Debotar Nalish – দেবতার নালিশ

 

দেবতার নালিশ
 নাটিকাদেবতার নালিশ  (রূপক ধর্মী)  

      – হরবিলাস সরকার

মর্ত্যে গণতন্ত্রের উৎসব চলছে। স্বর্গের উদ্যানে তখন দেবী কালী (কালিকা, চণ্ডিকা, শ্যামা, ভবতারিণী)চার রূপে বসে নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে ব্যস্ত।

কালিকাঃ ভবতারিণী, শুনলাম – মর্ত্যে এখন গণতন্ত্রের উৎসব চলছে।


ভবতারিণীঃ হ্যাঁ রে কালিকা, তুই ঠিকই বলেছিস।


চণ্ডিকাঃ গণতন্ত্রের উৎসব কেমন হচ্ছে, একবার নিজের চোখে দেখতে পারলে ভালো হতো।


শ্যামাঃ তা আর সম্ভব নয় চণ্ডিকা। ওখানে এখন বড্ড গরম।


কালিকাঃ গরম কেন হবে রে? এখন তো বর্ষাকাল।


ভবতারিণীঃ বৃষ্টি এবার তেমন হচ্ছে না। তাছাড়া পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।


চণ্ডিকাঃ তাহলে কীভাবে আমরা গণতন্ত্রের উৎসবের কথা জানতে পারবো?


শ্যামাঃ একটাই উপায় আছে। চিত্র সাংবাদিক দেবর্ষিকে আহ্বান জানানো হোক।


কালিকাঃ হ্যাঁ শ্যামা, এটা একেবারে যুক্তিসম্মত কথা। আয়, আর দেরি না করে আমরা সবাই দেবর্ষিকে আহ্বান জানাই।


(সকলে এক মনে, এক ধ্যানে দেবর্ষিকে  আহ্বান জানাতে থাকলো)


“হে দেবর্ষি, আপনাকে নমস্কার। আবির্ভূত হন স্বর্গের উদ্যানে।”


(সদা হাস্যময় দেবর্ষি আবির্ভূত হলেন নারায়ণের জয়গান করতে করতে)

“জয় জয় হে, জয় পুরুষ প্রধান ……।”


দেবর্ষিঃ (গান শেষে করজোড়ে) দেবী কালী, এই আনন্দভূমিতে চার রূপ ধারণ করে আমাকে আহ্বান জানানোর কারণ কী?


ভবতারিণীঃ দেবর্ষি, মর্ত্যভূমিতে এখন মনুষ্য জাতির গণতন্ত্রের উৎসব চলছে। সেই উৎসবের পূর্ণ বিবরণ জানতে এবং নয়ন ভরে দেখতে আমরা বড়ই উদগ্রীব।


দেবর্ষিঃ যথা আজ্ঞা দেবী ভবতারিণী, দেবী কালিকা, দেবী চণ্ডিকা, দেবী শ্যামা। আপনারা ধৈর্য সহকারে বসুন। আমি দেখছি –  ওখানে উৎসব কেমন চলছে।


(দেবর্ষি বিশেষ যন্ত্রে দৃষ্টি স্থাপন করলেন।

মানুষের উচ্চস্বরে কোলাহল, আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল। মূহুর্মূহু বিকট আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো।)


চণ্ডিকাঃ দেবর্ষি, উৎসবের মাঝে এসব কীসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি? ওখানে কি প্রকৃতির দুর্যোগ চলছে? ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত হচ্ছে?


দেবর্ষিঃ না দেবী। ওখানে যা চলছে – ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।


শ্যামাঃ পরিষ্কার করে বলুন, দেবর্ষি! আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।


দেবর্ষিঃ দেবী, প্রকৃতির দুর্যোগ নয়। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতও নয়। যা হচ্ছে, তা মনুষ্যজাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।


কালিকাঃ দেবর্ষি, যেখানে এত আনন্দ-উৎসব, সেখানে কী হচ্ছে, হেয়ালি না করে বলুন।


ভবতারিণীঃ হ্যাঁ দেবর্ষি, বলুন। আমরা বড়ই উৎকণ্ঠা বোধ করছি।


চণ্ডিকাঃ দেবর্ষি, গণতন্ত্রের উৎসব মনুষ্য জাতির পক্ষে মঙ্গলজনক নয় কেন?


দেবর্ষিঃ আপনারা শান্ত হোন, বলছি। হেয়ালি নয়, সত্যিকারেই বড় নির্মম ঘটনা।  গণতন্ত্রের উৎসবে চলছে মূহুর্মূহু গুলি আর বোমা বর্ষণ। ধারালো অস্ত্রে রক্তের স্রোত বইছে। নির্বিচারে চলছে নরবলি। একবার নিজেদের চোখেই দেখে নিন।


(দেবর্ষি তাঁর যন্ত্রের সাহায্যে ভয়াবহ ঘটমান দৃশ্য দেখালেন। দেবীগণ দেখে শিউরে উঠলেন।)


দেবীগণ একসঙ্গেঃ এ কী দেখালেন দেবর্ষি! নরবলি!


দেবর্ষিঃ হ্যাঁ দেবী, নরবলি। বড় ভয়ানক ঐ দৃশ্য।


(চার দেবী যন্ত্রণায় উন্মত্ত হয়ে উঠলেন।)


কালিকাঃ কোথায় বিষ্ণুদেব! আপনি আবির্ভূত হন।


ভবতারিণীঃ আপনি শীঘ্রই আবির্ভূত হন বিষ্ণুদেব! মর্ত্যভূমি হিংসার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে।


চণ্ডিকাঃ মর্ত্যের মাটি মনুষ্য-রক্তে লাল হয়ে উঠেছে, বিষ্ণুদেব! আপনিই পারেন বিহিত করতে।


শ্যামাঃ প্রভু, এই ধ্বংসলীলা আপনিই পারেন বন্ধ করতে।


           (বিষ্ণুদেব আবির্ভূত হলেন।)


বিষ্ণুদেবঃ দেবীগণ, কী হয়েছে?এমন কাতর    আহ্বান শুনে আমি যে বড় বিচলিত হয়ে পড়েছি।


দেবর্ষিঃ নারায়ণ, নারায়ণ। প্রভু, আপনি অন্তর্যামী, সবই জানেন।


বিষ্ণুদেবঃ দেবর্ষি, আমি বড়ই চিন্তিত। মর্ত্যের এই ধ্বংসলীলার পরিণাম অত্যন্ত অশুভ। আপনারা সকলে একটু ধৈর্য্য ধরুন, আমি আমার দিব্য চোখে আর একবার দেখে নিই – ওখানে কী ঘটে চলেছে।


(দিব্য চোখে বিষ্ণুদেব ঘটে চলা মর্মান্তিক দৃশ্য দেখলেন।)


দেবর্ষিঃ কী বুঝলেন প্রভু?


বিষ্ণুদেবঃ অশুভ শক্তির প্রবল দৌরাত্ম্য। বলির রক্তে ওরা ওদেরকে তৃপ্ত করতে চায়। গণতন্ত্র বিপন্ন।


কালিকাঃ বিষ্ণুদেব, আজ আমরা চার দেবী আপনার কাছে বিচারপ্রার্থী।


ভবতারিণীঃ হ্যাঁ বিষ্ণুদেব, আমাদের নালিশ – দেবতার উৎসবে একদিন মানুষ মানুষকে বলি দিত। বলির রক্তে সাজানো হতো পূজার অর্ঘ্য। সেই নিষ্ঠুর নরবলি-প্রথা চিরতরে বাতিল হয়েছে। কিন্তু মনুষ্যসমাজ তাদের গণতন্ত্রের উৎসবে আজও কেন মানুষকে বলি দিচ্ছে?


চণ্ডিকাঃ প্রভু, পুত্র তার পিতাকেও বলী দিচ্ছে। আপনি এই নরবলি-প্রথা বন্ধ করুন। নাহলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।


শ্যামাঃ প্রভু, আপনি নীরব থাকবেন না। আপনার ভেতরে যে অপরিমেয় শক্তি আছে, সেই শক্তিই পারে এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে।


বিষ্ণুদেবঃ দেবী, আপনাদের নালিশ এবং এই নরবলি-প্রথা বন্ধের আর্জি যথার্থই। কিন্তু বিহীতের উপায় বড়ই কঠিন। কেননা, গণতন্ত্রের উৎসবে রয়েছে ক্ষমতার লোভ আর অর্থের মোহ,যা মনুষ্যসমাজের শয়তানদের বড়ই ক্ষুধার্ত করে তুলেছে। ওরা পশুর চেয়েও হিংস্র হয়ে উঠেছে।


দেবর্ষিঃ নারায়ণ, নারায়ণ। প্রভু, তাহলে তো কঠিন এবং কঠোর সিদ্ধান্ত আপনাকে নিতেই হবে।


বিষ্ণুদেবঃ দেবর্ষি, মানব সমাজ এখন যুগের এক সন্ধিক্ষণে এসে উপনীত হয়েছে। পৃথিবীর আকাশ জুড়ে ঘোর অমানিশা। নতুন করে আবার এক ধর্মযুদ্ধ আসন্ন। 


দেবর্ষিঃ নারায়ণ, নারায়ণ। প্রভু, যুদ্ধ ! সে তো হিংসা, রক্তপাত। ত্যাগের আদর্শ, সুশিক্ষা আর ভালোবাসার বীজ বপনের

মধ্য দিয়ে কি অন্যায়কে দমন করা যায় না?


বিষ্ণুদেবঃ না দেবর্ষি, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করতেই হয়। শয়তান কখনও বাল্মিকী হয় না, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ হয় না। জমিতে সোনার ফসল ফলাতে হলে মাঝে মাঝে আগাছা নিড়িয়ে ফেলতে হয়। তেমনি পৃথিবীকে শান্তির রাজ্যে পরিনত করতে হলে শয়তান মুক্ত করতেই হবে। তাকে কখনোই হিংসা বলা  যায় না।


দেবর্ষিঃ প্রভু, দস্যু রত্নাকর বাল্মিকী হতে পারলে শয়তান মানুষ হবে না কেন?


বিষ্ণুদেবঃ দুর্ভাগা চুরি, ডাকাতি করে পেটের দায়ে। বোধের উদয় হলে সে একদিন মহান হতে পারে। কিন্তু শয়তানের লোভ, আকাঙ্ক্ষা পেটের দায়ে নয়। সে ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী, ভোগবিলাসী, আগ্রাসী, রক্তপিপাসু, অত্যন্ত নিষ্ঠুর। সে কখনও মানুষ হয় না।


দেবর্ষিঃ প্রভু, যথার্থই বলেছেন। কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ সেকারণেই অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।


দেবীগণ একসাথেঃ আপনাকে প্রণাম বিষ্ণুদেব। (দেবর্ষিও প্রণাম করবে)


বিষ্ণুদেবঃ দেবী, আপনাদের নালিশের মীমাংসা অবশ্যই হবে। শীঘ্রই মর্ত্যভূমির গভীর অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। আমি যে শুনতে পাচ্ছি – শ্যামল সুন্দর ভুবনে নতুন ঊষার আলোয় উজ্জীবিত, উচ্ছ্বসিত প্রাণের স্পন্দন।


নেপথ্যে সংগীতঃ এসো শ্যামল সুন্দর ……..।


             (দেবীগণের আনন্দে নৃত্য)


সমাপ্ত

……………………………………………………