Ei Amader Bangla – এই আমাদের বাংলা

ছোটগল্প
এই আমাদের বাংলা   – হরবিলাস সরকার

প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠল। খরা-বন্যার প্রকোপে পরপর কয়েক বছর ফসল ফলল না। দারিদ্র্য রুদ্র রূপে আবির্ভূত হল। পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া বিঘে ছয়েক জমি হারাতে হারাতে পতিরাম একদিন জমিহারা হয়ে গেল। রইল শুধু কাঠা তিনেকের ভিটেমাটি।

মুনিশ খেটে দিন আর চলছিল না। জিনিসপত্রের  দাম আকাশছোঁয়া। অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটতে লাগলো। গ্রামে কয়েক ঘর সংখ্যালঘুর একই অবস্থা। অপরদিকে ওসমান খান, আনোয়ার সেখ, দিলওয়ার হোসেনদের সম্পত্তি বাড়তে থাকল।

পতিরামের দুঃখের সংসারে চার সদস্য। তেরো বছরের মেয়ে ‘মিনতি’ স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। পুত্র দুখীরাম নিতান্তই বালক। যেদিন পতিরামের কাজ জোটেনা, মিনতিকে সাথে নিয়ে ওর মা গাঁয়ের বিত্তবান তথা অঞ্চলের চেয়ারম্যান ‘ওসমান খানে’র বাড়ি যায় ভাতের ফেন আনতে। বিবিজান অবশ্য ফেনটুকুই দেয় না, দুমুঠো ভাতও মিশিয়ে দেয়।

নিদারুণ করুন অবস্থা দেখে ওসমান একদিন পতিরামকে ডেকে বলল, মিনতিকে রোজই পাঠাইয়া দিও। বাড়ির কাজ-কাম করবে। খাবার, জামা-কাপড় পাইবে। কিছু মাইনেও পাইবে। পতিরাম রাজি হয়ে গেল।

বেশ কয়েক মাস পর, মেয়ের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে মা শিউরে ওঠে। জিজ্ঞেস করে, মিনুরে, কী হয়েছে তোর? সত্যি করে বল্, তোর এমন দশা কে করল? মিনতি কেঁদে ভাসাতে লাগল। মা, আমি আর ওসমান খানের বাড়ি যাব না। উনি আর ওনার বড় ছেলে ‘মইনুল’ ভীষণ খারাপ। ভয় দেখাতো। বলতো, কাউরে বলবি না। বইলা দিলে তোর বাবারে মাইরা ফেলব। অসহ্য বেদনায় গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে মা। হে ঈশ্বর, এ তুমি কোন্ অপরাধের শাস্তি দিলা আমারে?

পতিরাম মেয়ের অন্তঃসত্ত্বার খবরটা শুনে বড়ই বিচলিত হয়ে উঠল। অন্তরের তীব্র দহন-জ্বালায় মুহূর্তকালের জন্য হিংস্র হয়ে উঠলো। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও যে হাত দিয়ে মেয়েকে আদর করেছে, আজ সেই হাত দিয়ে মেয়ের গালে সপাসপ দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিল। পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ বসে গেল।

মারো বাবা, মাইরা ফেল। আমি আর বাঁচতে চাই না। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পতিরাম তার হাত আর উপরে তুলতে পারল না। রাত তখন এক প্রহর। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

পরদিন ভোরে উঠে দরজা খুলল পতিরাম। মনটা নিমেষে আরও খারাপ হয়ে গেল। মিনতি মা যে আমারও আগে উইঠা দরজা খোলে। বাপে ব্যথা দিয়াছে, তাই বুঝি আজ ওঠে নাই। ওর মাও রাইতে ঘুমায় নাই, এখন ঘুমাইতেছে। ভাবতে ভাবতে উঠানে দাঁড়িয়ে পূব দিকে চেয়ে দেখে – আম গাছের ডালে তার আদরের মেয়ে ঝুলছে। ছুটে গিয়ে দুটো পা বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে, মা রে, জীবনের সব যন্ত্রণা-জ্বালা জুড়াইয়া চইলা গেলি? ও মা, ……?

বাপের বুকফাটা কান্নার আওয়াজ শুনে মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে। ছোট্ট দুখীরামের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেও ছুটে আসে। ছুটে আসে প্রতিবেশীরা। দুঃখের খবর দ্রুত ছড়ায় চারপাশে। খবর যায় ওসমানের বাড়িতেও। গোপন কথাটা চাউর হয়ে যায়, আর সম্মানে ঘা লাগে – এই ভয়ে ওসমান লোক পাঠায় থানায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মৃতদেহের সৎকারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বিকেলের আগেই সৎকার হয়ে যায়। সন্ধ্যায় কিছু লোক এসে পতিরামের সুহৃদ সেজে তাকে ডেকে নিয়ে যায় ওসমানের বাড়িতে, এই বলে যে, ওসমান আর তার ছেলের বিচার হবে। দুঃসহ বেদনায় জলভরা চোখে মেঝের উপর বসে পড়ে পতিরাম। কিন্তু ওসমানই যে বিচারক। সে এক বান্ডিল টাকা পতিরামের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, আশাকরি এই টাকা তোমার মেয়ের শোক ভুলাইয়া দিবে। আর আজ রাইতের মধ্যে এই দেশ ছাইড়া তোমাদের চইলা যাইতে হইবে। এমনিতেই আমার কাছে তোমার যা ঋণ আছে, সুদে-আসলে এখন পাঁচ গুণ হইছে। ঋণের টাকা অনাদায়ে কাল সকালেই আমি তোমার বাড়ি দখল নিব।

ei amader bangla

“না সাহেব, পাপের টাকা আমি ছোঁবো না। দ্যাশ ছাইড়া চইলাই যাইব”, এই বলে পতিরাম চোখের জল মুছতে মুছতে চলে এলো। প্রাণের ভয়ে প্রিয়জনের মৃত্যুশোক হৃদয়ের অন্তস্তলে পাথর চাপা দিয়ে সে রাতেই ভিটেমাটিকে শেষ দেখা দেখে রওনা দিল ওপাড় বাংলা থেকে এপাড় বাংলার উদ্দেশ্যে। পরদিন এসে উঠল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সদর শহর সংলগ্ন এক গ্রামে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এক দশক আগে তারাও দেশান্তরী হয়ে এদেশে এসেছে। তবে বেশি দিন ঠাঁই হলো না এখানে। অনন্যোপায় হয়ে নয়ানজুলির ধারে জঙ্গল পরিষ্কার করে এক খণ্ড ত্রিপল টাঙিয়ে তার নিচে বসবাস শুরু করল পতিরাম। অচেনা জায়গায় প্রথমে ভিক্ষাবৃত্তি, তারপর সেই মুনিশ খাটা জীবন। ভোটের খাতায় নাম উঠল। মিছিলে হাঁটল। নেতাদের ফাইফরমাশ খাটল। ভোটও দিল। চেয়েছিল একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই। পেল শুধুই মিষ্টি-মুখের প্রতিশ্রুতি।

তারপর দুই দশক পেরিয়ে গেছে। জোটেনি এক টুকরো জমি, ঘর। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক পরিবর্তনও হয়েছে। দুখীরাম বিয়ে করেছে। দুটো ছেলেমেয়ে হয়েছে। বাবা-মা দুজনেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। সেই মুনিশ খাটা জীবনই দুখীরামের। বউও বসে থাকে না। দুধের ছেলেকে কোলে নিয়ে শহরে যায়। বাবুদের বাসায় কাজ করে। কত আশা! নিজেরা লেখাপড়া শিখতে পারেনি। ছেলেমেয়ে দু’টোকে মানুষ করবে।

দু’বছরে কিছু টাকা জমিয়ে, অর্ধেকটা ধারে এক কাঠা জমি কিনে বাঁশের খুঁটি, কঞ্চির বেড়া, টালির চালার একটা ছোট্ট ঘর বানিয়েছে। ধারের টাকা আস্তে আস্তে শোধ দেবে।

এ সময় রাজ্যে শাসকের পালাবদল ঘটল। লাল রং মুছে গিয়ে নীল-সাদা রঙে রঞ্জিত হল চারদিক। আপামর জনতার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। এবার স্বজন-পোষণ, দূর্নীতি, মা-বোনদের উপর অত্যাচার বন্ধ হবে। সত্যিকারের মানুষের রাজ কায়েম হবে। দুখীরাম সুদিনের স্বপ্নে বিভোর। পাঁচ বছরের মেয়েটাকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করেছে।

এরপর আশায় আশায় বারোটা বছর কেটে গেল। তবুও নিরন্তর পথ চেয়ে বসে থাকা। দিনের আলো নিভে গেছে ঘন কালো মেঘে। মুনিশের কাজ আর সেভাবে হয় না। দুখীরাম স্ত্রীর কাছে পরামর্শ নেয়, ওগো, শ্রমিকরা কাজের জন্য ভিন রাজ্যে চইলা যাইতেছে। আমি কী করবো, বুইঝা উঠতে পারতেছি না। স্ত্রী দুঃখ করে বলে, ওগো, আমি তোমাকে কী পরামর্শ দেবো! দুখীরাম বলে, শুইনাছি, দুঃখের পরে সুখ আসে। কিন্তু আমাগো দুঃখ বুঝি চিরকাল। অভাগা যেইদিকে চায়, সাগর শুকাইয়ে যায়। মনার বাপ, মন খারাপ ক’রো না। মেম্বারকে বলেছো ঘরের ব্যাপারে? বইলাছি। বলে, ঘর তুমি পাইবা। এবার না পাইলে সামনের বার পাইবা। ওরা কি সত্যিই আমাগো ঘর দিতে চায়? চায় না। খাতায় বারবার নাম ওঠে, বারবার কাইটা দেয়। একশো দিনের কাজের টাকার খবর কী? শুইনাছি, টাকা দেয়, আমার নামে, অথচ অন্য একাউন্টে ঢুইকা যায়। রেশনের চাল কয়টাই এখন বাঁইচা থাকার সম্বল। লজ্জা ঢাকবার একখণ্ড কাপড়ও কিনতে পারি না। এ তো গেল শরীরের লজ্জা। মনের লজ্জাই বা লুকাইবো কেমনে? পোলারে খাতা, কলম কিনে দিতে পারি না। স্কুলে যাওয়া বন্ধ কইরা দিয়াছে। বাজে সঙ্গদোষে স্বভাবটা নষ্ট হইয়া গেছে। বিড়ি ধরাইয়া টানে। চুরি করা ধরছে। নোংরা ভাষায় গালাগালি দেয়। কচুপাতা কাটতে কাটতেই একদিন ডাকাত হইবে। জন্তু-জানোয়ারের মতো দাপাইয়া বেড়াবে। আর মাইয়া, সেই বা কী করলো? হাতে কে একখানা মোবাইল ধরাইয়া দিল। কচিতেই পাইকা গেল। বড় হইয়া উঠতে না উঠতেই আমাগো মনে ব্যথা দিয়া পলাইয়া গেল। দুই মাস যাইতে না যাইতেই মুখে কলঙ্ক লেইপা ফিরাও আইলো। এখন তার গতি কী অইব? মনার বাপ, আমিও সেই চিন্তাই করি। কী দিন এল! ঘরে ঘরে এমন ঘটছে। মনার মা, ওপাড়ে সবল দুর্বলেরে নষ্ট করছে। এপাড়ে নিজেরাই নষ্ট হইতেছে। এর সাথে আবার প্যাটের চিন্তা। হ্যাঁ, গরিবের পেটের খিদা কে মেটাবে? চোখের সামনে দেখছি, বড়লোক আরও বড় হচ্ছে, নেতা-মন্ত্রীরা তিনতলা-চারতলা বাড়ি বানাচ্ছে, আর গরিবরা আরও নিচে ডুবে যাচ্ছে। বউয়ের দীর্ঘনিঃশ্বাসে দুখীরামের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। মনার মা, দুঃখের কথা বেশি বইলো না, তাতে দুঃখ আরও বাড়ে। মানুষেরা বলে, চোখে দেখিনি, এই বাংলা নাকি একদিন সোনার বাংলা ছিল। আসল কথা কী জানো – যেইদিন যায়, সেইদিনই ভালো যায়। যেইদিন আসে, সেইদিন আরও খারাপ হইয়াই আসে। কেন এমন ঘটে মনার মা, আর দ্যাশের গণ্যমান্য মানুষেরাই মিথ্যা বলে কেন যে, দ্যাশ আগাইয়া যাইতেছে, পৃথিবী আগাইয়া যাইতেছে? না গো, তেনারা ঠিকই বলেন। ছোট মাথায় আমরা কি তেনাগো কথার মানে বুঝতে পারি? লোকে বলে, ভাগ্যের খেলায় রাজা ফকির হয়, ফকির রাজা হয়। আসলে ভাগ্য বলে কিছু আছে কিনা, জানিনা। রাজা ফকির হয় কর্মদোষে, ফকির রাজা হয় ছলে-বলে। গণ্যমান্যদের কথার একখানা মানে আমি করতে পারি। দেশ বলো আর পৃথিবী বলো, তা তো দুই ভাগে বিভক্ত, ধনী আর গরিবে। ধনী আরও ধনী হয় মানুষেরে ঠকাইয়া। গরিব আরও গরিব হয় সর্বস্ব হারাইয়া। ঐ ধনীদের দিকে চেয়ে দেখ, সত্যিই কি মনে হবে না – দেশ, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে? জীবনের শত দুঃখ-কষ্টের চেয়েও আজ এই কথাগুলো দুখীরামকে আরও বেশি আঘাত দিতে লাগলো।

ক’দিন পরেই উৎসবের মেজাজে ফের ভোট এলো দেশে। সামনের সারিতে নেতৃবৃন্দ, আর পেছনে হাজার হাজার দীন-দুঃখীর উদ্দীপ্ত মিছিল। দুখীরামও দিনের পর দিন মিছিলে হাঁটে। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাটায়। ভালো-মন্দ সব কাজই বাধ্য হয়ে করে। মনে পড়ে বাবাকে। সেও যে এমন করেই উৎসবে সামিল হতো।

ei amader bangla

ভোটের দিন। অনেক আশা বুকে নিয়ে এক টুকরো মলিন পরনের একমাত্র আচ্ছাদন কোমরে জড়িয়ে প্রায় উলঙ্গ কঙ্কাল শরীরে ভোট দিতে যায় দুখীরাম।

……………………………………………………..

Leave a Comment