Ghor Kolir Samaj – ঘোর কলির সমাজ

(ছোটগল্প)
ঘোর কলির সমাজ – হরবিলাস সরকার

 

মাধবেন্দ্র চক্রবর্তী যজমানি করে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন রাত এগারোটা অতিক্রান্ত। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “রিজু, ব্রততী ফিরেছে? সুস্মিতা ক্রোধ মেশানো গলায় অদ্ভুত মুখভঙ্গিমায় উত্তর দিল, “ডিজের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো না? রিজু ক্লাবের সম্পাদক। সরস্বতী পুজোর রাত, দেরি হবে। ব্রততীর কলেজেও অনুষ্ঠান আছে। দু’জনেই সাবালক, এখনকার ছেলেমেয়ে। এই বয়সে একটু আনন্দ-ফুর্তি করছে। প্রতিবারই তো করে, ক্ষতি কী?”

মাধবেন্দ্র এবার কড়া মেজাজেই বললেন, “ক্ষতি হয়ে গেলে তার হিসেব কষতে পারবে? ছি! বলতে আমার লজ্জা করে। মা হয়ে এসবে মদত দিচ্ছ! সমাজে তোমার মতো মা আর কতজন আছে, জানি না। তবে একথা অবশ্যই বলতে পারি, সমাজটা গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আর তোমার অপশাসনে আমাদের ছেলেমেয়েদের পরিণতি যে ভয়ংকর হবে, তার ইঙ্গিতও আমি পাচ্ছি।” সুস্মিতা বিদ্রূপ হাসি হেসে উত্তর দিল, “তুমি তো দেখছি মানুষের ভবিষ্যৎও গণনা করতে পারো। তাহলে স্ত্রীর একটা উপদেশ অন্ততঃ নাও। ‘ওগো স্বামী, তুমি যজমানি ছেড়ে দিয়ে জ্যোতিষীগিরিই করো। ভালো হবে’।”

ঘোর কলির সমাজ

কিছুক্ষণ বাদেই প্রতিবেশী অমলবাবুর ছোট ভাই ‘সুজন’ এসে জোরে হাঁক দিল, “মাধবদা, বাড়ি ফিরেছেন নাকি?” “কেন গো, কিছু বলবে?” “জানেনই তো, বড়দা উচ্চ রক্তচাপের রোগী। আপনার ছেলেকে হাতজোড় করে বলেছি। শুনছে না। বিকেল থেকে শুরু হয়েছে। এখনও জোরে জোরে ডিজে বাজছে, মদ খেয়ে নাচানাচি চলছে। বড়দা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিছু একটা ঘটে গেলে কী হবে?” মাধবদা কিছু বলার আগেই সুস্মিতা বৌদি এগিয়ে এসে পরামর্শ দিল, “অবস্থা যখন এতটাই খারাপ, তবে হাসপাতালে নিয়ে যাও।” এরপর বোঝাতে লাগল, “সরকার উৎসবের জন্য ক্লাবগুলোকে টাকা দিয়েছে। ছেলেরা আনন্দ করবে না? তাছাড়া আমাদের মানা ওরা শুনবে কেন?” অমলবাবুর ভাই বাড়ি ফিরে গেল।

অভিযোগ পেয়ে রাত সাড়ে বারোটায় পুলিশ এসে সুজনকে ডেকে বলল, ছেলেরা থানার অনুমতি নিয়ে উৎসব করছে। আমরা নাচ-গান বন্ধ করতে পারি না। তবে বলেছি, আওয়াজটা একটু নিয়ন্ত্রণে রাখতে।”

পুলিশ চলে গেলে সুজনদের বাড়ি ভাঙচুর হল। তার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি হল। উল্টে রিজুই থানায় জরুরি ফোন করে অভিযোগ জানালো, “সুজন একটু আগে আমাদের বাড়ি ঢুকে আমার মায়ের শ্লীলতাহানি করেছে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে সুজনকে ধরে নিয়ে চলে গেল। অমলবাবু বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে বলতে লাগলো, “এ কোন্ সমাজ? কোথায় এসে আমরা পৌঁছেছি? …….?”

অরণ্যে রোদন। ভুক্তভোগী সবাই অথচ কেউ এগিয়ে এলো না অমলবাবুর দরজায়।

ঘোর কলির সমাজ

রাত সাড়ে চারটে। টলতে টলতে উসকো-খুসকো চুলে বাড়ি ফিরল ব্রততী। সোফায় বসে মোবাইলটা বের করে খুটখুট করতে লাগল। একটু বাদে মোবাইলে খুটখুট করতে করতে রিজুও ফিরল ক্লাব থেকে। দাদাকে দেখে আনন্দের ঝলক ফুটে উঠল বোনের মুখে। “আজ ভীষণ ফুর্তি করেছি রে দাদা। তোদের কেমন হলো?” “দারুণ। তবে মাঝে একটা উটকো ঝামেলা এসে জুটেছিল। আরে ঐ চৌধুরীদের ছোট ভাই, সুজন, ব্যাটাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি।” এমন সময় মা দু’কাপ গরম চা নিয়ে এসে বলল, “ছাড় ওসব। সারারাত ঘুমোসনি। এখন আবার মোবাইল নিয়ে বসলি কেন? গরম গরম চা খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে। ঠাণ্ডাও খুব পড়েছে।” “কী যে বলো না মা। আমার শরীরে এখন বেশ গরম ধরে আছে।” ব্রততী একটু রসিকতা করে দাদাকে বলল, “মা কী করে বুঝবে রে? বেচারা আজ খায়নি বোধ হয়। শুধু চা খেয়েছে।” মা বুঝল – ছেলেমেয়েদের মদের নেশা কাটেনি এখনও। মুচকি হেসে হালকা ধমক দিয়ে বলল, “আজ তোরা দাদা-বোনে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিস। মুখ থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে।” “কাল থেকে আরও দু’গ্লাস বেশি খাবো মা।” ব্রততী প্রশ্ন করে, “দাদা, একথা বললি কেন?” মা বলে,“কেন আবার, জানিস না ? কাল থেকে অনলাইনেও মদ পাওয়া যাবে। শুধু কি তাই? অলিতে-গলিতেও মদ পাওয়া যাবে। সরকার আরও লাইসেন্স দেবে।” রিজু এবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “এই দেখ্ রে বোন, একটা দারুণ খবর। বাংলা সিরিয়ালের সদ্য উঠে আসা এক নায়িকা ‘লিভ ইন টুগেদার’ করছে।” “এ আর নতুন খবর কী, দাদা! এরকম তো আজকাল কতই হচ্ছে। জীবনটা দু’দিনের। ভোগ করে যাওয়াটাই বেটার। কী বলো মা?” মা অন্তরে সম্মতি জানিয়ে তালে তাল দেয়, “ওরা নিয়মিত ওষুধ খায়। আর অসাবধানে বেবি চলে এলে তখন বিয়েটা করে নেয়। অবশ্য অসুবিধাও আছে। ছেলেরা অনেক সময় বেঁকে বসে।” রিজু প্রতিবাদ করে, “মা, তুমি পক্ষপাতিত্ব করছো। মেয়েরাও তো ছেলেদের ধোঁকা দেয়। কই, সেকথা তো বললে না।” মা ছেলেকে শান্ত করতে একটা নতুন খবর দেয়, “শোন্, আজ তোদের কলেজের হোস্টেলে এম. টেক, প্রথম বর্ষের এক ছাত্রকে দাদারা র‍্যাগিং করেছে।” মায়ের কথাকে কেড়ে নিয়ে ব্রততী বলে, “শুনেছি। ছেলেটাকে কী প্রশ্ন করেছে, জানিস্ দাদা?” “বল্, শুনছি।” ‘ফুলশয্যা রাতে তোমার প্রেমিকা-বউ লজ্জাবোধ করলে তুমি কী করবে?’ ছেলেটা উত্তর দিয়েছে, “আমি তো এখনও বিয়েই করিনি।” রিজু গোল গোল চোখ করে বলে উঠল, “বোকা ছেলে। আমি হলে উত্তর দিতাম, ‘হবু বউয়ের লজ্জা তো আমি আগেই ভেঙে দিয়েছি’।” “চমৎকার বলেছিস তো দাদা, বেশ স্মার্ট তুই।”

মাধবেন্দ্রর ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। উঠে এসে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বললেন, “সুস্মিতা, এ তুমি কী করলে? ছেলেমেয়েদের কোন্ পথে নিয়ে গেলে?” মাকে থামিয়ে ব্রততী উত্তরটা দেয়, “মা দোষের কী করলো, বাবা? ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুর মতো মেশে। ভালোই তো। এভাবেই এখন সমাজটা এগোচ্ছে। তুমি তো দেখছি ব্যাকডেটেড রয়েই গেলে। রাজনীতির নেতারা পর্যন্ত কেমন আধুনিক হয়ে গেছে। তুমি তো বলবে – ওদের মুখে অশ্লীল, বিশ্রী গালাগালি। আমি বলবো, ‘এভাবে ওরা টক-ঝাল-মিষ্টি দিয়ে বক্তৃতার ঝাঁঝ বাড়ায়’।” বাবা লজ্জায়, ঘৃণায় নিজের ঘরে চলে গেল।

ঘোর কলির সমাজ

কয়েক মাস পর মা টের পেল – ব্রততী অন্তঃসত্ত্বা। মেয়ের নতুন, পুরানো অনেক বন্ধু। কার দায়, সে নিজেও জানে না। এতদিনে মায়ের ঘুম ভাঙলো। পুরোহিত হিসেবে সমাজে মাধবেন্দ্রর একটা নাম-ডাক ছিল। মেয়ের কলঙ্কের কথা জানাজানি হতেই সব যেন ধুলোয় মিশে গেল।

কিছুদিনের মধ্যেই রিজুর জীবনেও নেমে এলো ঘোর অমানিশা। সহপাঠী বান্ধবীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়েছিল। তারপর দু’জনের মাঝে তৃতীয় কারও অনুপ্রবেশ ঘটে যায়। রিজুও আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। সম্প্রতি বান্ধবীকে বনভোজনে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন থেকেই নিখোঁজ ছিল মেয়েটি। পরে তার নিথর ক্ষতবিক্ষত দেহ মিলল নির্জন এক পোড়ো বাড়ির ভেতরে। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে – মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। বিচারে রিজু আর তার চার বন্ধুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে রিজুকে জেলখানায় নিয়ে গেল। মা আজ বুঝতে পারছে – বড় ভুল হয়ে গেছে। নিজেকে অপরাধী মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ব্যথায় কাতর হয়ে বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “সুস্মিতা, আমাদের ছেলেমেয়েরা সমাজের চলমান স্রোতের অনুকূলেই চলছিল। ভালো-মন্দ বিচার করেনি। তাতে তোমার ছিল নিরঙ্কুশ সমর্থন। তবে আজ কেন তুমি কাঁদছো?”

আজ আদালত চত্বরে বিশেষ কোন কাজে এসেছিলেন দেবী চৌধুরানী রোডের বাসিন্দা ‘পল্লবী মিশ্র’, প্রবীণা সমাজকর্মী। মাধবেন্দ্রর ছেলের পরিণতির কথা শুনতে পেয়েই এগিয়ে এলেন। দুর্ভাগ্য পিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “মাধবেন্দ্র, তুমি আমার প্রতিবেশী। তোমার ছেলে, মেয়ে দু’জনের কথাই শুনেছি। অত্যন্ত নিন্দনীয়। কিন্তু আমি বলব, এর পেছনে রয়েছে তোমার স্ত্রী ‘সুস্মিতা’র নির্লজ্জ প্রশ্রয়। আজ দিন এসেছে, তাই কিছু কথা আমাকে বলতেই হবে। দশ নাম্বার ওয়ার্ডে সুস্মিতার বাপের বাড়ি। ওখানকার এক প্রমোটার, বর্তমানে কাউন্সিলর, বছর চারেক আগে ঐ ব্যক্তি আর সুস্মিতার পরকীয়ার একটা খবর লোকাল পত্রিকায় বেরিয়েছিল। তুমি তা জানো। কিন্তু তুমি এটা জানো কি – ওদের সেই গোপন সম্পর্কটা এখনও টিকে আছে? চারপাশের গুঞ্জন আমার কানে আসে। এ আমরা কোন্ সমাজে এসে পৌঁছেছি মাধবেন্দ্র? সমাজ না ভাগাড়? দুর্গন্ধে টেকা বড় দায় হয়ে পড়েছে।” “দিদি, সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এতদিন শুধু পরগাছার মতো সংসার আঁকড়ে ধরেছিলাম।” “দেখ মাধবেন্দ্র, মানুষই সমাজ তৈরি করে। সমাজ একটা নিয়মে চালিত হয়। আমরা সেই নিয়মের অধীন হয়ে পড়ি। সেই নিয়ম যদি জীবনের পরিপন্থী হয়, তা ভাঙতে হয়, আমাদের সুন্দর সমাজ গড়তে হয়। তা না করে আমরা যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, অন্ধ স্নেহ-মায়ায় জড়িয়ে অথবা দুর্বলতাবশত, ভয়বশত প্রবহমান স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিই, তখন তো সমাজে দুর্বিসহ বিভীষিকা নেমে আসবেই, সমাজ দূষিত হয়ে পড়বেই,” এই বলে সমাজকর্মী চলে গেলেন। মাধবেন্দ্র কপালে হাত দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

দু’দিনের মাথায় মা, মেয়ে আত্মহত্যা করল। শোকে-দুঃখে কাতর মাধবেন্দ্র বড় একা হয়ে গেলেন। কাউকে লজ্জায় মুখ দেখাতেও পারছেন না। এ নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন। অদূরে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকে।

…………………………………………………….