Karmasangsthan – কর্মসংস্থান

ছোটগল্প (কল্পনাপ্রসূত)

Karmasangsthanকর্মসংস্থান

চন্দ্রনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরিটা পায়নি। উপর মহলের দরজায় দরজায় ঘুরেও কোন কাজ হয়নি। তালিকায় প্রথম দিকে নাম থাকা সত্ত্বেও কীভাবে যে বাদ পড়ল, আর অনেকের শেষ দিকে নাম থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তারা নিয়োগপত্র পেয়ে গেল, তার সদুত্তর মেলেনি। নালিশ উঠেছে আদালতে। দরদি বিচারক ভরসা দিয়েছেন। সেই অবলম্বনটুকুই সম্বল করে পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রনা ভুলে,  নিরাশায় কেঁদেও আশায় বুক বেঁধে চন্দ্রনাথের রাজপথে হেঁটে চলার ক্ষান্ত নেই। শুধু একা সে নয়, অনেকেই তার পথের সঙ্গী।

ছোটবেলা থেকেই চন্দ্রনাথ মেধাবী ছিল। প্রাথমিক, উচ্চ বিদ্যালয়ে বরাবরই শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে।  কলেজে প্রথম বিভাগে পাস করেছে। স্বভাবেও সবার কাছে প্রিয়। বিনম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী।

বাবা এতদিন পরের জমিতে দিনমজুরি খেটেছে। এখন বাতের ব্যথায় পঙ্গু, বয়সও হয়েছে। মায়ের শরীরও ভালো যাচ্ছে না। বাড়ি-সংলগ্ন রাস্তার পাশে টালির ঘরে একটা ছোট্ট মুদির দোকান দিয়েছিল। মা-ই চালাতো। ভীষণ কষ্টের মধ্যেও ছেলেমেয়ের পড়াশোনা ছাড়ায়নি। কলেজ পাস করার পর ধার-দেনা করে ছেলেকে ডি.এল.এড পড়িয়েছে। মেয়ে ‘পারমিতা’ তিন বছরের ছোট, তাকেও বি.এ পাস করিয়েছে। এখন আর দৌড়-ঝাঁপ করতে পারে না মা। পারমিতা সাহায্য করে। সে আবার সকাল-বিকেল কিছু ছেলেমেয়েকে টিউশন পড়ায়। এতদিন চন্দ্রনাথও পড়িয়েছে। এখন প্রায়ই কোলকাতা-বাড়ি করতে করতে তার ছাত্ররা অন্যত্র চলে গেছে।

এই দৈন্যদশার মধ্যেও বাবা-মায়ের বুকে আশা যোগায় পারমিতা। প্রতিদিন পথচেয়ে বসে থাকে,কবে  দাদা বাড়ি ফিরে বলবে, “বোন, আমার চাকরিটা হয়েছে।” এমনিকরেই একটা একটা করে দিন ফুরায়। কিন্তু সুদিন আসে কই? আশার আলো ক্রমে নিভে যেতে থাকে। তবু সব দুঃখ-ব্যথা গোপন রাখে, নিভৃতে চোখের জল মোছে।

Karmasangsthan - কর্মসংস্থান

কিছুদিনের মধ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে উঠল। একদিন গভীর রাতে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা একজন ভদ্রলোক এলেন এ বাড়িতে, সঙ্গে আরও কয়েকজন। হঠাৎ ধূমকেতুর মতো এমন ব্যক্তির আবির্ভাবে বাড়ির সকলে হতচকিত হলেও ক্ষণিক পরেই ঘোর কেটে গেল, যখন ভদ্রলোক বললেন, “আমি পঞ্চানন মণ্ডল, জেলা সভাপতি, সামনের ভোটে এই স্বরূপপুর কেন্দ্রের শাসক দলের প্রার্থী”। তমসা দূর হয়ে পূবের আকাশে যেন অকালে সূর্যোদয়ের সূচনা হল। বাবাকে নেতা বললেন, “আপনাদের কথা অনেক শুনেছি। গরিবের ব্যথা আমরা বুঝি। খুব শীঘ্রই আপনাদের দুঃখ ঘুচে যাবে।” মাকে বললেন, “আপনার সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে। ওদের জীবনে নিশ্চয়ই সুদিন আসবে।” বাবা-মায়ের স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। তবুও চোখে জল আসে। দু’চোখ মুছতে মুছতে বাবা বললেন, “আমার ছেলেমেয়ে দুটোর কাজের ব্যবস্থা করে দিন না বাবাজি!” “হ্যাঁ, সেজন্যই তো আসা। আপনি আমার পিতৃতুল্য। চন্দ্রনাথ, পারমিতা আমার ছোট ভাই-বোনের মতো। বড় দাদা হয়ে ওদের জন্য এইটুকু তো করতেই পারি।  সরকার আমাদের,  দায়িত্বও আমাদের।”

পারমিতার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। “বসুন, একটু চা খান,” এই বলে সে রান্না ঘরে চলে গেল। চন্দ্রনাথ আপন মনে বলতে লাগলো, “দাদা, ভাগ্য আমার মন্দ। স্কুলে আমারই আজ ছাত্র পড়ানোর কথা। সেখানে অন্য একজন যোগ্যতার পরীক্ষায় আমার চেয়ে অনেক পিছিয়ে থেকেও ছাত্র পড়াচ্ছে। আমি বঞ্চিত। জানিনা, এই দুর্দিনের অবসান কবে হবে!” “দুশ্চিন্তা ক’রো না। স্কুলে তুমি অবশ্যই পড়াবে। তবে তিনটে মাস তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। সবুরে মেওয়া ফলে। এই তিনটে মাস আমরা তোমার একটু সহযোগিতা আশা করছি। নির্বাচন উপলক্ষ্যে কিছু কাজকর্ম করতে হবে। তার জন্য তোমাকে কিছু দেওয়া হবে।  এটাকে পারিশ্রমিক ব’লো না, সাম্মানিক বলতে পারো। তবে সেটাও কম কিছু নয়।  আমরা স্থির করেছি – ব্লক ভিত্তিক তোমার মতো একশো জন করে বেকার যুবককে এই কাজে অংশগ্রহণ করানো হবে। প্রত্যেককে প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া দু’বেলা টিফিন, দুপুরের খাবার পাবে। এবার তোমাকে বলি, রাজি হয়ে যাও। ভবিষ্যৎ ভালই হবে।”

নিরুপায় চন্দ্রনাথ অকুল-অথৈ সমুদ্রে খড়-কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল। বললো, “আমি রাজি।” এমন সময় চা নিয়ে এলো পারমিতা। সভাপতি মহাশয় চায়ের কাপ তুলে নিয়ে, পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে পারমিতাকে বললেন, “এতে যার নাম, ফোন নাম্বার আছে, সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জেলায়, জেলার বাইরে, ভিন রাজ্যে, এমনকি বিদেশেও ওর ব্যবসা আছে। ওর অফিসে তুমি চাইলে একটা কাজ পেতে পারো। এটা রাখো, যোগাযোগ করে নিও।” হাত বাড়িয়ে দেয় পারমিতা।

পরদিন থেকেই কাজে যোগ দিল চন্দ্রনাথ। কয়েক দিনের মধ্যে পারমিতাও কাজে যোগ দিল। পাঁচ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে সদর শহরে গিয়ে বেসরকারি অফিসে লেখালিখির কাজ। সকাল ন’টায় বেরিয়ে পড়ে, ফিরতে রাত হয়। মন্দের ভালো। মন্দার বাজারে এটুকুইবা কে করে দেয়? মনে মনে ধন্যবাদ জানায় সভাপতিকে।

এক মাস পূর্ণ হলে, মাইনে পেয়ে পারমিতা সবার জন্য নতুন জামা কাপড় কিনে আনলো। চন্দ্রনাথ পুরো টাকাটা মায়ের হাতে তুলে দিল। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। মৃদুমন্দ দখিনা বাতাস বইছে। বসন্তের কোকিল কুহু-রবে ডেকে উঠল। মা ভাবছে মেয়েকে এবার পাত্রস্থ করতে হবে। “ওরে পারু, মা আমার, তুই তো বেশ সংসারী হয়ে গেছিস্। এবার তোকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। বাঁধা দিতে পারবি না।” “মা,আগে দাদার বিয়ে দাও,তারপর আমার।” “ওরে, চন্দ্র ছেলে। তাছাড়া স্কুলের চাকরিটা না হওয়া পর্যন্ত ও রাজি হবে না।” “কিন্তু মা, তোমাদের এই অবস্থায় রেখে আমি যেতে পারব না।” “মা রে, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস্, যেতে তো হবেই। তোর সুখেই আমাদের সুখ।”

বাবার বাতের ব্যথাটা আজ একটু কম মনে হচ্ছে। তবু চন্দ্র বলল, “কাল তোমাকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো বাবা। তোমার অসুখ সেরে যাবে।” ছেলের কথায় বাবার অন্তরে এখন স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি। রাত বাড়ে। পাশের আম গাছের ডালে পেঁচা ডেকে ওঠে। নিদ্রা-দেবীও আসে আমন্ত্রণ পেয়ে।

দু’মাস পরে একদিন পারমিতা বাড়ি ফিরে এসে মাকে জানালো, “মালিক আমার কাজে ভীষণ খুশি মা। আমাকে খুব শীঘ্রই কলকাতার অফিসে পাঠাতে চান।  থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাইনেও দু’হাজার টাকা বাড়বে। সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসতে পারবো। কিন্তু মা, আমি যাব না।” “কেন রে, নিশ্চয় যাবি। আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। বিয়ে হলেও তো তোকে অন্য কোথাও যেতে হবে।  আমরা তো কোলকাতাতেই একজন পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।” পারমিতা না বলতে পারলো না। প্রতিবেশী বুল্টি মাসিকে মাসে এক হাজার টাকার বিনিময়ে মা-বাবাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে ক’দিনের মধ্যেই কলকাতায় চলে গেল।

এরপর চন্দ্রনাথ একদিন খুশির খবর নিয়ে এলো বাড়িতে। “মা, সভাপতি বলেছেন, ‘ভোটে আমাদের জেতাতেই হবে। জিততে পারলে স্কুলের চাকরি পাকা।  আমরাও প্রতিজ্ঞা করেছি, হারবো না, জিতবোই। জিততে আমাদের হবেই মা।” “কিন্তু বাবা, না জিতলে কী হবে? ওদের অনেক বদনাম হয়েছে। মানুষের মন থেকে দূরে সরে গেছে।” “তুমি চিন্তা ক’রো না। মানুষের সমর্থন আমরা আদায় করে নেবোই।” মায়ের ভয় হয়। সেকথা বলতে পারে না ছেলেকে, শুধু অসহ্য বেদনায় গুমরে গুমরে ওঠে।

ওদিকে মেয়ের চলে যাওয়া দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। একবারও বাড়ি আসেনি। ফোনও করেনি। মা বারবার ফোন করলেও ‘বন্ধ’, কখনও ‘ব্যস্ত আছে’ বলছে। অফিস থেকেও বারবার ফোন করে জানতে চাইছে, “পারমিতা বাড়ি গেছে, এখনও এলো না কেন?” মাস ফুরিয়ে গেল, তাও পারমিতা বাড়ি ফিরল না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল মায়ের। অশ্রুধারা বইতে লাগল। চন্দ্রনাথ পুলিশের কাছে দিদির নিখোঁজের ডায়েরি করে এলো। এবার কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। কাল বাদে পরশু ভোট।

সভাপতি ফোন করে দুশ্চিন্তা না করতে বললেন। অবশেষে চন্দ্রনাথ অসহ্য যন্ত্রণা বুকে নিয়ে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়ে গেল। বলে গেল, “ভোট শেষ হলেই বাড়ি ফিরবো মা। তারপর বোনের খোঁজে যেখানে যেতে হয়, যাবো।”

আজ সন্ধ্যায় বুল্টি মাসি এসে মাকে একটা খারাপ খবর দিল, “জানো মাসি, যে লোকটা পারু বেটিকে কাজ দিয়েছে, তার অফিস থেকে আগেও নাকি অনেক মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। গ্রামে অনেকে বলাবলি করছে, ‘লোকটা মেয়ে পাচারের ব্যবসা করে। পুলিশ, নেতা,মন্ত্রী সবাই ওর পকেটের লোক’।” মা শিউরে ওঠে। “তবে কি আমার পারু বিক্রি হয়ে গেছে?” জ্ঞান হারায় মা। আত্মীয়-স্বজন যে যেখানে আছে, ছুটে আসে।

এলো ভোটের দিন। সূর্য তখন মাথার উপরে। নির্মম খবর এলো বাড়িতে। “বোমা বিস্ফোরণে চন্দ্রনাথ মারা গেছে।” কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়িটা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল। সন্তান হারানো মা-বাবার বুক-ফাটা কান্না প্রতিধ্বনিত হয় গোটা গ্রাম জুড়ে।

পরদিন বিকেল। শোকস্তব্ধ গ্রাম ছুঁয়ে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে বাজনা বাজিয়ে, আবিরে রাঙিয়ে, উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে একটা মিছিল  এগিয়ে আসে। বিজয় মিছিল। গ্রামের কাছাকাছি এসে থেমে গেল। কাল এখানে রজনীগন্ধার মালা পরানো হয়েছিল নিথর চন্দ্রনাথের গলায়। আজ সেই রজনীগন্ধার মালা পরানো হ’লো জনদরদি নেতা, হবু মন্ত্রী ‘পঞ্চানন মন্ডলে’র গলায়। তাঁর অমৃত ভাষণ ধ্বনিত হ’লো আকাশে-বাতাসে, “শহিদের রক্ত, হবে নাকো ব্যর্থ। সাহসী যুবক চন্দ্রনাথ, অমর রহে। হে আমার শ্রীপুরবাসী যুব সম্প্রদায়, চন্দ্রনাথের আত্মার শান্তি কামনা করে আজ আমি প্রতিজ্ঞা করছি – তোমাদের সকলের কর্মসংস্থানের মহা দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিলাম। ……..।”

………………………………………………………………………………