Hature Daktar – হাতুড়ে ডাক্তার

হাতুড়ে ডাক্তার - হরবিলাস সরকার
 ( গল্প ) হাতুড়ে ডাক্তার – হরবিলাস সরকার

 

শীতের রাতদুপুরে কে একজন এসে বার দুই-তিনেক দরজা ঝাঁকাল। তারপর গলা চড়িয়ে হাঁক দিল, “রহমান ভাই , ও রহমান ভাই। শুনতি পাচ্ছো, ও রহমান ভাই ।” ভেতর থেকে উত্তর এল, “কে গো, দাঁড়াও,আসছি।”


বাইরের আলোটা জ্বলে উঠলো। দরজাটা খুলে গেল। পাজামা পরনে, গায়ে চাদর জড়ানো লিকলিকে মানুষটা চোখ দু’টো কচলাতে কচলাতে বেশ আকুতি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ কী হয়েছে সনাতন দা?”  “এত রেতে তোমার কাঁচা ঘুমখান ভাঙাতি হলো ভাই। কী করবো , তুমিই তো আমাগো বিপদে-আপদে, সময়ের -অসময়ের বন্ধু।” “ওভাবে বলিও না সনাতনদা,আমি কোনো মহান মানুষ নই। এটা আমার কর্তব্য,  এটাই আমার জীবিকা। তো বলো,কার কী হয়েছে?” “আমার ছেইলিটার গো। সইন্ধ্যা থেকেই হঠাৎ গাটা গরম গরম লাগছিল। রেত বাড়তেই জ্বরও বাড়তি লাগলো। এইখন তো গাটা পুড়ে যাচ্ছে। মাথা দিয়া আগুন বাইর হইচ্ছে। বিগারে আবোল-তাবোল বইকছে। যা হয় তুমি ব্যবস্থা করো ভাই।” রহমান দেরি করলো না। ওষুধের বাক্সটা বের করে এনে বেলেডোনা-৩০ শক্তির চারটি পুরিয়া বানিয়ে দিয়ে আধঘন্টা অন্তর খাওয়াতে বলল। আর সকালে একবার আসতে বলে দিল।


সনাতন দুটো দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, “এত রেতে তোমাকে জাগালাম। আরও লাগবে ভাই?” রহমান একটা নোট ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ সবাই আমরা গরিব মানুষ গো দাদা। রাত-বিরেতে এসেছো বলে বেশি নেবো, এ তো ভারী অধর্মের কথা। আর অসুখ কি সময় বলে কয়ে আসে? তুমি যাও গো দাদা। তাড়াতাড়ি গিয়ে ছেলেকে ওষুধটা খাইয়ে দাও।”


সনাতন চলে গেলে রহমান দরজা বন্ধ করে বিছানায় চলে গেল। এরপর রাত আনুমানিক তিনটে। সুকান্তনগর থেকে সুনিরাম হেমব্রম সাইকেলে করে ছুটে এসেছে। বাঁ হাতে মোবাইল-টর্চের আলোটা ধরে ডানহাতে দু’বার দরজার কড়া নাড়লো। সাড়া-শব্দ না পেয়ে বার দু’য়েক ডাকলো। তৃতীয়বার আবার ডাকতেই রহমান দরজা খুলল। দেখে বুঝল – কিছু একটা অঘটন নিশ্চয়ই ঘটেছে। সুনিরামও কাকুতি-মিনতি করতে লাগলো, “ দাদা গো, মোর ঘরে তাড়াতাড়ি চলো কেনে বটে। দাই মাসি চেষ্টার কিছুইটো বাকি রাখেক লাই, কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছুই হয় লাই বটে। অবস্থাটা ভালো ঠেকছেক লাই। বউটার প্যাটে এইটো প্রথোম বাচ্চাটা আছে গো।” রহমান নিশ্চিন্ত হল – অবস্থা গুরুতর না হলে এই অসময়ে এমন করে কেউ ছুটে আসে না। দেরি না করে সাইকেলের পেছনে বাক্সটা নিয়ে দ্রুত চলল সুনিরামের বাড়ির দিকে।


বাড়ি পৌঁছানো মাত্রই অসহায়, অপারগ দাই মাসি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “ আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টাটো করেছি। আর পারলাম না ডাক্তারবাবু। এখন যা করার তুমিই করো কেনে।” সুনিরাম বউকে বড়ো ভালোবাসে। ঠারেঠোরে সেকথা বুঝিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে সেও বলে উঠলো, “পাড়ার মানুষগুলান এসে বলেছিল – হাসপাতালে লিয়ে যেতে। মুই তো জানি, সেটো কি আর চারটে খানিক পথ ?  দশ ক্রোশেরও বেশি বটে। তাছাড়া গাড়ি-ঘোড়াটো অসময়ে মেলবেক লয়। যদিটো মেলবেক ভাড়া অনেক আছে। কী বলবোটো দাদা, তোমাকে লিয়েও কথাটো উঠেছিল। বলেছিল –  এসব বেপারে রহমান ডাক্তার কীটো করবেক? আমি কানটো দিই লাই। আমি গরিব মানুষটো আছি বটে। তুমিই এখোন ভরসা গো দাদা।” রহমান দাই মাসিকে জিজ্ঞেস করল, “ মাসি, রোগী এখন কী অবস্থায় আছে?” “ অবস্থাটো আমার ভালো ঠেকছেক লয়। ব্যথাটো উঠছে ধীরে ধীরে, তেমনটো জোর লয়। জন্ম মুখটো খোলা। চাপটো দিতেক পারছেক লয়। তারই জন্য সন্তানটো ভূমিষ্ঠ হতে পারছেক লয়। চাপটো দেবে কী করে বটে? এতোটা দুর্বল আর রোগাটো হলে বলটাইবা পাবে কুথায়? গা-গতরটো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তবু পাখার বাতাসটো লিতে চাইছে। কী ঝামেলায়টো পড়লাম ডাক্তারবাবু ! এই দু’টো হাতে কত যে মেয়ের খালাসটো করলাম, কিন্তু এমোন মেয়ের পাল্লায়টো কখনো পড়িক লাই।”  “ঠিক আছে মাসি, দুশ্চিন্তা করিও না। দেখি কী করা যায়,” এই বলে রহমান বাক্স খুলে সিকেলি কর – ২০০ শক্তির কয়েকটা দানা বের করে একটা ড্রপিং শিশিতে পরিশ্রুত জলের মধ্যে মিশিয়ে দিল। তারপর কয়েকবার ঝাঁকিয়ে মাসির হাতে দিয়ে বলল, “ পাঁচ ফোটা করে আধা ঘন্টা অন্তর কয়েকবার খাইয়ে দাও।”


সুনিরাম পঞ্চাশ টাকা গুনে হাতে দিয়ে বলল, “ খুশিটো হয়ে এটাই লাও ডাক্তার।  ভালোয় ভালোয় বাচ্চাটা হয়ে গেলে  তোমাকে ঠকাবোক লয়। কাজ-কামটো করে হাতে পয়সা-কড়ি এলে আরও পঞ্চাশ টাকা দিবো বটে।” রহমান কুড়ি টাকা নিয়ে ত্রিশ টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ ভাই, অত টাকা আমি নিই না। বাড়িতে আসার জন্য শুধু দশ টাকা বেশি নিলাম। তোমাকে আর দিতে হবে না।” তালপাতার আসনে রহমান বসেই ছিল। এবার চাদরটা ভালো করে গায়ে মুড়িয়ে নিয়ে বলল,  “সুনিরাম,একটু দেখেই যাই – কী হয়।  তাছাড়া সকাল হতেও তো বেশি দেরি নেই।” সুনিরাম মনে মনে ভীষণ খুশি হল।


ভোরের আলো এখনও ফুটে ওঠেনি।  পাখিরাও ঘুম ভাঙানো গান ধরেনি। এরই মধ্যে সুনিরামের পুত্র সন্তান এলো ঘর আলো করে, কান্নার সুরে ভরিয়ে দিয়ে। তারপর বাড়ি ফিরে এলো রহমান।


সংসারে রহমানের স্ত্রী, পুত্র আর কন্যা। চাষের জমিজমা নেই অন্তত: দু’পুরুষ আগে থেকেই। রহমানের বাবাও গ্রামে ডাক্তারি করত। তবে হোমিওপ্যাথি নয়, এলোপ্যাথি। অনেক বছর আগের কথা। ছেলে তখন হাই স্কুলে পড়ে। পড়াশোনায় ভালো। বই-পাগল ছেলে। মাস্টেমশায়রাও নাম করেন। গণিতে একশোতে একশোই পায়। যুক্তি-তর্কে কেউ ওর সাথে পেরে ওঠে না। বাবার ইচ্ছে – ডাক্তারি পড়াবে। 


সত্যি সত্যিই সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাধ্যমিকে চারটি লেটারসহ স্টার পেল রহমান। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না।  বারো ক্লাসে ভর্তি হবে, ইতিমধ্যে তার বাবা চলে গেল চির বিদায় নিয়ে। কী এক ভয়ানক জ্বর হয়েছিল, আর দু’দিনের মধ্যে এমন বাড়াবাড়ি হয়েছিল যে, হাসপাতালের দরজায় পৌঁছানোর আগেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই মর্মান্তিক ঘটনায় রহমান বড়ই শোকাহত হয়েছিল। তারপর হাজার কষ্টে শোক কাটিয়ে উঠে সংসারের বোঝা তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে। ক্ষীণ আশায় পড়াশুনাও চলতে থাকল।


হঠাৎ মা-ও চলে গেল না ফেরার দেশে। বিদ্যালয়ের জীবনে চিরতরে ছেদ পড়ল রহমানের। জমিতে মুনিশ খাটা, পিচ রাস্তায় রিক্সা টানা – এই পথেই চলল জীবনের সংগ্রাম।  দারিদ্র্যের মধ্যেই একদিন জীবন-সঙ্গিনীও এলো ঘরে। তবুও হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা একেবারেই মরে যায়নি। কষ্টের অর্জিত টাকা দিয়ে একদিন কিনে আনলো হোমিওপ্যাথির মেটেরিয়া মেডিকা। একে একে আরও অনেকগুলো বই। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, রাত জেগে অধ্যয়ন, তবু ক্লান্তি নেই। তারপর একদিন ডাক্তার সেজে বসে পড়ল বাড়ির বারান্দায় বাবার সময়ের জোড়া-তালি মারা চেয়ার-টেবিল নিয়ে। যদিও মুনিশ খাটা, রিক্সা টানা পুরোপুরি বাদ দিতে পারেনি এখনও। তবে মনের প্রবল ইচ্ছা-শক্তি আর সুপ্ত বাসনায় ক্রমে গভীর অধ্যবসায় জন্মে গেল হোমিওপ্যাথির উপর। এটাই তার জীবনের একমাত্র সাধনা। একটা সময়ে এটাই হলো দিন গুজরানের একমাত্র পথ।


ফেলে আসা দিনগুলোর কতসব কথা রহমান স্মৃতির পাতায় লিখে রেখেছে। মাঝেমধ্যে উল্টে উল্টে দেখে। অনেকদিন পর্যন্ত বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তার না হতে পারার যন্ত্রণায় ছটফট করত। তবে এখন আর যন্ত্রণা হয় না, বরং রোগীর অভিভাবক এসে যখন বলে, “ডাক্তার, তোমার ওষুধ খেয়ে আমার ছেইলিটা এখুন ভালো আছে।”  তখন রহমানের ব্যথাভরা পিঞ্জরে মনোরম দখিনা বাতাস ছুঁয়ে যায়।


তথাপি নতুন করে নতুন রূপে আবার যন্ত্রণা ওঠে। নিন্দুকেরা এসে নিন্দা করে। একদিন গাঁয়ের মাথা ‘রহিম চাচা’ এসে বলল, “রহমান, তোমার সবই তো ভালো। কিন্তু বাপজান, আল্লার নামটা তো মুখে তুলোনা কখনও। একবার মসজিদেও যাওনা নামাজ পড়তি।” রহমান উত্তর দেয়, “ চাচা, মানুষকে সেবা করলেই তো আল্লার সেবা করা হয়। মানুষকে ভালবাসলেই তো আল্লার আশীর্বাদ পাওয়া যায়। মানুষেরা ডাকে, তাদের দুয়ারে দুয়ারে যাই। সেই তো আমার মসজিদে যাওয়া।” “না রহমান, তা বুললে  হবে? মানুষ যদি তোমাকে আর না ডাকে?এই যে তুমি এত এত বইপত্র পড়ো, কই বাপ,কখনও তো দেখি না কোরান ছুঁতে ?” “চাচা, আল্লার বাণী আমি যে এইসব বই পত্রেই খুঁজে পাই।” চাচা মনে মনে ক্ষুন্ন হয়ে ফিরে যায়। রহমান অকুল সমুদ্রে খুঁজে বেড়ায় রোগীর যন্ত্রণার নিদান।


চৈত্রের এক রাতে মসজিদে ডাক পড়ল রহমানের। সামনে দাঁড়িয়ে গায়ের যুবক ‘মোস্তফা’। রহমান জানতে চাইলো – কেন ভাই, মসজিদে যাবো কেন? যুবক হতভম্ব হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “ কেনেগো বড়ো ভাই, যে যখন ডাকে, বাক্সখান নিয়ে দৌড়াও। তবে আজ কেনে বুলছো – যাবো না?” রহমান ভাবছিল – হয়তো কোনো সমন জারি হয়েছে। এবার বুঝলো – নিশ্চয়ই কারও কিছু হয়েছে। তাই একটু বিনম্র হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ কার কী হয়েছে রে মোস্তফা?”  “মৌলবীর গো। ভোজ খিতে গেছিল। হজমের গন্ডগোল। পাতলা পায়খানা, বমি করছে গো। পিরের জলপড়া খেয়িছে, কাজ হয়নিকো। তাইতো তুমাকে ডাকতি বুললে।” রহমান দেরি না করে বাক্স নিয়ে ছুটল। গিয়ে দেখল – আরও অনেকের মধ্যে রহিম চাচাও আছে। চাচা বলল, “বাবজান আমার, বাধ্য হয়িই তুমাকে ডাকতি হল। যা হয় একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো। মৌলবি সাহেবের অবস্থা ভালো নয়। দু’বার মাত্র পাতলা পায়খানা, বমি হয়িছে। তার পর থিকে সর্বশরীর হিম হয়ি যাচ্ছে ,গায়ের কাপড়চোপড় ফেলি দিচ্ছে, পাখা চালাতি বুলছে। ক্ষাণিক বাদে আবার গরম ধইরছে , গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিচ্ছে, পাখা বন্ধ করতি বুলছে।” রহমান জানতে চাইল, “ হাতে-পায়ে খিল ধরছে? কপালে ঘাম হচ্ছে কি?” “ হ্যাঁ, তাই তো বুলছিল। কপালে হালকা ঘামও ছিল। এই দেখো বাপজান,  গা আবার হিম হতি শুরু করিছে, কাপড়-চোপড় ফেলি দিচ্ছে।” রহমান ক্যাম্ফর – ৩ শক্তির শিশিটা বের করে দু’ফোঁটা  শিশির জলে মিশিয়ে দিয়ে বলল, “কয়েকবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে ৫-৭ মিনিট অন্তর চার-পাঁচ ফোঁটা করে খাইয়ে দাও।”


ওষুধের ব্যবস্থা করেই রহমান চলে এলো বাড়ি। রহিম চাচা পরদিন সকালে রহমানের বাড়িতে একরকম ছুটে এলো। বইপত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “ রহমান, তুমাকে অনেক কথাই আমি বুলেছি। মনে রাখিও না বাপজান। আমি আমার দু’খান চোখে সত্যিই দেখলাম – আল্লার বাণী তুমার এই সব বইপত্রে সত্যিই লিখা আছে। যাই বাপ , এই কথাটা বুলতেই এসেছিলাম।” রহমানও চলল রোগী দেখতে।


বাংলা নববর্ষের দিন সকালবেলা মিনতি পিসি খবর নিয়ে এসেছে। “ওরে রহমান, শুনেছিস্ , শহর থিকে বড় ডাক্তার এয়েছে গাঁয়ে। সপ্তায় দু’দিন বসবি আমাদের ক্লাব ঘরে। প্রেসিডেন্ট অনুমতি দিয়েছে। আজই  তার উদ্বোধন হবি। সাইনবোর্ড লাগানো হয়িছে। কীসব যন্ত্রপাতিও আনা হয়িছে। দেখে এলাম – কোট-বুট পরা ডাক্তারবাবু এয়েছেন রঙিন কাঁচওয়ালা গাড়িতে করি। সঙ্গে পেটি পেটি ওষুধ। শুনলাম –  ডাক্তারবাবুর ফি ২০০ টাকা। তার উপর ওষুধের দাম।” “পিসি,  তারই বুঝি প্রচার চলছে সকাল থেকে?” “হ্যাঁ রে, প্রেসিডেন্টের ছেলি ‘হাবল’ অটোরিক্সায় মাইক বেইনধে এগাঁ, ওগাঁ, সেগাঁ, সব জায়গায় প্রচার করি বেড়াচ্ছে। কী বলছে, শুনেছিস্? হাতুড়ে ডাক্তার দেখাবেন না। রোগ ভালো হবি না। বই পড়ি পড়ি ওষুধ দেয়। গাঁয়ে পাস করা ডাক্তার এইসেছে। এবার থিকে তাঁর কাছে যান। আরও কত কী!”


রহমানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। পিসিকে বলল, “ কেউ যদি হাতুড়ে ডাক্তার না দেখায় সেতো তার নিজস্ব ব্যাপার। আর পিসি,তাহলে তো তোমাকেও যেতে হবে বড়ো ডাক্তারের কাছে।  মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দিল পিসি, “ না রে, পাস করা ডাক্তারের দেমাক বেশি। ওঁর দাম দিতি পারব আমি? তুই হ’লি গরিবের ডাক্তার। তুই-ই আমাদের ভরোসা রে। তবে মনে মনে ভেইবেছি – একবার গিয়ে দেখবো – সে কেমনতর ডাক্তার।”


আজ একজনও রোগী আসেনি। পিসি চলে গেলে রহমান মেটেরিয়া মেডিকাটা বন্ধ করে মাথা নীচু করে বসে রইল। ভেতরে তার কত যে ব্যথা ! একজন বুঝলো। সে ভেতর থেকে সব কথা শুনছিল, সবকিছু লক্ষ্য করছিল। রোগী দেখার এই ঘরটায় এসময় সে আসে না। আজ এলো। একেবারে কাছে এসে বলল, “ কী গো নূরজাহানের বাপ, বইটা বন্ধ করি রাখলে যে ? কে কী বলল, তার জন্য তোমার মন খারাপ করে লাভ কী? এর জবাব তোমাকেই দিতি হবি। আর তা জ্ঞানের অস্ত্র দিয়েই দিতি হবি। বড় ডাক্তার, সে তো বই পড়েই ডাক্তার হয়িছে। যে যত পড়াশোনা করে জ্ঞান লাভ করবি, সে তত বড় ডাক্তার। জ্ঞান না থাকলে পাস করা ডিগ্রির কী মূল্য আছে, বলতে পারো? আমি জানি, পাঁচটা রোগী কমি গেল  বলে তোমার মন খারাপ হয়নি। তুমি দুঃখ পেয়েছো, ওদের ওই বাঁকা বাঁকা কথাগুলোর জন্যই।”


মুখ তুলে তাকায় রহমান। মৃদু হাসে। সে অবাক হয়, “তার জীবন-সঙ্গিনী মনের অসুখটা কেমন করে ধরে ফেলল !” অসুখটা নিমেষে সেরেও গেল। আবার বই খোলে রহমান। সোফিয়া আরও বলে, “ লোকে বলে – জীবনে দুঃখের পরে সুখ আসে। হয়তো সবার জীবনে তা আসে না। আমরা সেই না আসার দলে। তার জন্য দুঃখ পেও না। যতই দুঃখ আসুক, আমরা দুজনে তা সমান ভাগ করি নেবো।”


স্ত্রীর অণুপ্রেরণায় বুকে বল পায় রহমান। তবু জীবন-আকাশে কালবৈশাখী ঝড় ওঠে। দমকা হাওয়ায় ন্যুইয়ে পড়ে সে।  বিদায়ী বৈশাখের এক সকালে পাঁচ বছরের মেয়েটা এসে বায়না ধরল, “আব্বু, পাঁকা আম নিয়ে এসো,আমার খিতে ইচ্ছা করছে।”হাতে যে একটা টাকাও নেই। তবু মিথ্যা আশা দিয়ে খালি পেটে বেরিয়ে গেল রহমান। সোফিয়ার ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। চাটুকুও আজ দিতে পারেনি। সাত কিলোমিটার সাইকেলে এসে বলাই কাকার গ্যারেজ থেকে ভাড়াটে টুকটুক নিয়ে রহমান বেরিয়ে পড়ল। দিনশেষে বাড়ি ফিরল ক্লান্ত শরীরে। যা রোজগার হয়েছে, সোফিয়ার হাতে তুলে দিল। মেয়ের জন্য আমও এনেছে। সোফিয়া মুখ লুকিয়ে আঁচলে চোখ মুছল। টুকটুক চালানোই আজ থেকে রহমানের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়াল। 


জৈষ্ঠের এক ভোরে সুনিরাম এলো তার পাঁচ মাসের ছেলেকে নিয়ে। ঠান্ডা লেগে ছেলের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট। রহমানের দরজায় পা রাখবে ঠিক এমন সময় মনসুর তার টোটো নিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। বলল,  “এই সুনিরাম, এখেনে কী করতি এইসেছিস? রহমান ভাই তো আর ডাক্তারি করে না। ওয়ার রোগীও হয় না। একি রে ? তোর ছেলি তো পাঁজর টানছে রে। দম পাচ্ছে না। অবস্থা কিন্তু ভালো ঠেকতিছে না আমার। তবে শুন্, ভয়ের কারণ নেইকো। ক্লাবে আজ বি.সি.রমন বইসাছেন। বিরাট ডাক্তার। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। একবার ওষুধ খাওয়ালেই ছেলি ভাল হয়ে যাবি। আমি ওই ধারেই  যাচ্ছি। ওঠ্, আমার টোটোয় চেপি বস্।” সুনিরাম মনসুরের কথা বিশ্বাস করল।


মিনতি পিসি দূর থেকে দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। “নাঃ কথাটা রহমানকে বলা দরকার।” না বলতে পারলে শান্তি পাচ্ছিল না সে । এক পা দু’পা করে এসে বলল, “ রহমান, দেখলি তো, মনসুর তোর রোগী ভাঙিয়ে নিয়ে চলি গেল পাস করা ডাক্তারের কাছে। দালালি করছে। রোগী পিছু পঞ্চাশ টাকা। প্রেসিডেন্ট আমাকেও বলেছিল, ‘ মিনতি, রোগী নিয়ে আসো। ভালো কমিশন পাইবা।’ তবে বাপ, আমি ওই অধর্মের কাজ করিনি, করবোও না। যার যে ডাক্তার ভালো লাগবি সে সেইখানে যাবি। রহমান জানতে চাইল, “পিসি,তুমি যে বলেছিলে – ডাঃ রমনকে দেখাবে, দেখিয়েছো?” মিথ্যা কথা বলবো না বাপ। গেয়েছিলাম। কিন্তু ওষুধে এখন পর্যন্ত উপকার পাইনি। চার রকমের ওষুধ দেছিল। এক গাদা টাকাও নেছিল। আমার ঘাট হয়েছে রে। আর যাবো না। হ্যারে বাপ , তুই তো একরকমই ওষুধ দিস।” “পিসি, উনি বড়ো ডাক্তার। ওঁনার জ্ঞান-গরিমার বিষয়ে আমার কি কিছু বলা সাজে? তাছাড়া গায়ের তুচ্ছ এক হাতুড়ে ডাক্তার এখন আবার টুকটুকওয়ালা। সে যদি বলে – হোমিওপ্যাথির নিয়মে একরকম ওষুধই হয়, তবে তো সেই নিয়ে সবাই হাসাহাসি করবে। না পিসি, আমাকে ওকথা জিজ্ঞেস করিও না।”  “বুঝেছি, ব্যবসা রে বাপ, ব্যবসা। যে যত বড় ডাক্তার, সে তত গলা কাটে,” বলতে বলতে পিসি হাঁটা ধরল। রহমানও কত কী ভাবতে ভাবতে টুকটুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।


আষাঢ়ের প্রথম দিকে নিম্নচাপের দরুন ক’দিন টানা বৃষ্টি হচ্ছিল। জলে ভিজে জ্বরে পড়ল রহমান। সোফিয়ার দিনরাত সেবা-শুশ্রুষায় আর নিজের ওষুধের জোরেই সে যাত্রা সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু সোফিয়া বলে দিল, “ চোখের সামনে তোমাকে আমি শেষ হয়ি যেতে দিবো না। তুমি আর টুকটুক চালাতে যাইবা না। আর অনেক দিন ধইরা বই খুলি বসোনি। এইটা কিন্তু ভারী অন্যায়। আজ থেইকা তুমি নতুন করি পড়াশোনা শুরু করবা। একেবারে নিয়মিত, নিয়ম ধরি বসবা। আমিও বসবো তোমার পাশে। জানার কি শেষ আছে ? শুনেছি – হোমিওপ্যাথি কূল-কিনারাহীন অথৈ সমুদ্রের মতো। তুমি নিজে আরও ভালো করি শিখবা, আমাকেও শেখাবা।” “ ডাক্তারি শিখবে? আমার মতো তোমাকেও লোকে বলবে – হাতুড়ে ডাক্তার। ডাক্তারখানায় বসে শুধু আমার মতো মাছি তাড়াবে।  তখন তুমিও বুঝতে পারবে – শুধু বই পড়া কেন,কোনো কিছুই আর ভালো লাগবে না।”  “ওগো, আমি বুঝি – তুমি কোন্ দুঃখে কথাগুলো বলতেছো। দুশ্চিন্তা করিও না। জানি, তোমার রুগিপত্র এখন তেমন আর হয় না। সেইকারণে বইপত্রেও মনোযোগ দাও না। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি – ধৈর্যের অশেষ গুন। নিজের কাজের উপর বিশ্বাস রাখো। তুমি বঞ্চিত হইবা না। এবার একখান কথা শোনো, তোমাকে না জানিয়ে আমি একটা কাজ জুটাইছি। ছাত্র পড়ানো। ক’জন ছোট ছোট ছাত্র পেয়েছি। আমাদের বাড়িতেই পড়তে আসবি ওরা। আমাদের মেয়ের সাথেই প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। মাসে হাজার দু’য়েক টাকা হবি গো। সংসারের কিছুটা তো সুরাহা হবি।” রহমানের মুখখানা কালো হয়ে আসে। সোফিয়া এবার বলে, “ ওগো, সংসারের বোঝাটা তুমি একা কেনে বইবা? আমাকেও একটু বইতে দাও।”


সত্যিই আজ রাতে সোফিয়া একখানা মেটেরিয়া মেডিকা নিয়ে বসলো। রহমানও বসলো কেন্টস্ রচিত মেটেরিয়া মেডিকা নিয়ে। সোফিয়া মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকায় আর হাসে। মনে মনে বলে,  “এইভাবেই ওর মনোযোগ বাড়াতি হবি, আর বাড়াতি হবি জ্ঞানের ভান্ডার।”


দিন কয়েক পর সোফিয়া শুধোয়, “ ওগো, আমার যে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সহজ কোনো উপায় আছে কি ? কতগুলো ওষুধ পড়লাম। সেইসবের সবগুলোতেই একই রকম একটা লক্ষণ আছে। যেমন, ক্যাম্ফর, আর্সেনিক এলব্, আর্সেনিক আয়োড, মার্ক সল, নেট্রাম মিউর – সবগুলোতেই নাক দিয়া জলের মতো সর্দ্দি ঝরে। তাহলে কি এইরকম ক্ষেত্রে এদের যে কোনো একটা ওষুধ দিলেই কাজ হবি ?”  রহমান হাসে। বলে, “ না। তাতে কোনো কাজই হবে না। জলের মতো সর্দ্দি ঝরা আরও অনেক ওষুধেই আছে। আমি তোমারগুলোর সাথে আরও কয়েকটা ওষুধ যোগ করছি।এলিয়ম সিপা,ইউফ্রেসিয়া,নাক্সভমিকা,আয়োডিয়াম। এই যে এখন এতগুলো ওষুধ হলো, এরা প্রত্যেকটিই অন্যটির থেকে আলাদা। এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যটা ধরতে হবে, আর ধরতে পারলেই কার ক্ষেত্রে কোন্ ওষুধটা লাগবে, তা নির্বাচন করতে পারবে। মনে কর,একজন রোগী এলো ঐ রকম সর্দ্দি নিয়ে। তুমি রোগীকে জিজ্ঞেস করলে –  তার সর্দ্দিস্রাব গরম না ঠান্ডা। তার ঠান্ডায় না গরমে উপশম, খাবারের স্বাদ পাচ্ছে কিনা ইত্যাদি, ইত্যাদি। রোগী বলল – ‘স্রাবটা গরম। স্বাভাবিকভাবে তার গরম ভালো লাগে, ঠান্ডা অসহ্য। তবে সর্দ্দিটা  খোলা বাতাসে উপশম হচ্ছে,গরম ঘরে বাড়ছে।’ এবার ওষুধ নির্বাচন করতে হবে। দেখা গেল, এদের মধ্যে কয়েকটি একবার গরম, একবার ঠান্ডা বোধ করে।” সোফিয়া বলে, “ হ্যাঁ গো, পড়েছি। ক্যাম্ফর, আর্স এলব, আর্স আয়োড, মার্ক সল, নাক্স ভম – এদের ঐ রকম হয়।” “কিন্তু ক্যাম্ফরের শরীর যতই ঠান্ডা হয়, সে ততই আরও ঠান্ডা পেতে চায়, জামা-কাপড় খুলে ফেলতে চায়। আবার শরীর যখন গরম হতে শুরু করে, সে তখন  জামা-কাপড় গায়ে দিতে চায়। আর্স এলব ও নাক্স ভম সব সময় গরম চায়, আবৃত থাকতে চায়। আর্স আয়োড এবং মার্ক সল  ঠান্ডা বা গরম কোনটাতেই আরাম পায় না। এলিয়াম সিপা আর আয়োডিয়াম গরমে কষ্ট পায়, ঠান্ডা চায়। নেট্রাম মিউরও গরম ভালবাসেনা, ঠান্ডা চায়, ঠান্ডা জল বারবার চোখে-মুখে দিতে চায়। ইউফ্রেসিয়া আবার  ভীষণ শীতকাতর। বিছানার গরমেও সে গরম হয় না। খোলা বাতাসে বা ঠাণ্ডায় সর্দ্দি তার বাড়ে।” “আচ্ছা, তুমি যা বললে, তাতে তো বুঝলাম – আর্স এলব,নাক্স ভম, ইউফ্রেসিয়া  ঠান্ডায় বাড়ে। এলিয়ম সিপা,আয়োডিয়াম, নেট্রাম মিউর গরমে বাড়ে। আর আর্স আয়োড,মার্ক সল ঠান্ডা বা গরম কোনোটাতেই আরাম পায় না। কিন্তু সবগুলোর মধ্যে পার্থক্যটা ধরতি পারলাম কই? ওগো, সত্যিই তো তালগোল পাকিয়ে গেল। নির্বাচন করবো কী কইরা? তবে হ্যাঁ, ক্যাম্ফরটা শুধু বুঝতি পারলাম।” “আরে শোনো, শেষ হয়নি এখনও। নাক্স ভম, আর্স এলব,আর্স আয়োড,আয়োডিয়ামের সর্দ্দিস্রাব গরম। আর মার্ক সল, নেট্রাম মিউরের সর্দ্দিস্রাব ঠান্ডা। এলিয়ম সিপা আর ইউফ্রেসিয়ার মধ্যে একটু মজার ব্যাপার আছে। এলিয়ম সিপায় নাক দিয়ে যে জল পড়ে তাতে ঠোঁট হেজে যায় কিন্তু চোখের জলে চোখের চার ধার হেজে যায় না। ইউফ্রেসিয়ায় চোখ দিয়ে যে জল পড়ে তাতে চোখের চারধার হেজে যায় কিন্তু নাক দিয়ে যে জল পড়ে তাতে ঠোঁট হেজে যায় না।” “বাঃ শুনে তো বেশ মজাই লাগছে। বলো, আরও কী মজা আছে, বলো।” “এলিয়ম সিপার মতোই নেট্রাম মিউর, আর্স এলব, আর্স আয়োড, মার্ক সলে নাক দিয়ে যে জল পড়ে তাতে ঠোঁট হেজে যায়। অর্থাৎ এদের নাকের সর্দ্দিস্রাব ক্ষতকারক এবং জ্বালাজনক। ইউফ্রেসিয়া ও নেট্রাম মিউরে সর্দ্দিস্রাবের সাথে ভয়ঙ্কর মাথা-যন্ত্রণা থাকে। কিন্তু নেট্রাম মিউর কোনো খাদ্য বস্তুর স্বাদ পায় না। আর্স এলব ও আর্স আয়োডের তরুণ সর্দ্দির সঙ্গে কখনও রক্ত বের হয়। আবার আর্স আয়োডের তরল সর্দ্দি থেকে ক্রমে হাঁপানির টান শুরু হয়।” “হ্যাঁগো, এদের মধ্যে কোন্ কোন্ ওষুধে নাক আটকে যায়?” “সন্ধ্যা বা রাতের দিকে নাক্স ভম,আর্স এলব, আর্স আয়োড, মার্ক সল, নেট্রাম মিউরের নাক আটকে যায়। নাক্স ভমিকার ক্ষেত্রে অন্য একটা মজা আছে। সে সব সময় গরম ভালোবাসে। কিন্তু সর্দ্দিতে  একেবারে বিপরীত। তখন সে  খোলা বাতাস চায়, গরমে কষ্ট পায়।” “বাঃ যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে কেমন সুন্দর মালা গেঁথে ফেললে। এ তো ডাক্তারি নয়, ভারী সুন্দর এক শিল্পকর্ম।” “বেশ, তাহলে বলো –   রোগীটিকে কী ওষুধ দেবে?”  “বলছি দাঁড়াও।” সোফিয়া দু’চোখ বন্ধ করে মনের খাতায় যুক্তিগুলো সাজিয়ে নেয়। তারপর হেসে বলে – পেয়েছি, নাক্স ভূমিকা দিতে হবে।” রহমান মনে মনে ভাবে – সোফিয়া এভাবে একদিন হোমিওপ্যাথিটা শিখে ফেলবে। আর সোফিয়া ভাবে – অসাধারণ জ্ঞান এই মানুষটার, এইভাবে ওর মধ্যে আরও জ্ঞানের ক্ষুধা জাগিয়ে তুলতি হবি।


তাই এখন থেকে প্রতিদিন রাতে সোফিয়া বই নিয়ে বসে। আর রহমান তার পাশে বসে জ্ঞান-জগতের দিক-বিদিক ঘুরে বেড়ায়। সোফিয়া বোঝায়, “ ওগো, যে যা বলে বলুক, উপহাস করে করুক, তাতে তোমার ক্ষতি কী? নাইবা থাকলো তোমার কলেজ পাসের ডিগ্রি, নাইবা থাকলো ডাক্তারের স্বীকৃতি,  তাতে লজ্জা কী?  মানুষের শরীরের যন্ত্রণা যদি জুড়াতি পারো, তার থেইকা বড়, মহৎ আর কী হতি পারে? তোমার ভেতরে যদি আলো থাকে, আজ কেউ নাইবা এলো, দেখবা – একদিন মানুষ তোমাকে ঠিকই খুঁইজা নেবে।” রহমান বলে,  “সোফিয়া, তুমি আমার প্রেরণা।”


এরপর গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এসেছে। মশার কামড়ে ডেঙ্গু-জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। চারদিকে শুধু মৃত্যুর খবর। এলোপ্যাথি ডাক্তারবাবুদের এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই, নির্দিষ্ট ওষুধও নেই।


ডাক্তার রমণের লোক এলাকাজুড়ে মাইকে প্রচার করে বেড়াচ্ছে – “সুধী নাগরিকবৃন্দ,  ডেঙ্গু-জ্বর হলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। হোমিওপ্যাথি তার প্রতিকার করতে সক্ষম। ………।” এই প্রচারের ফলে ডাঃ রমনের অসামান্য সুবিধা হয়ে গেল। রহমানেরও সামান্য সুবিধা হল। প্রতিদিন একজন, দু’জন করে জ্বরের রোগী তার কাছে আসছে। ওষুধ খেয়ে জ্বর সেরেও যাচ্ছে। খবরটা ক্লাবের প্রেসিডেন্টের কানে গিয়ে পৌঁছেছে।  তিনি তো রেগে গেলেন।  তারপর নিজেই বেরিয়ে পড়লেন গ্রামে। মানুষকে ডেকে ডেকে পরামর্শ দিলেন, “শোনো, সত্যি সত্যিই ডেঙ্গু-জ্বর হলে হাতুড়ে ডাক্তার দেখিও না। জীবনের ঝুঁকি আছে। ………..।”


কয়েকদিন পরে প্রেসিডেন্টের ঘরেও মারণ ব্যাধি হানা দিল। তাঁর ছেলের জ্বর এসেছে।  ডাক্তার রমন পরীক্ষা করে বলেছেন – ডেঙ্গু হয়েছে। খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। বাড়িতে এসেই রমন চিকিৎসা করছেন। যত্নের কোন ত্রুটি নেই, কিন্তু জ্বর কমার কোনো লক্ষণ নেই। তৃতীয় দিন সকাল থেকে হাবলের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। শরীর কাঁপছে। জ্বর বেড়েছে।  শীতবস্ত্রে ঢেকেও শীত যাচ্ছে না। জল খেলেই বমি, বমিতে পিত্ত উঠছে। রমণ এলেন খবর পেয়ে। রোগী দেখে ওষুধ পাল্টে দিয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন – ভয়ের কোনো কারণ নেই।


সন্ধ্যা হতেই জ্বর আরও এক ডিগ্রি বেড়ে গেল। বমিও বাড়ছে। প্রেসিডেন্টের স্ত্রী কাঁদতে শুরু করলেন। পাড়া-পড়শিরাও ছুটে এল। তারা বলতে লাগলো – “এই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছো না কেনে ? ও হাবলের মা, তোমরা কি ছেলিটাকে মেরি ফেলবা?” মোবাইলে ফোন করা হলো রমন ডাক্তারকে। ঘড়িতে তখন ঘন্টার কাঁটাটা আটটার ঘর পেরিয়ে গেছে। মিনতি পিসি কার কাছে খবরটা শুনেছে। সেও ছুটে এসেছে। ছেলেটার অবস্থা দেখে প্রেসিডেন্টকে বলল, “ দাদা, এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যান।” কিন্তু প্রেসিডেন্ট তো রমনের অপেক্ষায় বসে আছেন। তাঁর সাথে একবার পরামর্শ করে নিতে চান। মিনতি পিসি এবার বলল, “ দাদা গো, ডাক্তারবাবুর আসতি যদি দেরি হয়, রহমানকে একবার ডাকলে কেমন হয়?” “কী যে বলো মিনতি! কোথায় ডাক্তার রমন! আর কোথায় রহমান!” “ভুল বুঝোনাকো দাদা। বড়ো দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম, কাছেই রহমানের বাড়ি। সে যদি একবার এসে দেখে,ক্ষতি কী ?” জলভরা চোখে প্রেসিডেন্টের স্ত্রী বললেন, “ মিনতি,আমি তোমাকে বলছি, তুমি যাও। তাকে ডেকে নিয়ে আসো।”  মিনতি পিসি এক মুহূর্তও দেরি করল না।


প্রেসিডেন্টের ছেলের অবস্থার কথা শুনে রহমান বলল, “পিসি, উনি আমাকে খুব তুচ্ছ বলেই ভাবেন। তবুও যেতে আমার বাধা নেই। অহংকার আমি করি না। তবে কথা কী – আমার কোনো পরামর্শ উনি মেনে নেবেন না।” “নেবে রে নেবে। তুই চল্ কেনে।” রহমান পিসির কথা ফেলতে পারলো না।


রহমান পৌঁছাতেই ডাক্তার রমনের চার চাকার গাড়িটাও বাঁশি বাজিয়ে এসে থেমে গেল। রহমান তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্মোধন করে নিজের পরিচয় দিল। বিনিময়ে ভাগ্যে জুটল উপহাসের ডালি ভরা উপহার। “ওঃ তুমিই তাহলে রহমান ডাক্তার।” মৃদু হাসলেনও। এরপর তিনি মেজাজের সুরে নির্লজ্জভাবে প্রেসিডেন্টকে বললেন, “এরকম একজনকে ডাকবেন তো আমাকে ডাকলেন কেন? কাজটা ঠিক করেননি মশাই। তাছাড়া এতটা রাত করে আমি কোথাও যাই না। শুধু আপনি বলেই না বলতে পারলাম না।” প্রেসিডেন্ট অবশ্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন। বললেন, “হাবল আমার একমাত্র ছেলে,তাই একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম।” রমন একথায় কিছুটা শান্ত হয়ে রোগীকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। শত অপমান সহ্য করে সরল মনে রহমানও পাশে বসে রোগীকে দেখলো, শুনলো। এরপর রমন ভাবনা-চিন্তা করে ওষুধ নির্বাচন করে দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় রহমান তাকে কিছুটা কৌতুহল বশতঃই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, কী নির্বাচন করলেন?” সকলের সামনে অগত্যা বলতেই হলো।  “আর্সেনিক এলব – ২০০”। রোগীর কথা চিন্তা করে রহমান বলেই ফেলল, “স্যার, ‘আর্স এলব’ শরীরে ঢাকা নেয় কিন্তু মাথায় নেয় না। রোগী তো গোটা শরীরই ঢাকছে। বারবার  জল খাচ্ছে, বমি করছে, পিত্ত উঠছে। এই লক্ষণটা অবশ্য আর্স এলবেও আছে। কিন্তু  যখন ঘাম দিচ্ছে, শরীরের যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে,অথচ মাথার যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে না। এই লক্ষণটা তো আর্স এলবে নেই। তাছাড়া রোগীর তো অস্থিরতা, মৃত্যুভয়, দেহের ভেতরে জ্বালাপোড়া নেই। আর মাঝে মাঝে তীব্র যন্ত্রণায় রোগীর মনে হয় – ভিতরের হাড়গোড় সব ভেঙে গেছে।”  “হোমিওপ্যাথিটা ভালো করেই চর্চা করছো মনে হয়।” “সামান্যই বলতে পারেন।” “তো তুমি কী নির্বাচন করলে শুনি?” “ইউপেটোরিয়াম পার্ফো – ২০০ ।”  রমন মাথা নীচু করে কত কিছু ভাবলেন। তারপর ইউপেটোরিয়াম পার্ফো – ২০০ বের করে তিনটি ডোজ বানিয়ে দিয়ে বললেন,  “এখনই এক ডোজ, বাকি দুই ডোজ তিন ঘন্টা পর পর। আর সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা হোক।” রহমান তার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। রমনও আর বসলেন না, মোটা অঙ্কের ফি আর ওষুধের দাম নিয়ে গাড়িতে চাপলেন।


পরদিন সকাল হতেই খবরটা বিদ্যুৎ গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মিনতি পিসি দৌড়ে এসে খবরটা দিল, “ রহমান, তোর ওষুধে কাজ হয়েছে।”  রহমানের দু’চোখে তখন আনন্দের অশ্রুধারা। সোফিয়া এসে পাশে দাঁড়াল। ভেতরটা তার অসীম নির্জনতায় ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে। রহমান শুনতে পাচ্ছে সেই কান্নার সুর। ছোট্ট নূরজাহানও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে বুকে নিয়ে রহমান বলে উঠল, “সোফিয়া, দুঃখের মধ্যেও যে এত সুখ আছে, আজ বুঝি তার সন্ধান পেলাম।”


………………………………………………………