Pesha Badal – পেশা বদল

ছোট গল্প 

( রম্য রচনা )

বছর তিরিশের দুই যুবক,একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মানিকজোড়। একজন দেখতে বেশ সুন্দর, গৌরবর্ণ। ছোটবেলায় বাবা খুশি হয়ে নাম রেখেছিল সুদর্শন। চোখ দুটো পদ্মের পাপড়ির মতো। তাই মা আদর করে নাম রেখেছিল পদ্মলোচন। পদ্মলোচন নামটাই শেষে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবে এলাকায় সবাই পদ্ম বলেই ডাকে। অন্য জনের চেহারা জৌলুসহীন, কৃষ্ণবর্ণ,উপরের পাটিতে দুটো দাঁত যেন দাঁতাল। পিসিমা আঁতুড়ঘরেই নাম রেখেছিল গোবর্ধন। বড় হলে সেই নামই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবে বালক বয়সে গোবর্ধন স্কুল ফাঁকি দিয়ে গুবড়ে পোকা ধরে প্রতিবেশী হাড়-কৃপণ বোসদের পুকুরে লুকিয়ে বড়শি ফেলে মাছ ধরত। বোসদের ঠাকুরদা একদিন ‘চোর, চোর’ বলে তাড়া করলে গোবর্ধন গুবড়ে পোকাগুলো বুড়োর গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এলে ঠাকুরদা পোকাগুলো দেখিয়ে বলল, “ ছি! ছি! বিচ্ছু ছোকরাটা এগুলো আমার গায়ে ছুঁড়ে মেরে পালিয়েছে।” “ কে গো, কে?” “ আরে ওই গোবিন্দ বামুনের ব্যাটা ‘গুবড়ে’।” সেই থেকেই গোবর্ধনের নাম হয়েছে গুবড়ে। তবে বুড়ো-বুড়িরা অনেকে গোবড়া বলেও ডাকে।

পদ্মলোচন বি.এ পাশ করেও বেকার। শেষে অনন্যোপায় হয়ে পূর্বপুরুষের নরসুন্দরের পেশায় নেমে পড়েছে। গোবর্ধন মাধ্যমিকে তিনবার বসেও উত্তরাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বাপের ধমক খেয়ে তার পুজোপাটের বইখানা নিয়ে নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যা মন্ত্র আওড়াতে লাগলো। মাথায় টিকিও রাখল। তারপর এক পূর্ণিমা তিথিতে গায়ে নতুন পৈতা আর নামাবলী জড়িয়ে, হাতে শালগ্রাম শিলা নিয়ে সেও চৌদ্দ পুরুষের পেশাতেই নেমে পড়ল।

দুজনের পেশা আলাদা হলেও বন্ধুত্ব আরো নিবিড় হয়েছে। কেননা, একজনের ছাড়া আরেকজনের চলে না। পদ্ম বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধের কাজ ধরলে গুবড়েকে ডাকে। আবার গুবড়েও কাজের ডাক পেলে পদ্মকে ডাকে। রোজগার বেশ ভালোই হতে লাগলো। আবার ঝোলা ভর্তি হয়ে চাল, কলা, মিষ্টি ইত্যাদি নানাবিধও আসতে লাগলো। কিন্তু গুবড়েকে নিয়ে একটা সমস্যাও দেখা দিল। অনেকেই বলছে – গুবড়ে ,তোর মন্ত্র উচ্চারণ ঠিক নয়। ভুলও হচ্ছে। কথাগুলো পদ্মের কানেও এলো। পদ্ম বেকায়দা বুঝে গুবড়েকে একটা পরামর্শ দিল – “শোন্ গুবড়ে ,তোর সমস্যাটা তোকেই উপড়াতে হবে। নাহলে কিন্তু বাজারটা ধরে রাখতে পারবি না। তুই কতগুলো কথা যেমন – ওঁ,স্বাহা,নমঃ,নমহ বারেবারে একটু জোর দিয়ে বলবি। ‘ং’ বেশিরভাগ শব্দের সঙ্গে জুড়ে দিবি। লোকে বলবে – দারুণ মন্ত্রপাঠ হচ্ছে। আর যে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারিস না ,সেগুলো মুখের মধ্যে নিয়ে ড্রিবল করবি।” গুবড়ে বললো – সে নাহয় হলো , খটোমটো শব্দগুলো আমার একেবারেই মনে থাকেনা। তুই বরং বইটা নে। দু’চার দিন পড়লেই তোর মুখস্থ হয়ে যাবে। আটকালে আমাকে চট করে বলে দিবি। সেই মতোই পদ্ম বইটা বাড়ি নিয়ে এসে মন দিয়ে মুখস্থ করতে লাগল। কয়েকদিনে বেশ মুখস্থও হয়ে গেল।

দেখতে দেখতে বিয়ের মরশুম পড়ে গেল। বেচারা হরিচরণ মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে। ডাক পড়লো গুবড়ের। নিশুতি লগ্নে বিয়ে। গুবড়ে ধুতির কাছা এঁটে , টিকি দুলিয়ে পদ্মের পরামর্শ মতোই মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। কনে পক্ষের লোকেরা বলাবলি করতে লাগল – চমৎকার ঠাকুরমশায় ,কী সুন্দর মন্ত্রপাঠ! এই না হলে বামন? কিন্তু গন্ডগোল পাকালো বরপক্ষের লোকেরা। বরের ভাই দূর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো – থামুন ঠাকুরমশাই,থামুন। গুবড়ে হঠাৎ মন্ত্রপাঠ থামিয়ে পদ্মের মুখের দিকে তাকালো। পদ্ম এগিয়ে এসে কানে কানে বললো – কেস খেয়ে গেলিরে গুবড়ে। বিয়ের মন্ত্রের মধ্যে দু’লাইন শ্রাদ্ধের মন্ত্র বলে ফেলেছিস্। “কী হবে এখন?” “ কী আর হবে? ক্ষমা চেয়ে নে।” বরের ভাই কাছে আসতেই গুবড়ে হাত জোড় করে দাঁড়ালো। “দাদা ,ভুল হয়ে গেছে। প্রায়শ্চিত্ত করে নিচ্ছি। ” পদ্ম এক ধাপ এগিয়ে এসে বলল – “বামুনের মুখনিঃসৃত বাণী ,দোষের কিছু নেই। এতে আপনাদের মঙ্গলই হবে।” যাইহোক এযাত্রা রক্ষা পাওয়া গেল।

বিয়ের এই মরশুমেই বোসদের ছোট ছেলের ছোট মেয়ের অন্নপ্রাশন। ঠাকুরমশাই গুবড়ে। সে এবার অন্নপ্রাশনের মন্ত্রগুলো বেশ ভাল করে রপ্ত করে এসেছে। বোসদের ঠাকুরদা , যে গোবর্ধনের নামকরণ ‘গুবড়ে’ করেছিল, কয়েক বছর আগে সে পরলোকে চলে গেছে। ঠাকুমা এখনো বেঁচে আছে। এখনো ফোকলা দাঁতে সেই মিষ্টি হাসি আর টনটনে গলার আওয়াজ। গুবড়ে বাড়িতে ঢোকামাত্রই আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঠাকুমা হেসে বলল, “ কে রে, গোবড়া না? চুরি করে মাছ ধরতে ধরতে ঠাকুরমশাই হয়ে গেলি?” গুবড়েও একগাল হেসে বললো, “ সবই তোমাদের আশীর্বাদ ঠাকুমা।”

পদ্ম গুবড়েকে কানে কানে বললো, “ খবরদার, এখানে যেন ভুল না হয়। একেবারে মাঠে মারা পড়বি। বামুনগিরি তোর জন্মের মতো ঘুচে যাবে।” গুবড়ে ভয়ও পাচ্ছিল। বেশ সতর্ক হয়েই শুভ কাজ শুরু করলো। প্রথমদিকে ভালোই চলছিল। মাঝখানে ঠাকুমার চোখে চোখ পড়ায় হাত-পা কাঁপতে লাগল। গুবড়ে এবার চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। দু-একবার টিকিতে হাতও বুলিয়ে নিল। কাছাটাও এঁটে নিল। কিন্তু কাঁপুনি কমলো না। মন্ত্র উচ্চারণে বিকৃতি দেখা দিল। ভুল হতে লাগল। শেষে স্মৃতিও বেইমানি করল। মুখ থেকে বিয়ের মন্ত্র উচ্চারিত হতে লাগল। ঠাকুমা বামুনের মেয়ে না হলেও ভুলটা ঠাওর করতে তার বাকি রইল না । অমনি গোল গোল চোখ করে বলে উঠল, “গোবড়া ! এই তোর বামুনগিরি ? অন্নপ্রাশনে বিয়ের মন্ত্রপাঠ ?”গুবড়ে মন্ত্র থামিয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। পদ্ম বেগতিক দেখে আগেই চম্পট দিয়েছিল। এবার গুবড়েও খালি ঝোলা-ঝম্পা নিয়ে ‘ইতি ঠাকুমায় চরণে নমঃ’ বলে এমন ছুট দিল,পেছনে তাকাবার আর সাহস করলো না। ঠাকুমা চেঁচাতে লাগল, “ধর্ ,গোবড়াকে ধর্।” কে পায় আর গোবড়াকে ?

নববর্ষের শুরুতে পদ্ম কাজ ধরেছে বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত মাস্টেমশায়ের বাড়িতে। সদ্য তাঁর স্ত্রীর বিয়োগ ঘটেছে। শ্রাদ্ধের কাজটা কীভাবে করবে তা নিয়ে চিন্তিত গুবড়ে। ভয় ওকে ছাড়ছে না। শুনেছে – মদ খেলে নাকি কিছু সময়ের জন্য নার্ভগুলো সবল হয়। তাই কাজে বেরোনোর আগে পদ্মের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক বোতল দেশি কিনে এনে একশ্বাসে ঢক ঢক করে অর্ধেকটা গিলে নিল। বেরোনোর সময় পদ্মের কেমন কেমন মনে হলো। ব্যাপারটা সে আঁচ করলো। অগত্যা ওই অবস্থায় মাস্টেমশাইয়ের বাড়ি যেতেই হলো। পদ্ম অবশ্য রাস্তায় বুঝিয়েছে – “ধীরে ধীরে মন্ত্র পাঠ করবি। আমার মুখের দিকে আড়ছোখে তাকাবি । ভুল হলে বা ভুলে গেলে আমি ছোট করে বলে দেবো। শুনে শুনে বলবি। এতে দোষের কিছু নেই। ”

যথাসময়ে শ্রাদ্ধের কাজ শুরু হলো। আজ গুবড়ের হাত-পা না কাঁপলেও একটু আগে পর্যন্তও যে সমস্ত মন্ত্র মনে ছিল, মদের তীব্র ঝাঁজে এখন তার সবটাই গুলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় পদ্ম মন্ত্র বলে দেয় ,আর গুবড়ে শুনে শুনে বলে।

মাস্টেমশাই এমন মন্ত্রপাঠ থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ দেখ বাপুরা,আমি ইতিহাসের শিক্ষক ছিলাম। ধর্মশাস্ত্রের যুগে মানুষকে তার কর্ম অনুযায়ী চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছিল। অবশ্য এই চারটি শ্রেণীর বাইরে আরও একটি শ্রেণী ছিল। কিন্তু তখন এমন ছিলনা যে, ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম হলেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবে ,আর অব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিলেই তার ভেতরে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জিত হবে না। এরকম কোনো পাকাপাকি বন্দোবস্ত ছিল না। এই পাকাপাকি বন্দোবস্তটা কালক্রমে বিশেষ করে মধ্যযুগ থেকে কার্যকরী হয়েছে। বংশপরম্পরায় সেই ধারাটাই চলতে চলতে এখন তা আমাদের রক্ত-মজ্জায় মিশে গেছে। কিন্তু আমিতো তাতে মান্যতা দিই না। এই যে গোবর্ধন , তোমার ভেতরে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়নি ,তাই তুমি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিয়েও এই কাজের যোগ্য নও। ফলে তুমি গুবড়ে হয়েছো। আবার দেখো – পদ্ম কর্ম অনুযায়ী নরসুন্দরের ঘরে জন্মালেও ওর ভেতরে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জিত হয়েছে। তাইতো ও পদ্ম ,ওর পাপড়িগুলো কেমন সুন্দর বিকশিত । এই কাজের ও-ই অধিকারী। অতএব ,এই শ্রাদ্ধের ব্রাহ্মণের কাজটা পদ্মলোচন করবে। আর গোবর্ধন ,নরসুন্দরের কাজটা তুমি করো। এতে কোন লজ্জা নেই বাপু । সব কাজই সমান। শুধু যে যেটা করবে নিষ্ঠাভরে করবে।

পদ্ম বললো, “মাস্টেমশায়, আমার তো পৈতা নেই , নামাবলী নেই। ” “আরে ওসব কিচ্ছু লাগবে না। ভক্তিতে মুক্তি। মিথ্যা আড়ম্বরে জগতের অকল্যানই হয়। ”

যদিও পদ্ম গুবড়ের নামাবলীটা গায়ে দিয়ে ঠাকুরের আসন গ্রহণ করল। তারপর বিশুদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রাদ্ধের কাজ সম্পূর্ণ করলো। সেই থেকেই পদ্ম হয়ে উঠল ঠাকুর পদ্মলোচন , আর গুবড়ে গোবর্ধন নরসুন্দর।

……………………………………………………….