ফোন করেছিলেন, তো বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি? শুনুন, আজ নীল রঙের টাটা সুমোতে কিছু মাল যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্ডারে পৌঁছে দিতে হবে। সব থানাগুলোকে অ্যালার্ট করে দেবেন। কী আছে? সোনার বিস্কুট। কোন্ মালিকের? সেটা আপনার না জানলেও চলবে। এটা রাখুন। Fifty thousand আছে। মাল জায়গামতো পৌঁছে গেলে আরও twenty five বকশিশ পাবেন।  O k, এই বলে বড়বাবু বিদায় নিলেন।

T-M-C-Polytrick
একজন বয়স্ক লোক এসে বলল, দাদা, রাস্তার ধারে নয়ানজুলির উপর একটা দোকানঘর করব। আপনি অনুমতি দিলেই কাজটা শুরু করতে পারি। আমার রেট জানো তো? হ্যাঁ দাদা, জানি। এই নিন, ষাট হাজার আছে। ঠিক আছে। কাজ শুরু করে দাও।

বয়স্ক লোকটি বেরিয়ে যেতেই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবতী অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে হাত-জোড় করে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলো, দাদা, আমি প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে এসেছি। আমার পরিবার অত্যন্ত গরিব। বি এ পাস করেও একটা চাকরি জুটাতে পারিনি। আমার একটা চাকরি ভীষণ দরকার। শুনেছি,   আপনিই পারেন আমার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে অন্য রাজ্যে বা অন্য দেশে হলে আপত্তি নেই তো? মাইনে কেমন পাবো? যদি বিদেশে যাও প্রতি মাসে ভারতীয় টাকায় পঞ্চাশ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখও পেতে পারো। আমি রাজি। তাহলে তোমার দু’কপি ফটোসহ বাইয়-ডেট্যা দিয়ে যাও। যেদিন ফোন পাবে, সেদিনই চলে আসবে। যুবতী  নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল।

পাত্রীকে এবার পাত্র বলল, ওর যা চেহারা আছে, ঠিক জায়গামতো পৌঁছে দিতে পারলে, পাঁচ লাখ টাকা আমার একাউন্টে ঢুকে যাবে। যাকগে, তাহলে বুঝতে পারলে তো, আমার Multiform এর ব্যবসাটা? তিনটে নমুনা তো হাতে-নাতে বুঝিয়ে দিলাম।

পাত্রী বেঁকে বসল। বাবার কানে কানে বলল, চলো বাবা, আমার ভয় করছে। বাবা মেয়ের অরাজি’র কথাটা পাত্রকে বলে চলে যেতে উদ্যত হল। আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। অতিথি নারায়ণ। কিছু না খেয়ে গেলে আমার পাপ হবে। দু’জন কাজের মেয়ে নানাবিধ মিষ্টি, ফল, ঠান্ডা পানীয় নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তিনটি প্লেইটে সেসব সাজিয়ে টেবিলের উপর রেখে চলে গেল।T-M-C-Polytrick
খেতে খেতে পাত্র পাত্রীকে বলল, তুমি রাজি হয়ে যাও। অট্টালিকায় থাকবে। আমার কম করেও একশো কোটি টাকা bank balance আছে। এই শহরে গোটা চারেক এরকম প্রাসাদসম বাড়ি আছে। গোটা পাঁচেক দামি গাড়ি আছে। একটা বাড়ি, একটা গাড়ি আর কয়েক কোটি টাকা তোমার নামে লিখে দেবো। বছরে দু’বার বিদেশে বেড়ানোর সুযোগ পাবে। আরও অনেক কিছু পাবে। পাত্রী নানারকম চিন্তাভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে। দ্রুত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়েও ওঠে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনকে বোঝায়, দারিদ্র আজ আর কাউকে মহান করে না, করে শুধুই নিঃস্ব। এরপর একগাল হেসে বলে দিল, আমি রাজি। বাবা মেয়েকে কানে কানে ধমকায়, কী করছিস্? সব জেনে-শুনে নিজের পায়ে কুড়াল মারছিস? একটা অমানুষের ঘরে গিয়ে তুই বাঁচতে পারবি?পারবিনা। টাকার পাহাড়ে শুয়ে মানুষ ভোগ-বিলাসের স্বপ্ন দেখে। সম্পর্কের বন্ধন ওদের কাছে তুচ্ছ। করালগ্রাসী নদীর মতো নিয়ত একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে। ভাঙনের তীরে ঘর বাঁধতে নেই,  মা। তার উপর ধরা পড়লে ওকে জেলের ঘানি টানতে হবে। মেয়ে চুপিচুপি বাবাকে বোঝালো, বাবা, জানি, ও ঘৃণারই যোগ্য, কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম, আজকের পৃথিবীতে টাকা যার, সুখ তার। চুরি-বাটপাড়ি-তোলাবাজি বড় ধর্ম, যদি না পড়ে ধরা। আর আমি নিশ্চিত,ও ধরা পড়বে না। ছেলেটাকে দেখছো না, ওর muscle power, money power দুটোই আছে।

ঠিক এসময় একজন প্রভাবশালী নেতা ‘ফণী ভিতরে আছো?’ বলে সদলবলে ঢুকে পড়ল। ওঃ আত্মীয়-স্বজন বুঝি? হ্যাঁ ব্রজভূষণ দা। আপনাকে ব্যস্ত মনে হচ্ছে, প্রচারে বেরিয়েছেন বুঝি? তো বলুন, কী সমাচার নিয়ে এসেছেন।  মিউনিসিপ্যালিটির ভোটটা করিয়ে দাও। পঁয়ত্রিশে পঁয়ত্রিশটা সীটই চাই। চিন্তা করবেন না। ধরে নিন, জিতেই বসে আছেন। নেতা বহুগুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফণীর প্লেট থেকে দুটো মিষ্টি তুলে মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

ফণী এবার পাত্রীর বাবাকে বোঝাতে লাগল, দেখুন, আপনি সামান্য স্কুল-শিক্ষক। ঘরে আপনার একমাত্র ছেলে বেকার বসে আছে। শুনেছি, মাথার উপর বিরাট অঙ্কের লোনের খাঁড়া।  আর আমি এখন বৈভবের উপর দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু গরিবের মর্ম আমি বুঝি। একদিন আমি আধপেট খেয়ে দিন কাটিয়েছি। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছি। আর চড়াই-উতরাই পথে চলতে চলতে নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব হয়েছি। বিনা চিকিৎসায় মা-বাবা মারা গেছে। এক দোকানের কর্মচারী ছিলাম। কাজের একটু গাফিলতি হলেই মালিক অমানুষিক অত্যাচার করত। কাজ ছেড়ে দিলাম। তারপর দিন বদলাতে থাকল। অবশেষে এক ঝটকায় পথ-ঘাটের রঙ বদলে গেল। হঠাৎ একদিন আমার জীবনের রঙও বদলে গেল। নতুন পথের সন্ধান পেয়ে গেলাম। বুকে সাহসও পেলাম। শুরু করলাম টি এম সি পলিট্রিক্স। সমাজ আমাকে এই পথে টেনে এনেছে। এই আমার নতুন পৃথিবী। আজ আমার অফুরন্ত সুখ।  ইচ্ছে করলে অনেক বড় ঘরে সম্বন্ধ করতে পারি। কিন্তু আপনার  মেয়েকে আমার পছন্দ। অমত করবেন না।

বাবা ভাবতে লাগলেন, নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধের দিন পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। ছেলেটি বাধ্য হয়ে এই পথ অবলম্বন করেছে। আবার একথাও ঠিক, ওর সাথে উপমহলের নেতাদের বেশ খাতির আছে। আমার বেকার ছেলেটার একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারে। অন্ততঃ এই দুর্বলতার কারণে বিবেকের মৃত্যু ঘটে গেল। মনে মনে আরও ভাবল, ধরা ছেলেটা পড়বে না। পড়লেও  ওর শাস্তি হবে না। আর তখনই বাবার ম্লান মুখমন্ডল কোমল, হাস্যময় হয়ে উঠল। ‘আমার চন্দ্রিমার ভাগ্যের ফেরে যদি দিবাকরের ভাগ্য ফেরে, তবে মত আমি দিলাম’।

T-M-C-Polytrick

ফণী ওরফে ফণীভূষণ চন্দ্রিমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। করমর্দনে দু’টো হৃদয়ের কাছাকাছি আসার সংকল্প দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হল।

……………………………………………………… 

Leave a Comment