Mayamrigo – মায়ামৃগ

 

মায়ামৃগ

                               – হরবিলাস সরকার


“কাছের মানুষ, কাজের মানুষ বাইজিদ বিশ্বাস জিন্দাবাদ, ‘জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’। ঘরের ছেলে বাইজিদ বিশ্বাস যুগ যুগ জিও, ‘যুগ যুগ জিও, যুগ যুগ জিও’। এবার ভোটে  জিতছে কে? ‘বাইজিদ বিশ্বাস, আবার কে?’ দিকে দিকে উঠছে রব, ‘জব্দ হবে শাসক তোমার জামানত’। শ্রমিক-কিষান একজোট,  ‘হরিণ চিহ্নে সব ভোট’। মা-বোনেরা একজোট, ‘হরিণ চিহ্নে সব ভোট’। ………।”

মিছিলটা ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। মিছিল তো নয়, জনসমুদ্র। উজ্জীবিত, প্রাণবন্ত  জনতার ঢেউ সমস্ত পিচ-রাস্তা জুড়ে ধেয়ে আসছে। হাজার হাজার উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর অনুরণিত হচ্ছে আকাশে-বাতাসে। এ যে স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে মানুষের দৃঢ় অঙ্গীকার, “আমরা করব জয়, হবে নিশ্চয়। …….।”

রাস্তার দু’ধারে অগণিত মানুষ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। গৃহবধূ, বয়স্ক মা-বাবা, এমনকি ছোটরাও এসেছে। কারও হাতে ফুল, কারওবা হাতে ফুলের মালা। এক আম্মি নিজ হাতে গাঁথা হরেক পুষ্পশোভিত একটি মালা দু’হাতে ধরে নিয়ে অধীর অপেক্ষায়। তাঁর নির্মল হাসি, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছে। “ওই তো, সবার আগে আমার আজাদ আর রাহেনা ফেস্টুন ধরে হেঁটে আসছে। ফেস্টুনের ওধারে মাঝ বরাবর বাইজিদ বিশ্বাস, আরও কয়েকজন করজোড়ে মানুষকে নমস্কার জানাচ্ছে, আর ওদের মাথার উপর বর্ষিত হচ্ছে পুষ্পবৃষ্টি। বাইজিদ তো আমার ছেলেরই মতো। না, মতো নয়, ও আমার বড় ছেলে, আমাদের সবারই ঘরের ছেলে। ভোটে জিতে ও এই করণদীঘির নাম উজ্জ্বল করবে, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকবে,  সুখ-দুঃখের অংশীদার হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। সেই শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ে ওর পাশে থাকবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। ………..।”

মিছিল খুব কাছে আসতেই আম্মি তাঁর বড় ছেলের গলায় পরিয়ে দিল মালা। ছেলেও তা সাদরে গ্রহণ করল। তারপর আম্মি আজাদকে বলল, “দে বাপ ফেস্টুনটা আমার হাতে।” ফেস্টুন দণ্ড হাতে নিয়ে উচ্ছ্বাসে আম্মি পা মেলাতে লাগলো মিছিলে। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশী মা-বোনেরাও যোগ দিল।

বিস্তীর্ণ এলাকার মাঝখানে চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছে মিছিল থেমে গেল। সেখানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাইজিদ আবেগময় কণ্ঠে বলতে লাগলো, ”আমার মা, বাবা, আম্মি, আব্বাজান, দাদা, দিদি, ভাই ও বোনেরা, আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের জন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমি জানি এবং আমার বিশ্বাস –  আপনাদের আশীর্বাদ বৃথা যাবে না। আপনারা অনেক আশা নিয়ে এসেছেন এবং আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আপনাদের মনের কথা আমি বুঝি। নির্যাতিতা,অসহায় মা-বোন, তোমাদের চোখের জল আমি প্রতিদিন দেখতে পাই, শুনতে পাই কান্নার করুণ সুর। আমার হৃদয়তন্ত্রীর তারে সেই ক্রন্দন-ধ্বনি এসে বাজে। আমি ব্যথায় কাতর হই। তোমরা তো আমারই মা, আমারই বোন। শুনতে পাই কত দুর্ভাগা পিতার দীর্ঘনিঃশ্বাস। কত অবলা শিশু বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কর্মহীন কত ভাই-বোনের স্বপ্ন মিলিয়ে যায় মরীচিকায়। আমি জানিনা, আর কত অশ্রু ঝরবে! কথা দিচ্ছি, আমি সবার পাশে আছি,থাকবো। দীন-দুঃখী, নিপীড়িত, বঞ্চিত, সর্বহারা, সবার সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে দিন কাটাবো। এ আমার শুধু কথা নয়, অশ্রু দিয়ে লেখা এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। ……..।”

বক্তৃতা শেষ হলো যখন, জনতা অভিনন্দন জানালো হাততালি দিয়ে। শুধু হাততালিই নয়, মুহুর্মুহু স্লোগান উঠল। “বাইজিদ বিশ্বাস জিন্দাবাদ, ‘জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’। বাইজিদ বিশ্বাস যুগ যুগ জিও, ‘যুগ যুগ জিও,যুগ যুগ জিও’। ……….।” রমজান, ফয়জল ভাই মঞ্চে উঠে গিয়ে বাইজিদকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমরা তোমার পাশে আছি।” অরুণ, রিনা, শিবু মাস্টার, পদ্ম মাসি, সেলিনা, আফসানা বিবি পুষ্প স্তবক দিয়ে এলো। বাদল মুর্মু হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে এলো, “দাদা, নিজের মানুষ হয়ে তোমার পাশে থাকবো বটে।” সবার শেষে  আজাদ আর রাহেনাকে সাথে নিয়ে উঠলো আম্মি। বাইজিদকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “বাবা, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। আজ থেকে জানবো – আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে।” বাইজিদও আম্মির পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে সম্পর্ক স্বীকার করে নিল।

বিধানসভা উপনির্বাচনের আর মাত্র কয়েকটা দিন। দিন যতই এগিয়ে আসছে মানুষের সমর্থন বাড়ছে বাইজিদের প্রতি। আর আজাদ হয়ে উঠেছে বাইজিদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। মাইকে প্রচার, বাড়ি বাড়ি ঘোরা, পোস্টার সাঁটানো, কত কী! সর্বোপরি একটা অঞ্চলের সমস্ত বুথের মূল দায়িত্ব পড়েছে আজাদের উপর। এই বুথগুলোতে শাসক দল অত্যন্ত সক্রিয়। মানুষের সমর্থনে ভাটা পড়ছে দেখে, বিশেষকরে বিগত ভোটে জেতা কেন্দ্রটা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় ভেতরে ভেতরে যত রাগ এসে পড়েছে আজাদের উপর। আজাদ তার আঁচ টের  পাচ্ছে কিন্তু তাতে সে আরও মরীয়া হয়ে উঠেছে। খবর পেয়েছে – ভোট কিনতে টাকা-পয়সা বিলি হবে। রাত জেগে দলবল নিয়ে পাহারা দিচ্ছে, যাতে প্রলোভনের টাকা-পয়সা কারো হাতে পৌঁছাতে না পারে। বাড়িতে আম্মিকেও সেকথা বলেছে। আম্মি ভয় পায়নি, বরং সাহস যুগিয়েছে, আর  বলেছে, “চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করিস্ বাপ, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। শত্রুপক্ষ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কাজ হাসিল করে নেবে।”

মায়ের উপদেশ শিরোধার্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আজাদ। ভোটের ঠিক দু’দিন আগে গভীর রাতে পাহারার কাজ শেষ করে একা বাড়ি ফিরছিল। আজ মনে হয়েছিল – শত্রুপক্ষ দমে গেছে। সামান্য অসতর্কতা বা ভুলে যে  মর্মান্তিক মুহূর্ত ঘনিয়ে আসতে পারে তা উপলব্ধি করতে পারেনি। বাড়ির দরজায় পা রাখার মুহূর্তে দু’টো গুলি বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একবার শুধু ‘আম্মি’ বলতে পেরেছিল, তারপরেই লুটিয়ে পড়ল। আম্মি জেগেই ছিল ছেলের প্রতীক্ষায়, কখন বাড়ি ফিরবে! এমন ‘আম্মি ডাক’, এ তো মরণকালের আর্তনাদ, শোনামাত্রই আম্মিরও বুক ফুঁড়ে যেন দু’টো গুলি বেরিয়ে গেল। অসীম যন্ত্রণায় উদভ্রান্তের মতো ছুটে এল আম্মি। আর্তনাদ শুনে প্রতিবেশীরাও দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। বাইরের আলোটা জ্বালানো হল। আজাদ তখনও দু’চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, যেন বলছে, “আম্মি, তুমি কেঁদোনা। তোমার তো আরেক ছেলে বেঁচে আছে।”

নির্মম খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ছুটে এলো বাইজিদ। আম্মিকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। একটু পরে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর এক ফালি চাঁদ উঠল আকাশে। রাত পোহাতে আর বেশি দেরি নেই। জনারণ্যে ঢুকলো পুলিশের গাড়ি। মানুষের দুঃসহ বেদনা, আর্তনাদ এবারে বিক্ষোভ, বিদ্রোহে পরিণত হলো। পাথর-প্রতিমা আম্মি বাইজিদকে ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। এক হাতে বুক চেপে ধরে বলল, “বাইজিদ রে, আমার আজাদ চলে গেল, তুই তো আছিস্ বাপজান। তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাস্ না।” বাইজিদ বলল, “ছেলে কি কখনও আম্মিকে ছেড়ে যেতে পারে?” পরক্ষণেই বলল,“কে বলেছে তোমার আজাদ মরে গেছে? আম্মি চেয়ে দেখো,তোমার চারপাশে সহস্র আজাদ দাঁড়িয়ে আছে। ঐ তো, ওরা তোমাকে বলছে – আম্মি, কেঁদোনা।”

এরপর ভোট হয়ে গেল। ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছে বাইজিদ। আম্মির খুশির অন্ত নেই। তাঁকে সামনে রেখে অগণিত মানুষের শোভাযাত্রা হল। এই অনাবিল আনন্দ করণদীঘির মানুষকে ভুলিয়ে দিল নিদারুণ শোক।

এদিকে উপনির্বাচনে হেরে শাসকের স্বস্তি নেই। যেন এক মহাশক্তিশালী কালবৈশাখী ঝড় ধেয়ে আসছে, সব ওলট-পালট করে দেবে নিমেষে। দুষ্টর ছলের অভাব হয়না। যে করেই হোক, মহাপ্রলয় আটকাতে বাইজিদকে দলে চাই।

কিছুদিনের মধ্যে বাতাসে একটা উড়ো খবর ভেসে এলো যে, বাইজিদ শাসক দলে যোগ দিচ্ছে। আম্মি বিশ্বাস করলো না। বলল, “বাইজিদের মতো ছেলে এ কাজ করতে পারে না। যারা তার ভাইকে খুন করেছে, তাদের সাথে সে যোগ দিতে পারে না। করনদীঘির মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেনা। আমার বাইজিদ ন্যায়ের প্রতীক, অন্যায়ের সাথে কখনোই আপোশ করবেনা।”

সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বাইজিদও বলল, “যারা আমাকে বিশ্বাস করে ভোট দিয়েছে, আমি তাদেরই একান্ত আপনজন। মানুষ অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, সেই লড়াইয়ের আমি এক বিশ্বস্ত সৈনিক। সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে যাব – এ আমার নীতি, আদর্শ। আদর্শকে রক্ষা করবার জন্যই আমার ভাই শহীদ হয়েছে, আমি আমার আম্মির চোখের জল মুছে দিয়েছি, সেকথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। ………।”

টিভির পর্দায় চোখ রেখে আম্মিও শুনলো ছেলের কথা। খুশিতে মনে মনে কত কথাই না বলল, “বড়ো ভাগ্য করে এমন সোনার ছেলে পেয়েছি। এ ছেলেকে পেটে ধরিনি তবু তার চাইতেও অনেক বেশি। সে আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারে না। …………..।”

কয়েক মাস পর

একদিন সত্যি সত্যিই বিধায়ক বাইজিদ বিশ্বাস হাতে তুলে নিল স্বৈরাচারী শাসকের পতাকা। সংবর্ধনা সভায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলল, “আজ আমি আমার প্রকৃত জায়গাতেই ফিরে এসেছি। ঢোক গিলে মনে মনে বলল,’বেফাস কিছু বলা যাবে না, যাতে সবাই বুঝে ফেলবে যে, টিকিট পাইনি বলেই দল ছেড়েছিলাম’।” একটু স্বাভাবিক হয়ে আবার বলতে লাগল, “দলের অভ্যন্তরে সামান্য ভুল বোঝা-বুঝির কারণে অন্য দলে চলে গিয়েছিলাম ঠিকই, তবে মনটা আমার এখানেই ছিল। তাছাড়া ওখানে গিয়ে মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে পারছিলাম না, করাও সম্ভব নয়। তাই নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। দলও আমাকে বরণ করে নিয়েছে।” মনে মনে আবারও ভাবল, ‘যাক্, কথাগুলো বেশ গুছিয়েই বলা হল। আশা করি – ছল-চাতুরিটা গোপনই থাকবে। দশ কোটি টাকার অফার, কে এমন সাধু-পুরুষ আছে, ছেড়ে দেবে? একেই বলে রাজার নীতি।’ পুনরায় বলতে লাগল, “এই মুহূর্তে আমার অত্যন্ত ভালো লাগছে। আজ আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। ……….।”

আজকের বাইজিদের কথা করণদীঘির মানুষেরা শুনলো, গোটা দেশ শুনলো, আম্মিও শুনলো। মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। “এ কোন্ বাইজিদ? তবে কি আমরা ওকে চিনতে ভুল করেছিলাম?” আমরা সবাই অন্যায়-অত্যাচার, স্বৈরাচারের অবসান চেয়েছিলাম। বাইজিদ রূপ বদল করে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভোটে জিতল। তারপর নিজের স্বরূপ ধরে চলে গেল। কেউ তাকে চিনতে পারিনি?” হতাশাগ্রস্ত, ঠকে যাওয়া মানুষগুলোর অন্তরে জেগে উঠল ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। “এই যদি চলতে থাকে, তবে ভোট দিয়ে কী হবে?  দেশে আইন আছে, আদালত আছে, হবে কী এই অরাজকতার নিরসন? নাকি ভোট বয়কটের রাস্তাই বেছে নিতে হবে? নাকি ভেঙে ফেলতে হবে, আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিতে হবে এই ঘুঘুর বাসা? ……….?”

আম্মি আজ আর কাঁদলো না। অশ্রুসাগর শুকিয়ে এখন খাঁ খাঁ করছে। দু’হাতে মৃত ছেলের ছবিটা কিছুক্ষন বুকে চেপে ধরে রইল। তারপর বেরিয়ে এলো দীর্ঘনিঃশ্বাস। নিদারুণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলে উঠল, “আমি তোকে চিনতে পারিনি বাইজিদ। এই তোর প্রতিদান! তুই সোনার হরিণ সেজে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলি। আমার আজাদের মতোই আমি তোকে আদর করে,  বুকভরা ভালবাসা দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছিলাম। আমার আজাদ ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জীবন দিয়েছে, ছলনা করেনি। আল্লার কাছে প্রার্থনা করি –  হে আল্লা, তুমি দেখেছো, ওরা আমার আজাদকে কেড়ে নিয়েছে, দুঃখ নেই। তোমার আশীর্বাদে ঘরে ঘরে যেন আজাদরা জন্ম নেয়। মরণের পরেও আমি শান্তি পাবো।”
……………………………………………………….