Boishamyer Beej – বৈষম্যের বীজ

(গল্প)

বৈষম্যের বীজ
হরবিলাস সরকার

“না, আমি অসাম্যের পূজারি নই, আবার সাম্যকেও অলীক বলে মনে হয়। কিন্তু অলীক হলেও হৃদয়জ। অসাম্য তো রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, ঘরে-বাইরে, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সভ্যতার একেবারে গোড়া থেকেই। তা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই বলে কি বাস্তবে সাম্যের রূপদান সম্ভব? আসল কথা হল, বৈষম্যের বীজ কীভাবে নির্মূল হবে?” প্রশ্নটা একজন স্কুল-শিক্ষকের, একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদকে।

“হরিচরণ, বৈষম্যের শিকড় আমাদের মনে, চিন্তা-চেতনায়। তুমি তো ছাত্রদের পড়াও। বিভিন্ন ঘর থেকে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রী আসে। শ্রেণিকক্ষে সবার জন্য একই পাঠদান কর। সেখানে কি বৈষম্য থাকে?”

“না, তা থাকে না। কিন্তু বৈষম্যের বীজগুলো যেন আপনা থেকেই বপন হয়ে যায়। দেবপ্রসাদবাবু, আপনি বড় মাপের একজন চিন্তানায়ক, একজন দার্শনিকও বটে। একটা গল্প বলতে ইচ্ছা করছে আপনাকে। বিষয়টা পরিষ্কার হবে। মাফ করবেন, আপনাকে বোঝানো আমার ধৃষ্টতাই বলতে পারেন। যদি অনুমতি দেন, বলতে পারি।”

দেবপ্রসাদবাবু হাসিমুখে বললেন, “এমন করে ব’লো না মাস্টার, তোমার চিন্তার ক্ষমতা আমি জানি। তুমি আদর্শ শিক্ষক। আমরা বিপরীত মেরুর মানুষ হলেও সত্যের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা আছে। তাই তো তোমার কাছে দৌড়ে আসি। তর্ক-বিতর্ক করি, কিছু নেবার থাকলে নিই। আলোচনা, যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়েই তো সত্য বেরিয়ে আসে। হ্যাঁ একথা ঠিক, বৈষম্য আমরাই তৈরি করি। আমরা লাভের অংক কষি, স্বার্থপর হয়ে উঠি। এসব কারণে কখনও যথার্থ ব্যক্তি বঞ্চিত হন এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। তোমার কথাই বলি, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওনি ঠিকই, কিন্তু আমার বিচারে তুমি যোগ্য। বঞ্চনার শিকার, তথাপি মনে তোমার দুঃখ নেই। তাইতো তুমি মহান। বেশ, বলো তোমার গল্প, শুনি।”

“শুনুন তাহলে। আজ থেকে বছর পনেরো আগে গ্রামের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন ছেলে আমাদের স্কুলে ভর্তি হতে এসেছিল। ওরা যে বেশ গরিব, তা ওদের পোশাক-আসকেই বোঝা গিয়েছিল। আদব-কায়দাও ছিল শহরের ছেলেদের থেকে আলাদা। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে ওরা মানিয়ে নিয়েছিল। এই রে, মাঝে কিছু কথা রয়ে গেছে, একটু বলে নিই।

ওরা ঐ যে ভর্তি হতে এসেছিল, তা ওদের একটু যাচাই করে নিতে হয়েছিল। ভার পড়েছিল আমার উপর। আমি তখন গণিতের সহকারী শিক্ষক। গণিতের উপরই তিন জনকে তিনটি করে প্রশ্নের সমাধান করতে দিয়েছিলাম। বড় ছেলেটি, ‘বাদল’, অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হবে। পেল দশে শূন্য। মেজটি, ‘সজল’, সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হবে। পেল এক। ছোটটি, ‘কাজল’, দশে দশই পেল। অত্যন্ত মেধাবী ছেলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির অনুমতি ওর ক্ষেত্রে নিশ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু একটা সমস্যাও দেখা দিল। দুই দাদাদের ছাড়া ও আসতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক দুই দাদাকেও ভর্তির অনুমতি দিলেন।

ওরা নিয়মিত স্কুলে আসতে লাগল। বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষায় কাজল প্রথম স্থান অধিকার করল। সজল অল্প নাম্বার পেয়ে পাস করল। বাদল বিবেচনায় উত্তীর্ণ হল। এরপর দু’বছর পরের কথা বলি। কাজলের কৃতিত্বের ধারা অব্যাহত রইল। সজল নিবন্ত বাতির মতো ক্ষীণ আলোয় জ্বলতে থাকলো। আর বাদল মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে পড়াশোনা ছেড়েই দিল।”

“কিন্তু হরিচরণ, এর মধ্যে তুমি বৈষম্য কোথায় পেলে? সকলের মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা সমান হয় না। সেকারণে মেধাও সমান হয় না। তাছাড়া পড়াশোনার প্রতি একাগ্রতা, অধ্যাবসায় সকলের একরকম থাকে না।”

হরিচরণ একথার উত্তর দিতে গিয়ে একটা প্রশ্ন করে বসল, “আপনি কি জন্মগত প্রতিভার কথা বলছেন? আপনার কথার উত্তরে এটাই আসে। যদিও আমি তা বিশ্বাস করি। আর বৈষম্যের শুরু এখান থেকেই।”

“না, ভুল ভেবেছ। প্রতিভাকে আমি জন্মগত বলছি না। প্রতিভা আসলে নিরন্তর সংগ্রামের ফল। জন্মগত হলে তো রবীন্দ্রনাথের ছেলে আরেকজন রবীন্দ্রনাথ হতেন। তা না হলেও অন্তত কাছাকাছি একজন হতেন। উল্টো দিক থেকে বলা যায়, মেঘনাদ সাহা নামমাত্র শিক্ষিত পিতার পুত্র হয়েও বিজ্ঞানীর আসনে বসেছিলেন। আবার তাঁর ছেলেমেয়েরা সেই প্রতিভা ধরে রাখতে পারল না। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় – এই তিন পুরুষ তাঁদের প্রতিভার ধারা অক্ষুন্ন রাখতে পারলেও পরবর্তী বংশধরগণ সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি। কেননা, যে সংগ্রাম প্রয়োজন ছিল, তা অবশ্যই তারা করতে পারেন নি।”

“হ্যাঁ, আপনার যুক্তিকে আমি সম্মানের খাতিরে মান্যতা দিচ্ছি। কিন্তু আমার মনে বিতর্কের ক্ষান্ত হলো না। ধরুন, একটি শিক্ষিত, অগ্রসর পরিবারে জন্মানো সন্তান এবং একটি নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া পরিবারে জন্মানো সন্তান উভয়ই নিজ নিজ পরিবেশে নিরন্তর সংগ্রাম পরিচালনা করলো। কে অধিক উচ্চতায় পৌঁছাবে? নিশ্চয়ই শিক্ষিত পরিবারের সন্তানটি? কেননা, বংশগত বৈশিষ্ট্যে উভয়ের মস্তিষ্কই জন্মলগ্ন থেকেই আলাদা। ফলে প্রকৃতির আলো বাতাসের মধ্যে থেকে জ্ঞানের বা শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা ওই অগ্রসর পরিবারের সন্তানটিরই বেশি থাকবে।”

“হরিচরণ, আপাত দৃষ্টিতে তোমার যুক্তি অকাট্য। তবে তা খণ্ডনযোগ্যও। আচ্ছা, ঐ দুই সন্তানকে জন্মাবার পর, চারপাশকে চেনা-বোঝার আগেই, যদি কোল পাল্টাপাল্টি করে দেওয়া হয় অর্থাৎ অগ্রসর পরিবারের সন্তানটিকে রাখা হবে অনগ্রসর পরিবারে এবং অনগ্রসর পরিবারের সন্তানটিকে রাখা হবে অগ্রসর পরিবারে। বলো দেখি এবার, তোমার ওই বংশগত প্রতিভা বা বংশগত বৈশিষ্ট্য কি ধোপে টিকবে?”

প্রতিপক্ষের নিরবতা দেখে দেবপ্রসাদবাবু মুচকি হাসলেন। পরক্ষণে হরিচরণও মুচকি হেসে একটা প্রশ্ন করল, “দেবপ্রসাদবাবু, অনুকূল পরিবেশ পেলে অনগ্রসর পরিবারের ছেলেটিও জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে, আপনি তো তাই বোঝাতে চাইলেন, নয় কি? তাহলেও বৈষম্যের সৃষ্টি যে শুরু থেকেই, এ যুক্তি থেকে সরার উপায় নেই।”

“বুঝেছি,তুমি কী বলতে চাইছো। দেখ হরিচরণ, ভৌগোলিক কারণে, জলবায়ুর কারণে, এক কথায় পরিবেশগত কারণে, এছাড়া খাদ্যাভ্যাস, হরমোনের আধিক্য বা ঘাটতি জনিত কারণে যে বৈষম্যের বাতাবরণ তৈরি হয়ে যায় আপনা থেকে, তার নিরসন মনুষ্য জাতির পক্ষে কোনদিন সম্ভব কিনা, আমি জানিনা। মানুষ ফর্সা-কালো, খাটো-লম্বা হয়ে জন্মায়, বুদ্ধি কম-বেশি নিয়ে জন্মায়, সেসবের নিরসন করা বোধ হয় ঈশ্বরেরও অসাধ্য।”

“আপনি প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ। শেষকালে আপনাকেও ঈশ্বরের আশ্রয় নিতে হল, আবার তাঁর অক্ষমতাও প্রকাশ করা হলো, এখানেই একটু অবাক হলাম। আপনি তো নাস্তিক। দোষ নেবেন না, আসলে এটা ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ, সত্যকে আড়াল করবার একরকম কৌশল। যাই হোক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল যে, রত্নগর্ভা বসুন্ধরা বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই দৃঢ় করতে হয় একতার বন্ধন। আবার সাম্যের প্রশ্নে বসুন্ধরার জঠরই হল সকল বৈষম্যের উৎস। দেবপ্রসাদবাবু, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললাম না তো?” “না হরিচরণ, তুমি তোমার যুক্তির যথার্থ প্রমাণ দিচ্ছো, তাই আমার ভালোই লাগছে। শুরু কর তোমার বাকি গল্প।”

 বৈষম্যের বীজ

“বেশ, শুনুন। ঠিক এক যুগ পরের কথা। ভাইয়েরা আলাদা হয়েছে। বাদল রাজমিস্ত্রির যোগানদারের কাজ করে অতি কষ্টে সংসার চালায়। সজল বেসরকারি কোন এক সংস্থায় দারোয়ানের কাজ করে। সংসার তারও কোন রকমে চলে। ছোট ভাই কাজল, ডব্লিউ.বি.সি.এস অফিসার হয়েছে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তার সুখের সংসার। তিন কাঠার পৈত্রিক বাড়িটা ভাগ না হলেও সংসার সবার আলাদা। একদিন কাজলের স্ত্রী ‘স্মৃতিলেখা’ কাজলকে পরামর্শ দিল, ‘ওগো, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চলো, আমরা শহরে চলে যাই।’ কাজল বলে, ‘বুঝেছি, তুমি ডব্লিউ.বি.সি.এস অফিসারের বউ। আমার দাদারা আমার তুলনায় কত নগণ্য কাজ করে। বৌদিরা বাসায় কাজ করে। বোধ হয়, সে কারণে তোমার আত্মসম্মানে ঘা লাগছে।’ ‘আচ্ছা, তুমিই বলো, তা কি লাগার কথা নয়? কোথায় তোমাদের পরিবার, আর আমাদের পরিবার! আমার বাবা শুধু তোমার চাকরিটা দেখেই বিয়ে দিয়েছে। বাবা প্রফেসর, মা হাই স্কুলের শিক্ষিকা। এ বাড়িতে লজ্জায় আসতে পারে না।’ কাজল প্রশ্ন করে, ‘কোন বড়লোকের কি গরিব আত্মীয় থাকতে পারেনা? কত আছে!’ ‘হ্যাঁ, আছে মানি। তাদের মধ্যে সম্পর্কও তেমন করেই আছে।’ ‘তুমিও তেমন করেই থাকো। তাছাড়া আমরা প্রত্যেকে আলাদাই তো থাকি।’ ‘তাহলেও আমি মানিয়ে নিতে পারছি না। চোখে চোখে দেখা হয়, ‘নে’ ‘দে’ করে কথা বলে। অসহ্য মনে হয়। সম্পর্কে বড় ঠিকই, কিন্তু ওদের শিক্ষার লেশমাত্রও নেই। একজন উচ্চ শিক্ষিতা মেয়ের তো খারাপ লাগবেই।’ ‘বৌদিরা ভোর হলেই, যে যার কাজে চলে যায়। কতক্ষণই বা বাড়িতে থাকে! একটু মানিয়ে নিলে ক্ষতি কী?’ ‘তিনটে বছর তো মানিয়ে নিলাম। বাড়িতে একজন কাজের মেয়ে রাখো নি। বলেছো – বৌদিরা লোকের বাসায় কাজ করে, আমি কাজের মেয়ে রাখলে কেমন দেখায়! তাও মেনে নিয়েছি। কিন্তু আর কত? তার উপর একটা ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’ কাজল আর একটা কথাও বলল না। স্মৃতিলেখা ভাবল, স্বামীর মনটা বুঝি পাওয়া গেছে।”

দেবপ্রসাদবাবু হাতের ঈশারায় হরিচরণকে থামতে বললেন। মনে মনে একটু যেন রেগে গেলেন। সে রাগ চেপে না রেখে প্রশ্ন করেই বসলেন, “হরিচরণ, এই স্মৃতিলেখার মনোভাবনাকে তুমি সমর্থন কর?”

“না, কখনোই না। কিন্তু সমাজের সংস্কার, শিক্ষা ঐ মহিলার মধ্যে যে মিথ্যা অহংকার, বৈষম্যের বীজ বপন করে দিয়েছে, তা অস্বীকার করি কী করে ?” “বেশ, বলতে থাকো।”

“শারদীয়া উৎসব এগিয়ে আসছে। কাজল এবছরও দাদাদের ছেলেমেয়ে আর নিজের একমাত্র ছেলে কাঞ্চনের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনে এনেছে। স্মৃতিলেখা এটাকে দয়া-দাক্ষিন্য মনে করে। বছর বছর এমন দয়া-দাক্ষিন্যে রুষ্ট হলেও মুখ ফুটে কিছু বলেনি, কিন্তু এবার তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সকালে আজ ঘর-বাড়ি ঝাঁট দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই বৌদির সাথে এক প্রস্ত করে কথা কাটাকাটি হয়েছে। স্মৃতিলেখা চেয়েছিল – ওরা যদি পালা করে তার ঘরটা একবেলা ঝাঁট দিয়ে দেয়, ভালো হয়। তাতে রাজি না হওয়ায় সারাদিন ভেতরটা জ্বলছিল। এখন স্বামীর এই দয়া-দাক্ষিণ্যে জ্বলনটা বহুগুণ বেড়ে গেছে। সেকারণে রাগের ঝাল মেটালো স্বামীর উপর, ‘এতকাল দিয়েছো, আর নয়। আমার সংসারে তারা কোন্ কাজে লাগছে?’ এরপর যা হল সে তো একেবারে লঙ্কাকাণ্ড। দাদাদের ছেলেমেয়েদের পোশাক আর তার আদরের কাঞ্চনের পোশাক বের করে দেখল – সেগুলো একই মানের। উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ‘ঝি-চাকর খাটে যারা, তাদের ছেলেমেয়েদের পোশাক আর ডব্লিউ.বি.সি. এস অফিসারের ছেলের পোশাক একই রকম?’ কাজল বোঝাতে লাগলো, ‘সবার জামাকাপড়ই ভালো, বেশ দামি। তুমি নাহয় ছেলেকে এর চেয়েও দামি আর একটা সেট এনে দিও।’ মাথায় রক্ত উঠলে কে শোনে কার কথা! আগুন ধরিয়ে ছেলের নতুন জামা-প্যান্ট পুড়িয়ে দিল। এ বেলা বাড়িতে আজ সবাই ছিল। বৌদিরা এসে দুজনেই তাদের ছেলেমেয়েদের হাত থেকে জামা কাপড় কেড়ে নিয়ে কাজলকে ফেরত দিয়ে দিল। বড় বৌদি দুঃখ করে বলল – ঠাকুরপো, তুমি বড় অফিসার। সম্মানীয় ব্যক্তি। তোমার অফিসে গেলে নাহয় তোমাকে ‘আপনি’ বলেই কথা বলতাম। কিন্তু বাড়িতে সম্পর্কে তুমি ছোট, তাই ‘তুমি’ বলেই বলছি। আমরা লেখাপড়া সামান্যই শিখেছি। তোমাদের পায়ের তলারও যোগ্য নই। তোমার দাদা রাজমিস্ত্রির যোগানদারের কাজ করে। কোনদিন খাই, কোনদিন না খেয়ে থাকি। ছেঁড়া, মোটা কাপড় পরি। তবু আমাদের দুঃখের অংশীদার হতে কাউকে বলি না। তোমাকেও বলি না। তুমি তোমার ইচ্ছা বা মন থেকেই কিছু দাও। কিন্তু তা দিলে যদি নিজেদের মধ্যে অশান্তি হয়, তবে না দেওয়াই ভালো। মেজ বৌদিও বলল, ‘ঠাকুরপো, তোমারই ভুল হয়েছে। তোমরা উঁচু দরের মানুষ। আমরা খুবই ছোট, নগণ্য। পেটে কালির আঁচড় নেই। আমাদের ছেলেমেয়েদের সাথে তোমার ছেলেকে এক আসনে বসানো উচিত হয়নি। তোমার উচিত ছিল, তোমার ছেলের জন্য আরও বেশি দামের জামা কাপড় কেনা। আর একটা কথা বলি – তুমি আর আমাদের উপর দয়া-দাক্ষিণ্য ক’রো না।’ এরপর দু’জনে চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেল।

আজকের ঘটনার পর কাজল অবশ্য মনে মনে ভাবল, ‘নাঃ, এ বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না। অফিসের কর্মী-বন্ধুরা যদি কোনদিন এ বাড়িতে আসে, বৌদিরা শহরে বাবুদের বাসায় কাজ করতে যায়, চিনে ফেলতে পারে, যদি দাদাদের চিনে ফেলে, কী হবে? সত্যিই আমার সম্মানহানি হবে।’

স্মৃতিলেখার মাথা ঠান্ডা হলে কাজল চুপি চুপি কাছে এসে মিষ্টি হেসে বলল, ‘ভেবে দেখলাম – তুমিই ঠিক। এবার থেকে তোমার কথা মতোই সব হবে। শহরে একটা ভালো দেখে ফ্ল্যাটবাড়ি কিনব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাব।’

তারপর রাতের হালকা হিমেল হাওয়ায় জানালা দিয়ে শিউলির সুবাস ভেসে এলো যখন, আপন মনে গুনগুন করে গান ধরল স্মৃতিলেখা। সময় তখন ন’টার কাছাকাছি। কাজল ড্রাইভারকে ফোন করল, অফিসের গাড়িটা নিয়ে আসতে। স্মৃতিলেখার গোলাপি ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে এসে বলল, ‘ছেলেকে সাজিয়ে নাও। গাড়ি আসছে। আমিও তৈরি। আজ তিনজনে একসাথে বেরোবো।’ স্মৃতিলেখার সমস্ত রাগ নিমেষে জল হয়ে গেল। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,’কোথায়?’ ‘না, এখন ব’লবো না। আগে তৈরি হয়ে নাও, তারপর ব’লবো।’

স্বামীর সোহাগে মন ভরে উঠেছে। তাই বুঝি স্মৃতিলেখার তৈরি হতে দেরি হলো না। খানিক পরে গাড়ি এল। কাজলের মুখপানে তাকিয়ে আছে স্মৃতিলেখা। দেখল, একজোড়া চোখে আর মুখে প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়ির মতো হাসি। হাসিভরা মুখে, মিষ্টি-মধুর সুরে বলে উঠল, ‘চলো, শপিংমলে যাবে না? আজ আমরা আমাদের মনের মতো পুজোর বাজার করব।’ স্মৃতিলেখার আনন্দের সীমা রইল না।

ক’দিন পরেই আগমনির সুরে সুরভিত হল আকাশ-বাতাস। নবমীর সকালে মেজ বউয়ের মা এলো নারকেলের নাড়ু নিয়ে। তার নাতি-নাতনিরা খেল আনন্দ করে। বড় বউয়ের ছেলেমেয়েদেরকে গোটা ক’য়েক করে নাড়ু দিল হাতে হাতে। ছোট বউয়ের ছেলেটাইবা বাদ যাবে কেন? একরত্তিটা উঠোনে পূজোর দামী জামা-প্যান্ট পরে খেলা করছিল। হাত নেড়ে ঈশারায় ডাকলেন দিদিমা। কাছে এলো ছোট্ট কাঞ্চন। গোটা কয়েক নাড়ু হাতে দিয়ে কোলে তুলে নিল, আর বলল, ‘খাও দাদু।’

ব্যাপারটা নজরে পড়ে গেল স্মৃতিলেখার। দৌড়ে এসে ছেলেকে ছোঁ মেরে কোল থেকে কেড়ে নিল। হাতের নাড়ুগুলো এক ঝটকায় ফেলে দিল। এখানেই ক্ষান্ত হলো না। ভেতরের আগুনে-রাগ ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো সাময়িককাল চাপা থাকলেও আজ মুহূর্তে চণ্ডাল হয়ে উঠল। ছেলের গালে কষে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিল। ‘ছি! এমন জঘন্য খাবার তুই খাস্ কখনো! কুকুর-বিড়ালে যা খায়, তোকেও তাই খেতে হবে?’ মেজ বউ সামলাতে না পেরে একটু মেজাজে মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দিয়ে বসল, ‘এতই যদি মহান, তো এই কুকুর-বিড়ালের সাথে না থাকলেই হয়।’ কাঞ্চন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কাজল ছেলেকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। মেজ বৌদির কথা শুনে এবার সেও চটে উঠে উত্তর দিয়ে বসল, ‘বৌদি, তোমরা তাহলে এটাই চাও?’ বড় বৌদির এতক্ষণে সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে এসে ঠাকুরপোকে বলল, ‘তোমরা শিক্ষিত মানুষ, তোমাদের ভুল ধরার সাধ্য আমাদের নাই। তবে মনে কিছু ক’রো না ঠাকুরপো, এই চাওয়াটা তো তোমার বউই চেয়েছে। আর সত্যি করে বলতো, তুমিও কি তাই চাও না?’

কাজল নীরব থাকে। বড়দা এতদিন কিছু বলেনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আজ বলতে বাধ্য হল, ‘কাজল, ভাইরে, তুই যেখানে গিয়ে ভালো থাকবি, তোর মান-সম্মান নষ্ট হবে না, সেখানেই চলে যা। তোর অংশটুকু তুই কাউকে নাহয় বেচে দিয়েই চলে যা। খাই বা না খাই, আমরাও ভালো থাকবো। যদি মরি, শান্তিতে মরতে পারবো।’ কাজল মনে মনে ভাবল – যাক, এভাবে বড়দার অনুমতি যখন পাওয়া গেল, মনের দিক থেকে আর কোন বাধা রইল না। অতএব, চুপচাপ থাকি। কথা বাড়িয়ে, সহানুভূতির জালে জড়িয়ে, এই অনুমতিকে খারিজ হতে দেওয়া যাবে না।

দাদার কথাকে অস্ত্র করে এক মাসের মধ্যে কাজল বাড়ি ভাগ করে তার ভাগের অংশটুকু বেচে দিয়ে শহরে রাজকীয় এক ফ্ল্যাটবাড়ি কিনে চলে গেল।”

হরিচরণ এবার বলল, “দেবপ্রসাদবাবু, গল্পের একটা অধ্যায়ের শেষ হলো। আর আমার প্রশ্ন হল, ‘দাদাদের সাথে ছোট ভাইয়ের এই বিচ্ছেদের নেপথ্যে বৈষম্যই কারণ। তার জন্য দায়ী আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং অহংকারের শিক্ষা, নয় কি?”

দেবপ্রসাদবাবু তাঁর সুচিন্তিত মতামত রাখতে গিয়ে একটু ভেবে নিলেন। তারপর বললেন, “আমরা বিদ্যালয়ে পুঁথি পড়ে শিক্ষালাভ করি, শিক্ষালাভের পর একটা শংসাপত্র লাভ করি, যাকে ডিগ্রি বলা হয়। কিন্তু একজন কৃষক, একজন রাজমিস্ত্রি, তারাও শিক্ষা লাভ করে, মাথা খাটিয়ে শিক্ষা লাভ করে। তবে তাদের কোন ডিগ্রি থাকে না। অর্থাৎ কারোর ডিগ্রি আছে, কারও নেই। যার আছে, সে উৎকৃষ্ট। যার নেই, সে নিকৃষ্ট। অনন্তকাল ধরে এই ভাবনা তৈরি হয়েছে সমাজ-মননে। কর্মের মধ্যে উঁচু-নিচু তৈরি হয়ে যায়। সব কর্মই সমান – শুধুই কথার কথা। এর ফলে অফিসের বাবু আর দিনমজুরের মধ্যে তৈরি হয় বৈষম্য। কারও বেতন মাসে পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার, এক লক্ষ, দু’লক্ষ, পাঁচ লক্ষ টাকা। আর যে লোক দিন আনে দিন খায়, একদিন কাজ না হলে তাকে উপোস দিতে হয়, অথচ পেট তো সবারই সমান। সবারই একটু ভালো-মন্দ খেতে ইচ্ছে হয়, ভালো পরতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সবাই পারে না, সবার সেই সুযোগ থাকে না। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় – সব কর্মই যদি সমান, তবে পারিশ্রমিকের বেলায় বৈষম্য কেন? আসলে এ বৈষম্য সভ্যতার গোড়া থেকেই আছে। আগামী পৃথিবীতে কোন উন্নত সমাজ না এলে এই বৈষম্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। আশা করি তুমি দ্বিমত করবে না। হরিচরণ, তুমি এখন তোমার গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করতে পারো।”

দ্বিতীয় অধ্যায় শুরুর আগে হরিচরণ দেবপ্রসাদবাবুকে আবারও প্রশ্ন করল, “এই যে আপনারা সাম্যের কথা বলেন, সাম্যবাদী সমাজের কথা বলেন, গীতায় শ্রীকৃষ্ণও সাম্যের কথা বলেছিলেন। বৈষম্য নিরসন নিয়ে এর পেছনে কী ভাবনা – আমার জানা নেই। যদি বৈষম্য মুছে ফেলা না যায়, তবে সাম্য কি আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে?”

দেবপ্রসাদবাবু চিন্তামগ্ন হলেন। অতঃপর বললেন, “দেখ, সাম্য হল সাম্যবস্থা। যেমন, বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য বজায় থাকলে জীবের অস্তিত্ব বজায় থাকে। তেমনি সমাজে থাকবে সমবন্টন ব্যবস্থা। সেখানে ধনী-গরিব, মালিক-মজুর, এই শ্রেণিবিভাজনের নিরসন ঘটবে। মস্তিষ্কে জ্ঞানের ভাণ্ডার কম-বেশি থাকলেও, কর্ম আলাদা হলেও, সেখানে সকলেই হবে শ্রমিক। কেউ কর্মহীন থাকবে না, অভুক্ত থাকবে না। এভাবেই সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকবে। বিজ্ঞানের নিয়মে সমাজ একদিন সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবেই।”

“আপনার কথার প্রেক্ষিতে আরও অনেক প্রশ্ন দানা বাঁধছে মনে। যেমন, আজ যে মালিক, কাল সে কীভাবে শ্রমিক হবে? তার মালিকানা কি কেড়ে নেওয়া হবে না সে স্বেচ্ছায় মালিকানা ছেড়ে দেবে? আপনারা তো বলেন – অধিকার কেড়ে নিতে হয়। তবে নিশ্চিত – ‘দুনিয়া কেঁপে উঠবে, রক্তপাত ঘটবে, মৃত্যু ঘটবে। আঘাতে প্রত্যাঘাত আসবে। কোন শক্তির উত্থান ঘটবে, কোন শক্তি নিস্তেজ হবে। কিন্তু নিস্তেজ শক্তি তো সবল হয়ে পুনরায় ফিরে আসতে পারে। কেননা, বিজ্ঞানের নিয়মে কোন শক্তিকে ধ্বংস করা যায় না। কেবল তার রূপান্তর সম্ভব। তাহলে প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল দুই শক্তিই যে রূপেই হোক, চিরকাল অবস্থান করবে। এক্ষেত্রে ‘সাম্য প্রতিষ্ঠা’ কথাটা অলীক কল্পনায় পর্যবসিত হয়। আবার সাম্য না এলে পৃথিবীর মাটি থেকে ‘বৈষম্য নিরসন’ অসম্ভব। কিছু বৈষম্যের কথা আপনিও স্বীকার করেছেন, যা কখনোই নিরসন সম্ভব নয়। তাহলে বৈষম্যের বীজ যদি থেকেই যায়, তার থেকে অঙ্কুর বের হয়ে বৃক্ষে পরিণত হবে। সাম্যের পৃথিবীতে আমরা কখনো পৌঁছাতে পারবো কি? অলীক কল্পনা কখনো বাস্তব রূপ পাবে কি? যদি কখনও বাস্তব রূপ পায়ও, টিকবে কি? সোভিয়েতের সমাজতন্ত্রের মতো ভেঙে পড়বে না তো? যাই হোক, শুনুন গল্পের পরের অধ্যায়।”

“বছর দুয়েক ধরে কাজলের সঙ্গে বড়দা, মেজদার কোন যোগাযোগ নেই। ইতিমধ্যে রাজমিস্ত্রিদের সংগঠন গঠিত হয়েছে। সেই সূত্রে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে বাদল। মাঝেমধ্যে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয়, দলীয় অফিসে যায়। বাদল সেসব নিষ্ঠার সাথেই করে।

বৈষম্যের বীজ

প্রতিবছর ২৬ সেপ্টেম্বর, বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উদযাপন করে দল। সেই উপলক্ষে জেলার নেতা-নেত্রী, কর্মীরা শহরের এক ঐতিহ্যমণ্ডিত হলঘরে সন্ধ্যাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বাদল সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে ফেরার পথে সেখানে উপস্থিত হল। অনুষ্ঠান শুরু হবার মুহূর্তকাল আসন্ন। নেতা-নেত্রী, কর্মীরা, তাদের বাড়ির লোকজন এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা ভিড় জমিয়েছে। বাদলকে দেখে জেলা কমিটির একজন কমরেড সামনাসামনি মন্তব্য করে বসলো, ‘এই যে, গেঁয়ো-ভূত এসে গেছে। কথাটা বাদলের ভেতরে যেন ঘৃণার মহাশক্তিশেল হয়ে বিঁধল। তবুও যন্ত্রণা উপেক্ষা করে এক চিলতে হাসি তার মুখে ফুটে উঠল। পরক্ষণেই নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো – গরিব মানুষ, ময়লা-ছেঁড়া-ফাটা জামা কাপড় পরি, কিন্তু তাই বলে আমাকে গেঁয়ো-ভূত বলা হলো! এই পাথর-চাপা যন্ত্রনা বুকে নিয়েই একটা ফাঁকা চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল। একজন নেত্রী প্রায় ছুটে আসার মতো করে এসে বললেন, ‘বাদল, চেয়ারে নয়, তুমি নিচে বসো। দেখছো না, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসছেন। তাদের তো বসার জায়গা দিতে হবে। মাটিতে চট পাতা আছে, সেখানে বসেই বাদল গোটা অনুষ্ঠানটা দেখল। মাঝে এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট পেয়ে তৃপ্তি করে খেয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে দেখল, ‘নেতা-নেত্রী, অতিথিদের মিষ্টির প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে। ভাবল – একটু অপেক্ষা করি,সবাইকেই নিশ্চয়ই দেওয়া হবে।’ কিন্তু একজন নেতা এরূপ ভাবগতি দেখে এগিয়ে এসে বললেন, ‘বাদল তুমি চলে যাও। অনুষ্ঠান তো শেষ হয়ে গেছে। আর শোন, মনে কিছু ক’রো না, তোমাকে মিষ্টি দেওয়া হ’লোনা বলে। ওগুলো অতিথি, শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ আর যারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের জন্যই আনা হয়েছে।’

বাদলের মুখখানা অপমানে কালো হয়ে গেল, তবু সেই কালো ঢাকতেই মুখে তার একটু সরলতার হাসি ফুটে উঠল। ‘না কমরেড, এতে আবার মনে করবার কী আছে! চা বিস্কুট তো খেয়েছি। খিদে পেটে মিষ্টি কি আর ভালো লাগবে? বাড়ি গিয়ে দুটো ভাত খাবো।’ এই বলেই বেচারা বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল।

এরপর বেশ কিছুদিন দলের অফিসমুখী হয়নি বাদল। ইতিমধ্যে অতিবৃষ্টির ফলে জেলায় জেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চাষীদের ফসল ক্ষতির মুখে। জিনিসপত্রের দাম আকাশ-ছোঁয়া। দিনমজুরদের দৈনিক কাজও নেই। আবার মজুরির টাকায় সংসার চালানো দায়ভার। এহেন দূরাবস্থার মধ্যেই ক্ষমতাসীন দক্ষিনপন্থী শাসক আবার এক ঘোষণায় বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীদের মাসিক বেতন এক লাফে প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকা বাড়িয়ে দিলেন। এত বৈভব, ঐশ্বর্যের হাতছানি দলের কোনও বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী উপেক্ষা করতে পারল না।

রাজমিস্ত্রি সংগঠন ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সংগঠনের সভাপতি ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এ কেমন দেশ-সেবা? জনগণ মরে মরুক, ভাসে ভাসুক, আমি যেন থাকি অট্টালিকায়, মহাসুখে, দুধে ভাতে। এখন ভোট ফুরিয়ে গেছে, কুঁড়েঘরের দরজায় আর পা পড়বে না ওদের।’

ক্ষোভের এই আগুন লুফে নিল বিরোধী সাম্যবাদী দল। রাজধানীর রাজপথে আইন অমান্যের ডাক দেওয়া হলো। অনেক দাবির মধ্যে রাজমিস্ত্রিদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিটাও আছে। নেতা-কর্মীদের ঘন ঘন যাতায়াতে বাদল আবার অফিসমুখী হল। ২২ অক্টোবর, দুর্গাপুজার দু’দিন আগে আইন অমান্য। সব রাজমিস্ত্রি যখন যাবে, বাদলও যাবে। ক’দিন ধরে গায়ে হালকা জ্বর, তবুও কথা দিয়েছে, মানুষের ন্যায্য লড়াইয়ে সে সামিল হবে।

২১ অক্টোবর, রাতে ঝাণ্ডা হাতে ট্রেনে চাপলো বাদল। দিন-দুঃখী, প্রতিবাদী মানুষের ভিড়ে পা রাখার জায়গা নেই। ট্রেন চলতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে বাদলের জ্বর বাড়তে লাগল। তার সামনে সিটে বসে থাকা বছর পঞ্চাশের একজন যাত্রী, একটা পত্রিকা পড়ছিলেন, মিছিলের লোক নন, বাদলের অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদাভাই, আপনার কি শরীর খারাপ?’ বাদল কোন কথা বলল না। শুধু মানুষটার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল। লোকটি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আপনি অসুস্থ, বসুন।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল বাদল। কামরার ভেতরে, অদূরে কোন এক কমরেড গান ধরেছে, ‘নতুন সূর্য, আলো দাও, আলো দাও। …….।’ সেই সুর বেশ জোড়ালো হয়ে কানে আসছে। লোকটি এবার বলতে লাগলেন, ‘আপনাদের মনের জোর অনেক বেশি। দলকে আপনারা নিজেদের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসেন। আপনাদের আত্মত্যাগ, লড়াইয়ের মানসিকতা দেখলেই বোঝা যায় – কমিউনিস্টদের জীবন কী। সমাজকে বদলাতে আপনারাই পারবেন। বড় মন, বড় চরিত্র না হলে সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে কখনোই পৌঁছানো সম্ভব নয়।’ এরই মধ্যে একটা বড় স্টেশনে ট্রেনটা এসে থেমে গেল। এখানে মিনিট দশেক দাঁড়াবে। লোকটি নেমে গেলেন প্লাটফর্মে চা খেতে। এমন সময় কেউ একজন বড়সড় নেতা গোছের হবেন, উঠলেন ঐ কামরাতেই। সঙ্গে আরও দু’তিনজন কমরেড। বাদলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাদলের অতি পরিচিত, তার জেলার এক নেতা দূর থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। উষ্ণ সম্বোধন জানালেন, ‘লাল সেলাম, ভুবনদা। আপনার তো কলকাতায় থাকার কথা। এখানে?’ ‘ওঃ, নির্মল তুমি? কাটোয়ায় একটা কর্মসূচী ছিল। ওটা সেরেই যাচ্ছি। তা তোমাদের জেলার কত লোক যাচ্ছে? রাজমিস্ত্রিদের একটা ভালো সংখ্যা থাকছে তো?’ ‘হ্যাঁ, সংখ্যাটা খারাপ হবে না। এইতো আপনার সামনে বসে আছে, ও বাদল, রাজমিস্ত্রি। আর বাদল, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ইনি আমাদের রাজ্য কমিটির একজন নেতা।’ বাদল ‘লাল সেলাম’ বলে সম্বোধন জানালো। কিন্তু পরক্ষণেই ঘটল অন্য কিছু। কমরেড নির্মল হালকা মেজাজ নিয়ে বললেন, ‘আরে বাদল, তুমি বসে বসে লাল সেলাম জানাচ্ছো! ওঠো, ওনাকে বসতে দাও।’ এবার সুরে কিছুটা মিষ্টভাব এনে নেতার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ভুবনদা, রিজার্ভেশন করলেই তো পারতেন।’ ‘হ্যাঁ, ভালোই হতো। বুকিংটা আসলে আজকের ডেটে পাওয়া যায় নি।’

বাদল উঠে দাঁড়ালো। রাজ্য-নেতা বসলেন। বাদলের শরীরটা কাঁপতে লাগলো। এমন সময় এক চা বিক্রেতা জানালার কাছে এসে ‘চা, গরম চা’ বলে হাঁক দিতে লাগলো। কমরেড নির্মল হাত বাড়িয়ে চার কাপ চা নিলেন। রাজ্যনেতা সহ চার কমরেড যখন চায়ের চুমুক দেবেন, বাদল বলে উঠল, ‘নির্মলদা, বড্ড শীত শীত করছে। একটু গরম চা পেলে ভালো হতো।’ নির্মলদা এবার এক গাল হেসে বললেন, ‘শীত শীত করছে, তার মানে তো জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছো, বাদল। তোমার তো দরকার ক্যালপল। চা খাবে কেন? কিন্তু স্টেশনে ফেরিওয়ালারা কি ক্যালপল বিক্রি করে?’

যে লোকটি চা খেতে নেমে গেছিল, সে কিছুক্ষণ হল উঠে এসেছে। ক্যালপল কথাটা কানে যেতেই সে বলে উঠল, ‘দাঁড়ান, ক্যালপল আমার ব্যাগে আছে। আমি দিচ্ছি ওনাকে।’ তার আগে চা বিক্রেতার থেকে এক কাপ চা নিয়ে বাদলদার হাতে দিয়ে বললেন, ‘নিন, চুমুক দিন, ভালো লাগবে।’ এরপর ব্যাগ থেকে গোটা চারেক ক্যালপল ট্যাবলেট বের করে বাদলদার হাতে দিলেন। ট্রেন চলতে লাগল। লোকটি এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আপন মনে বললেন, ‘সম্মুখ সমরে লড়াইটা তো এই দুর্ভাগা মানুষগুলোই করেন। অথচ এরাই বেশি অনাদরে থাকেন।’

পরদিন বেলা ১টা। মিছিল এগিয়ে চলল দূর্বার গতিতে। সামনে পুলিশের প্রতিবন্ধক। লক্ষ দুর্ভাগা মানুষের তেজদীপ্ত কণ্ঠস্বর আকাশ,বাতাস অনুরণিত করে তুলল। প্রতিবন্ধক ছুঁয়ে ফেলতেই সামনের সারিতে থাকা নেতাদের গাড়িতে তুলে নেওয়া হল। তাদের পেছনে যারা রইলো, তাদের উপর চলল নির্মম পাশবিক অত্যাচার। ‘ক্ষুধার রাজ্যে ক্ষুধার কথা বলা বারণ। সে আইন ভাঙার সাধ্য কারও নেই,’ প্রভুভক্ত প্রহরীদের লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান, গুলি সেকথাই যেন বলে চলছিল বীর বিক্রমে।

এরপর নেতারা যখন জেলের ভেতরে আন্দোলনের সফলতা নিয়ে আলোচনায় মশগুল, বাদল তখন রাজপথে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। এরকম অগণিত বাদল, কারও পায়ের হাড় ভেঙেছে, কারও মাথা ফেটে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। বাদলের চেনা-পরিচিত সঙ্গী-সাথী যারা গেছিল, তাদেরও অবস্থা একই। জ্ঞান ফিরলো যখন, বাদল দেখল – সে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছে, হাতে-পায়ে, মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা।

দিন পনেরো পরে বাদলকে বাড়ি নিয়ে আসা হল। একটা পায়ে তার গুলি লেগেছিল, সেটাকে কেটে বাদ দিতে হয়েছে। আপাতত আরও একমাস তার বিশ্রাম।

এই এক মাসে নেতারা একবার দেখতে এসেছিলেন। একজোড়া ক্রাচ দিয়ে গেছেন। বাদল যতদিন বেঁচে থাকবে, ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটবে। স্বামীর এমন পরিণতি দেখে বড় বউ নীরব পাথর-প্রতিমায় পরিণত হয়েছে। ছেলেমেয়েরা মাকে সান্তনা দেয়, বাবাকে সাহস যোগায়।

জানা গেছে, দলের এক সর্বক্ষণের কর্মীর নিকট-আত্মীয়, সেও রাজমিস্ত্রি, সেদিন মিছিলে ছিল। গুলি লেগে তারও একটি পা বাদ গেছে। দলের পক্ষ থেকে চাঁদা তুলে তার জন্য কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এদিকে মরার উপর আবার খাঁড়ার ঘা এসে পড়ল। বাদল বকেয়া বিদ্যুতের বিল শোধ দিতে না পারায় অফিসের লোকেরা এসে তার লাইনটা কেটে দিয়ে চলে গেছে। তার পাশে কেউ এসে দাঁড়াল না। অথচ প্রতিবেশী রাজু পাণ্ডে, আটা কলের মালিক, তার বিরুদ্ধে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের অভিযোগ আছে। তার লাইনটা কাটবে কে? তার যে বড় হিতাকাঙ্খী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। শুনেছি, প্রতি মাসে বড় অংকের চাঁদা জমা পড়ে পার্টি-ফাণ্ডে।

বাদলের থাকার ঘরটাও ক্রমশঃ জীর্ণ-শীর্ণ হতে হতে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আবাস যোজনায় একটা ঘর চেয়েছিল। আশায় আশায় বুক বেঁধে আজও পায়নি।”

হরিচরণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “বাদলের ভবিষ্যৎ কী হবে, আমরা কেউই জানিনা। এখন আর একটা কথাই আমার বলার আছে। গল্পে যে সাম্যবাদী দলের কথা বলা হয়েছে, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, আপনি সেই দলেরই কেন্দ্রীয় কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কথাটা এই কারণেই বললাম যে, অসাম্যের সিন্ধুপাড়ে বৈষম্যই দুঃখের কারণ। মানুষ আপনাদের ভরসা করেছিল। মুক্তির পথ খুঁজেছিল। সে পথ মরীচিকা মনে হয়। অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকারে স্বপ্নগুলো অগোছালো হয়ে হারিয়ে যায়। অথৈ সাগরে নিঃস্ব, সম্বলহীনদের দুটো হাত আকুল হয়ে খড়-কুটো আঁকড়ে ধরে।”

দেবপ্রসাদবাবু গভীর ব্যথায় কাতর হলেন। ভাবতে লাগলেন নতুন করে, কত কিছু! তার ভাবনার শেষ নেই।

……………………………………………………