Bibortan – বিবর্তন

(ছোটগল্প)
বিবর্তন   – হরবিলাস সরকার

আট ক্লাসের পড়া শেষ না করেই বিশু, রাজা স্কুল-ছুট হয়েছিল। কারণ ছিল দুটো। একঃ  আর্থিক অনটন। দুইঃ  পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া।

আলাদা গ্রামে বাড়ি হলেও স্কুল জীবনে দু’জনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। যত অপকর্মের শিরোমণিও ছিল দু’জন। চুরি, ছিনতাই, মারামারি, নারী ও নেশায় আসক্তি, কত কী! সেসব চলতেই ছিল।

bibortan

একুশ-বাইশ বছর বয়স, ইতিমধ্যে দু’জনে বার দশেক জেল খেটেছে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ত্রাসিত, ঠিক তখন ওরা নজরে পড়ল এক প্রভাবশালী নেতার। বললেন,  “দামাল ছেলে”। অপকর্মের লাগামহীন ছাড়পত্র। রাজা, বিশু ভাবে, ‘আপন কর্মগুণে এহেন স্বর্গরাজ্যে এসে পৌঁছালাম’। নেতা  ভাবলেন,  ‘রাজা, বিশু হাতে থাকলে সংগঠন শক্তিশালী হবে। ভোটে আমাদেরকে কে হারাবে?’

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা। অল্পদিনেই রাজা ব্লক সভাপতি, বিশু সহ-সভাপতির পদে নির্বাচিত হলো। জনপ্রিয় নেতার তকমাও পেয়ে গেল। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ওঁরা মিছিলের সামনের সারিতে হাঁটে।  পরদিন সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ওঁদের ছবি ছাপা হয়।

বিধানসভার ভোটে দলীয় প্রার্থীকে জেতানোর পর আবারও পদোন্নতি হল। রাজাসাহেব জেলা সভাপতি, বিশুসাহেব জেলা সহ-সভাপতি। পদপ্রাপ্তির পর আয়োজিত প্রথম জনসভায় অন্যতম বক্তা হিসেবে রাজাসাহেব বললেন, “বন্ধুগণ, দেশ আমাদের মা। সব্বাই আমরা দেশমাতার শ্রেষ্ঠো সন্তান। মা, মাটি, মানুষকে নিয়ে আমাদের কারবার। আপনাদের মোঙ্গোলের জন্য আমরা জান দিতে প্রস্তুত।……।” বিশুসাহেবও আবেগময় বক্তৃতা  করলেন, “মাই ডিয়ার ফেরেন্ডস্, উই হাব টু ইসটেরাগেল ফর এগজিসটানস্। আমাদের ইসটেরাগেল চলছে, চলবে। সকলের দুঃখ, যন্ত্রণা ঘোচাতে আমরা বদ্ধপরিকর।……”।

লক্ষ করতালিতে মুখরিত হ’লো আকাশ বাতাস। মুহুর্মুহু স্লোগান উঠল, “রাজাসাহেব, বিশুসাহেব জিন্দাবাদ। রাজা সাহেব, বিশু সাহেব যুগ যুগ জিও।” প্রশংসায় পঞ্চমুখ মুখ্যমন্ত্রীও। “ওদের মতো নেতা সমাজে বিরল। ওরা দলের সম্পদ।”

এরপর একদিন দলের জেলা কমিটির বিশেষ বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী পরামর্শ দিলেন, “রাজা, বিশু, যেন-তেন-প্রকারেন আমাদেরকে ক্ষমতা ধরে রাখতে হবে। ক্ষমতা থাকলে দল বাঁচবে, তোমরাও বাঁচবে। পুলিশ, আইন-আদালত হাতে থাকবে। আরেকটা কথা, চাই টাকা।  টাকায় দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা নিবারণ হয়। মানুষের দারিদ্র, যন্ত্রণা আছে। থাকাটা খারাপ নয়। মোক্ষম সময়ে কিছু আর্থিক সুবিধা দিলেই সব যন্ত্রণা ভুলে, মানুষ আমাদেরকেই ভোট দেবে।”

দু’বছর পর

………………….

এক গভীর রাতে বিশু টাকা-ভর্তি একটা সুটকেস নিয়ে এসে স্ত্রীকে বলল, “চমৎকার একটা বাড়ি বানাবো। নাম হবে ‘সুনন্দা শান্তি নীড়’।” সুনন্দা চমকে ওঠে। “এত টাকা! পেলে কোথায়? ডাকাতি!” “না গো, মানুষের নেতা হয়েছি, এখন ওসব করবো কেন? শুধু একটু গ্যাঁড়াকল করি, আর তা ‘মাথা’দের পরামর্শেই। কামানো টাকার বেশিটাই ওঁদেরকে দিতে হয়।” “না, এ অভিশাপের টাকা। ওগো, এ কাজ তুমি ক’রোনা। পাপের ভাগীদার আমরা কেউ হব না। কোলে একরত্তি ছেলে আমার ।  এই পাপ ওকেও ছাড়বে না। এমন রাজনীতি তুমি ক’রো না। গায়ে খেটে ডাল ভাত খাবো, তবু অট্টালিকার সুখ চাই না। ঠাকুর, ওকে সুমতি দাও। ……।”

রাত পোহাতেই বিশুর ছেলে জ্বরে পড়ল। ডাক্তার ডাকা হল। ওষুধ খেয়েও জ্বর কমলো না। বিশু ভয় পেয়ে গেল। পাপেরই সাজা, বুঝতে পেরে সোজা চলে গেল বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে। মন্দির প্রাঙ্গণে ধ্যানমগ্ন জটাধারী সন্ন্যাসীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বলে উঠলেন, “এসেছিস নরাধম? পাপ থেকে মুক্তির উপায় বড় কঠিন। তোকে পুনর্জন্ম লাভ করতে হবে।” “পুনর্জন্ম! মানে মৃত্যু?” “না রে, জীবিত থেকেও পুনর্জন্ম লাভ করা যায়।” “কীভাবে?” “মানুষের সেবাই যদি করবি, তোকে সৎসঙ্গে থেকে তা করতে হবে।” “কোথায় গেলে পাবো সেই সৎসঙ্গ?” “সে এক নতুন পৃথিবী। সেখানে ভোগ, বিলাসিতা নেই, শুধু আছে  ত্যাগের আদর্শ। দুঃখ থাকলেও, আছে অনন্ত শান্তি। দস্যু রত্নাকর পাপস্খলনের জন্য ‘রাম’ নাম জপতে শুরু করেছিল। ‘মরা’, ‘মরা’ বলতে বলতে একদিন  মুখে ‘রাম’ উচ্চারিত হয়েছিল। আর সেদিন থেকেই তার পুনর্জন্ম লাভ হয়েছিল। সে ছিল এক কঠোর সাধনা। তেমনি  কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তোকেও ভেতরের পশুত্বকে বিনাশ করতে হবে। দেখবি আপনা থেকেই দেবালয়ের দরজা উন্মুক্ত হবে।” “বাবাজি তাই হবে। কিন্তু আমার ছেলে, ওর কী হবে বাবাজি?” “জীবনে কত মানুষের অভিশাপ কুড়িয়েছিস! কত চোখের জল ঝরিয়েছিস! তাদের ব্যথা-বেদনা হৃদয়ের অন্তস্তলে একবার অনুভব কর্। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। তিনি চাইলে তোর ছেলে পুনর্জীবন ফিরে পাবে,” এই বলে সন্ন্যাসী পুনরায় ধ্যানস্থ হলেন। বিশু অশ্রুনয়নে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাঁর জয়গান করতে করতে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। এসে দেখলো – তার ছেলে সুস্থ হয়ে মায়ের সঙ্গে খেলা করছে।

bibortan

বিশু তৎক্ষণাৎ টাকার সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে পাপের সংশ্রব চিরতরে ত্যাগ করে চলে এল। তার ভেতরে সৎচিন্তা জাগরিত হয়ে উঠল। দুঃখকে বরণ করে নেবার অদম্য স্পৃহায় মন বড় উদাসী হয়ে উঠলো।

কিছুদিন বাদে একদিন সন্ধ্যায় রাজা তার বাগানবাড়িতে ডেকে পাঠালো বিশুকে। বিশু অনিচ্ছায় হলেও শেষবারের মতো গেল। রাজা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “একি রে! তোর এই ভিখারি-দশা হল কেমন করে? সাধু-সন্ন্যাসীর পাল্লায় পড়ে জীবনটা বরবাদ করবি নাকি?” বিশু ইশ্বরের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে বলে উঠলো, “তুমি আমাকে শক্তি দাও।” “ছাড়  ওসব ভণ্ডামি। আমার এই প্রাসাদ দেখে তোর হিংসা হয় না? চারখানা বানিয়েছি। সোনা-গয়নায় ভর্তি লকার।  পাঁচখানা বিদেশি গাড়ি, একশো বিঘার উপরে চাষের জমি, পঞ্চাশ বিঘার উপর মাছের ভেড়ি, বিদেশের ব্যাংকে চল্লিশ কোটি টাকা গচ্ছিত করেছি। সবচেয়ে বড়ো খবর, সামনের বিধানসভার ভোটে আমি প্রার্থী হচ্ছি, আমাদের রায়দিঘি কেন্দ্রে। মন্ত্রী হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। বড় সুযোগ তোরও আসবে, ভুলটা শুধরে নে।” মদের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “গলাটা একটু ভিজিয়ে নে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ্।” “না, পাপের পথ আমি ত্যাগ করেছি। ঈশ্বর আমাকে সুপথ দেখিয়েছেন,” এই বলে বিশু বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল।

এমন সময় বাইরে অপেক্ষারত এক মধ্যবয়সী গরিব চাষি আলতো করে দরজাটা ঠেলে দিয়ে অনুমতি চাইল, “রাজাসাহেব, ভেতরে আসবো?” “কেন রে?”  “জমির লিজের  বাকি টাকাটা দিয়ে দিন।  আজ আমি টাকা নিয়েই যাবো।” রাজাসাহেব  প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললেন, “তোর সাহস তো কম নয়। রাজার সামনে  কেউ এভাবে কথা বলে না। তোর জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। আর এক টাকাও পাবি না। যদি আর কোনোদিন টাকা চাইতে এসেছিস, তোর বউকে বিধবা করে দেবো।”

লোকটি কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। এবার ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক গৃহবধূ ভেতরে ঢুকল। রাজা সাদরে ডাকল, “এসো রানু, এসো।” মেয়েটি মনে করালো, “আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য দেবেন বলেছিলেন। আজ এসময় এখানে আসতে বলেছিলেন। ” “মনে আছে। আমি হাজার পাঁচেক টাকা দিচ্ছি।” ওদিকে বিশুর কী মনে হল,  কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এসে, জবা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলো। এদিকে ভেতরে মেয়েটি খুশি হয়ে আনত মস্তকে মনে মনে বলতে লাগলো, “আপনি মানুষ নন, গরিবের ভগবান।”

রাজা এই অবসরে দরজার ছিটকানিটা লাগিয়ে দিয়ে এল। তারপর মেয়েটির হাত ধরে টেনে নিয়ে খাটের উপর বসালো। “একটু বসো, দিচ্ছি,”এই বলে হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল। মেয়েটির মুখের হাসি নিমেষে মিলিয়ে গেল। ফাঁকা বাড়ি। একরাশ আতঙ্ক। “না রাজবাবু, টাকা আমার দরকার নেই,” এই বলে প্রাণপণে ঘর থেকে বেরোনোর চেষ্টা করতেই রাজা তাকে দু’হাতে জাপটে ধরল। “কিছু পেতে গেলে, কিছু দিতে হয়। গরিবের ঘরে সুন্দরী বউ।  স্বামী অসুস্থ। কী সুখ পাচ্ছো? সেই সুখ যদি আমি দিই, ক্ষতি কী?” দানবের শক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে মেয়েটি চিৎকার করে উঠলো।

বিশু দৌড়ে এসে প্রবল শক্তিতে দরজায় লাথি মারলে ছিটকানিটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে সিংহের মতো গর্জে উঠল, “রাজা, এই তোর সমাজসেবা?” মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গেল। রাজা আলোটা জ্বালিয়ে এবার বিশুর মুখোমুখি হয়ে বাঘের মতো হুংকার দিল, “আমি রায়দিঘির ‘বেতাজ বাদশা’ রাজা সেখ। এভাবে ক’টা শিকার আটকাবি?”  বিশুর মেজাজটা ভীষণ চড়ায় উঠল। “তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, স্কুলে আমরা পাঞ্জা লড়তাম। তুই কখনোই আমাকে হারাতে পারতি না। আজও এই কব্জিটা ইস্পাতের মতই শক্ত আছে। মেয়েরা আমার কাছে দেবী। যে হাতে দেবীর চরণে ফুল দিই, সেই হাতে প্রয়োজনে অসুরও নিধন করতে পারি।” বজ্রমুষ্টি হাত উপরে তুলেও নামিয়ে নিলো। “ছি! ঘেন্না হয়। তোর বিচার রায়দিঘির দেবীরাই করবে,” এই বলে বিদায় নিল।

বছর তিনেক পর

……………………

bibortan

রাজা নারী নির্যাতনের অপরাধে জেল খাটার পর বিধানসভার ভোটে প্রার্থী হয়েছে।   আর বিশু, সে যে বিশ্বনাথ, সবার প্রিয়, শ্রীরামচন্দ্রের একনিষ্ঠ উপাসক। নিচেরতলার অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িতের সুখ-দুঃখের সাথী। তাঁর উদাত্ত আহ্বান, “হে আমার সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষী, পিতা, মাতা,বোনেরা, জেগে ওঠো, এসো আমরা ‘সিন্ধুর তীরে’ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করি।”

…………………………………………………….