Hridayer Bandhan – হৃদয়ের বন্ধন

সুজাতা বিছানায় পড়ল। কী যে অসুখ, মুখ ফুটে বলে না, ডাক্তারবাবুও কূল-কিনারা খুঁজে পায় না। সুদর্শন সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফেরে যখন, রাত নেমে আসে পৃথিবীর উপর। হাত-মুখ ধুয়ে, ক্লান্তি কাটিয়ে, দু’মুঠ মুখে দিয়ে বসে টিভির সামনে। ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায় একরত্তি মেয়ে ‘পিপাসা’। দু’বছর এখনও পূর্ণ হয়নি। বাবা-মায়ের আদর পায় না। বড় হয়ে উঠছে এক সেবিকার স্নেহ-মমতার পরশে।

ফাল্গুন মাস পড়েছে। এক বিকেল। সেবিকার জরুরি ফোন পেয়ে সুদর্শন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলো। সুজাতার কাছে  এসে বসল। মাথায়, কপালে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সুজাতা? গরমে কষ্ট হচ্ছে? শ্বাসকষ্ট কখন থেকে?  দুঃচিন্তা ক’রো না। ডাক্তারবাবুকে এক্ষুনি ডাকছি।” সুজাতা বারণ করে, “না, ডেকো না। এইতো আমি এখন স্বাভাবিক বোধ করছি।”

সুদর্শন মনে মনে বলে, “সুজাতা, আমি তোমার কাছে এসে বসতেই অমনি তুমি সুস্থ হয়ে গেলে?” সুজাতাও মনে মনে ভাবে, “তুমি আমার কাছে থাকলে আমার সব রোগ পালিয়ে যায়। আসলে কী জানো, আমি জানি না, কেন যে দুশ্চিন্তা হয়, এই বুঝি তুমি আমার থেকে দূরে চলে গেলে। কিন্তু সেকথা আমি তোমাকে বলতে পারি না। ভালবাসার পাত্রকে কেমন করে সন্দেহের চোখে দেখি?” সুদর্শন এবার ভাবতে থাকে, “আমার জীবনে যা ঘটে চলেছে, সে এক কঠোর সত্য। তবে কি সেই সত্য সুজাতা জানে?” সুজাতা এবার জিজ্ঞেস করে, “সুদর্শন, কেউ কি ভবিষ্যৎকে দেখতে পায়?” “এ কেমন প্রশ্ন, সুজাতা? তুমি দর্শনের ছাত্রী ছিলে, জানি। তাই বলে …….। না না সুজাতা, এ তোমার এলোমেলো চিন্তা। বুঝেছি ,এটাই তোমার অসুস্থ হবার কারণ।” সুদর্শন আশ্বস্ত হয়, ‘যাক্, সুজাতা সত্যটা জানে না।’ সুজাতা এবার জোর দিয়ে বলে, “কিন্তু আমি যে আমার ভবিষ্যৎকে দেখতে পাই।” “তুমি দেখতে পাও! সত্যিই তুমি মানসিক রোগী হয়ে গেছো।” “না গো, আমার কোনও অসুখ নেই। হ্যাঁ, একথা ঠিক, ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।” “তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবো না। অলীক কল্পনার রাজ্যে বিচরণ ক’রো না। সুজাতা, আমরা অতীত, বর্তমানকে দেখতে পাই, ভবিষ্যৎকে দেখতে পাই না। কেবল অনুমান করতে পারি। সেই অনুমান তো কল্পনামাত্র।” “কল্পনা আসে বাস্তব থেকেই। আবার কল্পনাও একদিন বাস্তবে পরিণত হতে পারে। তুমি কি জানো, মানুষের মনেরও চোখ আছে। সেই চোখে সবাই হয়তো দেখতে পায় না। কিন্তু আমি আমার ভবিষ্যৎকে দেখতে পাই।” “ঠিক আছে, তুমি তোমার ভবিষ্যতের কথা বলো দেখি, শুনি।” “শুনবে! সে ভারী দুঃখময়। দেখতে পাই, আমি পড়ে আছি একা গভীর অন্ধকারে। বড় অসহায়। তুমি চলে গেছো অনেক দূরে, যেখান থেকে আর ফেরার উপায় নেই।” “ওঃ তুমি আমার মরণের কথা বলছো? এই দেখো, মরণ তো একদিন সবারই হবে। সবাই যে যার মতো না ফেরার দেশে চলে যাবে। তবে সাথে সাথে এও তোমাকে বলি, এ তোমার অলীক কল্পনা।”  “অলীক কল্পনা নয়। আর বালাইষাট, আমি তোমার মরণের কথা বলব কেন? মরণের পথযাত্রী তো আমিই হব। এই দেখ, কী বলতে যে কী বলে ফেললাম। আসলে আমি যে তোমায় বড় ভালোবাসি। তোমার হৃদয়কে আমি যে ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছি। তাই বুঝি এমন করেই ভাবছি।” সুদর্শন এখন বড়ই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগল, “সুজাতা কি সত্যিই আমার মনের মাঝে লুকানো সত্যটা জেনে ফেলেছে? তাই কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? কিন্তু তা যদি হতো, এতদিন ধরে কি সেই সত্যের মুখোমুখি হয়ে বজ্রনিনাদ ঘটাতো না?”

এমন সময় সেবিকা চা নিয়ে ঢুকল। কোলে তার পিপাসা। “বৌদি, চা খেয়ে নাও। ভালো লাগবে। দাদা, তুমিও নাও।” পিপাসাকে কোলে টেনে নিল সুদর্শন। তারপর চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দেয়। “বৌদি, তোমরা কথা বলো। পিপাসা তো ওর বাবার কোলে বেশ আছে। আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি। একটু পরে এসে ওকে নিয়ে যাবো,”  এই বলে সেবিকা চলে যাচ্ছিল। সুজাতা ডাক দিল, “রঞ্জনা, শোন্। এক গ্লাস জল নিয়ে আয়। বড্ড পিপাসা লেগেছে।” “দাঁড়াও, আনছি,” বলে রঞ্জনা জল আনতে চলে গেল।

পিপাসা মায়ের কোলে যাবার জন্য বায়না ধরল। ‘মা’, ‘সোনা’ বলে বাবা আদর করতে লাগলো, আর বোঝাতে লাগলো, “সোনা মা, দেখছো না, মায়ের শরীর খারাপ। তোমাকে নেবে কেমন করে?” সুজাতাও বোঝায়, “হ্যাঁ সোনামণি, তুমি বাবার কোলেই থাকো। তোমার মায়ের সত্যিই শরীর খারাপ।” ছোট্ট পিপাসা মায়ের কথা যেন বুঝতে পাড়ল, আর বাবার আদর পেয়ে চুপ করে রইল।

সুজাতার চোখে জল আসে। ভেতরের কত যে ব্যথা কথার মালা হয়ে ফুটে ওঠে, “কতদিন পর আজ তুমি মেয়েটাকে কোলে নিলে! বাবার একটুখানি আদর পেল। দেখতো, কেমন চুপ করে গেল! বুঝতে শিখেছে। আমিই বা ওকে কতটুকু আদর করতে পারি! আমরা থেকেও মেয়ে আমাদের অনাথ। রঞ্জনা আছে বলে বাবা-মায়ের শূন্যতা বুঝতে পারে না। সপ্তাহে শনি,রবি দু’টো দিন ছুটি পাও, তাও বাড়ি থাকো না। ক্লাবে যাও, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও, ঘুরে বেড়াও। শুধু আপনজনকে সময় দিতে পারো না। রঞ্জনার ফোন পেয়ে আজ ছুটে এলে। কেন এলে, কোন্ মন নিয়ে আজ ছুটে এলে, আমি জানিনা। জানতেও চাই না। শুনলাম, দু’দিন বাদে বেড়াতে যাচ্ছো। সেকথাটাও জানাওনি। সহধর্মিনী হিসেবে সে অধিকারও আজ আমার নেই।”

সুদর্শন ভাবতে বসল, “এই রে, সুজাতাকে  বেড়াতে যাওয়ার কথা কে জানালো? প্রতিবারই আমরা সহকর্মীরা মিলে বেড়াতে যাই। সুজাতাও সঙ্গে যায়। এবার জানাইনি। যদি বলি, ‘তুমি অসুস্থ, যেতে পারবেনা। তাই জানাইনি,’ এ তো নিছকই কাঁচা যুক্তি হয়ে যাবে। সুজাতা মানবে না। বরং আমার দুর্বলতা ওর কাছে আরও বেশি করে প্রকাশ হয়ে পড়বে। অরুন্ধুতী আমার  সহকর্মী-বান্ধবী, বার দু’য়েক এ বাড়িতে এসেছে। সুজাতার সাথে ভালো আলাপও হয়েছে। ওর ফোন নাম্বারও নিয়েছে। তবে কি অরুন্ধুতীই সুজাতাকে …….? না না , অঙ্কটা তো মিলছে না। অরুন্ধুতী নিজেই চায় না যে, সুজাতা এবার আমার সঙ্গে যাক। তাই যদি হয়, তবে এও তো হতে পারে যে,  অরুন্ধুতী নিজে একবার পরখ করে নিতে চেয়েছে, সত্যিই সুজাতা যাচ্ছে কিনা? অঙ্কটা খানিকটা মিলল। এখন আবার মনের মধ্যে অন্য প্রশ্নও জাগছে। ‘একটা বছর ধরেই সুজাতা মানসিকভাবে অসুস্থ।’ আবার একথাও সত্য যে, একটা বছর ধরে আমার-অরুন্ধুতীর মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, ক্রমে তা গাঢ় হয়েছে। সেসব কি সুজাতা আঁচ করতে পেরেছে? তাই বুঝি ওর মনের আকাশে প্রবল ঝড় উঠেছে? কিন্তু তাহলে কি, যতই চাপা মনের হোক, সুজাতার ভেতরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরিটা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বিস্ফারিত হত না? এক্ষেত্রে কিন্তু অঙ্কটা মিলছে না। যাক্, একটা বিষয়ে নিশ্চিত হলাম যে, আমার-অরুন্ধুতীর বন্ধুত্বের কথাটা সুজাতা জানে না। অফিসের বাইরেও আমরা কোথাও একসঙ্গে যাইনি। তাহলেও …..।” সুদর্শনের ভাবনার যেন শেষ হয় না।

এরই মধ্যে রঞ্জনা জল নিয়ে এলো। পিপাসা এবার মায়ের কাছে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠল।  জল খেয়ে সুজাতাও হাত বাড়িয়ে দিল। মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে গেল পিপাসা। বসে থেকে কিছুক্ষণ আদর করে ফের রঞ্জনার কোলে তুলে দিল। রঞ্জনা পিপাসাকে নিয়ে চলে গেল অন্য ঘরে।

সুজাতা কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠল। “কই, প্রশ্ন করলে না তো, কে আমাকে জানালো তোমাদের বেড়াতে যাবার কথাটা? তুমি নীরব মানেই ধরে নিতে পারি, তুমি জানো না। তবে শোনো, ‘অরুন্ধুতী’ আজ আমাকে কী মনে করে ফোন করেছিল, জানিনা। ‘কেমন আছি’,  জানতে চেয়েছিল। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পরক্ষণেই আবার জিজ্ঞেস করে বসল – আমি বেড়াতে যাচ্ছি কিনা। বললাম, ‘শরীর অপারগ। মনও চায় না।’ ওর কাছেই সুখবরটা পেলাম।” “হ্যাঁ, হঠাৎ করেই ঠিক হয়েছে।  দু’রাতের জন্য দিঘার হোটেল বুক করা হয়েছে। তোমাকে বলি বলি করে বলা হয়নি।” “বলোনি, ভালই হয়েছে।  আমারও ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হতে চলেছে। একটু একটু করে বন্ধনটা শিথিল হওয়া, হয়তো তারই পূর্ব লক্ষণ।” “এভাবে অহেতুক উল্টোপাল্টা করে ভেবোনা। মানসিক জটিলতা তাতে বাড়বে বই কমবে না। রোগটাও বেড়ে যাবে।” “কী করবো? আমি তো চাই দুশ্চিন্তা কমাতে। পারছি কই? হয়তো এভাবে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে, দুশ্চিন্তার পাহাড় জমতে জমতে একদিন আমার ভালোবাসার মনটা মরে যাবে। তারপর শরীরটাও একদিন শেষ হয়ে যাবে।”

সুদর্শন আর কোনো প্রতিক্রিয়া দিল না। রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভিটা চালালো। একটি চ্যানেলে ধারাবাহিক চলছিল, তারই দৃশ্যে মনোনিবেশ করল। দু’জন বিবাহিত-বিবাহিতা পুরুষ-মহিলার পরকীয়ার কাহিনী। তাদের অবাধ স্বাধীনতা।

সুজাতা টিভির পর্দায় চোখ না রাখলেও বুঝতে পারে, একদিকে সুখের সংসারে ভাঙ্গন,অন্যদিকে নতুন করে ফুলশয্যার স্বপ্নে বিভোর দু’টি জীবন। সে প্রশ্ন করে, “সুদর্শন, “জীবনে প্রেম বুঝি বারবার আসে, তাই না?” উত্তরটা নিজেই দেয়, “সে বহুরূপী,ভীষণ চঞ্চল, ছলনাময়ী। এমনটা না হলেই ভালো হতো। স্রোতস্বিনী নদীর মতো। এপাড় ভাঙ্গে, ওপাড় গড়ে। কখনও সুন্দর, কখনও কুৎসিত। কিন্তু পৃথিবীকে দেখ। তাঁর আকাশে একটাই চাঁদ। কী সুন্দর! চির সুন্দর। তোমারও কি তাই মনে হয় না, সুদর্শন?”

সুদর্শন টিভির পর্দা থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। ঝলমলে রঙিন দৃশ্য তার মন কেড়ে নিয়েছে। শুনলোই না প্রশ্ন, কী উত্তর দেবে? সুজাতা নীরব হয়ে গেল। তার মনের আকাশে কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে। এ ঝড় সহজে থামবে না। ধারাবাহিক শেষ হলে সুদর্শন বেরিয়ে পড়ল সান্ধ্যভ্রমণে। আর সুজাতা? মনের ঘরে দরজা এঁটে একাকিনী পড়ে রইল সব আলো নিভিয়ে দিয়ে।

রাত পেরিয়ে দিন। দিন পেরিয়ে রাত। আবার দিন, আবার রাত। ঘুম আসে না। অবশেষে তন্দ্রা এসে আচ্ছন্ন করে।  অতীতের সুখের স্মৃতিগুলো দুঃখের সিন্ধু-পাড়ে এসে ভিড় করে। স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমায় সুজাতা।

হৃদয়ের বন্ধন

ফাগুনের দখিনা বাতাস বইছিল। জীবনের বসন্ত কাননে সেদিন সুজাতা প্রথম হেঁটে চলেছিল। দেখা হয়েছিল সুদর্শনের সাথে। শুরু হয়েছিল একসাথে পথচলা। সুদর্শন বেকারত্বের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠল যখন, সুজাতা দেখিয়েছিল আশার আলো। একদিন খরাপীড়িত ভূমিতে ঝমঝমিয়ে নেমে এল এক পশলা বৃষ্টি। হৃদয়ের বন্ধনে পরিণতি পেল ভালবাসা। বেঁধেছিল সুখের ঘর।

বছর ঘুরে এলো। সুজাতা একদিন সুখবর দেয় একান্ত আপনজনকে, “ওগো আমাদের সন্তান আসতে চলেছে পৃথিবীতে।” সুদর্শন খুশি হয়ে বলে, “আমাদের ঘরে একটা ফুটফুটে মেয়ে আসুক, যে তোমারই মতো কোমল, সুন্দর। নাম রাখব তার ‘পিপাসা’।” সুজাতা হেসে বলে, “মহাশয়ের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, মেয়ে যদি না হয়, তাছাড়া আরও কত নাম থাকতে পিপাসা কেন?” সুদর্শনও হেসে হেসে উত্তর দেয়, “আমার আশাই পূর্ণ হবে। আমাদের মেয়েই হবে। আর আমি ভাবি – খরাপীড়িত রাজ্যে তোমার শুভ আগমনের বার্তা পেয়েছিল তৃষ্ণার্ত পথিক। তুমি এসেছিলে। বৃষ্টিও নেমেছিল। তুমিই যে আমাকে দিয়েছিলে পিপাসার জল। স্নিগ্ধ-শীতল ভূমিতে আমাদের মিলন হয়েছিল। দু’জনের ভালবাসার উপহার স্বরূপ তাই আজ যাকে আমরা পেতে চলেছি, তার নাম অবশ্যই হবে ‘পিপাসা’।” সুজাতা অনাবিল আনন্দে হাসতে হাসতে পাগল হয়। সুদর্শন সেই মিষ্টি হাসি দু’চোখ ভরে উপভোগ করে।

এরপর সত্যিই একদিন ঘর আলো করে পিপাসা এলো। আদর-স্নেহ-মমতায় বড় হতে থাকে। এক বছরে দু’পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। আধো আধো করে ‘মা’-‘মা’, ‘বা’-‘বা’ বলতে শিখেছে। ঠিক তখনই
দূরারোগ্য মানসিক এক যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ল সুজাতা। মনের কথা সে মনের কুটিরেই গোপন রাখে। রাগ করে না, জোরও করে না, শুধু নীরবে-নিঃশব্দে ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ির মতো ম্লান হয়ে গুটিয়ে থাকে। সামনে গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে কে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে সুদর্শনকে। সুদর্শন তার উদাত্ত আহ্বান উপেক্ষা করতে পারে না। সুজাতা উঠে দাঁড়াতে অপারগ, তার রুখে দাঁড়ানোরও সাধ্য নেই। দু’টো মনের বন্ধন একটু একটু করে ছিন্ন হতে থাকে।

যখন পিপাসার  দু’বছর বয়স, সুজাতা শয্যাগত হয়। সুদর্শন সংসারে থেকেও যেন নেই। অনাথ পিপাসা সেবিকার কোলে মানুষ হয়। সুজাতা দেখতে পায় তার ভবিষ্যৎকে। বড় নির্মম। সে পড়ে আছে একা অন্ধকারে, আর সুদর্শন চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। সুদর্শন, সুদর্শন বলে আকুল হয়ে ডাকতে ডাকতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সুজাতার। “ঠাকুর, এ আমি কী দুঃস্বপ্ন দেখলাম! এই বুঝি আমার ভবিষ্যৎ।”

এমন সময় ভোরের সূচনা হয়েছে। শনিবার। সুজাতা একরাশ আতঙ্কে উঠে বাইরের দিকে তাকায়। তখনই বেড়াতে যাবার গাড়িটা দরজায় এসে দাঁড়াল। ছোট গাড়ি। ভেতরে চার জন। সবাই নিশ্চয় যাবে না। অরুন্ধুতী এবার একা। গতবার ওর স্বামী সংগে ছিল। সুদর্শন উঠে বসল ওর পাশে। গাড়ি এবার ছুটলো দিঘার উদ্দেশ্যে। ঘন্টা চারেকের পথ।

দীঘা পৌঁছালো যখন, সূর্য প্রায় মাথার উপর। স্নান খাওয়া-দাওয়া করে হোটেল-কক্ষে ক্ষণিকের বিশ্রাম। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় যে যার মতো বেরিয়ে পড়ল সমুদ্র-তীরে। আজ এই প্রথম মুক্ত নীলাকাশের নীচে অরুন্ধুতী-সুদর্শন একসাথে ঘুরে বেড়াবে। জনসমাগম এড়িয়ে হাতে হাত ধরে অনেকটা দূরে নির্জন সমুদ্র তীরে এসে পৌঁছালো দু’জন। যে সম্পর্ক এতদিন ‘আপনি’-‘তুমি’তে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ এই বেলায় ঊর্ধ্বতন-অধঃস্তন সহকর্মীর বিভেদ মুছে ফেলে শুধু ‘তুমি’ আর ‘তুমি’তে পর্যবসিত হয়েছে।

হৃদয়ের বন্ধন

সূর্য তখন অস্তরেখার কাছাকাছি, ছোট্ট এক ঝোপের পাশে সাদা বালির উপর খবরের কাগজ বিছায়ে পাশাপাশি বসে পড়ল ওরা। এই প্রথম এত কাছাকাছি আসা। এক অবর্ণনীয় অনুভূতি দুটো মনকেই ছুঁয়ে যায়। এ সুযোগ আগে কখনও আসেনি। অনেক কথার মাঝে কখনো হাসি, কখনো চোখে চোখ, তারই মাঝে জলের সুবিশাল ঢেউ মহাকলরবে এসে আছড়ে পড়ছে বালির চরে। হৃদয়তন্ত্রীর তারে তা যেন ঝংকার তুলে দিয়ে যায়। সুরেলা কন্ঠে গান গেয়ে ওঠে অরুন্ধুতী।

ইতিমধ্যে এক ষাটোর্ধ দম্পতি বেড়ানোর পালা শেষ করে অদূরের পথ দিয়ে ফিরছিল। গানের সুর টেনে আনল তাদের।  গান শেষ হলে মহিলা হাসিমুখে বললেন, “বাঃ, সুন্দর গাও তো তুমি। অস্পষ্ট অন্ধকারে তোমার মুখখানা ভালো দেখতে না পারলেও বেশ বুঝতে পারছি, তুমিও ভারী সুন্দর। নতুন বিয়ে হয়েছে বুঝি? নিশ্চয়ই তোমাদের ভালবাসার বিয়ে। তোমার বয়সে আমিও খুব সুন্দর গাইতাম।” অরুন্ধুতী একগাল হাসল। সুদর্শন বয়স্ক লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন উপভোগ করছেন?” লোকটি আপ্লুত মনে উত্তর দিল, “খুব ভালো। সংসার জীবনে আমরা বার চারেক এসেছি। প্রথমবার তোমাদের মতোই বিয়ের পরে এসেছিলাম।আমাদেরও ভালবেসে বিয়ে ছিল কিনা। তবে এখন অনুভূতিটা অন্যরকম। কারণ, আমরা এখন সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত। একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়েছে। নাতি-নাতনি হয়েছে। নাতি-নাতনিরাও বড় হয়ে উঠেছে।” “আপনাদের দেখে মনে হয়, আপনারা বেশ সুখী।” “হ্যাঁ বাবা। চল্লিশটা বছর ধরে আমরা একসাথে আছি। তবে একটা কথা মনে রেখো, সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে। আবার স্বামীটিকেও স্ত্রীর মনের মানুষ হতে হবে। এক পুরুষের এক নারী, আবার এক নারীর এক পুরুষ, দু’টি হৃদয়ের বন্ধন তবেই  অটুট থাকে। মনুষ্যেতর প্রাণীদের শরীরের মিলন হয়, হৃদয়ের বন্ধন হয় না। বেশ, অনেক কথাই বলা হল। থাকো তোমরা। সুখী হও”, এই বলে দম্পতি বিদায় নিলেন।

সুদর্শন ভাবতে বসল, “কী বার্তা দিয়ে গেল দম্পতি! কত সুখী ওরা! একদিন আমি আর সুজাতাও ওদের মতোই হৃদয়ের বন্ধনে জড়িয়েছিলাম। এই সমুদ্র-পাড়ে বসে কত প্রহর কাটিয়েছিলাম। আমি ওকে সুখ দিতে পারিনি। ওর বিশ্বাসে আঘাত করে আমি ওকে দুঃখই দিয়েছি। ……।”

সূর্য অস্তরেখার নীচে নেমে গেছে। পাখিরা নীড়ে ফিরে গেছে। সমুদ্র এখন বেশ শান্ত। অদ্ভুত এক নীরবতা। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সমুদ্রের গর্জন সুমিষ্ট কলতানে পরিণত হয়েছে। শুক্লপক্ষের সপ্তমীর এক ফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। ফিকে অন্ধকার চারপাশে। এই মধুময় প্রহরে অরুন্ধুতী সুদর্শনের গলাটা জড়িয়ে ধরে। তার চঞ্চল শরীর মিলনের বাসনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে।    এমন সময় সুদর্শন শুনতে পাচ্ছে সুজাতার কণ্ঠস্বর, ”সুদর্শন, আমি তোমার সহধর্মিনী। কথা দিয়েছিলে, জীবনে-মরণে তুমি আমারই থাকবে। আমিও তাই বলেছিলাম। এমনই এক প্রহরে সেদিনও আকাশে চাঁদ উঠেছিল। সমুদ্র শান্ত হয়ে এসেছিল। অনন্ত আকাশের পানে আমরা তাকিয়েছিলাম। আকাশও দেখেছিল চেয়ে চেয়ে। কী করে পারলে সব ভুলে যেতে? মানুষ্যেতর প্রাণীর চেয়েও তুমি আজ অধম! আমার জীবন, ভালোবাসা, চোখের জল তোমার কাছে কি সব মূল্যহীন? একটি বারের জন্যও যদি অনুভব করতে ‘আমার বুকের ভেতরে কী যে ব্যথা!’ না থাক্। তোমার সুখের পথে আমি কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। আজ আর আমার সে অধিকার, ইচ্ছা, কোনটাই নেই। ভালোবাসার যে কুঁড়িটা ফুল হয়ে ফুটেছিল, তার সুন্দর পাপড়িগুলো অনাদরে শুকিয়ে গেছে। এই আমার ভবিষ্যৎ। আজ আর আমার কোনো অভিমান নেই। প্রার্থনা করি, তুমি সুখী হও।”

সুদর্শনের ভেতরে সহসা এক মহাশক্তির জাগরণ ঘটলো। তাঁর অমিত তেজে পশু-রূপী মানুষটা নিমেষে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। সুদর্শন হয়ে উঠলো এক সুন্দর মানুষ। প্রবল শক্তিতে এক ঝটকায় সে অরুন্ধুতীকে ঠেলে ফেলে দিল। বলল, “আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবোনা।” অরুন্ধুতী বিরক্তির সুরে বলে উঠল, “এখানে অসুবিধা হলে  চলো, হোটেলে গিয়ে আমরা একটা আলাদা ঘর ভাড়া করে নিই।” “না, আমরা সবাই একসঙ্গেই থাকবো। অরুন্ধুতী, আমি অনেক নীচে নেমে গেছি। এটা অন্যায়, মনুষ্যত্বের বিচারে ক্ষমাহীন অপরাধ,” বলতে বলতে সুদর্শন দ্রুত এগিয়ে চলে হোটেলের উদ্দেশে। পেছনে পেছনে ছুটে চলে  অরুন্ধুতী। “দাঁড়াও সুদর্শন, আস্তে হাঁটো। শোনো, একটু আগে যা চেয়েছিলাম, তা আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম। দেশের সর্বোচ্চ আদালত দু’জন পূর্ণ বয়স্কের পরকীয়াকে ন্যায়সঙ্গত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাজও মানিয়ে নিচ্ছে। তাহলে অপরাধ কোথায়?”  সুদর্শন উত্তর দেয়, “তাহলে মনে করো, আমার সমাজ আলাদা, পৃথিবী আলাদা। তাছাড়া তুমি আমার সহকর্মী। তোমাকে বন্ধুর মতোই মনে করেছি এতদিন। হয়তো সম্পর্কটা গভীর হয়েছিল। তাই বলে আমার সহধর্মিনীর আসনে তোমাকে বসাতে পারি না। তোমারও তো স্বামী আছে। মুহূর্তের আবেগে আজ যে ভুল করতে যাচ্ছিলাম, আমি তার জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। প্রয়োজনে যা শাস্তি হয়, মাথা পেতে নেব।” “একটা বছর ধরে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা তুমি এক মুহূর্তে ভেঙে দেবে সুদর্শন?” “আর যে সম্পর্কই হোক্, অরুন্ধুতী,তা হৃদয়ের সম্পর্ক হতে পারে না।”

হোটেলে ফিরে সুদর্শন শুয়ে পড়লো বিছানায়। দুশ্চিন্তায় মনটা বড় উচাটন করছে। “আমার সুজাতা কেন অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তিল তিল করে শরীরটা ক্ষয়ে যাচ্ছে, আজ আমি বুঝতে পারছি। অথচ মুখ ফুটে কখনো কোনদিন অভিযোগ করেনি। ……..।” দুশ্চিন্তার প্রহর গুনতে গুনতে রাত গভীর হয়। ঘুম ধরে না চোখে। নিশতির প্রহরে আচ্ছন্ন ভাব আসে।  সন্ন্যাসীর বেশে কে একজন সামনে এসে দাঁড়ায়। তাঁর সারা গায়ে তীব্র আলোর ছটা। মধুর কন্ঠে সে বলে উঠল, “সুদর্শন, তুই কামিনী-কাঞ্চনের অদম্য বাসনা, লালসার  হাতছানি উপেক্ষা করতে পেরেছিস, যা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তুই ধন্য, আর সব অপরাধ থেকে মুক্ত। শাস্তি চেয়েছিলিনা? মুকুব করে দিলাম। তুই জীবনে সুখী হবি।”

সুদর্শন চোখ মেলে তাকায়। অদৃশ্য হয় সন্ন্যাসী। মনে প্রশান্তি আসে। ঘুম ধরে চোখে। ভোর রাতে স্বপ্ন দেখে, সুজাতা চলে যাচ্ছে চির বিদায় নিয়ে। বলে যাচ্ছে, “সুদর্শন, এই আমার ভবিষ্যৎ। যা আমি  নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলাম। তুমি সুখে থেকো। বিদায়!” “না সুজাতা, তুমি চলে যেও না। এ সুখ আমি চাই না।” ঘুম ভাঙ্গে। ভয়ে, একরাশ শূন্যতায় শিউরে ওঠে।

সকাল হয় ভারাক্রান্ত বেদনা নিয়ে। মন টানছে বাড়ির দিকে। সহকর্মীরা বোঝায়, “অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে হয়তো বেশি দুশ্চিন্তা করছেন, তাই স্বপ্ন দেখেছেন। দুর্বল মনের প্রতিক্রিয়া।” সুদর্শন মনে মনে বলে অন্য কথা, “আমার জীবনের গতিপথে এক অমোঘ সত্য লুকিয়ে আছে। তোমরা তা জানো না। বড় ঘৃণা হয় নিজের উপর। কিন্তু আমার মন বলছে, সুজাতার জীবনে নির্মম কিছু একটা ঘটতে চলেছে। …….।”

এমন সময় হোটেলের বাইরে থেকে সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “বনমালী গো,  পরজনমে হইও রাধা। ……।” ”নারী কন্ঠে কে গাইছে এই গান?” জানবার কৌতুহলে বাইরে বেরিয়ে এলো সুদর্শন। দেখল, এক ভিখারিনী তার অক্ষম স্বামীকে ধরে নিয়ে গান গাইছে আর পথে পথে ভিক্ষা করছে।  সুদর্শন বিষ্ময়ে ভাবতে লাগলো, “মাঝ বয়সী ভিখারিনী, সুস্থ এবং বেশ সুন্দরী। স্বামীর প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা। ইচ্ছে করলেই নতুন করে সংসার বাঁধতে পারে কিংবা কারও হাত ধরে ফুর্তির স্রোতে গা ভাসাতে পারে। এত দুঃখ, কষ্টের মধ্যেও কোন্ মহামন্ত্র-বলে দুটি হৃদয়ের বন্ধন এত দৃঢ়, জানিনা। সত্যিই আমি তা জানিনা। গান শেষ হলে দশটা টাকা হাতে দিয়ে শুধোল, “তোমাদের খুব কষ্ট হয়, তাই না?” ভিখারিনী উত্তর দিল, “না বাবু, ঈশ্বরের কৃপায় বড় শান্তিতে আছি। আর আপনারা আমাদের পাশে আছেন বলেই মনে বল পাই। এই অক্ষম মানুষটার সেবা-যতনে ত্রুটি রাখি না। আমার আরাধ্য দেবতা। একদিন আমার সুখের জন্য কত কিছু করেছে! গাড়ি চালাতো। আজ থেকে দশ বছর আগে একদিন মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাণে বাঁচবে, ডাক্তারবাবুরাও আশা করেননি। পরম করুনাময় আমার কাতর প্রার্থনা শুনেছিলেন,” এই বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে চলল ভিখারিনী।

সুদর্শনের অন্তর্যামী এখন চিৎকার করে বলছে, “নিঃস্ব-নিপীড়িত মানুষগুলোর ভিতরে যে মনুষ্যত্ব আছে, তুই তা অর্জন করতে পারিসনি সুদর্শন। শতবার ধিক তোকে।” মুহূর্তে মোবাইলটা বেজে উঠলো। রঞ্জনা ফোন করেছে, “দাদা, জীবনদীপ নার্সিংহোম থেকে বলছি। বৌদির অবস্থা ভালো নয়। যত তাড়াতাড়ি পারো, চলে এসো।”

সুদর্শন আর কী শান্ত থাকতে পারে? আজকে রাত কাটিয়ে কাল ভোরে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু না, এক মুহূর্তও দেরি নয়। উন্মাদের মতো ছুটলো গাড়ি ভাড়া করতে। প্রায় দ্বিগণ টাকায় উচ্চগতির একটা গাড়ি পাওয়া গেল। অরুন্ধুতীও ছুটে এসে সামনে দাঁড়াল। লজ্জায়, নিজের প্রতি ঘৃণায় মাথাটা নত হয়ে গেল। হাত জোড় করে বলল, “সুদর্শনবাবু, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। প্রলোভনটা আমিই আপনাকে দেখিয়েছিলাম।” সুদর্শন চোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ছুটলো  নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে।

তিন ঘণ্টায় গাড়ি চলে এলো নার্সিংহোমে। তখনও সুজাতা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।  দরজার ওপাশে রঞ্জনা পিপাসাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট্ট সোনামণি ‘মা’, ‘মা’ বলে ডাকছে। রঞ্জনার দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। ভেতরে আছেন অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবু আর এক সিস্টারদিদি। সুদর্শন  দৌড়ে এসে ভেতরে ঢুকে হাতজোড় করে কাতর আবেদন জানালো, “ডাক্তারবাবু, সুজাতা আমার স্ত্রী, ওকে বাঁচান। আমার দু’বছরের মেয়েটা কার স্নেহে মানুষ হবে?”

ডাক্তারবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঊর্ধ্বপানে তাকালেন। “আপনি এসেছেন! বেশ ভালো হলো, পাশে বসুন। আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, চাপা দুঃখ-শোকে ওনার ভেতরে যে ব্যাধির জন্ম হয়েছে, তাতে বাঁচার আশা ক্ষীণ। তার উপরে অধিক মাত্রায় ঘুমের ওষুধ সেবন, অত্যন্ত বিপজ্জনক। যদি জ্ঞান ফিরে আসে, একটাই উপায় বাকি আছে, স্বামী হিসেবে আপনার সান্নিধ্য পাওয়া। আমি আমার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এখন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছা,” এই বলে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে গেলেন। কর্তব্যরত সিস্টারদিদিও কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেলেন। সুদর্শন আকুল হয়ে ডাকতে লাগলো, “সুজাতা, চোখ খোলো। চোখ খোলো সুজাতা। চেয়ে দেখো, এইতো আমি এসেছি।” মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রার্থনা করল, “হে ঈশ্বর, তুমি আমাদের হৃদয়ের বন্ধন ছিন্ন ক’রো না।”

কিছুক্ষণ বাদেই জ্ঞান ফিরলো সুজাতার। চোখ মেলে দেখল সুদর্শনকে। চোখের কোনে জল। সুদর্শনও চোখ মুছতে লাগলো। সিস্টার এসে বললেন, “দাদা, বড় সৌভাগ্য আপনার। ডাক্তারবাবুকে চটজলদি ডাকলেন। ছুটে এলেন ডাক্তারবাবু। চোখে-মুখে তাঁর একরাশ আনন্দ।  “সুদর্শনবাবু, এবার আপনার সাহচর্যই ওনাকে জীবনের পথে ফিরিয়ে দেবে। আমার কাজ শেষ,” এই বলে তিনি বিদায় নিলেন। রঞ্জনা পিপাসাকে নিয়ে ভেতরে এল। পিপাসার দু’গাল ধরে একটু আদর করে সিস্টারও চলে গেলেন। সুদর্শন সুজাতার দু’হাত ধরে অন্তর থেকে ক্ষমা চাইলো। “তোমাকে অনেক কথা বলার আছে, সুজাতা, ঈশ্বর আমাকে ‘অধর্মের পথে পথচলা’ থেকে  বিরত করেছেন। আর তোমার অন্তরের ভালোবাসা আমাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে এনেছে। তুমি বুঝতে পেরেও আগে কেন আমাকে ফেরাওনি? শুধু গুমরে গুমরে কেঁদেছো, আর তিল তিল করে নিজেকে নিঃশেষ করেছো। জানিনা, হৃদয়ে তুমি কত যন্ত্রনা সয়েছো!”

পিপাসা মায়ের  মুখপানে তাকিয়ে আছে। সুদর্শন মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। বলে, “কত আদরের সোনামণি।” সুজাতার চোখ রেখে বলে, “তোমার-আমার ভালোবাসার ফল।   স্নেহ-মমতা-ভালবাসা থেকে আর কখনও বঞ্চিত হবে না।” সুজাতা মুখ তোলে। চোখে  পলকহীন কোমল দৃষ্টি। তার অন্তর্যামী বলে ওঠে কত কথা, “ঠাকুর, এই ফাগুনেরই এক সাঁঝবেলায় তোমাকে সাক্ষী রেখে দুটি হৃদয়ের বন্ধন রচিত হয়েছিল, তুমি তা ছিন্ন হতে দাওনি। জীবনের চলার পথে অন্ধকার নেমে এসেছিল, তুমি জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছো। তোমার জগত-সংসারে যে সংসার আমরা পেতেছি, জীবনভর এমনি করেই তুমি রক্ষা ক’রো।”

শুরু হয় সুদর্শন-সুজাতার জীবনের নুতন অধ্যায়। চির বসন্তের দক্ষিণা বাতাস বয়ে চলে হৃদয়-কাননে।

.
……………………………………………………