পরিযায়ীর ইতিকথা


– Harabilash Sarkar ( হরবিলাস সরকার )

ছেলে আমার বাড়ি ফিরবে বলে

কাল ফোন করেছিল,

“মা, বারো দিন হল খাবার ফুরিয়ে গেছে,

হাতে যে ক’টা টাকা ছিল

বিস্কুট আর  চিড়ে কিনতে তাও ফুরিয়ে গেছে,

কাজ না হলে মালিক আর মজুরি দেবে কেন?

বাড়ি ফেরারও কোন উপায় নেই, গাড়ি-ঘোড়া যে সব বন্ধ,

থাকার ঘরটাও ছাড়তে হয়েছে,

এখন খোলা আকাশের নিচে গাছতলায়, কখনও প্লাটফর্মেই দিন কাটে,

একটু জলই প্রাণ বাঁচানোর শুধু ভরসা,

তাও ভিন রাজ্যের মানুষকে জলের কল কেউ ছুঁইতে দেয় না,

জনপ্রাণীহীন শুনশান রাস্তা, কোথায় একটু জল পাবো!

পুলিশের বড্ড কড়াকড়ি, ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকি,

তবে মা তোমার ছেলের জন্য চিন্তা ক’রোনা,

তোমার আশীর্বাদে ছেলে তোমার ভালোই থাকবে,

কত ঝড়-জল সহ্য করে, কত মাঘের শীত গায়ে মেখে যাকে বড় করেছো,

নীড়হারা পাখির মত

অসহায় সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছো,

তার কি কোন ক্ষতি হতে পারে?

জানতে পেলাম,

বড়লোকের ছেলেরা বিদেশে আটকে আছে,

তাদের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা হয়েছে,

ভেবেছিলাম,

এবার লক্ষ শ্রমিকও ঘরে ফিরবে

নিখরচায় ট্রেনে চেপে ।

বিধিনিষেধের কথা মাথায় আসেনি,

অনাহারেই মরতে হবে যখন, তখন কি আর মারণ-ব্যাধির ভয় থাকে?

তাইতো হতভাগ্যরা জড়ো হয়েছিলাম রেলস্টেশনে,

সহস্র কাকুতি-মিনতি-প্রার্থনায়ও মন গলেনি,

বরং ব্যবস্থা হয়েছিল শাস্তির ।

লাঠির ঘায়ে কপালটা একটু ফেটেছিল, রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে,

ব্যথাটা এখনো আছে,

ভয় পেয়ো না মা, তোমার ছেলে ভালোই আছে,

মাগো, এর চেয়ে বেশি আঘাত তুমি যে পেয়েছো,

সব যন্ত্রনা কেমনে সইতে হয় তুমিই তো শিখিয়েছো ।

এবার তোমাকে একটু আশার কথা শোনাই,

আজ শুক্লপক্ষের সূচনা হয়েছে,

রাত নামবে যখন, পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে আকাশে,

সেই আলোয় আমরা ক’জন পায়ে হেঁটে রওনা দেবো,

হাজার মাইল পথ, ক’দিন পরেই ঠিক পৌঁছে যাবো ।”

মায়ের বুক ফেটে যায়,

অতিমারি ‘করোনা’র রোষে দেড় মাস গৃহবন্দি,

আরও কতদিন! জানা নেই,

কত বিনিদ্র রাত কেটে গেছে!

কতদিন উপবাসে ফুরিয়েছে!

তবু আজ তপ্ত মরুবুকে যেন এক পশলা বৃষ্টি,

খিদে তাঁর নিবৃত্তি হয়ে গেছে,

কাতর চোখে পাশে দাঁড়িয়ে কঙ্কালসার নাতি-নাতনি,

দুহাতে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে –

দাদু, দিদি –  ছেলে আমার আসছে ।

কেজি পাঁচেক চাল পেয়েছিল, ‘সাহায্য’,

বৌমাকে ডেকে বলে – জনমদুঃখিনী মা আমার,

তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী,

ক’টা চাল রেখে দাও,

খোকা যেদিন বাড়ি ফিরবে সেদিন রেঁধো,

উঠোনের চারা আমগাছটা খোকা লাগিয়েছিল,

এই প্রথম একটাই আম ধরেছে,

বোঁটার ধার হলদে হয়ে আসছে, সেদিন পেরে দিও ।

 এরপর শুধুই পথ চেয়ে থাকা,

চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে গেছে,

 জরা শরীরটা অনড় পাথর হয়ে গেছে,

 বৃষ্টিতে ভিজে কলসির চাল-ক’টা পচে গেছে,

শিল পড়ে গাছের আমটাও ঝরে গেছে,

 অবশেষে যেদিন  চাঁদ ডুবে গেল অমাবস্যার অন্ধকারে,

সেই অন্ধকার ঠেলে, তীব্র আলোয় ঝলমল করে

কড়া প্রহরায়, রাজকীয় সমাদরে

ছেলে এলো স্বর্গরথে পালঙ্কে শুয়ে,

পুষ্প-মালায় বরণীয় হয়ে ।

নিস্তব্ধ পল্লীর বৃক্ষরাজি আজ শোকাহত , চারপাশে গুমড়ে চাপা কান্নার রোল উঠলো,

মা শুনতে পেল – ছেলে তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকছে,

কাছে এসে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দেখে – ছেলে ঘুমোচ্ছে ।

‘ঘুমোও সোনা, কত রাত ঘুমোওনি, কত ক্লান্তি, একটু জিরিয়ে নাও’ ।

সযত্নে হাত বুলায় মাথায়, স্নিগ্ধ স্নেহের পরশ,

‘ইস! কতদিন খায়নি সোনা, পেটটা পিঠের সাথে লেগে গেছে,

চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে, পায়ের তলায় থিকথিকে  ঘা,

মানিক, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।’

“মানুষ না দেবতা ? ”


Tags: best bengali magazine site, best site of india, best story, Harabilash Sarkar, india, magazine site, poem book, poem on coronavirus, srijanee, কবিতা অর্থ, সৃজনী, হরবিলাস সরকার