Chokher Jol – চোখের জল


ছোট গল্প
(কল্পনাপ্রসূত এবং লেখকের নিজস্ব মতামত )


2014 সালের টেট হয়েছিল 2015 সালে। অর্পিতা পরীক্ষা দিয়ে এসে মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো – তোমার মামনি এবার শিক্ষিকা হবে। “তুই এতটা নিশ্চিত যে, ইন্টারভিউ-এ ডাক পাবি?” হ্যাঁ মা,আমি নিশ্চিত।

তবু অর্পিতা শিক্ষিকা হতে পারেনি। এখন সে তেমাথার মোড়ে চা বিক্রি করে। বাবার দু-দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। মা-ও নানান দুশ্চিন্তায় শয্যাগত । ছোট বোন মানসী

মাধ্যমিক পাশ করে আর স্কুলে যেতে পারেনি। বাড়ির যাবতীয় কাজ সে একা হাতে করে।

দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। চাকরিটা হয়নি বলে সে বিয়ে ভেঙে যায়। এখন অর্পিতা অবশ্য বিয়ের কথা ভুলে গেছে। বরং বোনকে বিয়ের জন্য শুধোয়। বোন কাঁদে আর বলে – না দিদি, মা-বাবাকে কে দেখবে? তুই সারাদিন দোকানদারি করিস্ ,আমি ঘর সামলাই। অসুস্থ মা-বাবার সেবা-যত্নটুকু করি। এ অবস্থায় আমি চলে গেলে তুই যে অথৈ সাগরে ভাসবি। “কাঁদিস না। তোর চোখের জল দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়। তুই আমার সাত বছরের ছোট আদরের ছোট বোন।” আর তুই যে রাত দুপুরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলিস্, কবিতা লিখিস্, তাতে কি আমার কষ্ট হয়না? আমি তোর ছোট বোন হলেও আমারও তো বোঝার বয়স হয়েছে। আমি সব বুঝি রে।

দিদি আর কথা বলেনা। গতরাতে দিদি যে কবিতাটা লিখেছিল বোন তা আবৃত্তি করে শোনায় :

জীবনে দুঃখ যতই আসুক

নীরবে সইতে যেন পারি।

আকাশ মেঘে যতই ঢাকুক

জোনাকি যেওনা মোদের ছাড়ি।

জন্মদাতা বাবা,জন্মদাত্রী মাগো,

জানি, কেউ চিরদিন বাঁচে না গো।

তবু তো তোমরা আছো সন্তানের বড় কাছে, 
সান্ত্বনা মোদের- আছি বটবৃক্ষের ছায়া তলে।

অর্পিতা কেঁদে ফেলে। দিদিকে দু’হাতে ধরে মানসীও কাঁদে। জিজ্ঞেস করে – ডাক্তারবাবু কী বলেছেন দিদি? “ বাবা ভালো নেই। মা-ও ভালো নেই।” বড় অসহায় মনে করে মানসী নিজেকে। দিদি শক্ত করে ধরে বোনকে। “ভয় পাস না ,আমি তো আছি।” মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও চাকরিটা তোর হলো না। চাকরিটা হলে আজ বাবা-মায়ের চিকিৎসা করাতে পারতাম। দিদি বোনকে বোঝায়, “ দুঃখ করিস্ না, তাতে যে দুঃখ আরও বাড়বে।” দিদি শুনলাম – বঞ্চিত যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা কোলকাতায় আন্দোলন করছে। “ হ্যাঁ রে ,আমারও সেই আন্দোলনে যোগ দেবার কথা। ভাবছি – রোজ না পারি, সপ্তাহে অন্তত:একদিন গিয়ে যোগ দেবো।” তাই যা দিদি। যেদিন যাবি সেদিন আমি দোকানটা চালাবো। সব সামলে নেবো। না হয় একটু কষ্ট হবে।

শুরু হয় অর্পিতার আরও এক কঠিন লড়াই। একটি মফস্বল শহর থেকে ভোর রাতে রওনা হয়ে একশো দশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হওয়া, সারাদিন পর ফের সান্ধ্য বেলায় ট্রেন ধরে রাত এক প্রহর শেষে বাড়ি ফেরা ,তারপর মা-বাবার যত্ন নেওয়া, বোনের অসমাপ্ত কাজে হাত দেওয়া, এই কষ্টকর জীবন সে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে। মানসী রাগ করে, দিদিকে বকে – সারাদিন কত কষ্ট করে এত রাতে বাড়ি ফিরিস্, তারপর আবার বোনের হাতের কাজটা কেড়ে নিয়ে করিস্ ,এতে কি আমার ভালো লাগে দিদি? “আমার আদরের বোনটা, আমি যেদিন না থাকি, কত ঝড় সামলায়! কত কষ্ট করে! তাতে কি আমারও ভালো লাগে?” মানসী গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে। দিদিও বোনকে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদে।

ক’দিন পরে খবর পাওয়া গেল – মহামান্য হাইকোর্টের একজন বিচারক এক শিক্ষিকার চাকরি বাতিল ঘোষণা করেছেন। সেই চাকরি ছিল যোগ্য একজনকে ঠকিয়ে পাওয়া । যোগ্য সেই যুবতীকে চাকরিটা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সহ। যার চাকরি বাতিল হয়েছে সে রাজ্যের এক মন্ত্রী-কন্যা।

আবারও ক’দিন পরে আরেকজন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। সেই স্থানে যোগ্য প্রার্থী বহালও হয়েছে। মানসী দুঃখ করে বলে , “ দিদি, অন্যায়ভাবে এভাবে কত চাকরি হয়েছে তার হিসেব কেউ করেছে?” হ্যাঁ ,সি বি আই আজ কোর্টে একটা রিপোর্ট পেশ করেছে। তাতে উপযুক্ত প্রমাণ সহ বলা হয়েছে – মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আট হাজারের উপর অযোগ্যদের নিয়োগ করা হয়েছে। সত্যি ভাবতে আমার অবাক লাগে ,গা শিউরে ওঠে। “আচ্ছা দিদি,প্রাইমারি স্তরে নিশ্চয়ই আরও বেশি অযোগ্যদেরকে চাকরি বিক্রি করা হয়েছে ,তাই না ?” তা তো অবশ্যই। না হলে মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে শত শত কোটি টাকা উদ্ধার হবে কেন? আর মন্ত্রী, মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ জেলেইবা যাবেন কেন? “মহামান্য বিচারক কি অযোগ্যদের চাকরি বাতিল করবেন?” জানি না কী হবে, তবে উনি কথা দিয়েছেন – কেউ ছাড় পাবে না। পাশাপাশি আমাদেরকেও ভরসা যুগিয়েছেন। বলেছেন আন্দোলন চালিয়ে যেতে। আমরাও শপথ করেছি -জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবো।
সামনেই শারদোৎসব। একটি দূরদর্শন চ্যানেল ইতিমধ্যে প্রায় সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে বিপুল সংখ্যক অযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকার পরিচয় পাওয়া গেছে। সাংবাদিকরা তাদের ইন্টারভিউ নিয়েছেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। প্রায় সকলেই উত্তর দিতে ইতস্তত বোধ করেছেন। লজ্জিত হয়ে মাথা নত করেছেন। এসব শুনে অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষ আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। সরকারকে প্রতিবাদের স্মারকলিপি দিয়েছেন। সংবাদপত্রের এই খবর আন্দোলনকারীদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
দু’দিন পরেই দেবীর বোধন। রাতে দোকানদারি করে বাড়ি ফিরে অর্পিতা বোনকে বলে – আজ ভোররাতেই আমাকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে বোন। জরুরি খবর এসেছে। পুলিশ জোর করে আমাদের আন্দোলন বন্ধ করে দিতে চাইছে। মানসী দু:শ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে। “ওরে দিদি, আমার মনে যে কু গাইছে। তুই যে আমাদের মাথার উপরের একমাত্র ভরসা।” বোকা মেয়ে,ভয় মানুষকে দুর্বল করে। দুর্বল হলে আমরা সামনের কঠিন পথে চলবো কী করে? বোনের মাথায় দিদি হাত বুলিয়ে দেয়।

আজ রাতে ঘুম আসেনি মানসীর চোখে। শেষ রাতে দিদি বেরিয়ে গেল ট্রেন ধরতে। বাইরে আগমনীর সুরে আকাশ মূখরিত।বাতাসে শিউলির গন্ধ। তবু এ বাড়িতে আনন্দের লেশমাত্রও নেই।

পরদিন দুপুরে মানসীর ভালো লাগছিল না। মোবাইলটা খুলল একরাশ আতঙ্ক নিয়ে। যে দুশ্চিন্তা করছিল তাই যে অমোঘ সত্য হয়ে ফলে গেল। দেখল পুলিশের নৃশংস বর্বরতা। আন্দোলনকারীদের মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে মারা হচ্ছে। কাউকে কিল, ঘুষি, লাথিও মারছে। কাউকে মৃত পশুর মতো পা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলছে। শোনা যাচ্ছে আন্দোলনকারীদের করুন আর্তনাদ। ওদের রক্তে স্নাত হয়েছে রাজপথ। তবুও ওরা ওদের দাবিতে অটল। “আমরা যোগ্য প্রার্থী, সরকার আমাদের চাকরি দিন। আমাদের ন্যায্য আন্দোলনে পুলিশি হস্তক্ষেপ বন্ধ করুন। আন্দোলন আমাদের নৈতিক অধিকার, কেড়ে নিতে পারেন না। ………..। ”

বাড়ি ফেরেনি দিদি। মানসী যেন একা কূলহীন অথৈ সমুদ্রের মাঝে এক মুঠ খড়কুটো আগলে ধরে আছে । বাবা উৎকন্ঠায় চেয়ে আছে। মা শুধোয় , “ কী রে, তোর দিদি এখনও ফিরল না কেন?” দু’হাতে বুকটা চেপে ধরে মানসী উত্তর দিল, “ মা, দিদি আজ ফিরবে না। জরুরি কী একটা দরকার আছে। ”
আজকের একটি জনস্বার্থ মামলায় কোর্ট কাল জরুরি ভিত্তিক তলব করেছে সরকারের মূখ্য সচিব এবং পুলিশের ডিজিকে।
রাত পোহাল। যথারীতি বেলা বারোটায় কোর্ট বসলো। মহামহিম বিচারক সরাসরি প্রশ্ন করলেন ডিজিকে, “চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায় সংগত আন্দোলনে অত্যাচার করলেন কেন?” “ধর্মাবতার ,আমরা হুকুমের গোলাম,তাই আর কোনো উপায় ছিল না।” “নিরীহ যুবক-যুবতীদের উপর নৃশংসভাবে লাঠি চার্জ করেছেন। মানবিকতার লংঘন নয় কি?” “ধর্মাবতার , পুনরায় বলছি – আমরা শুধুমাত্র উপরের নির্দেশই পালন করেছি।” এবার মূখ্য সচিবকে জিজ্ঞাসা – “আপনাদের সরকার কি গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা ভুলে গেছেন ?” “ হুজুর, আসলে শারদ উৎসব চলাকালে রাজপথে আন্দোলন চলুক ,সরকার তা চায় না। তাতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।”যোগ্যদের বঞ্চিত করে হাজার হাজার অযোগ্যদের চাকরি দিয়েছেন,তাতে কি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে?” সচিব নিরুত্তর থাকেন। “আমি নির্দেশ দিচ্ছি – যাদের ধরে নিয়ে লক আপে পুরেছেন ,অবিলম্বে তাদের মুক্তি দিন। যোগ্য চাকুরীপ্রার্থীরা উৎসবের মধ্যেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবে। আর আপনাদের নিশ্চিন্ত হবার কোনো কারণ নেই যে,অন্যায়ভাবে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পাওয়া চাকরিগুলো টিকে থাকবে।” “ হুজুর, সরকার মানবিক ,চায়না কারও চাকরি চলে যাক্। ইতিমধ্যে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে তাতে রাজ্যজুড়ে কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। চাকরি চলে গেলে চোখের জলে সুনামির আকার ধারণ করবে। ”

ভাষ্য শোনামাত্রই বিচারপতি ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে রুমালে চোখ মুছে নিলেন। তারপর বললেন – “অপরাধের অকুন্ঠ স্বীকৃতি ! আপনারা অপরাধীদের চোখের জল দেখলেন। যারা নিরাপরাধী ,রাজপথে বসে অবিরাম কেঁদে চলেছে ,তাদের চোখের জল দেখতে পেলেন না ?” এরপর তিনি এজলাস ছেড়ে চলে গেলেন।

আহত অর্পিতা বাড়ি ফিরল দিনের শেষে। স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল মানসীর। আনন্দের অশ্রু তার দুচোখের কোণে ।

…………………………………………………..