আঁধারেও অমলিন দাদাঠাকুর (50 বছর পরেও)




হরবিলাস সরকার

কোন কোন মানুষ তাঁর জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মহান কৃত কর্মের দ্বারা সাধারণ
থেকে অসাধারণে
 পরিণত হন । তিনি হয়ে ওঠেন মাইলফলক,পাথেয়। তিনি অন্ধকারে আলো,দুঃখের মাঝে সান্তনা, বন্ধুর পথে চলার প্রেরণা তাইতো তিনি আঁধারে অমলি। তিনি শরৎচন্দ্র পণ্ডিত
আমাদের সকলের ঠাকুর।

উত্তাল সাগরে মিলেছিল মৃদুস্রোতা নদী :-

     আমাদের দেশে বাংলার নবজাগরণ ছিল চেতনার সর্বাগ্রগণ্য
এক ইতিহাস । রাজা রামমোহন রায় ছিলেন তাঁর প্রথিকৃৎ। তাঁরই ধারাবাহিকতায়
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরিণত হয়েছিলেন নবজাগরণের অন্যতম অভিব্যক্তি রূপে
,আর দাদাঠাকুর সেই
অভিব্যক্তিরই ক্ষুদ্র হলেও উৎকৃষ্ট রূপ। দুজনেই জন্মেছিলেন গ্রামে
দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারে । দুজনেই তেজস্বী
, সত্যনিষ্ঠা,কর্তব্যকর্মে, আর্দশের পথে ছিলেন
অবিচল । একজন ছিলেন রোদনপ্রবণ
,আরেকজন হাসতেন। জীবনের কোনো প্রতিকুলতা তাঁদের কর্তব্য হতে পারেনি দমাতে ।
একজন ছিলেন উত্তাল সাগর
, আর একজন মৃদুস্রোতা নদী ।

একই দারিদ্র-বৃন্তে দুটি কুসুম :-

         ‘হে দারিদ্র্য তুমি
মোরে করেছ মহান
’ – সাম্যবাদী কবি
নজরুলের এই উক্তি যেন মুহূর্ত হয়েছিল দাদাঠাকুরের ভেতরে। তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ
কর্মপন্থা স্থির করেছিলেন যুগ চেতনার আলোকে। স্বাধীনচেতা সত্যনিষ্ঠ এই মানুষটি
জীবনে কষ্ট সহ্য করেছেন তথাপি কারো অধীনে চাকুরীর দাসত্ব পছন্দ করেননি। তিনি তাঁর
গড়া আদর্শপথে আজীবন পা ফেলেছেন নিঃস্বার্থভাবে। তাঁর রচনার শিল্প-উৎকর্ষ কোনও
শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতনা সত্য কিন্তু তাঁর সার্থকতা কথা ছিল যুগানুগত পরিবিদ্ধ
ক্ষমতায়। তাঁর কবিত্ব ছিল কশাঘাত প্রধান। তাঁর ভাষা ছিল কৌতুক পূর্ণ
, গ্রাম্য কিন্তু
অশ্লীলতা-বর্জিত
, চটুল অথচ মর্মভেদী।
তিনি ছিলেন স্বাধীনতাঁর
, জাতীয় মুক্তি চেতনার, ধর্মের কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের, সামাজিক অসাম্যের প্রতি অঙ্গুলি সংকেতের মূর্ত প্রতীক। সত্যের পূজারী, নির্লোভ, নীতিপরায়ণ এই
দাদাঠাকুরের খোঁজখবর রাখতেন রবীন্দ্রনাথ । গভীর সম্পর্ক ছিল কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ।

জীবন প্রভাতে:-

       পথ চলা শুরু
হয়েছিল দুঃখের বোঝা বয়ে। সেই শৈশবেই হারিয়েছেন বাবা-মাকে। বুকে তুলে নিয়েছিলেন
জঙ্গিপুরের দফরপুর নিবাসী কাকা রসিকলাল। সামান্য একটি পল্লী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন
তিনি। সামান্য আয়। পিতৃস্নেহে কঠোর অনুশাসনে পালন করতে লাগলেন শরৎকে। শরৎ তাকে
বাবা বলেই ডাকতো। রসিকলাল শরৎকে মানুষ করবার জন্য বিয়ের বাসনা ত্যাগ করলেন। তাঁর
অন্তর কোমল হলেও নীতি পরায়নতা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে কোন আপোস ছিল না। সংসারের
সহস্র অস্বচ্ছলতা তাকে তাঁর সত্যবাদিতা
, নীতিনিষ্ঠা, আদর্শের পথ থেকে
বিচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর সংযম
, কষ্টসহিষ্ণু তাঁর পরাকাষ্ঠার শিক্ষা শরৎ যেন পায়-এই ছিল অভিপ্রায়।বাল্যের
চঞ্চলতায় একদিন হয়তো শরৎ একটু অবাধ্য হয়ে পড়েছিল
, তাই কাকা খড়ম দিয়ে
আঘাত করেছিলেন। নিভৃতে সেই ব্যথা সয়েছিলেন কাকাও । শরৎ পেয়েছিল মানুষ হবার
শিক্ষা।

কৃচ্ছ্রসাধনের শিক্ষা :-

       তপ্ত বালির চরের
উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হতো বালক শরৎকে। কষ্টের কথা একদিন বলে কাকাকে।
কাকা এলাকার এক স্যাকরাকে খবর দিয়ে ডেকে আনলেন। শরৎ খুশি হয়ে ভাবছে – এবার বুঝি
তাঁর সোনার জুতো গড়িয়ে দেবেন কাকা। স্যাকরা ক্রাচে ভর করে সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তাকে দেখিয়ে কাকা বলেন –
শরৎ, ওর একটা পা নেই, কাঠের পায়ে হাটে।
তোমার দুটো পা আছে। তাতোও তোমার কষ্ট হয়
?” সারা জীবন আর জুতোর কথা ভাবেনি শরৎ। জুতো কেন,একটা জামাও কাকা তাকে কিনে দেননি। ভ্রাতুষ্পুত্রের
কাঁধে একটা সাদা ও উড়ানী
, সাদা থান কাপড়, গামছা ছাড়া আর কোনো পোশাক কিনে দেননি। এর জন্য শরৎ কোনদিন কখনো অভিযোগ করেনি।

     একদিন কাকার সঙ্গে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে সে একটু বেশি
পরিমাণে ভাত খেয়ে ফেলেছিল। শেষে পরিবেশনকারী পরমান্ন নিয়ে এলে তা আর খেতে পারল
না। ফেরার পথে বেরিয়ে এসে কাকা বললেন –
শরৎ আজ যেমন অন্ন বেশি খেয়ে পরমান্ন খেতে পারলে না, তেমনই অর্থ, অর্থ বেশি করলে
পরমার্থ মেলে না।
এই শিক্ষাই শরৎকে
পরবর্তী জীবনে নির্ভীক
, নির্লোভ, পরার্থপর, সততার উদাহরণ, সংকল্পে দৃঢ  হবার পথ খুলে
দিয়েছিল। মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী বলতে যা যা বোঝায় তা অর্জন করার পথ সুগম
হয়েছিল
  বিবেক মনুষ্যত্বের বিচারধারার মধ্য দিয়ে, পরিবেশের
দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে
, দুঃখ জয়ের মধ্য দিয়ে। দুর্যোগ, অন্ধকারময় পথে পথে আলো দেখিয়েছিলে কাকা।

সাগর পাড়ে নুড়ির খোঁজে:-

      একদিন প্রবল বৃষ্টি
পড়ছিল । বিরাম ছিল না। খড়ের চাল ভেদ করে বৃষ্টির জল পড়ছিল। শরৎ নিরুপায় নিরুপায়
হয়ে ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণে বিছানা সরাচ্ছিল। সরাতে সরাতে জ্যামিতির অংশবিশেষ
মস্তিষ্কে এসে ধাক্কা মারল। বোঝার চেষ্টা করল । বুঝল। পরবর্তীতে তা নিজের মুখের বর্ণনায়
পাওয়া যায় – দেখলাম
, এক কোণ আর এক কোণের সমান এবং সব কোণ সেই কোণের সমান। অতএব, কোণগুলো পরস্পর
সমান।

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে :-

       প্রথাগত শিক্ষা
তাঁর বেশি দূর হয়নি
, দারিদ্র করেছে বঞ্চনা। জঙ্গিপুর হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করিয়ে কাকা
তাকে বর্ধমানের এক কলেজে
F.A পড়তে পাঠিয়েছিলেন । দু-তিন মাস চালিয়েওছিলেন। পরে মাইনের অর্থ যোগাতে না
পারায় আবার ছাড়িয়েও নিলেন। ছাত্র হিসেবে শরৎ ভালোই ছিল । সেসময় একটা যে কোন
চাকরি পেতে এই লেখাপড়াটুকু যথেষ্টই ছিল। কিন্তু কাকা একদিন বললেন
, “শরৎ, গোলামির চেযে আনাহার
শ্রেয়।
বহুজন শরৎকে  চাকরি দিতে পারত
কিন্তু সে আর কারুর অধীনে খুব সম্মানিত পদেও চাকরির জন্য খোসামুদি করেনি । কাকার
দেখানো পথই গ্রহণ করল এবং স্বাধীন বৃত্তির চিন্তায় মনোনিবেশে
  গভীর ভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল। স্থাপিত হয়েছিলপন্ডিত প্রেস

সংসার নদীতে ভাসলো তরী আদর্শের পাল তুলে :-

       এবার কাকার
অনুমতিতেই সংসার ধর্ম পালন। সংসারী হয়ে শরৎচন্দ্র দফরপুরেই অবস্থান করলেন। মিশলেন
অন্তরঙ্গভাবে গ্রামের দরিদ্র কৃষক – শ্রমিকদের সাথে। ভালোবেসে
, একান্ত আপনার মনে
করে তাঁরা শরৎচন্দ্র কে বলতো
দাদাঠাকুরসেই থেকেই
শরৎচন্দ্র পণ্ডিত হয়ে উঠলেন
দাদাঠাকুরতিনি লালিত হয়েছেন
কবি – আলকাপ – গাজন – মনসা – বাউল – ফকিরের লোকায়ত বৃত্তে । সত্যিই আমজনতাঁরই
তিনি দাদাঠাকুর।
       তিনি তাঁর স্ত্রী
পুত্রদের ও অতি সামান্য প্রয়োজনীয় বস্তু ছাড়া বিলাসিতা করার সুযোগ দেননি। শোকে
, দুঃখে কেউ আচ্ছন্ন
হয়ে থাকলে দাদাঠাকুর প্রতিদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে সান্ত্বনা দিতেন । বড়লোক
, গরিব সকলকে সমভাবে
দেখতেন ।

       দারিদ্র ছিল তাঁর
নিত্যসঙ্গী। সপ্তায় সপ্তায় কলকাতা যেতেন পত্রিকা বিক্রি করতে। সেখানে ট্রামে
তিনি সেকেন্ড ক্লাসে চড়তেন। বলতেন –
গরীবরাই আমার নিজের শ্রেণীর , মূটে-মজুররা আমার সগোত্র, আমি তাদের গায়ের ঘামের গন্ধে আরাম বোধ করি। প্রথম শ্রেণীর স্নো, পাউডার, এসেন্সের  গন্ধে অস্বস্তি বোধ
করি।
চিরকাল নগ্নপদ, নগ্ন গাত্র
ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের বেশি অংশ চাষী
, মুটে, মজুরদের মত
বাহুল্যহীন জীবনই ছিল তাঁর আদর্শ।

দুঃখকে স্যাটায়ার:-

     দুঃখের সাপ আছে তাঁরবিদূষকপত্রিকায়। এই পত্রিকার উপর লেখা থাকতো –ধামাধরা উদারপন্থী দলের সাপ্তাহিক মুখপাত্র। থাকতো
বিদূষকের চেহারার কার্টুন। কার্টুনের ভাঁজ পড়া কপালে লেখা থাকতো
দুঃখ’, বুকে লেখা থাকতোদুরাশা’, পেটে –উদর রে তুঁহু মোর
মন বড়ি দুশমন
’! তাঁর চলার পথ
বন্ধুর
, কন্টকাকীর্ণ হলেও
এগিয়ে চলেছেন মাথা সোজা করে । কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেননি ।

খাঁটি এক মানুষ:-

    দুঃখ – দারিদ্র্যের যন্ত্রণা তাঁর আনন্দ কেড়ে নিতে পারেনি।
কলকাতাঁর রাস্তায় তাঁর
বোতল পুরাণপত্রিকা বিক্রি
করতেন গান করে করে। সেই এক অনাবিল আনন্দ গানের ছন্দে
, তালে ধরা পড়ে
——–

আমার বোতল নিবি কে রে?
এই বোতলে নেশাখোরের নেশা যাবে ছেড়ে ।
বোতল নিবি কে রে?
অথবা
হিউমার স্যাটায়ার উইট আর  ইন মাই পাবলিকেশন ।
জেন্টেলম্যান, টেক দ্য বটল ফর ইওর রিলাক্সেশন। ।
অথবা
কালা এইসা বোতল মে
লাল রঙকে মাল ।
দো আনা পৈসা দেকে
পিয়ালামে ঢাল । ।
—————————————————————–
——————————————————————
।।

     এগিয়ে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র । নিজের পকেটের টাকা খরচ
করে
বোতল পুরাণহকারির লাইসেন্স
তাঁকে করিয়ে দিয়েছিলেন ।

     দুঃখ- কষ্ট কখনো
প্রতিকূলতা হয়ে দাঁড়ায়নি তাঁর সামনে। সব বাধা তিনি জয় করেছেন দৃঢ় প্রত্যয় আর
হাস্যরসের মধ্য দিয়ে। প্রবল অর্থ কষ্টের কথা তামাশার ছলে বলতেন —
ছেলেবেলায় কালা
জ্বর হয়েছিল।
Antimony Injection দিয়ে রোগ সারলো, কিন্তু ‘Anti-money’ ব্যাধিগ্রস্থ হলাম।তাঁর কখনো মানি ব্যাগ ছিল না। বলতেন —আমার অ্যাকাউন্ট খোলা আছে রিভার ব্যাঙ্কে । এ ব্যাংকে আবার কারেন্ট একাউন্ট
করা সোজা নয়। ফ্লোটিং অ্যাকাউন্ট
, সিংকিং ফান্ড সব আছে।
    
কর্তব্যনিষ্ঠার এক উজ্জ্বল নিদর্শন:-

     একটি স্কুলের প্রশ্নপত্র চেপে দেওয়ার বরাদ্দ
পেয়েছিলেন তিনি । সময় মত প্রশ্ন পত্র গুলো ছেপেও ফেলেছিলেন । হঠাৎ ঘনঘোর বর্ষা
নেমে বিপত্তি ঘটাল । বর্ষার দাপটে রেলপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ।
30 মাইল দূরের সেই
স্কুল । কীভাবে পৌঁছানো যাবে ! কিন্তু পৌঁছাতেই যে হবে । শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা
শুরুর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই
30 মাইল পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছে দিয়েছিলেন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ।

কবি মনীশ ঘটক যথার্থই লিখেছিলেন —

চারিত্র্য দুর্ভেদ্য বর্ম, নির্লোভ ব্রাহ্মণ
জ্বলিত তোমার ভালে হরকোপানল !
কপর্দকহীন তুমি, যবে নিঃসম্বল
হেলায় ঠেলেছো পায়ে সর্ব প্রলোভন ।

বিপদের হাতছানি তবু নিবেদিতপ্রাণ আর্তের সেবায়:-

     বহু যক্ষা, কলেরা রোগীর শুশ্রূষা করতে হয়েছে তাঁকে । বৃদ্ধ পিতার কন্যার আবেদনে সাড়া
দিয়ে তাকে আনতে তিনি ছুটেছেন অসমের পার্বত্য অঞ্চলে । কেউ যেতে চাইছে না
, অথচ তিনি গেলেন
ছোঁয়াচে যক্ষা রোগীকে নিয়ে মাদ্রাজের মদনাপল্লীর হাসপাতলে পৌঁছে দিতে । এভাবে
তিনি কত শত
, সহস্ত্র জনের
উপকারে লেগেছেন তাঁর ইয়ত্তা নেই । নিজে বনেদী কাঙাল হয়েও প্রয়োজনে অন্যকে
নির্দ্বিধায় দান করেছেন । তাঁর মহত্ব কে ভুলতে পারে !

আত্ম-মর্যাদার এক পরিচয়:-

     জঙ্গীপুর হাইস্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক শ্রদ্ধেয়
ন্যাংটেশ্বর তর্ক চূড়ামণি অবসর গ্রহণের পর তৎকালীন বিদ্যালয় সম্পাদকের কাছ থেকে
10 টাকা করে অনুদান
পেতেন । পরবর্তীতে সেক্রেটারি পরিবর্তন হলে নতুনজন এসে তা বন্ধ করে দেন।
তর্কচূড়ামণি মশায় তখন পরিচালক কমিটি সদস্যদের দেওয়ার জন্য সংস্কৃতে লেখা একটি
আবেদনপত্র পন্ডিত প্রেসে ছাপাতে আসেন । দাদাঠাকুর তাঁর শিক্ষক মশাই – এর
দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে দরখাস্তটি ছিঁড়ে ফেলে দিলেন আর শিক্ষকমশাইয়ের বাড়িতে
মাসের পয়লা তাঁরিখে দশ টাকা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেন।

পণ প্রথার বিরোধিতা ছড়ার গানে:-

     পণপ্রথার বিষক্রিয়া নিয়ে দাদাঠাকুর গান লিখলেন এবং
গাইলেন
, যেন সদ্য বিবাহিতা
নতুন বউ তাঁর স্বামীকে বলছে-
তুমি প্রভু, আমি দাসী, আমি স্ত্রী, তুমি স্বামী।
কারণ তোমার বাবা মহাজন, আর আমার বাবা আসামী । ।
মুখে বলেন –বেহাই বেহাই’ , অল্পে কিন্তু দেননি
রেহাই
,
তাঁর মুখে মধু,অন্তরে বিষ,ব্যবহারে চাষামি ।।
——————————————————–
—————————————————-
পিতৃগন তো আমার গুরু, আমার প্রেমের কল্পতরু।
গরুর গুরু পরম গুরু – শ্বশুরমশাই জল্লাদ।

পর্দা প্রথার বিরোধিতা তালে ও ছন্দে:-

দাদাঠাকুর পর্দাপ্রথাকে সমর্থন করতেন না । তুরস্কের কামালপাশা বোরখা প্রথা
তুলে দিলে তিনি তাতে সমর্থন জানিয়ে লিখলেন —-

‘………………………………………………………………
……………………………………………………
পর্দা প্রথা গর্দা জিনিস, এ যুগের তা চলবে না,
ঘোমটা -আড়াল না ছাড়ালে আর তো সুফল ফলবে না ।
নারী জাতির কাছে যদি কর্ম চাহা অধিক আর
পুরুষ লোকের সমান তাদের দিতে হবে অধিকার।

নিদারুণ শোকে – দুঃখেও নিরুদ্বিগ্নমনা :-

     দাদাঠাকুরের এক ছেলে  টাইফয়েডে মারা গেছে । স্ত্রী শোকে বিহ্বল। চিতায়
পুড়ছে পুত্রের শবদেহ । তিনি শ্মশানে বসে প্রাণ খুলে গাইছেন —-

দুঃখ দিয়ে বুক ভাঙবে তুমি তাই ভেবেছো ভগবান !
আমি মার খাবো তাও কাঁদবো নাকো, পরান খুলে গাইবো
গান
 । ।
তোমার দেওয়া তোমার নেওয়া, আমার এতে কি লোকসান?
…………………………………………………………………
……………………………………………………………………
তোমার ভান্ডারের দুঃখ করে খালি, করব দুঃখের অবসান।

তিনি হারিয়েছেন একাধিক সন্তানকে । মৃত্যুর মিছিল তাঁর হৃদয়কে পাথরে পরিণত
করেছে । তথাপি বাইরে তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত
, বোঝার উপায় ছিল না।

একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য লাভ :-

সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর ছিল আন্তরিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক
। নজরুলের প্রিয় পুত্র বুলবুল
6 বছর বয়সে মারা গেলে তাঁর শেষ কাজটুকু করেছিলেন দাদাঠাকুর নিজে । এমন
মানবতাবাদি উদার
 মানুষটিকে নজরুল তাঁরচন্দ্রবিন্দুবইটি উৎসর্গ করে
লিখেছিলেন —–

হে হাসির অবতাঁর ! / লও গো চরণে
ভক্তি প্রণত কবির নমস্কার ।

বুলবুলের মৃত্যু – শোকের করাল ছায়া কবিকে মৌন, ম্রিয়মান করে তুলেছিল । কিন্তু সেই ছায়া ভেদ করে
বেরিয়ে এলো উজ্জ্বল হাসির রশ্মি প্রবাহ । যেন যেতে চাইছেন উত্তরণে
, সময়ের জীবন
ছাড়িয়ে চিরায়ত জীবনে। আর তাঁর মানসের দোসর হিসেবে ধরা পড়েছেন দাদাঠাকুর ।
তাইতো এই উৎসর্গ ।

দেশাত্মবোধ :-

স্বদেশের বিপ্লবীদের প্রতি দাদাঠাকুরের ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি
তাঁর রঘুনাথগঞ্জের প্রেসে বিপ্লবীদের আশ্রয় ও আত্মগোপন করে থাকতে দিতেন । পুলিশের
চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি এই কাজ করতেন । তাঁর একটি বিশেষ গুণ ছিল। কোন সিরিয়াস ও
গম্ভীর ঘটনাকে তাঁর স্বভাবসুলভ রসিকতার আড়াল দিয়ে সমাধান করতে পারতেন । একটা
উদাহরণ দিই। নলিনীকান্ত সরকার তখন দাদাঠাকুরের প্রেসে কাজ করে। আবার কাশি
ষড়যন্ত্র মামলায় পলাতক আসামি বিপ্লবী গোপেশ চন্দ্র রায় নলিনী সরকারের কাছে আসে
এবং দাদাঠাকুর তাকে আত্মগোপনে সহায়তা করেন। ইংরেজ গোয়েন্দা পুলিশ দাদাঠাকুরকে এ
ব্যাপারে সন্দেহ করে থানায় তলব করল। সচেতন দাদাঠাকুর একেবারে নির্বোধের মত
স্বরভঙ্গিসহকারে অভিনয় করে
, যুক্তি অথচ তামাশার ছলে কথার মারপ্যাঁচে গোয়েন্দাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

নলিনী সরকার আপনার প্রেসে কাজ করে ? কেমন লোক সে ?”
অনর্থক এ প্রশ্ন করছেন, খারাপ লোক জেনে কেউ কাউকে নিজের কাছে রাখে?”
————————————————————————————————-
————————————————————————————————-
“—– এই যে দেশে স্বদেশী
আন্দোলন হচ্ছে
, সেই সব দলের সঙ্গে
ওর কোন যোগ আছে কিনা
, বলতে পারেন ?” “——-এ কথা সবাই জানে। ও
স্বদেশী গান গায়
,——-” “সে স্বদেশীর কথা
আপনাকে জিজ্ঞেস করছিনে
, সে বিপ্লবী দলের লোক কিনা বলতে পারেন?” “——নলিনী তো বিপ্লবীই
। ——- দেখুন
, আমাদের দেশে চোরে
চোরে মাসতুতো ভাই বলে একটা কথা চলিত আছে। ওর মাসতুতো ভাই যখন বিপ্লবী দলে ইন্টার্ন
হয়ে আছে
, তখন নিশ্চয়ই ও
বিপ্লবী।
” “…….?” “….. গোয়েন্দারা ভাবলেন, কিছুতেই
দাদাঠাকুরকে বোঝানো যাচ্ছে না। তাই এবারে গোপেশচন্দ্র রায়ের বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন
, “25 – 26 বছর বয়স, গায়ের রং কালো, চোখে চশমা, সামান্য ফ্রেঞ্চ
কাট দাড়ি – এরকম চেহারার কোন লোক আপনার ছাপাখানায় নলিনী সরকারের কাছে আসে
? ” “আজ্ঞে আসে।উৎসাহিত হয়ে
প্রশ্ন:
কে সে? নাম তাঁর জানেন?” “আমাদের সুশীল
মোক্তার। সবে মোখতারি পাস করেছে । আপনি যেমনটি বললেন
, সুশীল মোক্তার
দেখতে ওই রকম।

এবার গোয়েন্দারা হতাশ হয়ে দাদাঠাকুরকে বিদায় দিলেন।

মানবতায় বিশ্বাসী:-

ধর্মের উপাসক তিনি ছিলেন না। পুজো – আহ্নিক করা, ব্রতাতি পালন, উৎসব এসবে তাঁর বাসনা ছিল না। মন্ত্রেদেহি দেহিবলতে হবে বলে
দেবতার উপাসনা অপছন্দ করতেন। আসলে প্রকৃত বাস্তবতাকে জীবনে গুরুত্ব দিতেন। তাঁর
জীবনের মূলমন্ত্র ছিল
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।মানবিক ধর্মই ছিল তাঁর কাছে প্রকৃত ধর্ম। তবে প্রচলিত ধর্ম কে তিনি অবজ্ঞাও
করেননি । তিনি যুক্তি দিয়ে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করেছেন। জগত সংসার যে নিয়মের দ্বারা
পরিচালিত তা প্রকৃতির নিয়ম
, সেখানে অদৃশ্য কোন কাল্পনিক শক্তির হাত নেই,  তা বিজ্ঞানের নিয়ম – এই চিন্তা তাঁকে কুসংস্কারমুক্ত
করেছিল। ছেলের অসুখ ভালো করে দিতে তাঁর স্ত্রী মা দুর্গার কাছে মানত করার কথা
বলেছিলেন। শুনে দাদাঠাকুর বলেছিলেন
, “যিনি নিজের ছেলের (গণেশের) শুঁড় ভালো করতে পারেন না, তিনি তোমার ছেলের
কি করবেন
?”

তিনি বুঝেছিলেন – বিশ্বপ্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ । সেই মানুষের জ্ঞান, চিন্তাকেই
প্রাধান্য দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি ।
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই” – এই ছিল তাঁর মর্ম কথা।
পরাধীন ভারতের ঘুম ভাঙুক, এঁকেছিলেন লেখনীর ভাষায় :-

পরাধীনতার গ্লানি, মানুষের দুঃখ- দুর্দশা তাকে ভাবিয়ে তুলত । তাঁরজঙ্গিপুর সংবাদপত্রিকায়
সম্পাদকীয়তে বারে বারে তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যেত । জাতীয়তাবাদী প্রসঙ্গ ও
স্থানীয় বহু সমস্যার কথা উঠে আসত ।
1929 সালে দেশের দশশীর্ষক
সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন –
যে দেশবাসী ভারতবাসীদের মানুষের অধিকার দিতে একেবারেই গররাজি, ভারতবাসীকে যাহারা
ঘৃণা করে
, সেই দেশবাসীর অজস্র
কোটি কোটি টাকার পণ্য ভারতের বাজারে স্বচ্ছন্দে বিক্রিয়া যাইবে
, ভারতবাসী তা হাসি
মুখে কিনিবে
, বিলাস ও আনন্দের
দ্রব্য করিবে
, তাহাদের পণ্যের
বাজার এখানে তাহারা জোর করিয়া চালাইবে
, দেশবাসী ও দেশের বিধি-বিধান তাহাদের বাধা দিবেনা, এমনি চমৎকার
বিচিত্র দেশ ভারতবর্ষ। চোখের উপর এইসব দেখিয়া – শুনিয়াও দেশবাসী চুপ করিয়া
থাকে। জাতির ধৈর্য ও মোহ ইহাদের জড়তা ভাঙ্গিয়া এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে
দাঁড়াইবার সাহস দেয় নাই। তাই অন্যায় দেশবাসীর ঘাড়ে ক্রমশঃ আরো হাঁকিয়া
বসিতেছে ।

    ‘বিলাতি দ্রব্যের আমদানিশীর্ষক আরেকটি
সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন —–
 “…… আম আমাদের ঘুম কি ভাঙিবে না ?…… আমরা শ্রমজীবীরা
ন্যায়কলের কুলি হইব
আর শ্রমের কড়ি জীবনের প্রয়োজনে বিদেশীর  নিকট খরিদ করব – ইহা অপেক্ষা অদ্ভুত কথা আর কি হইতে পারে?”

    লবণ সত্যাগ্রহের সমর্থনেলবণ যুদ্ধশীর্ষক
সম্পাদকীয়তে লিখেছেন –
“……. মহাত্মা জনসাধারণের দুঃখকে অবলম্বন করিয়াই আজ এই লবণ সত্যাগ্রহে আত্মনিয়োগ
করিয়াছেন।……. । সত্যের প্রতি যাহার চরম নিষ্ঠা
, ঈশ্বরের প্রতি যাহার অটল বিশ্বাস রহিয়াছে তাহার জয়
অবশ্যম্ভাবী।

    কেননা, দাদাঠাকুর ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছেন  ‘জীবে প্রেম করে যেই জনসেই জনের মধ্যে। প্রেমের শক্তিই হলো ঐশ্বরিক শক্তি। মানুষের শুভশক্তিই চিরকাল
অশুভকে পরাস্ত করে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। সেই শুভশক্তির ধারক যিনি
, তিনিই ঈশ্বর ।

সততা ও মহত্ত্বের পরিচয় :-

এক সময় দাদাঠাকুর একটা উন্নত প্রেসের দরকার পড়লে কিছু টাকা জোগাড় করে কলকাতা
গেছিলেন এক প্রতিষ্ঠানে। ঘটনাচক্রে মালিক এক ইংরেজ সাহেব। সাহেব প্রসন্ন হয়ে
লেখা- পড়া চুক্তি ছাড়াই কিস্তিতে একটা মেশিন দিতে রাজি হন দাদাঠাকুরকে। আর বলেন
তোমার আমার দুজনের মৃত্যু হলেও আমার উত্তরাধিকারীকে তোমার উত্তরাধিকারী ঋণ শোধ করে
দিতে পারবে। দাদাঠাকুর এই প্রস্তাব সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন । পরে ওই
সাহেবের সাহায্যেই অন্য জায়গা থেকে পছন্দমত মেশিন নিজের নামে কিনে আনেন । তাঁর এই
আদর্শ তাঁর সততার
, মহত্ত্বের পরিচয়।

    আবার পন্ডিত প্রেস যখন ভালভাবে চলছে তখন লালগোলার
মহারাজা যোগীন্দ্র নারায়ন রায়
, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্র নারায়ন রায় , কুচবিহারের মহারাজা, জবাকুসুমের সেনরা দাদাঠাকুরকে বেশ কিছু পরিমাণ আর্থিক
সাহায্য করতে চেয়ে ছিলেন । তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন ।
জীবনে বাড়তি সুযোগ অথবা সাহায্য তিনি কোনদিনই কারও কাছ থেকে চান নি । এও তাঁর
মহত্তম আদর্শের পরিচয়।




শতবর্ষ পেরিয়েপন্ডিত প্রেসজঙ্গিপুর সংবাদ’ :-

আর ইউ কামিং ফ্রম জাঙ্গল?
ইউ আর রাইট, আই অ্যাম কামিং
ফ্রম জাঙ্গল।
তুমি কি চাও?
একটি মেশিন কিনতে এসেছি।
কি করো তুমি?
আমি একজন জংলি কাগজের জংলি এডিটর।

     কথোপকথনের ওপ্রান্তে ছিলেন এক ব্রিটিশ সাহেব(
ব্যবসায়ী) আর এ প্রান্তে খালি গা
, খালি পা, হাঁটুর উপরে ধুতি, কোঁচা কোমরে বেড়
দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা। তাঁর এক হাতে টিনের চোঙার মতো একটা বাক্স
, অন্য হাতে
কলিকাশীর্ষ হুক্কা ও ব্যাগে ছাতা।

    সাহেবের চোখা ইংরেজির চোখা জবাবে কোন ঘাটতি নেই ।
কৌতুহলী সাহেব টিনের বাক্স দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- হোয়াট ইজ দিস
? ইট ইস স্মোকিং
অ্যাপার‍্যাটাস।

    সাহেব খুশি হলেন। কম দামে ধারে একটি মেশিন দিতে চাইলেন।
দাদাঠাকুর রাজি হলেন না। পরে অবশ্য নগদে একটি পুরনো মেশিন সাহেবই ব্যবস্থা করে
দিয়েছিলেন। শুরু হলো সংবাদপত্র ছাপাখানার কাজ ।
1914 সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলজঙ্গিপুর সংবাদদাদাঠাকুর নিজেই
ছিলেন পত্রিকার এডিটর
, কম্পোজিটার, প্রফরিডার, প্রিন্টার ও
ডেসপ্যাচার । এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত ইতিহাস
, কত কাহিনী । 1968 – এর 26 জুন দাদাঠাকুর
প্রয়াত হন। তারপর থেকে তাঁর উত্তর পুরুষেরা পত্রিকা দায়িত্বভার বহন করে আসছেন।

তাঁর শিল্প – প্রতিভা বহু ধারায় বিকশিত:-

পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন ছড়া,দুরন্ত গান, কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক ছড়া, তৈরি করেছেন শব্দ ও
বাক্য নিয়ে নানা খেলা। মুখে মুখে ছড়া বানানোর বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল তাঁর। তাঁর
খোকার ভোটছড়াটি সেসময়
বাবা-মায়েদের মুখে মুখে ঘোরাফেরা করত ——

খোকা যাবে ভোট নিতে / দুলে বাগদি পাড়া, / কেউ তোমরা ভোট দিও না / আমার খোকা ছাড়া ।./…… / সঙ্গে যাবে কে ? / বাড়িতে আছে ঝামা
চাকর / সঙ্গে চলেছে । /…../.. ভোট দিয়ে যা।
তাঁরকলিকাতার ভুলছড়াটি
রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা কুড়িয়েছে ।
মরি হায়রে, কলকাতা কেবল ভুলে
ভরা
, / সেথায় বুদ্ধিমানে
চুরি করে
 / বোকায়  পড়ে ধরা /………../……../….. ।

অর্থ সম্পদে দরিদ্র হলেও অন্তর সম্পদে বিত্তবান:-

কষ্ট সহিষ্ণু নির্লোভ এই মানুষটি, অন্তরের বিপুল ঐশ্বর্যে ছিলেন বিত্তবান । তাঁর ডিগ্রী লাভে, পাঠ্য পুস্তকের
জ্ঞান আহরনে দারিদ্র করেছে বঞ্চনা ঠিকই
, তবে বাস্তবের জ্ঞান ভান্ডার ছিল বিস্তীর্ণ । সেকারণেই বাকযুদ্ধে তিনি ছিলেন
অপরাজেয়। তিনি অনায়াসে বাংলা
, ইংরেজি, হিন্দি ও সংস্কৃত
শব্দ ও বাক্য নিয়ে মজার খেলা খেলতে পারদর্শী ছিলেন। ছিলেন প্রাণবন্ত
, রসবন্ত, তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে
ও রঙ্গরসিকতায় পরিপূর্ণ । তিনি শুকিয়ে যাওয়া ঘাসে ফুল ফোটাতে পারতেন । আবদ্ধ ঘরে
বয়ে আনতে পারতেন বসন্তের দখিনা বাতাস ।

সহজ – সরলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত:-

জীবনের তখন অপরাহ্নবেলা। মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে এসেছে । একদিন তাতে একটা
টিকটিকি পড়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তা দেখে তাঁর মেয়ে বলে উঠলেন- বাবা
, আপনার মাথার উপর
টিকটিকি পড়ে আছে
, আপনি কি টের পাননি ? বাবা উত্তর দিলেন –
জানি মা
, শুনেছি মাথায়
টিকটিকি পড়লে নাকি রাজা হওয়া যায়
, তাই একটা চান্স নিচ্ছি, আর কি !

বিরল গুণের এই মনীষীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ও কিছু কথা:-

  কবির কথায়-হৃদয়ে হৃদয়ে
পৌঁছাতে পারি যেন
                                                তোমার নাম,
        হে চিরস্মরণীয়
মানব
                                                      লহ মোর প্রণাম ।

আজ একবিংশ শতকে একমেরু বিশ্বে বিশ্বায়নের যুগে প্রবল গতি আর জোয়ারের ঘূর্ণিপাকে
এই চরিত্রগুলো ক্রমশ অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রসভ্যতা আমাদের যন্ত্রমানবে পরিনত
করেছে। ছকে বাঁধা জীবন। তার সাথে গতি এনেছে ব্যস্ততা। ফলে অবকাশ কমে যাচ্ছে
, চিন্তার পরিসর কমে
যাচ্ছে । পুঁজির সাহায্যে ধনকুবেরদের মুনাফা-লোভ এনেছে বিশ্বজুড়ে মন্দা
, তীব্র সংকট। আরো
উন্নতি প্রযুক্তি আসায় কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে বেড়েছে দারিদ্র্য
, বেকারত্ব ।
সর্বোপরি আপন নিয়মে উপনীত মুমূর্ষু পুঁজিবাদ তাঁর নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে
জীবনের সুন্দর যা কিছু
, সুকুমার প্রবৃত্তি  প্রভৃতি  ধ্বংসের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে।  এই পরিস্থিতিতে  জীবনের এখন বেঁচে
থাকার উপায় এবং উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে- ছুটে বেড়াও
, যেন-তেন-প্রকারেণ
রোজগার কর
, খাও-দাও আর বিনোদন
কর। ওসব বড় মানুষদের অনুসরণ করো না
, জীবন বৃথা হয়ে যাবে। দেশাত্মবোধ, মূল্যবোধ ওসব দিয়ে তোমার পেট ভরবে না ।

    দারিদ্র অবশ্য তখনও ছিল। তবে মনুষত্বের এত বড় অধঃপতন
শুরু হয়নি। তাই বুঝি দারিদ্র কতজনকে মহান হতে
 প্রেরণা যুগিয়েছে । দাদাঠাকুর তেমনি একজন মহান মানবে
পরিণত হয়েছিলেন
, দারিদ্র যাঁর
পদস্খলন ঘটাতে পারেনি । যে বিপ্লবীরা এদেশ থেকে ইংরেজ রাজত্ব উচ্ছেদের জন্য জীবন
উৎসর্গ করেছিল তাঁদের অনেককেই তিনি গোপন আশ্রয় দিয়েছেন
, ছলে – কৌশলে রক্ষা
করেছেন বিপদের আশঙ্কা জেনেও । আমাদের দেশে অনেকেই বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়ে উপঢৌকন
পেয়েছেন
, রায় বাহাদুর উপাধি
পেয়েছেন
, কিন্তু দাদাঠাকুর, এইখানেই তাঁর
মহত্ত্ব। দৃঢ়
, ইস্পাতসম কঠিন
পদার্থকে আঘাত করে সহজে ভাঙা যায় না। আবার তিনি অন্তরের কোমলতা
, সরলতা এবং রসিকতা
দিয়ে সবকিছু জয় করেছেন অতি সহজে। এদেশের মাটিতে তিনি ছিলেন যথার্থই
 বিদ্যাসাগরের
উত্তরসূরী ।

      সমাজ-পরিবেশ অনেক
বদলেছে। আজকালকার যুবক-যুবতীরা ক্ষুদিরামের কথা উঠলে বলে —– বোকা ছেলে
, বেঘোরে প্রাণটা
দিল। নেতাজির কথা উঠলে বলে —— কী লাভ হয়েছে জীবনটাকে উচ্ছন্নের দিকে ঠেলে
দিয়ে
? সিভিল সার্ভিস পাস
করা ছেলে
, বড় চাকরি,  বাংলো, এসব নিয়ে ঘর সংসার
করলেই তো ভালো করত। ফলে এখন আর ক্ষুদিরাম
, নেতাজির জন্য কারো বুক কেঁপে ওঠে না, অথচ সেদিন ছোট্ট সুভাষের পরবর্তীতে নেতাজি হয়ে ওঠার প্রথম প্রেরণা ছিল
ক্ষুদিরাম। আর দাদাঠাকুর
, মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র তাঁকে বেশিদূর এগোতে দেয়নি। তবু সেদিনের
প্রবেশিকা পাস করা ছেলে একটা ভালো চাকরি নিশ্চয়ই জোটাতে পারতো । তবু তিনি কষ্টের
জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন। দুঃখের কথা
, জঙ্গিপুরেরই (রঘুনাথগঞ্জ) অনেক মানুষ  তাঁকে আজ চেনে না। অমাবস্যায় ভরা জোয়ারের টানে দিশাহীন পথে ছুটে চলেছে
প্রজন্মের পর প্রজন্ম
, আর চোরা পাঁকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে সমাজের অগ্রগণ্য চিরস্মরণীয়
মানুষগুলো ।

       সুবিধা পাইয়ে
দেবার চটকদারি রাজনীতি আমাদের সুবিধাভোগীতে পরিণত করেছে । এখন শুধুই অপরকে
 ঠকিয়ে নিজের আখের
গুছানোর পালা । আগেও এ জিনিস ছিল না
, তা নয়, তবে এখন গোটা
পুকুরের জলটাই নষ্ট হয়ে গেছে
, মাছ গুলো সব ভেসে উঠে কৃত্রিম উপায়ে নিশ্বাস নিচ্ছে । আমরা ঠিক তেমন করেই
বেঁচে আছি। এখানে বিবেক নেই
, মনুষ্যত্ব নেই, ভালোবাসা নেই, প্রাণখোলা হাসি নেই
। যা আছে
, তা শুধুই বন্যের
জীবনযাপন
, কদর্য যৌনতা আর
উন্মাদনা। দুর্নীতির জালে জর্জরিত গোটা সমাজ
, একেবারে উপর থেকে তলা পর্যন্ত। প্রবাদে পরিনত হয়েছে-চুরি করা মহা ধর্ম
যদি না পড় ধরা ।
আবার ধরা পড়লেও
শাস্তি দেবে কে
? চোরে-চোরে সবাই যে
মাসতুতো ভাই।
 মানুষ গড়ার কারিগর যে শিক্ষকরা, তাঁরাও চৌর্যবৃত্তির শিকার হচ্ছেন। কর্তাঁর ইচ্ছায় কর্ম, না হয়ে উপায় কী
আছে ! আর সেদিন
, দাদাঠাকুরের
নিদারুণ দারিদ্র- কষ্টের মধ্য দিয়ে যখন সংসার চলছে
, পন্ডিত প্রেসের কাজ চলছে, কত রাজা-মহারাজা
তাকে বেশ অর্থ সাহায্য দিতে চেয়েছেন
, তিনি তা গভীর শ্রদ্ধার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

       লোভ- লালসা আজ চরম
সীমায় পৌঁছেছে। চাই
, আরো চাই। সৎ পথে না হলে অসৎ পথে চাই। ব্যবসায় আরো লাভ পেতে ভেজাল মেশাও, চাকরিতে মোটা মাইনে
সত্ত্বেও উপরি নাও
, শ্রেণীতে না
পড়িয়ে বাড়িতে টিউশন পড়াও —- জীবনের এই হয়েছে আজ ব্রত।

       আজ মহৎ আদর্শ পিষ্ট
হয় পদতলে
, খলনায়কের গলায়
পরানো হয় বিজয় মালা। তাদেরই দাপট
, তাদেরই দৌরাত্ম্য, তারাই মানুষের ভাগ্য নিয়ন্তা। তাদের মুখনিঃসৃত বাণীই মন্ত্র, তারাই পাথেয়।

      এই বিরুদ্ধ পরিবেশে
আজও কিছু মানুষ
, যুবক-যুবতী, হয়তো সংখ্যায়
নিতান্তই অল্প
, ক্ষুদিরামের বেদনা
বুকে বয়ে নিয়ে চলে
, নেতাজির অপূর্ণ স্বপ্নকে সফল করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলে, বিদ্যাসাগরের মতো
দৃঢ় সংকল্প নিয়ে
, দাদাঠাকুরের মতো
কষ্ট সহিষ্ণু হয়ে এগিয়ে চলে এই মাটির পৃথিবীতে জীবনের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার
জন্য। দুঃখের হলেও সত্য
, তাঁঁরা উপহাসের পাত্র হন ।

     সুবিধাবাদ ও সুবিধাবাদীর এই স্বর্গধামে আদর্শবাদী
মানুষের আজ আর কোন জায়গা নেই। অথচ প্রয়োজন ছিল দাদাঠাকুরের মত এমন সোজা
শিরদাঁড়ার মানুষগুলোকে ভীরু
,স্বার্থপর, লোভী দেশবাসীর
সামনে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করার।

     প্রজ্বলিত আলোগূলোকে কেমন নি:শব্দে-নীরবে আমরাই মুছে
ফেলে কী অদ্ভূতভাবে অন্ধকারের নিবিড় গহবরে ঢুকে যাচ্ছি
, যেখানে নীল আকাশ
নেই
, নির্মল বাতাস নেই, আনন্দ নেই, জীবনের প্রাণকণাও
নেই ।




তথ্যসূত্র:
1. সংবাদ প্রতিদিন- 2 মার্চ 2014
2. ঝড়। । আলোকপাত
3. ঝাড় 25 জুন 2018
4. বুড়ো আংলা একদিন নবপত্রিকা
5. গণশক্তি 10 আগস্ট 2013 (সাত সকাল)
6. অনন্য দাদাঠাকুর- শিল্পনগরী প্রকাশনী