Shrikanter Shiksharatna – শ্রীকান্তের ‘শিক্ষারত্ন’

 

srijanee.com

যারা প্রতিদিন স্নিগ্ধ-শীতল, শ্যামল-সুন্দর নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে,সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে, শ্রীপুরের আনন্দময়ী শিশু নিকেতনের ‘শ্রীকান্তবাবু‘ তাদেরই একজন কিনা – সেকথা সময় বলবে।

তাঁর দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের চলার পথ কখনো বন্ধুর হয়ে ওঠেনি। তিনি স্রোতের বিপরীতে কখনও চলারও চেষ্টা করেননি। সমাজে ঘটে যাওয়া ন্যায়-অন্যায় নিয়েও মাথা ঘামাননি। শাসকের রং বদলেছে, তিনিও নিজেকে নির্দ্বিধায় বদলেছেন। স্থান-কাল-পাত্র নিরীক্ষণ করে নিজেকে নিরন্তর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখনও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত।


একদিন জেলার স্কুল বোর্ডের সভাপতির গাড়ি এসে থামলো স্কুলের দরজায়। সঙ্গে আরও দুজন। প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা পালনে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন শ্রীকান্তবাবু। খবরটা দ্রুত পৌঁছে দিলেন এক শ্রেণিকক্ষ থেকে আরেক শ্রেণিকক্ষে। নিমেষে সব কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল। এরপর ছুটলেন গাড়ির দিকে। তাঁর যে ধর্ম – আপ্যায়নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখবেন না। “আসুন স্যার, আসুন।”


সভাপতি মহাশয় শ্রেণিকক্ষ ঘুরে দেখতে লাগলেন। অভিভূত হয়ে মন্তব্য করলেন,  “বাঃ চমৎকার! বেশ রং-চঙে হয়েছে তো।” “স্যার, যে টাকাটা দেওয়া হয়েছিল, তার পুরোটাই খরচ করেছি। শ্রেণিকক্ষগুলো মেরামত করে বালি-সিমেন্টের প্রলেপ লাগিয়েছি। একটা নতুন কক্ষও নির্মিত হয়েছে। ভালো কোয়ালিটির রং লাগানো হয়েছে।” “এত সুন্দর কাজ , আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি।” “এবার স্যার আসুন, বাগান দেখবেন।”


হাঁটলেন সভাপতি মহাশয় শ্রীকান্তবাবুর পিছুপিছু। বাগান দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন তিনি। প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। “ফুলের গাছগুলো বেশ দেখার মতো হয়েছে। কত বিচিত্র ফুল ফুটেছে!” “ স্যার, একশোর উপর দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ আছে।” “শাক-সবজিরও চাষ করেছেন দেখছি।” “হ্যাঁ। ডাটা, পালং, বড়বটি, ঝিঙে, কুমড়ো,লাউ, বেগুন, লঙ্কা, শিম,ঢেড়শ, পেঁয়াজ,রসুন – এ সবই আছে। এ মাটিতে এগুলো ভালোই ফলে। ছেলেমেয়েদের দুপুরের খাবারে বাগানের তরকারিই রান্না হয় স্যার।” “আপনি তো কাজের মানুষ দেখছি। এতসব করেন কখন?” শ্রীকান্তবাবু মৃদু হেসে বললেন, “ এখনও বাকি আছে স্যার। চলুন, পুকুর দেখবেন।” “ পুকুর!” “হ্যাঁ স্যার, ঐ তো সামনে।”


পুকুর দেখে সভাপতি বিস্মিত। ছোটখাটো হলেও জল থই থই করছে । তার মধ্যে নানারকম মাছেরা সাঁতার কাটছে। ক্যামেরায় ছবিও তুললেন তিনি। শ্রীকান্তবাবু বললেন, “ ভাতের সঙ্গে মাঝেমধ্যে একটু মাছের ঝোল হলে বাচ্চারা খুব খুশি হয়।”  “সেতো হবেই। আপনি ধন্য মশাই,” এই বলে  সভাপতি মহাশয় অফিস রুমের দিকে এগোতে লাগলেন। পেছন থেকে বলতে লাগলেন শ্রীকান্তবাবু, “ স্যার, ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা শৌচাগার তৈরি করেছি, শিক্ষকদের জন্যও করেছি। ট্যাপকল বসিয়েছি।”  “কোনদিকে?” “ চলুন, অফিস ঘরের পাশেই। তার কাছাকাছি রয়েছে রান্নাঘর আর স্টোর-রুম।” “এলাহি কান্ড, আমি তো ভাবতেই পারছিনা – এতসব কী করে হলো।” “ স্যার, প্রবাদ আছে – ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। সবটাই মনের জোরে হয়েছে স্যার।”


“ আমার তো মনে হয় – স্কুলকে আর ছেলেমেয়েদেরকে ভালোবেসেই এমন মহতী কাজ সম্ভব হয়েছে।” “ স্যার, স্কুলের সীমানা জুড়ে নানারকম ফলের গাছও আছে। বেশ কয়েকটি আম গাছ আছে। আম ধরেও প্রচুর। বাচ্চারাই খায়। কাঁচা আম চাটনি করে খাওয়ানো হয়।” “ গাছগুলোর পরিচর্যা করেন বুঝি?” “ হ্যাঁ স্যার, মানুষের মতই যত্ন করা হয়।” “ আপনি তো একজন গাছপ্রেমীও দেখছি।”


ক্লান্ত হয়ে এবার সভাপতি মহাশয় অফিস রুমে গিয়ে ঢুকলেন। রাঁধুনি দিদিরা ইতিমধ্যে চা তৈরি করে নিয়ে এসেছে । শ্রীকান্তবাবু নিজের হাতে ঢেলে দিলেন। “স্যার, দার্জিলিং চা।”


চা পান করতে করতে অফিসিয়াল কিছু কথাবার্তা চলতে থাকল । তারই মধ্যে শ্রীকান্তবাবু বললেন, “ স্যার, ইচ্ছা আছে আরও অনেক কিছু করার। স্কুলের তোরণ নির্মাণ, পুকুর পাড় বাঁধানো, একটা প্রার্থনা কক্ষ তৈরি আর খেলার মাঠ সংস্কার।” “আপনি এগিয়ে যান। টাকার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে ,” বলে উঠে দাঁড়ালেন সভাপতি মহাশয় । রওনা হলেন গাড়ির দিকে। পেছন পেছন পা মেলাচ্ছেন শ্রীকান্তবাবু, হাতে বেশ বড়সড় তিনটি মিষ্টির প্যাকেট। শেষ পাতে একটু মিষ্টি, ভালোই হলো, আর তা নিয়ে ছুটল সভাপতির গাড়ি।


প্রথম অর্ধবেলাটা বেশ খুশিতে কাটলেও পরের অর্ধবেলার শুরু থেকেই শ্রীকান্তবাবুর মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। ভাবছেন – না জানি সহকারীরা আজ তাকে কতটা বিব্রত করবেন। ভাবনাটা সত্যিই হলো। শিক্ষকদের দশ মিনিটের তাৎক্ষণিক বৈঠকে সহকারী শিক্ষক প্রশ্ন তুললেন। “ স্যার, স্কুলে দু’জন মাত্র আসিস্ট্যান্ট টিচার, আমি আর ম্যাডাম। পাঁচটা ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দুটো ঘরে বসানো হয়। আমাদের ব্যক্তিগত ছুটি-ছাটাও নিতে হয় । বাধ্য হয়ে তখন একটা ঘরেও বসাতে হয়।  বলতে তাই লজ্জা বোধ হচ্ছে, ক্ষমা করবেন, গরু-ছাগলের মতো শুধু সামলানো ছাড়া আর কিছুই হয়না। একটা আশা নিয়ে মা-বাবারা ওদেরকে স্কুলে পাঠায়। আপনি তো স্কুলের সাজসজ্জা আর বাগান নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলেমেয়েগুলোর পঠন-পাঠন নিয়ে ভাবনার কোন অবকাশই থাকে না। অথচ এই দিকটাই তো প্রধান।” শ্রীকান্তবাবু ভেতরে ভেতরে বেজায় ক্ষুব্ধ হলেন। তবে অত্যন্ত চালাক মানুষ তো। ভেতরের রাগ বহি:প্রকাশ করলেন না। বোঝালেন –  “দেখুন, এখন চাকচিক্যের যুগ। বাইরের সৌন্দর্যটাই লোকের আগে চোখে পড়ে। উপরমহলে স্কুলের একটা নাম-ডাক হচ্ছে। এই যে নিত্যনতুন ছবি পাঠাচ্ছি হোয়াটসঅ্যাপে। সেসব সত্য কিনা – যাচাই করতে কর্মকর্তারা আসছেন স্কুল দেখতে। তাঁরা প্রশংসা করে যাচ্ছেন। মডেল স্কুলের তালিকায় আমাদের নাম লিখেছেন। এ তো সৌভাগ্যের কথা। আপনারা কেন যে বুঝতে চাইছেন না, আমি জানিনা। এতসব কর্মকাণ্ড না করে আমি যদি শুধুমাত্র পঠন-পাঠনে জোর দিতাম, এই সুফল কি মিলতো? তাছাড়া বেশিরভাগ মা-বাবা গরিব,অক্ষর জ্ঞান নেই, এমন ঘরের ছেলেমেয়েরাই তো এখানে আসে। এদেরকে কতটা-কী শেখানো যাবে? আর বাইরে তা কখনোই ফুটে উঠবে না।” সহকারী শিক্ষকেরা এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করলেন না। একজন তো রসিয়ে বলেই ফেললেন, “ স্যার,তাই বুঝি আপনার খ্যাতি কীসে বারে, তার ব্যবস্থা করছেন , হয়তো শিক্ষারত্ন পুরস্কারটাও পেয়ে যাবেন, কিন্তু ইতিহাসে এর মূল্য কোথায়?” প্রধান শিক্ষক আর তর্ক  বাড়ালেন না।


মে মাসের শুরুতে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে শ্রীকান্তবাবু কোদাল কোপাচ্ছেন। সবজির চাষ হবে। জনা সাতেক ছেলেমেয়েদেরকেও সঙ্গে নিয়েছেন। ওরা জল ঢেলে মাটি নরম করছে। ঘাস তুলে তুলে ফেলে দিচ্ছে। ঘামে ওদের শরীর ভিজে যাচ্ছে। পোশাকে ময়লা লাগছে । কেউ খিদে শরীরে হাঁপিয়ে উঠলে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। শ্রীকান্তবাবু উৎসাহ যোগাচ্ছেন, “ আর একটু কর্, ভাত রান্না হলেই খেয়ে নিবি। আজ তোদের ডিম দেবো।”  ডিমের আশায় ছেলেমেয়েরা মনোবল ফিরে পায়। সহকারী শিক্ষিকা অসহনীয় হয়ে উঠলেন। এসে বললেন, “এই  ছেলেমেয়েগুলো শুধু পড়াশোনা থেকেই বঞ্চিত হলো, তাই নয়। এরা অসুস্থ হয়ে পড়বে স্যার। তাছাড়া এই সবজি যখন উঠতে শুরু করবে ততদিনে তো গরমের ছুটি পড়ে যাবে।”  উত্তর ভেসে এলো, “এরা মুনিষ খাটা ঘরেরই ছেলেমেয়ে । চট করে অসুস্থ হবে না। আর ছুটিতে সবজি ওদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবো। পড়াশুনার ঘাটতিটাও পূরণ হয়ে যাবে। বেশি করে ছুটির কাজ দিয়ে দেবো।” এমন সমাধানসূত্রের পর আর কিছু বলার থাকল না।


দু’দিন পর গাছ থেকে কাঁচা আম পাড়া হল। ছেলেমেয়েরা কুঁড়িয়ে এনে জড়ো করলো। সহকারী শিক্ষক বললেন, “ এত আম কী হবে স্যার?” “ আজ ছেলেমেয়েদের পাতে চাটনি পড়বে।” খুশিরই কথা। হোয়াটসঅ্যাপে আমের ছবিও পোস্ট করা হলো। কিন্তু অতিরিক্ত আম ঝোলা ভর্তি হয়ে যখন অন্যত্র চলে গেল, তখনই বিতর্ক দানা বাঁধল। “স্যার, কী হবে ঐ আম?” “ওগুলো কেটে শুকানো হবে। তারপর আচার তৈরি হয়ে আসবে। ছেলেমেয়েরা খাবে।” “স্যার, এর আগেও বছর বছর আম গেছে কিন্তু আচার তৈরি হয়ে স্কুলে আসেনি।” “ এবার আসবে।”


প্রশ্ন আরও উঠল। “স্যার, গতবার ছেলেমেয়েদেরকে একদিন মাত্র পুকুরের মাছ খাইয়েছেন। শুনেছি, কুড়ি হাজার টাকায় কাউকে লিজে দিয়েছিলেন। এবারও দিয়েছেন।” “ আচ্ছা এ খবর আপনাদের কে দিয়েছে বলুন তো? যাকগে শুনুন, ওই টাকা দিয়ে স্কুলের কত কাজ হয়েছে জানেন?”  “জানবো কী করে? আপনি তো কোন কিছুরই হিসেব দেন না।” “আপনারা পাঠদান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাই আপনাদের মাথাতে এসব চাপাই না।”  “স্যার, খবর আর একটা আছে। একজন সহৃদয় ব্যক্তি সদ্য পুত্রহারা হয়েছেন। পুত্রের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিনি স্কুলকে একটা বিরাট অংকের টাকা দান করেছেন। ওটার কথা কি উপরমহল জানে?  কী করা হবে ঐ টাকা দিয়ে?” “ শুনুন,সবকিছুই যে উপরে জানাতে হবে – এমন কোনও কথা নেই। ওই টাকা মহৎ কাজেই লাগানো হবে। এটুকু মনে রাখবেন –  আমি সৎ এবং সত্যের পূজারি।” “ জানি স্যার , সে বিশ্বাসে কোন চির নেই। তবে কিনা – বাইরে থেকে শুধুমাত্র দেখে শুনে সত্যকে বিচার করা যায় না। সত্যের বাইরেও আরেক সত্য লুকিয়ে থাকে। যেমন যুক্তির বাইরেও অনেক যুক্তি তৈরি হয়ে থাকে।”  “আমার ভেতরে সত্য একটাই, যুক্তিও একটাই।” হ্যাঁ এই সত্য-কথন আর ক্ষুরধার বুদ্ধিই আপনাকে  স্বীকৃতির চরম শিখরে নিয়ে যাবে।” “ কোন্ স্বীকৃতির কথা বলছেন?” “ শুনলাম –  শিক্ষারত্ন নিয়ে আপনার নাম চর্চা হচ্ছে।” একগাল হাসলেন প্রধান শিক্ষক।


পঁচিশে বৈশাখের আয়োজন চলছে। এবার রবীন্দ্র জন্মোৎসব বড় করে পালন করা হবে। গোটা স্কুলবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হচ্ছে। কিন্তু বিবেকে আঘাত লাগল, যখন দেখা গেল – ছেলেমেয়েরা টয়লেট, বাথরুম পরিষ্কার করছে। চুপ করে থাকা তো অন্যায়কেই সমর্থন করা। তাই জিজ্ঞেস করা হল, “স্যার, এই কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?”  “সব কাজের উপর  ঠিক-বেঠিক বিচার হয়না। সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। তাছাড়া সব শিক্ষাই সবার জীবনে প্রয়োজন।” “বেশ, তাহলে এই ছবিটাও পোস্ট করে দিন।” “ না, এই ছবিটা উপরমহলের দৃষ্টিগোচরে আনা ঠিক হবে না। আমরা সব সময় সত্য হলেও অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করি না। মানুষের নীতি-নৈতিকতার মধ্যে এটা পড়ে।” “ এটা কী ধরণের নীতি-নৈতিকতা? স্যার, সত্যিই বলুন তো – কাজটা কি ভালো হয়েছে? আপনার বিবেক কী বলে ?” “জানেন তো – স্কুলে ডি গ্রুপের বা সুইপার পোস্টে কোন লোক নেই। অযথা হইচই করে লাভ কী?” “একজন সুইপারকে  ডেকে তো কাজটা করাতে পারতেন।”  “হাজার টাকা চেয়ে বসতো। ঐ টাকাটা দিয়ে  এক গাড়ি গোবর সার কিনতে পারবো।”  “কিন্তু স্যার,  আমরা যাঁর জন্মতিথি পালন করতে চলেছি, সেই রবীন্দ্রনাথই বলেছেন –  অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে তৃণ সম দহে। আপনি-আমিতো তাঁরই গলায় মালা পরাবো,শোভা পাবে?” “শুনুন, এভাবেই জগৎটা চলছে। বাইরেটা ঠিকঠাক রাখুন। ভেতরটা কে দেখছে?”  “না স্যার ,তাতে আপনার পুরস্কারটা পাওয়া যাবে ঠিকই ,কিন্তু সমাজটা অন্ধকারের অতলে ডুবে যাবে।” প্রধান শিক্ষক আর কথা বাড়ালেন না। ছেলেমেয়েদের সরিয়ে দিয়ে ঝাঁ-চকচকে টয়লেট,বাথরুমের ছবি তুলে পোস্ট করলেন। তারপর পরিস্কার জায়গায় নিজে কিছুটা জল ঢাললেন, সে ছবিও তুলে পোস্ট করলেন।

যাইহোক, এরপর যথারীতি সাড়ম্বরে অনুষ্ঠান হয়ে গেল। কয়েকদিন পর গরমের ছুটিও পড়ে গেল।


জুনের মাঝামাঝি খুলল স্কুল । জুলাইয়ে বাগানে আবার নতুন করে সবজি চাষের তোড়জোড় চলছে। আবারও ছেলেমেয়েরা কাজে নেমে পড়েছে। বেগুন, লঙ্কা, মিষ্টি- কুমড়ো, চাল-কুমড়োর বীজ পোঁতা হলো। কয়েকদিনে বাগানের বেড়ে ওঠা জঙ্গলও তুলে ফেলা হলো। আগস্টে নতুন করে নানারকম ফুলের গাছও লাগানো হলো। গুটিকয়েক বাচ্চা নিয়ে শ্রীকান্তবাবু নিজের হাতে বেড়া মেরামতের কাজও সেরে ফেললেন বেশ নিপুণ দক্ষতায়। অনুদানের একটা টাকাও এসে ঢুকেছে স্কুলের একাউন্টে। কয়েকদিনের মধ্যে তোরণ নির্মাণের কাজও শুরু হয়ে গেল। পুজোর ছুটির আগে নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে তার গায়ে রঙের তুলি পড়ল। স্কুলে নামটাও জ্বলজ্বল করছে, চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। পথচারীদের একটাই কথা – এমন স্কুল এ রাজ্যে দুটো মিলবেনা।


পুজোর ছুটি শেষ হয়েছে। বাতাসে হালকা শীতের ছোঁয়া । বাগান ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। এমন সময় একদিন চক্র পরিদর্শক এলেন সৌন্দর্যের টানে। ফুলের তোড়ায় প্রাথমিক আপ্যায়নের পর শ্রীকান্তবাবু ঘুরে ঘুরে বাগান দেখাচ্ছেন মান্যবর কর্মকর্তাকে। তিনি অভিভূত। “এ আপনি কী তৈরি করেছেন!এ তো স্বর্গের উদ্যান। ……..।” মিষ্টিমুখ করে চলে যাবার সময় তিনি বলে গেলেন, “ পুরস্কারের জন্য আপনার নাম পাঠানো হয়েছে। আমার বিশ্বাস – মনোনীত হচ্ছেনই। অবশ্য আমি নতুন করে একটা সুপারিশ পত্র পাঠাবো। সমাজে এমন শিক্ষকই প্রয়োজন। তাঁর সংস্পর্শে সোনা ফলুক, এই আমাদের সকলের কামনা-বাসনা।”


সপ্তাহ দুয়েক পর শ্রীকান্তবাবুর ফোন এলো – “আপনি শিক্ষারত্ন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। পঁচিশে ডিসেম্বর রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আপনার হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন। …….।


দিন গুনছেন শ্রীকান্তবাবু। প্রশংসা ও ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন আসছে নানা প্রান্ত থেকে। তিনি নিজেও ফোন করে আত্মীয়-স্বজনদের একে একে সুখবরটা জানাচ্ছেন। নিজের হাতে সৃষ্ট সৌন্দর্য-শোভিত বাগানে  দাঁড়িয়ে অসীম তৃপ্তি লাভ করছেন। জীবনের এই সুখ এখন স্বর্গ-সুখের চেয়েও বড়। সুখের এই একেকটা দিন যেন ক্রমাগত বড় হয়ে আসছে । সুখ ভোগের অফুরন্ত সময়। এ যেন উপরের অকৃপণ আশীর্বাদ


বারোই ডিসেম্বর থেকে বিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পর্বের মূল্যায়নও শুরু হয়ে গেল। সারাটা বছর যিনি বাগান আর অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, এখন সেই তিনিই প্রতিদিন প্রতিটি শ্রেণীতে গিয়ে সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সরিয়ে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নপত্র বুঝিয়ে দিচ্ছেন, উত্তর লিখতে আপ্রাণ সহযোগিতা করছেন। কৃষ্ণফলকে উত্তর লিখেও দিচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা দেখে দেখে ছবি আঁকার মতো করে লিখে নিচ্ছে উত্তরগুলো। শ্রীকান্তবাবু মনে মনে বলছেন – একটু বেশি নাম্বার পেলে খুশি হবে বাচ্চাগুলো। এখন তো নাম্বারেরই যুগ।


এভাবে মূল্যায়ন পর্ব শেষ হয়ে গেল। তড়িঘড়ি খাতা দেখা, রেজাল্ট তৈরীও হয়ে গেল। সেই রেজাল্ট দিয়ে দিলেন ছাত্রছাত্রীদের হাতে হাতে।


অবশেষে এলো পঁচিশে ডিসেম্বর, সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সুদিন। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই শ্রীকান্তবাবু কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। বিকেলের নির্ধারিত শুভক্ষণে দু’হাত পেতে নিলেন শিক্ষক-জীবনের অমূল্য পুরস্কার ‘শিক্ষারত্ন’ ।


পরদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় শিরোনামে ছাপা হলো শ্রীকান্তবাবুর নাম, “ এক মহান আদর্শ শিক্ষক, সমাজ গড়ার কারিগর, শিক্ষারত্ন প্রাপক” এতসব বিশেষণে ভূষিত করে। বিভিন্ন স্কুল থেকে আমন্ত্রণ-বার্তা আসতে লাগল। যথাসময়ে নিজের স্কুলে এলেন পুরস্কার হাতে নিয়ে। দলে দলে পুষ্পস্তবক নিয়ে এলেন অতিথি, অনুগতেরা ।  আর এলেন রেজাল্ট হাতে রিন্টু, মিন্টু, মনিকা, অভিজিৎ, বাচ্চু, দেবিকাদের মা-বাবারা। একদিকে অনাবিল আনন্দ। একে একে অতিথি,অনুগতদের সংগীত পরিবেশন ও মধুর সম্ভাষণে মূখরিত অনুষ্ঠান প্রাঙ্গন। অন্যদিকে বাইরে গুমড়ে গুমড়ে উঠছে করুন কণ্ঠস্বর, “ স্যার, আমাদের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় অনেক নাম্বার পেয়েছে অথচ নিজেদের নামটা পর্যন্ত লিখতে পারেনা। একটা লাইন বাংলা পড়তে পারেনা। যোগ-বিয়োগ দূরের কথা, একশো পর্যন্ত লিখতে পারেনা। আপনি বলুন – এখন আমরা কী করবো?……..?  আপনি মহান হয়েছেন, আপনার জীবন সার্থক হয়েছে। আর আমাদের ছেলেরা অন্ধকারে ডুবে গেল। ওদের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে গেল। …………।

যতই নির্দয় হোক, শ্রীকান্তবাবুর এখন এমন কান্না শোনার ইচ্ছে নেই। বরং ভেতরের ক্রোধ সংগোপনে চাপা রেখে সহজ-সরল হাসি মুখে অতিথিবৃন্দের মাঝে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন তিনি। তাঁর গলায় রজনীগন্ধার মালা। সামনের টেবিলে শোভা পাচ্ছে ‘শিক্ষারত্ন‘ উপহার।

……………………………………………………