Pulisher Bandhutba – পুলিশের বন্ধুত্ব






অণুগল্প 

(রম্যরচনা )

থানার বড় অফিসার ‘ভীমসেন’ কনস্টেবল ‘ফটিক’কে নিয়ে ছুটলেন চোর ধরতে। চোর যে সে নয়, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যায় পারদর্শী এম.টেক পাস করা বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের তরতাজা যুবক ‘দেবেশ মিত্র’। চাকরি না পেয়ে সে এই কাজে হাত পাকিয়েছে । খবর আছে – সে আবারও এ. টি. এমের টাকা চুরি করে পালাচ্ছে বাইক হাকিয়ে। ভীম সেন গলা চড়ালেন, “ড্রাইভার, গাড়ি বের করো,কুইক,ভেরি কুইক।”

বাইক ছুটছে। পুলিশের গাড়িও পেছনে ধাওয়া করেছে। দেবেশ আয়নায় তা দেখতে পেল। ভাবল – অনেকটাই পেছনে আছে। কিন্তু পরমুহুর্তেই তার ভয় হতে লাগল – এখনও আরও পঞ্চাশ কিলোমিটার পেরোতে না পারলে মহাবিপদ। তাছাড়া এই থানার সঙ্গে রফাও হয়নি। ধরা পড়লে নির্ঘাত জেল, যাবজ্জীবন পচে মরতে হবে। ফলে বাইকের গতি সে বাড়িয়ে দিল।

পুলিশের গাড়িও জোরে ছুটছে। ভেতর থেকে বজ্রকন্ঠের হুঙ্কার, “ দেবেশ, এবার তোর নিস্তার নেই, আমার নাম ভীম সেন, ধরা তোকে পড়তেই হবে।

ফটিক জিজ্ঞেস করল, “ স্যার, এই নিয়ে ব্যাটা ক’বার চুরি করেছে?” “ বহুবার। বারবারই হাতের নাগাল থেকে ফস্কে পালিয়ে গেছে।” “ তাহলে এবার তো ওকে ধরতেই হবে।” “ বেশ বুদ্ধিমান। ধরা মোটেই সহজ নয়। তবে এবার আর ফস্কাতে দেবো না।” “ কিন্তু স্যার, ও যদি বাইক ফেলে পালানোর চেষ্টা করে, আপনি কি এই হেলদি বডি নিয়ে দৌড়াতে পারবেন?” “ আমি না পারি, তুই আছিস কী করতে?” “ হ্যাঁ, আমি তো আছি। তবে এই ছিপছিপে শরীরে একটা ভারী রাইফেল নিয়ে দৌড়ে ধরা কি সহজ হবে স্যার?” “ দৌড়াতে পারবিনা তো এই আনফিট বডি নিয়ে পুলিশের চাকরি করতে এলি কেন? বল্, কী করে তুই চাকরি পেলি, ঘুষ দিয়ে?” “ হ্যাঁ স্যার, হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক কথা। আপনাকে ঘুষ না দিলে কি আপনার এই চাড়ির মতো ভুরি হতো?” “বাজে কথা বলবি না।” “বাজে-কথা নয় স্যার, পুলিশ ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেটটা তো আপনিই দিয়েছিলেন।” “আমি? ও হ্যাঁ, হ্যাঁ,মনে পড়ছে। না, সে তো তুই মিষ্টি খেতে দিয়েছিলি, তাই নিয়েছিলাম।” “ স্যার সবাই তো মিষ্টি খেতেই নেয়। কেউ কি আর মাছ, মাংস, দুধ, ঘি খাবে বলে নেয়? যাইহোক স্যার, এই ছেলেটির প্রতি আপনার এত কড়া মনোভাব কেন?” “ ও তুই বুঝবিনা, নতুন এসেছিস্ কিনা।” “ ঠিকই বলেছেন, তবে স্যার আমার বুঝতে বেশি সময় লাগবে না।” ফটিক সামনের দিকে এবার গভীর মনোযোগ দিল। “স্যার, স্যার, দেখুন, আর মাত্র দুশো মিটার।” ভীম সেন আবারও গলা চড়ালেন, “ ড্রাইভার, আরেকটু জোরে, ধরে ফেলেছি প্রায়।” কনস্টেবল এবার লক্ষ্য করলো – বাইকের গতি ক্রমশ: কমে যাচ্ছে। কমতে কমতে জিরো। “স্যার, ঐতো দেবেশ বাইক থামিয়ে নেমে পড়ছে। কিন্তু স্যার, ছুটে পালাবে না তো?” “আরে না না,সে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । সম্ভবত: ও ওর চিন্তাধারা বদল করেছে। জানতাম, ধরা ওকে দিতেই হবে।”

ফটিক মনে মনে ভাবে – জহুরি জহর চেনে। দেবেশও ভেবেছে – পালিয়ে নিস্তার নেই। এবার না হলেও একবার ধরা পড়তেই হবে। এসব ব্যবসা করতে হলে পুলিশের সাথে এক-আধটু ভাব রাখতেই হবে। পথটাও খোলসা হয়ে যাবে। সেই মতোই গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দেবেশ সটান পুলিশের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। পুলিশের গাড়িটাও পঞ্চাশ মিটার পেছনে থেমে গেল। অফিসার দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। ফটিক নামতে গেলে অফিসার বললেন, “আরে আরে ফটিক,অত ভারি রাইফেল নিয়ে তোর নামার দরকার নাই। ও যখন সারেন্ডার করেছে আমি একাই সামলে নিতে পারবো। আর লাল্টু, গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে তোরও নামার দরকার নাই।”

ভীম সেন এগিয়ে যেতেই দেবেশ হাতজোড় করে অভিবাদন জানাল। অফিসার মুচকি হাসলেন। তারপর মোচে পাক দিয়ে ,ভ্রু উঁচিয়ে,চোখ পাকিয়ে বললেন , “এত বড়ো কাজে হাত দিয়েছিস্, “ভেবেছিস্ -সব মালকড়ি একাই খাবি,তাই না ?” “না স্যার,তা কী করে সম্ভব,তাছাড়া সেই মনোবৃত্তি নিয়ে এ কাজ যে হয়ও না ,তা আমি ভালো করেই জানি।” দুজনের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকলো।

ফটিক আজ ভুল করে ছেলের খেলনা দূরবিনটা পকেটে পুরে নিয়ে এসেছিল। সেটি চোখে দিয়ে দেখল – দেবেশ হাসতে হাসতে পকেট থেকে বেশ কয়েকটি দু’হাজারের নোট বের করে অফিসারের হাতের মুঠোয় গুঁজে দিল। অফিসার তা পকেটে পুরে মিষ্টি হাসি হাসলেন। শেষে দেবেশের সাথে করমর্দন করে ফিরে এলেন।

ফটিক জিজ্ঞেস করল, “ স্যার,গেলেন তো আসামিকে ধরতে , কিন্তু হাত মিলিয়ে চলে এলেন। ধরলেন না?” “ ছেলেটি অত্যন্ত ব্রিলিয়্যান্ট, খুব ভালো। ক্ষমা চেয়ে নিল আমার কাছে। বলল – এসব বাজে কাজ আর করবে না। তাই ছেড়ে দিলাম। অবশ্য একটা মৌখিক কেস-ডায়েরি লিখে নিয়েছি। প্রতি মাসে থানায় এসে আমার সাথে দেখা করে যাবে।” “ মিটেইতো গেল, আবার প্রতি মাসে থানায় আসবে কেন?” “নিয়ম-কানুনের ব্যাপার, ও তুই বুঝবি না।” “না স্যার, যেটুকু বাকি ছিল, তাও আজ এখানে এসেই বুঝে ফেলেছি। পুলিশের কাজ , দেরি করে বুঝলে হবে?” অফিসার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন।

গাড়ি রওনা হল থানার উদ্দেশ্যে। ফটিক এবার বললো, “স্যার,আপনাদের কথাবার্তার মধ্যে দুজনেই দুজনের পকেটে হাসিমুখে একবার করে হাত ঢোকালেন,প্রথমে দেবেশ তারপর আপনি, এই কায়দাটা বেশ ভালো লাগলো। এটা বোধহয় আপনাদের দুজনের কাজের সাফল্যের একটা অভিব্যক্তি। তবে সাফল্যটা কি দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন?”

অফিসার চটজলদি কিছু ভেবে নিয়ে পকেট থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট বের করে একটা ফটিককে আর একটা হাত বাড়িয়ে লাল্টুকে দিয়ে বললেন, “ আমার তরফ থেকে আজকের কাজে সাফল্যের জন্য বকশিশ, মিষ্টি খেয়ে নিস্।” ফটিক একগাল হেসে বলল, “ স্যার, আপনার দয়ার শরীর। পাকা চোরকেও ক্ষমা করতে পারা আর তার সাথে বন্ধুত্ব করা – মোটেই সহজ কাজ নয়। ফলে আপনার সাফল্যটা একটু বেশি। আমরা চুনোপুটি মাত্র। আপনার সাথে কোনো তুলনাই হয় না। বেশি কিছু নয়,এমন এক-আধটু বকশিশ পেলেই চলে যাবে। তবে কিনা স্যার, আপনার সাথে লোকের এমন বন্ধুত্ব তো বারবারই হবে। আশীর্বাদ করুন , এই অধম ফটিকও যেন আপনার সাথে বন্ধু হয়ে থাকতে পারে ।

……………………………………………………….