মুর্শিদাবাদের চিঠি

কল্যানীয়েষু ‘নিশিকান্ত’,
         
           আজ আমি সমাজের বর্তমান চিত্র,শ্রমজীবী মানুষের এবং তোমার কী করনীয়-এসব সম্পর্কে কিছু কথা বলব।সমাজের শ্রমিক শ্রেণি দুভাগে বিভক্ত,কর্মহীন এবং কর্মরত শ্রমিক অথাৎ বেকার ও চাকুরিজীবি।বেকারের সংখ্যাটা অগণিত,সীমাহীন সাগরের জলবিন্দু-সংখ্যার সাথেও তুলনীয়।
                      
       ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থা বিজ্ঞানের অমোঘ নিয়মেই এখন বার্ধক্যে জরাজীর্ণ,মৃত্যুশয্যায় শায়িত।বিশ্বজুড়ে তার বাজার সংকট।উৎপাদনে তাই মন্দা,তদুপরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কর্মসংস্থানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।কর্ম খোয়াও যাচ্ছে।ফলে শ্রমিকের জীবনে তৈরি হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয় তাদের দুর্ভাগা জীবনের মর্মগাঁথাকিন্তু জীবনতো থেমে থাকে না।বেঁচে থাকার কী আপ্রাণ চেষ্টা!যেখানে যতটুকু কর্মসংস্থানের সংকীর্ণ পথ এখনও খোলা আছে সেখানে মেঘভাঙা বৃষ্টির জলরাশির মতো বেকারের ঢল নামে।এদের মধ্যে থেকেই একটা নগণ্য অংশ কাজ পাচ্ছে।এক্ষেত্রে মেধা খুব একটা মান পাচ্ছে না।যাদের পরিবার আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল তারাই ছলে-বলে-কৌশলে আখেরটা গুছিয়ে নিচ্ছে।এর ফলে দেখা যাচ্ছে -কোনো পরিবারে বাবা,মা,ছেলে,মেয়ে চারজনই চাকুরি করছে,আবার কোনো পরিবারে একটা চাকুরি অত্যন্ত জরুরি,মেধা থাকা সত্ত্বেও চাকুরিটা না পেয়ে আত্মহত্যা করছে।তবে কষ্ট করেই হোক আর প্রভাব খাটিয়েই হোক,যারা একটু সুবিধা পেয়ে গেছে বা পাচ্ছে তাদের লোভের যেন অন্ত নেই।দুঃখের বৈতরনী পেরিয়ে কেউ একবার ডাক্তার হতে পারলে রোজগারের নেশা তাঁকে ভুলিয়ে দেয় তাঁর নিজের অতীত।অসহায় রোগী তাঁর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে তিনি বিরক্ত হয়ে হাসপাতালের পথ দেখিয়ে দেন।একদিন যার আশ্রয় ছিল না,হঠাৎ ভাগ্যের খেলায় ধনপতি হয়ে গেল।সে এখন অট্টালিকায় সুখের জীব,শিল্পপতি হবার স্বপ্নও দেখে,অথচ তারই নিচে পথের ধুলায় তারই বন্ধুসম কত কাঙাল চোখের জলে বিনিদ্র রাত কাটায়,তাদের খবর নিতে সে লজ্জা পায়।   
       
      যুগের এই সন্ধিক্ষণে নীতিনৈতিকতা,বিবেক-মনুষ্যত্ব,মূল্যবোধ,মর্যাদাবোধের মৃত্যু ঘটছে প্রতিমুহুর্তে।মানুষগুলো যেন নেমে এসেছে মনুষ্যেতর অবস্থানে।হীন স্বার্থপরতার করালগ্রাসে নিকট আত্মীয়-পরিজন হয়েছে পর।যেমন করেই হোক্,রোজগার কর,খাও-দাও আর ফুর্তি করো।এর বাইরে আর কোনো জীবন নেই।যে এক্টুখানি স্বচ্ছল হয়েছে,অর্থের লোভ তাকে আরও বেশি পাগল করে তুলেছে।যিনি অধ্যাপক হয়েছেন,তাঁর যে অধ্যাপিকা পাত্রীই চাই।যিনি শিক্ষিকা হয়েছেন,তাঁর শিক্ষক পাত্রই চাই।একটা সরকারি চাকুরি জুটে গেলেই জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীকেও সরকারি চাকুরিজীবি হতেই হবে।কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরি হলে তো খুঁত থাকলেও চলবে;মাইনেটা যে বেশ বড় অঙ্কের।একটু বড়সড় ব্যবসাদার হলে তো তাঁর চাহিদা-আরও বেশি।আসলে এইসব মানুষের কাছে অর্থ-সম্পদই হল মান বিচারের মাপকাঠি।এরা সুবিধাভোগী শ্রেণি।অদূর ভবিষ্যতের কথা বাদই দিলাম,এখনই খোঁজ নিলে দেখা যাবে-এই সুবিধাভোগী শ্রেণির দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সব দম্পতিই সরকারি চাকুরিজীবী কিংবা দুজনেই ডাক্তার,শিক্ষক-শিক্ষিকা,নয়তো দুজনেরই পিতামাতা বড়লোক।এই শ্রেনির মানুষের জীবনে এসেছে প্রভূত স্বচ্ছলতা আর বৃহৎ অংশের মানুষের জীবনে চির বিরাজমান নিষ্ঠুর দরিদ্রতা।
          
         পরিনতি হিসেবে সমাজে অত্যন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।হৃদয়ভরা ভালবাসা মরে যাচ্ছে।ব্যর্থ প্রেমের যজ্ঞে কতজন জীবন আহুতি দিচ্ছে,কতজন কত ফুলের মতো জীবন পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে!দারিদ্র জীবনের এক বড় অভিশাপ।আজ আর দারিদ্র কাউকে মহান করে না।শোনো তবে,একটা বেকার ছেলে তার বাবার কাছে টাকা চেয়েছিল ব্যবসা করবে বলেসামর্থ্যহীন বাবা টাকা দিতে পারল না বলে ছেলেটা আত্মহত্যা করল।আবার ছেলে,ছেলের বউ দুজনেই চাকুরি করে,ওদের আরও চাই।বৃদ্ধা মাকে জোর করে সম্পত্তি লিখে দিতে বলল।মা রাজি না হওয়ায় তাঁকে গলা টিপে হত্যা করল ছেলে-বৌমা।হতাশা আর লোভ দুই-ই কতনা অনিষ্ট সাধনে ইন্ধন জোগায়!মানুষকে কত অমানুষ করে তুলতে পারে!এরকম উদাহরণের শেষ নেই,উপলব্ধি করে নিও।তবে একটা উদাহরণের কথা বলছি,তা যে না বললেই নয়,যেটা আমাকে ভীষণভাবে আহত করছে,শোনো তবে-অসহিষ্ণুতা ব্যাধিটা আজকাল যেন মহামারীর আকার ধারণ করেছে।আলাদা আলাদা মতাদর্শের লোক কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছেনা,নিজ নিজ শিবিরেও চলছে অবিরাম মারামারি,রক্তারক্তি।একই কারণ,সেই অর্থের লোভ।তার জন্য চাই ক্ষমতালাভজোর যার মুলুক তার।ক্ষমতা দখলের জন্য যুদ্ধ অনিবার্যসেই যুদ্ধে নিরীহ মানুষগুলোই ঝাঁপিয়ে পড়েদেখে মনে হয় সমাজে আজও মরণখেলা চলছেএক ভাই আরেক ভাইয়ের বুক গুলিতে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে আর উপরের যবনিকার আড়ালে রাজসিংহাসনে বসে সমাজ প্রভুরা বিজয়োল্লাস করছেকবে বন্ধ হবে এই মরণখেলা!জানিনা

        অতএব,এই মরণখেলার সাথে তুমি কোনোভাবেই যুক্ত থেকোনা,কোনো শিবিরেই পা রেখোনা।তুমি ভদ্র,শান্ত,শিক্ষিত ছেলে,মানুষ গড়ার কারিগর,ক্ষমতার প্রলোভন আসবে জানি,তুমি তা সরল মনে উপেক্ষা করো।সমাজ গড়ার কাজটা বাইরে থেকেও করা যায়।তাছাড়া ভালো মানুষই তো ভালো সমাজ গড়বে।তাই তোমার ব্রত হবে ভালো মানুষ তৈরি করা।একথা আমি বলছি কেন,তুমিতো জানোই যে আজকাল সব শিবিরেই ভালো মানুষের যোগ্য সম্মান নেই।
      
        আর এখন তোমাকে যে কথাটা বলব আশাকরি তুমিও তেমনই ভাবছো।প্রেম,ভালবাসা প্রতিটি জীবের মধ্যেই আসে।জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কাউকে যদি ইতিমধ্যেই নির্বাচন করে থাকো তবে সে যেন চাকুরিরত না হ্য়,যদি হয়ও তাহলে তোমাদের দুজনের একজনকে চাকুরি ছাড়তে হবে।কেননা,সেই চাকরিটি আরেকজন করলে তাতে আরেকটি পরিবারের মঙ্গল হবে।আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব-তুমি যদি গরিব ঘরের একটি শিক্ষিতা মেয়েকে তোমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করো।
       
         এমনটাই হওয়া উচিত।সমাজতো এখনই সবাইকে কাজ দিতে সক্ষম নয়,তাই প্রতিটি একক পরিবারে একজনই চাকুরি করুক,তাতে বেকার সমস্যার অনেকটাই নিরসন হবে।যদি পারো-এই ভাবনাটাই সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিও।বলো-‘লেখাপড়া শিখে ডিগ্রি লাভ করলেই চাকুরি করতে হবে কেন? যদি কাজ করতেই চাও,ভাল কথা,তবে সেবামূলক কিছু কর’।প্রকৃত শিক্ষার মর্মার্থ হল-মানুষ হওয়া,মানুষকে ভালবাসা,সকলের মঙ্গল কামনা করা। আজ এখানেই শেষ করছি।
                                                                   ইতি,

রাধারঘাট,বহরমপুর,মুর্শিদাবাদ                       তোমার পিতৃতুল্য শিক্ষক
০৩.০৪.২০১৮                                             হরবিলাস সরকার