Ucchista – উচ্ছিষ্ট

 

srijanee.com
(গল্প ) –  উচ্ছিষ্ট  –  হরবিলাস সরকার

জীবনের অপরাহ্ণে একদিন অলকা তার মেয়ে ‘ফেলি’কে নিয়ে এলো কাজের বাড়িতে। ফেলি সবে বিয়ে পাস করেছে। অনেক কষ্টের বিনিময়ে ওর এই সাফল্য। এখন ভালো একটা কাজ পেলে দুঃখের জীবনটা সুখের একটু কিনারা খুঁজে পাবে। এই আশা নিয়েই বাবুকে বলল, “আপনি পৌরসভার চেয়ারম্যান। আপনার অনেক ক্ষ্যামতা। শুইনাছি, অফিসে লোক নেওয়া হইব। আপনিই পারেন মাইয়াটাকে একটা কাজের ব্যবস্থা কইরা দিতে।” বাবু বললেন, “তোমার ফলিকে তো সেই ছোটতে দেখেছি। কোলে করে নিয়ে আসতে। একটু বড় হল যখন, তখন থেকেই আর আনতে না। তারপর তো অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেল। তা ওর ভাল নাম-টাম রেখেছো কি? ফেলি নিজেই মুখ তুলে বলল, “ফুলকুমারী, ফুলকুমারী দাস।” “বাঃ খুব সুন্দর নাম তো।” অলকা আজ ভেতরের চাপা কথাটা বলেই ফেলল। “ও আমার ফ্যালনা মাইয়া। আমি অরে ফেলি বইলাই ডাকি।” “ফেলি তোমার ফেলনা মেয়ে?” “হঁ বাবু। সে এক  দুঃখের কথা। ছেলে ছেলে কইরা পরপর আমার তিন মাইয়া জন্মাইল। আমার স্বামী আমাকে বলল – এরপর আবারও মাইয়া হইলে জঙ্গলে ফ্যালাইয়া আইবো। শেয়াল-কুকুরে খাইয়া ফ্যালাইব। সত্যি সত্যিই আমার আবারও মাইয়া হইল। আমি মরা-ঘুম ঘুমাইয়া ছিলাম। আতুরে বাচ্চাটাকে রাতের অন্ধকারে কখন যে ফেলাইয়া দিয়া আইছে, জানতে পারি নাই । ঘুম ভাঙলে দেখি – মাইয়া আমার পাশে নাই। অনেক কান্নাকাটির পর বাতি হাতে লইয়া খুঁজতে লাগলাম। এ জঙ্গল, সে জঙ্গল, তারপর বড় রাস্তার ধারে একটা ঝোপের মধ্যে মাইয়াকে পাইলাম প্রায় মরা অবস্থায়। কপাল জোরে মাইয়া আমার বাঁইচা গেল। তখন থেইকাই অর নাম হইয়া গেল ‘ফেলি’।” “আরে অলকা, এত বছর ধরে কাজ করছো কই একথা তো আগে বলোনি আমাকে।” “দুঃখের কথা কাউকেই বলি নাই।” “তোমার তাহলে চারটে মেয়ে?” “ হঁ বাবু, তবে ফেলি ছাড়া আর কেউই  বাঁইচা নাই।”  “কী হয়েছিল ওদের, মারা গেল কীভাবে?” “তখন ওপার বাংলায় ছিলাম। অভাব লাগল দ্যাশে। না খাইতে পাইয়া বিনা চিকিৎসায় দুইজন মইরা গেল। সেই বছর বানও হইছিল। যে তখনও বাঁইচা ছিল, ভরা পুকুরে নাইয়া যাইয়া ডুইবা গেল। তারপর বানের জল শুকাইয়া গেল। চইলা আসলাম এই দ্যাশে। হইল ফেলি।” “দেখ, তোমার ভেতরে যে এত দুঃখ-যন্ত্রণা আছে, তার সবটা তো তুমি এতদিন বলোনি। তুমি শুধু বলেছিলে –  স্বামী তোমার ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সেখানে সে নতুন করে সংসার পেতেছে। ব্যাস এইটুকুই। যাইহোক, শোনো, তোমার ফেলি তো বেশ বড় হয়ে উঠেছে। লেখাপড়াও অনেকটা শিখেছে। কিন্তু এভাবে তো সরকারী চাকরি হয় না। তার জন্য পরীক্ষা দিতে হয়।” ফেলি বাবুকে বলল, “পরীক্ষা আমি দিয়েছি। ভালই হয়েছে।” “তাহলে তো ভালো কথা। এখন তবে একটু অপেক্ষা কর। ফলটা প্রকাশ হোক।”

ফল একদিন প্রকাশ হল। মেধা তালিকায় নামও উঠল। এরপর নিয়োগপত্রের আশায়  দিন গুনতে থাকা। অবশেষে অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে গেল। ফেলি মায়ের সাথে আবার এলো বাবুর কাছে। বাবু বললেন, “অলকা, চাকরিটা তোমার মেয়ে কেন পেল না, আমি জানি না। বিশ্বাস কর, এটা আমারও উপরের কর্তাদের বিষয়। আমার করার কিছুই ছিল না।” ফেলি জানতে চাইল, “মেধা তালিকা অনুযায়ী  চাকরিটা তো আমারই পাওয়ার কথা। তাহলে আমার জায়গায় চাকরিটা কে পেল?” “দেখ মেয়ে, তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না। তবে তোমার কথা আমি ভেবেছি, একটা ব্যবস্থাও করেছি।” বাবুর কথা শুনে অলকার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগল, “আমি জানতাম, বাবু আমার মাইয়াকে নিরাশ করবেন না। অরে ফেলি, বাবু মানুষ না, ভগবান। পায়ে হাত দিয়া পেন্নাম কর্।” ফেলি ইতস্ততঃ হয়ে কিছুই না বুঝে প্রনাম করল আর উৎকণ্ঠায় বাবুর মুখের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। “এই শহরে আমার এক বিশ্বস্ত বন্ধু আছে ,অত্যন্ত ঘনিষ্ঠও। ললিত ঘোষাল, চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। তাঁর অফিসে একজন মহিলা স্টাফ নেবে। বেতন ভালোই দেবে। ফেলির কথা তাঁকে আমি বলে রেখেছি।” অলকা জানতে চাইল, “কত টাকা দেবে বাবু?” “দশ-বারো হাজার তো বটেই। বছর বছর বাড়বে, বোনাস দেবে।” মায়ের হাসিতে ফেলিরও মুখখানা হাসিতে ভরে উঠল কিন্তু ওর ভেতরটা নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল। সেই যন্ত্রণার কথা মুখ ফুটে বলতে পারল না, শুধু মনকে বোঝালো – ‘আমরা গরিব, অবহেলিত, বঞ্চিত। যোগ্য হয়েও ভাগ্য আমাদের ফেরায় বঞ্চনার গৃহে। যা কিছু ভালো, তা আমাদের জন্য নয়। শেষ পাতে যা পড়ে থাকে, তা নিয়েই আমাদের খুশি থাকতে হয়,খিদে মেটাতে হয়।’ বাবু বললেন, “তুমি কালই জয়েন করে নেবে। বেলা দশটার মধ্যে আমার এখানে এসো। ললিতের লোক এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।” অলকার ভেতরে অফুরন্ত আনন্দ।


বাড়িতে ফিরে এসে ফেলি কেঁদে ফেলল। মা বোঝাতে লাগলো, “মা রে, আমি জানি, তুই তর ন্যায্য দাম পাসনি। কিন্তু মা, তার জন্য তুই কাঁদলে তর চোখের জলের মূল্য কে দিবে? জীবনে আমিও যা আশা কইরাছিলাম,তা কি পাইছি? যা পাইছি, দু,হাত পাইতা নিছি।  তবু তো বাঁইচা আছি। দুঃখের কথা শোন্ মা তাহলে। আজ থেইকা একুশ বছর আগে, যখন ওপার বাংলা থেইকা এপারে চইলা আসলাম, না ছিল থাকবার জায়গা, না ছিল এক মুঠ খাবার। ভিক্ষা করতে লাগলাম। অল্প বয়স। প্যাটে তুই। তখন কেউ ভিক্ষাও দিতে চাইতো না। খাইয়া না খাইয়া দিন কাটতো। হইলি তুই। তর বাপ তরে মাইরা ফ্যালাইতে চাইল, পারল না। ওই অবস্থায় আমাকে ফ্যালাইয়া  চইলা গেল। আশ্রয় তখন গাছ-তলায়, ত্রিপল টাঙাইয়া থাকি। আর পথে পথে ঘুইরা বেড়াই একটা কাজের জন্য। চেনে না,  জানে না, কে দিবে আমারে কাজ? প্যাটের খিদা বাঁধ মানে না। একদিন সন্ধ্যাবেলায় তরে কোলে লইয়া শহরের এক বিয়া বাড়িতে গিয়া ঢুইকা পড়লাম। বাড়ির লোকেরা ভিখারী ভাইবা কুকুর-বিড়ালের মতন বাইরে খেদাইয়া দিল। তবু অন্ধকারে দাঁড়াইয়া থাকলাম। দ্যাখলাম,   বয়সে প্রায় আমারই মতন, এক বিধবা মানুষ ঝুড়িতে কইরা এঁটো খাবার আইনা নোংরা ফেলার জায়গায় ফেলাইতে লাগল। আর কতগুলো কুকুর আইসা কাড়াকাড়ি  কইরা খাইতে লাগল। সেই খাবার আমিও তুইলা লইতে লাগলাম। শ্যাষবার এঁটো ফেলানো হইয়া গেলে বিধবা আমার কাছে আইসা জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কে গো?’  অর কথায় দয়া,মায়া আছে দেইখা আমি কাঁইদা ফেললাম। আর কোনো কথা জানতে না চাইয়া ও আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। সেই রাতে ও আমাকে লইয়া আইলো অর বাড়িতে। বড় রাস্তার ঢালে নয়ানজুলির ধারে ধারে সাইরে সাইরে অগুনতি কুঁড়েঘর, তারই একখানা অর। দেখলাম, ঘরে অর সাত বছরের একটা ছেইলা আছে। ভবতোষ বইলা ডাকল। বাসায় কাজ কইরা আহার জুটায় আর ছেইলাকে মানুষ করে। আমাকে বলল – ‘আজ থেইকা তুই আমার বুইন। থাক্ আমার কাছে যতদিন এইখানে একটা ঘর বানাইতে না পারিস আর তর মাইয়া একটু বড় না হয়। তরে আমি ভালো দেইখা বাসার কাজ ঠিক কইরা দিমু।’ কথা  শুইনা বুঝলাম – দিদি এই দ্যাশেরই মাইয়া, আমারই মতন এক হতভাগিনী। বিছানায় শুইয়া অনেক রাইত অবধি গল্প হইল। বুঝলাম – ভাইগ্যের দুর্বিপাক শুধু ওপারের মানুষেরই নয়, এপারের মানুষেরও।”


ফেলি মন দিয়ে শোনে নিদারুণ মর্মস্পর্শী কাহিনী। মায়ের দুঃখের গল্প ফুরাতে চায় না।চোখের জল মোছে। আবারও বলে,“কত  জায়গার মানুষ আইসা একটা জায়গায় মিলিত হইছে তবুও কেউ কারো কাছে পর নয়। সবাই সবারই আপনজন। ঝগড়া-বিবাদ হয়, আবার মিটাইয়া নেয়। দিদির মুখে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাইয়া গেলাম। বড় নির্ভাবনার ঘুম।”


“কয়টা দিন পর জন্ম দিদি একটা কাজ ঠিক কইরা দিল। দু’বছরের মধ্যে নয়ানজুলির ধারে আমিও একখানা কুঁড়েঘর বানাইলাম।”  “তুমি কার কথা বলছো মা, কমলা মাসি?” “হঁ, সে ছাড়া আর কার কথা কইমু? বড় মুখ কইরা কইয়াছিল – ‘অলকা, তোমার মাইয়া যখন আমার ঘরে আইসা পড়িছে, ও আমার ঘরেই লক্ষ্মী হইয়া থাকবে। অকে মানুষ কর্।’ কথা আমি রাইখাছি। তাই এখন শুধুই অপেক্ষায় আছি। ভবতোষ একটা ভালো কাজ পাইলেই তোদের চার হাত এক কইরা দিমু।”


মা এতদিন তুমি এসব কথা আমাকে বলোনি কেন? বলতে আমার বাধা নেই, সত্যিই ভবদা,আমি দুজন দুজনকে ভালোবাসি। এখন বুঝতে পারছি – ওদের বাড়ি গেলে কমলা মাসি কেন আমাকে কাছে টেনে নেয়, আমার মাথার চুল বেঁধে দেয়, কিছু না খেয়ে আসতে দেয় না। কিন্তু মা, আজ আমার বড় কষ্ট হচ্ছে তোমার অতীত জীবনের কথাগুলো শুনে। তোমাকে উচ্ছিষ্ট খেতে হয়েছে!” ফেলি নিদারুণ যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠে। দুচোখের জল মুছে দেয় মা, আর বলে, “ ভাবিসনা আমাকে লইয়া। নিজেরে লইয়া ভাব্। কাল থেইকা তর নতুন জীবন শুরু। নতুন চাকরি। কাজটা ভালোভাবে করতে হইব।” ফেলি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “সে আমি করবো মা। আজ তুমি আমাকে যে শিক্ষা দিলে তাতে আমার সব অহংকার চূর্ণ হয়ে গেছে মা। তোমার গর্ভের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে তোমাকে কত নীচে নামতে হয়েছে, উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খেতে হয়েছে। না মা,তা কিছুতেই ছোট নয়, তা যে জীবনের এক মহতী কাজ।”


পয়লা অঘ্রাণ, ভোরবেলা। ভবতোষ নিজে এসেছে ফুলকুমারীকে নিয়ে যেতে। দু’দিন আগে ভবতোষই নিজে এসে গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিল। আজ এসে ফুলের মাকে বলল, “কাকিমণি, ফুল সেদিন নিশ্চিত করে বলেনি যেতে পারবে কিনা, তাই তো আমাকে আসতে হলো। মা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলেছে।” “হঁ বাবা, লইয়া যাও। আমি একটু পরে যাইব। আসলে মাইয়া আমার কাজে ছুটি পাইব কি পাইব না,তাই তোমারে ভরসা দিতে পারে নাই। ছুটির ব্যাপারে ফেলিরও মন খারাপ করছিল। বলছিল, “মা, ভবদা জায়গা কিনে নতুন বাড়ি বানাইছে, আনন্দের কথা। ছুটি যদি না পাই যাইব কেমন কইরা? তা শ্যাষ পর্যন্ত ছুটি পাইছে। মনটাও এখন অর খুশি।” “হ্যাঁ কাকিমণি, আমারও ভালো লাগছে। আরও ভালো লাগছে এই কারণে যে, বড় কষ্ট করে টিউশনের টাকা জমিয়ে জমিয়ে এক কাঠা জায়গা কিনেছি। সেখানে থাকার মত একটা ছোটখাটো বাড়িও তৈরি করতে পেরেছি। আজ মা, আমি সেখানে প্রথম পা রাখবো।” “আশীর্বাদ করি, তুমি আরও বড় হও। এম.এ পাস কইরাছ, এখন তোমার একটা চাকরি হইলেই ভালো হয়।” মায়ের আরও কিছু কথা বলার ছিল। সেকথা মনের মধ্যেই চাপা রাখল। এরই মধ্যে ফেলি প্রস্তুত হয়ে এসে বলল, “মা, আমি তাহলে আসছি। তুমিও তাড়াতাড়ি চলে এসো কিন্তু।”


হৃদয়ের বড় প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে ফুলের আজ খুশির ইয়ত্তা নেই। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় দুজন ঘুরতে বেরিয়েছিল ভাগীরথীর পাড়ে। নদীর বয়ে চলাকে ফুল দেখতে লাগলো। তার মনের খবর নিতে ভবতোষ জিজ্ঞেস করল,  “কী দেখছো?”  “দেখছি না, ভাবছি। ভাবছি, আমাদের জীবন হল নদীর মতো। নদী সাগরে মিলবার আশায় আপন বেগে বয়ে চলেছে। আমরাও দুজন বুক-ভরা আশা নিয়ে মিলন-মোহনার দিকে এগিয়ে চলেছি।” ভবতোষ শুধোয়,  “তুমি কি নদীর কলতান শুনতে পাচ্ছো?” “পাচ্ছি তো, ঐ কলতানের মাঝে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে আমাদের দুজনের মনের গুঞ্জন। অস্ফুট,অস্পষ্ট, অথচ সবই বোঝা যায়। আচ্ছা ভবদা, নদীর সুন্দর রূপ তুমি দেখেছো?” “দেখেছি। অনেক রূপ দেখেছি। এখন নদী শান্ত, যেন সাগরের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে থাকার বাসনা তার পূর্ণ হয়েছে। জ্যোৎস্না রাতে সে সেজে উঠে অপরূপ সৌন্দর্যে। খোঁপায় তাঁর রজনীগন্ধার মালা, মাথার উপর ঝরে পড়ে অবিরত জুঁই, কামিনী, মল্লিকা। বর্ষায় সে বেগবতী, যৌবনা। বুকে তখন তাঁর হার না মানার পণ,” বলতে বলতে ভবতোষ পাশের ঝোপ থেকে একটা ফুল তুলে ফুলের মাথায় পরিয়ে দিল। বলল, “ফুলটা জঙ্গলে ফুটেছে। কত অযত্নে থেকেও খুব সুন্দর। তাই তো তোমাকে উপহার দিলাম।”  “কেন?”  “তুমিও যে এই ফুলটার মতোই সুন্দর।” “ঠিকই বলেছো, আমি গরিব ঘরে জন্মেছি। কত অবহেলা, অনাদরে বড় হয়েছি। তবুও সৃষ্টিকর্তা আমাকে অপরূপ সৌন্দর্য দিয়েছেন।” “তোমার বাইরের থেকে ভেতরের সৌন্দর্য আমাকে আরও বেশি করে আকৃষ্ট করে। তাইতো আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি।” “তোমার মত আমিও ভাবি, বড় ভাগ্য করে আমি তোমার সান্নিধ্য পেয়েছি।” জানো ফুল,  দারিদ্র্যের বিভীষিকাময় রূপ আমিও দেখেছি। তখন আমার চার বছর বয়স। পৃথিবীকে সবে একটু একটু করে চিনতে-জানতে শুরু করেছি। বাবা মনীন্দ্র বি.টি মিলে চাকরি করতো। কাপড় তৈরি করতো। মিলটা  হঠাৎ উঠে গেল। শহরের পথে পথে রিকশা চালানো ধরল বাবা। রোদ, ঝড়-জলে ভিজে আর দুর্ভাবনার প্রহর গুনতে গুনতে এক বছরের মধ্যে টি.বি আর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল। সেই যে গেল, আর ফিরে আসেনি। মা আমাকে নিয়ে অথৈ সাগরে। গ্রামে দু’কাঠা ভিটেমাটি আর একটা টালির ঘর ছিল সম্বল। তাও বন্ধক রাখা হয়েছিল বাবার চিকিৎসার জন্য গ্রামেরই এক বিত্তবানের কাছে। অসহায় মা কখনো পরের জমিতে, কখনো ইটভাটিতে কাজ করতে লাগলো।  ইটভাটির মালিক ওই বিত্তবানই। বিপথে চালিত করবার দুর্বার হাতছানি তখন মায়ের সামনে। একথা আমি বড় হয়ে জেনেছি।” রুমালে চোখ মোছে ভবতোষ। “ভবদা, যে অতীত অপ্রিয়, ঘৃণাময়, তার স্মৃতিচারণ না করাই ভালো।” “কিন্তু ফুল, সে অতীত প্রেরণাও দিয়েছে। অন্ধকার পথে চলার সাহসও জুগিয়েছে। বিত্তবানের অনেক প্রলোভন মা এড়িয়ে চলতে লাগল। তবু একদিন মিথ্যা অপবাদে মায়ের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠল। শুধু আমার মুখপানে চেয়ে বেঁচে রইল মা। নিরুপায় হয়ে তখন রাতের অন্ধকারে আমাকে নিয়ে চলে এলো দূর বস্তিতে। শুরু হয়েছিল জীবনের নতুন যুদ্ধ। আজও চলছে। জানিনা কবে থামবে এই যুদ্ধ।” “থামবে কিনা আমিও জানিনা। তবে যা শুনলাম, তাতে তোমার মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। আর তোমার-আমার হৃদয়ের বন্ধন আরও দৃঢ় হল। আজ এই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্য আর ভাগীরথীকে সাক্ষী রেখে বলছি, জীবনে-মরণে যেন এভাবেই তোমার পাশে থাকতে পারি।”


দুঃখের জীবন-তরী বাইতে বাইতে ঘরে ফিরে এলো ভবতোষ আর ফুল। ওদের মায়েদের মধ্যে তখনও চলছে দুঃখ-সুখের গল্প গাথা। কিন্তু সময় বাধ সাধল। ফুলের মা এবার বলল, “হ্যাঁগো দিদি, সন্ধ্যা নাইমা আইলো। এবার তো আমাগো চইলা যাইতে হইব। বেশ হাসিখুশির মধ্য দিয়াই কাটতেছিল। মনটা আবার খারাপ হইয়া যাইব।” “বোনরে,মনটা কি শুধু আমাদের দুজনেরই খারাপ হবে? ওদের দুজনেরও ভালো লাগবে না।” “হ্যাঁগো দিদি, দুজন দুজনের লাইগা পথ চাইয়া বইসা থাকে। ঠাকুর অদের মিল কইরা দিক।”  “তাই যেন হয়। ঈশ্বরের কাছে শুধু সেইটুকুই কামনা করি।”


মার্চের প্রথম সপ্তাহে খাদ্য দপ্তরের পরীক্ষার ফল বেরলো। ভবতোষের নাম সফল তালিকায় স্থান পেয়েছে। খবরটা সে প্রথম জানালো তার মাকে। দুঃখময় জীবনে এ আনন্দ মা উৎসর্গ করল তার মৃত স্বামীর উদ্দেশ্যে। বসন্তের দক্ষিণা বাতাস গিয়ে ঢেউ খেলে গেল ফুলের বাড়িতেও।


কিন্তু দুর্ভাগা জীবনে সুখ বেশিদিন সইল না। চাকরিটা হয়নি ভবতোষের। গ্রীষ্মের  দাবদাহে বসন্তের সব সৌন্দর্য পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। কাগজে কাগজে খবর বেরিয়েছে – চাকরি বিক্রি হয়েছে। তাই নিয়ে কোর্টে মামলা উঠেছে। মন্ত্রীকে জেলে পোরা হয়েছে। বিচারপতি আশ্বাস দিয়েছেন সুবিচারের।


আশায় দিন গোনে ফুল। আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে ভবতোষ। তবু আছে – মা, কাকিমণির সান্ত্বনা আর আশীর্বাদ। এভাবেই বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত,শীত, বসন্ত পেরিয়ে গেল।


নতুন বছরের সূর্যও উঠল। সেদিন ভাগ্যের তরী এসে ভিড়লো এক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরজায়। মা এতেই খুশি।  সন্ধ্যাবেলা বাবুদের বাসা থেকে ফিরে এলো অনেক উপাদেয় খাবার নিয়ে। সেসব থালায় ছেলের সামনে সাজিয়ে দিয়ে বলল, “খা বাবা। তোর চাকরির কথা শুনে বাবু, গিন্নিমা দুজনেই খুশি হয়েছেন। আজ আবার ওদের মেয়ের জন্মদিন ছিল। পোলাউ, পায়েশ কত কিছু হয়েছে। সবই দিয়েছে। বেশি করেই দিয়েছে।” “মা, সত্যিই কি এগুলো খুশির উপহার না তুমি আমাকে খুশি করার জন্যই বলছো? কোনোদিন তোমার মুখের উপর কথা বলিনি। আজ মনটা আমার জানতে চাইছে। এতগুলো মিষ্টি কি সত্যিই ওনারা খুশি হয়ে দিয়েছেন।”  মায়ের মুখখানা নিমেষে কালো হয়ে আসে। মনে মনে ভাবে – জীবনের কোনো সত্যই সে ছেলের কাছে লুকোয়নি,আজও গোপন রাখবেনা। “না বাবা, থালা ভর্তি করে মিষ্টি সাজিয়ে দিয়েছিল মেয়ের সামনে। অত মিষ্টি খেতে পারেনি। গিন্নিমা বলল, ‘কমলা, এগুলো তুমি নিয়ে যাও।’ তবে মিষ্টিগুলো ভালো বাবা। মেয়েটা শুধু এক পাশ থেকে ক’টা খেয়েছে।” “তবুও তো ওগুলো উচ্ছিষ্ট। ঠিক আছে , এনেছো যখন, খাবো মা। তোমার আদেশ কখনও অমান্য করিনি, আজও করবো না। চাকরিটাও সাদরে গ্রহন করবো। আবেদন করেছিলাম, পেয়েছি। দুর্মূল্যের বাজারে এটাই বা ক’জন পায়?”  “সে তুই যাই বলিস বাবা, বাবুদের আমি নিন্দা করতে পারবো না। ওদের জন্যই আমরা বেঁচে আছি, তোকে মানুষ করতে পেরেছি।”


আমন্ত্রণ পেয়ে সন্ধ্যার পর ফেলি আর তার মা এলো। ফেলি মনে মনে রাগ করেছে, আর তা এতক্ষণে উগরে দিল মনের মানুষের উপরে। “ভবদা, চাকরিটা পেলে, কই, নিজের মুখে একবার জানালে না তো? নাকি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছো – ব্যর্থ জীবনের সব কথা নাইবা জানালাম।” “ফুল, পৃথিবীতে কোনো কাজই ছোট নয়, সে আমি জানি। বেসরকারি স্কুল হলেও আমি তো সেই শিক্ষক। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় মানুষ করে তুলব। এ তো আনন্দের কথা। হয়তো অনেক কষ্ট হবে,হোক না। জানবো,এও আমার জীবনের এক সৌন্দর্য।”  “ওভাবে ব’লোনা। অনেক কষ্ট আমিও তো বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। আবার একথাও সত্য – সমাজ তোমাকে যোগ্য মর্যাদা দেয়নি।” “সেই মর্যাদা তুমিও পাওনি।” “মানুষ যা চায়, সবই কি পায়?  আবার কেউ না চাইতেই অথবা অর্থ আর ক্ষমতার বলে অনেক কিছুই পায়। আমাদের তো কোনো বলই নেই। তা আশাও করি না। তাই যা পেয়েছি তাতেই খুশি থাকতে চাই। হয়তো তুমি বলবে – ‘হতাশা’, আমি বলব -এটাই বাস্তব।” “আসলে এ হল ব্যর্থ জীবনের প্রতি সান্ত্বনা। আমি ভাবছি,  পরিত্রাণ কিসে? এই নরক যন্ত্রণার নিরসন কবে হবে? চিরকালই কি অন্যায়,অধর্ম, অত্যাচার চলবে? একদল সর্বস্ব লুঠে নেবে,অন্যরা পথে পথে ভিক্ষা করবে, এই তো আমাদের সমাজ। অনেকেই অঙ্গীকার করেন – পৃথিবীকে তাঁরা স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবেন। সেই বিশ্বাস আমাকে আহত করেছে। আমি তাদের সান্নিধ্য ছেদ করেছি।” “সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমারও কম কিছু নেই। ক্লান্ত শরীরে, ক্ষুধা পেটে মিছিলে হেটেছি মাইলের পর মাইল। রোদে পুড়েছি, জলে ভিজেছি। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছি। তাদের কাছে টানার চেষ্টা করেছি। রাজপথে দাঁড়িয়ে শোষণ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি। ধনী-গরিব, মালিক-মজুরের সম্পর্কের নিরসন চেয়েছি। রাজপ্রহরীদের  নিষ্ঠুর, নির্মম নিপীড়নও হাসিমুখে সহ্য করেছি। একদিন মনটা ভেঙে গেল, যখন দেখলাম – মাথাওয়ালা মানুষগুলোর গোপন বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মত্যাগের বাণী আওড়ে গোপনে নিজ-স্বার্থ চরিতার্থ করা, অন্যকে উৎসাহিত করে দুর্যোগময় বিপদ-সংকুল পথে এগিয়ে দেওয়া, আর নির্দ্বিগ্ন ঘেরাটোপে একান্ত আপনজন, প্রিয়জনের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার তোড়জোড়।” “জানি, অপ্রিয় হলেও সবই সত্য। আবার অন্য সত্যও আছে।  মানুষের মুক্তির প্রয়োজনে বারবার সমাজের পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে এ সমাজও একদিন বদলে যাবে, আসবে নতুন সমাজ।” “ভবদা,তার আগে অন্ধকারময় পথে পথে দীপ জ্বালিয়ে যাঁরা আগে আগে হাঁটছেন, তাঁদের নিজেদের মনের জঞ্জাল সর্বপ্রথম দূর করতে হবে। এসব কথা না হয় এখন থাক্। আজ তোমাকে আমার কিছু বলার আছে, পরামর্শও বলতে পারো।” “বেশ, বলো।”  “যা পেয়েছো,আমিও যা পেয়েছি, তাই নিয়েই দুজনকে চলতে হবে। ওতে ঠিক চলে যাবে। আমাদের মায়েরা আমাদের বন্ধনের ব্যাপারে বড়ই উদগ্রীব। আমরাও সেই স্বপ্নে বিভোর। তবে আর দেরি কেন?” “ফুল, লক্ষ্মীটি আমার, পরিস্থিতিকে আমরা অবহেলা করতে পারি না। বাড়ির কিছুটা কাজ এখনো বাকি আছে। আশা করি কয়েক মাসে তা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তারপর …….। ”


কমলা মাসি এমন সময় ডাক দিল, “ফুল, ভবতোষ, তোরা এখানে আয়। চা হয়ে গেছে।” “আসছি মাসিমণি।”  ফুল এসে থালা ভর্তি চাল ভাজা দেখে অবাক হয়। ভবতোষ হেসে বলে, “মা রেশনের চাল ভেজেছো? বাঃ খুব সুন্দর হয়েছে তো।” সামনের বারান্দায় একটা ছোট্ট টেবিলের চারদিকে চারজন বসেছে। ফুলের মাও এবার হাসতে হাসতে বলে, “দিদিগো, চাইলটা ভালো। মাঝেমধ্যে আমিও ভাইজা খাই।” “কিন্তু বোন, চাল তো এবার অনেকটাই কম পেয়েছি। দুজনের আট কেজি পাওয়ার কথা, পেয়েছি চার কেজি।” “আমিও তাই পাইছি দিদি।” ভবতোষ কিছু না বলে থাকতে পারল না। “কাকিমণি, গরিবের জন্য কোনও সাহায্য বরাদ্দ হলে, তার প্রায় নয় ভাগই আসার পথে উধাও হয়ে যায়। গরিবের ভাগ্যে জোটে মাত্র এক ভাগ।” “ভবদা ঠিকই বলেছে মা। তবে সত্য আরো আছে, যা না বললেই নয়। এই মোটা চাল সমাজের উপরের মানুষের জন্য নয়, নীচের ভুখা মানুষগুলোর জন্যই।”  “ফুল, আমি আর একটু যোগ করছি। এই যে সাহায্যের যেটুকু এসে গরিবের পাতে পড়ছে, এও তো সেই উচ্ছিষ্ট, নয় কি?” “ঠিকই, তবে সেই উচ্ছিষ্টই আমরা ভক্তিভরে গ্রহণ করি। আমাদের জীবনও বেঁচে থাকে।” “জানি ফুল। এ বড় ব্যথার কথা। বন্য জীবেরাও বেঁচে থাকে। সমাজের নিয়ন্তাগান সভ্যতার ঊষাকাল থেকে এভাবেই বিলিয়েছে অসহায়, দরিদ্রকে ক্ষুধার অন্ন। শাসকের রং বদলায় কিন্তু এই অভ্যাসের বদল হয় না।” “অলকারে, বুইন আমার, পোলা-মাইয়ার কথাগুলা শুইনা ল,  কী কয় অরা।”  “কী সুন্দর কইলা। দিদিগো, তুমি তো আমাগো ভাষা ভালই শিখ্খা ফ্যালাইছ।” “না শিখলে তর লগে কথা কইমু কেমন কইরা?” ফুল হাসে, ভবতোষও হাসে। ওদের মায়েরাও হাসে। এ হাসি আসলে দুটি অবিচ্ছেদ্য প্রাণের হাসি। “তবে দিদি, অরা যা বলতেছে বলুক, যা ভাবতেছে ভাবুক। তুমি অদের কথায় কান দিও না।” ফুল এবার একগাল হেসে মাকে বলে, “মা, ‘অরা’ নয়, ‘ওরা’। ‘অদের’ নয়, ‘ওদের’।” “তুই থাম তো মাইয়া। মাতৃভাষা ছাড়মু কেমন কইরা? হঁ, আমি ঠিকই কইছি।”


কমলা মাসি এবার একটু গম্ভীর হয়ে ছেলেকে, ছেলের হবু বউকে বোঝায়, “তোরা অনেক বুদ্ধিমান, বুদ্ধিমতী। তোদের চিন্তাধারায় ভুল কিছুই নেই। তবে ফুল মা,  তুমি তো ঠিকই বলেছো। আমিও বলি – গরিবেরা উচ্ছিষ্ট খেয়েই বেঁচে থাকে। আবার একথাও আরও বেশি ঠিক – যারা উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে অভুক্ত প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে, তারাই গরিবের বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব অস্বীকার করার উপায় থাকে না।” ফুলের মা সমর্থন জানায়। “হঁ দিদি, আমাগো মতন মানুষ যারা, তাদের ভালো-মন্দ ভাববার অবসর কোথায়?খাওয়া-পড়াটুকু পাইলেই তারা জীবন সার্থক বইলা মনে করে।” ফুল আর চুপ করে থাকতে পারেনা। বলে, “মা, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই জীবনের সবকিছু নয়। এই যে দেখছো ভবদাকে, ও কি জীবনে ওর যোগ্যতার ন্যায্য সম্মানটুকু পেতে পারত না? আমাদের হকের চাকরি কেন চুরি হয়ে গেল, তুমি প্রশ্ন করবে না?” ভবতোষও চুপ করে থাকল না। “না কাকিমণি, মা,ফুল অন্যায় কিছু বলেনি। তোমাদের দুজনকেই বলছি, তাহলে কি চিরকাল একদল মানুষের সব কিছুর প্রতি সমস্ত অধিকার থাকবে, আর তাদের কাছে অসংখ্য মানুষ একটু সাহায্য, সহানুভূতি পাবার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দেবে?”  কাকিমণি ভবতোষের মাথায় হাত রেখে বলে, “বাপ আমার, মানিক আমার, এই প্রশ্নের উত্তর দিবার সাইধ্য আমার নাই। তোমার জ্ঞান গরিমার নাগাল আমি পাইমু না। তাই বলি কি – থাক্ এইসব কথা। আমরা আইজ আসি। তোমরা মায়ে-ব্যাটায় একদিন আমাগো বাড়িতে আসো। ও দিদি, গরিবের কুঁড়েঘরে আপনার পায়ের ধুলা কবে পড়বে, সেই আশায় থাকমু কিন্তু।” “নিশ্চিন্তে থাকো বোন। গরিবের কুঁড়েঘরে গরিবেরই পায়ের ধুলো পড়বে।”


বাড়ি ফেরার পথে ফুল মাকে বকতে লাগলো, “তোমার ওভাবে কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। ভবদা মনে মনে রাগ করল কিনা জানি না। ভীষণ চাপা মনের মানুষ। উচিত কথা বলে।  কোনো স্বার্থের কাছে মাথা নোয়ায় না। কোনো প্রলোভনে পা বাড়ায় না।  দেখো মা, সামনে বিধানসভার ভোট। তোমার যাকে ইচ্ছা, ভোট দিও। ওরা এলে এই নিয়ে কোনো কথা ব’লোনা। ভোট দেবার ব্যাপারে তোমার ইচ্ছা ভবদার উপর চাপাতেও চেওনা।” “শোন্, তুই আমার নিজের মাইয়া। তকে তো বলতেই পারি। তর উপর জোর খাটাইতে পারি। তবে এখন বড় হইছিস। আমার ইচ্ছা তরও উপর আর চাপাইব না। নিজে যা ভালো বুঝবি তাই করবি। আর ভবর কথা বলছিস্, অরে আমি চিনি। বড় ভালো ছেইলা। বড় ভাগ্য কইরা অরে পাইছি। যা বলে, যা ভাবে, সবই ঠিক। দু’মুঠো ভাতের জন্য আমাকে, অর মাকে কত অন্যায় সমর্থন কইরা চলতে হয়।” “যাক্,বড় ভালো লাগলো মা। মা,আজ তোমাকে একটা অত্যন্ত খারাপ কথা বলবো, যা আর কাউকে বলা যায় না।” “কী কথা? বল্।” “হ্যাঁ মা, আমার অফিসের ‘বস’ ললিতবাবু, ভোটে   প্রার্থী হয়েছেন। সারাদিন তাকে ঘোরাঘুরি করতে হয়। তার ছেলে ‘রোহিত’ এখন নিয়মিত অফিসে বসে। মতিগতি ভালো না। আমি বুঝতে পারি, আমার প্রতি ওর কুনজর পড়েছে। খোলামেলা মিশতে চায়। গল্প করতে চায়। বলে, ‘আমি  তোমার ভালো বন্ধু। চলো, বাইরে কোথাও বেরিয়ে আসি।’ কথাটা পাঁচকান ক’রো না কিন্তু। আমি সজাগ আছি। ওর পাতা ফাঁদে আমি পা দেব না।” মা ভয়ে শিউরে ওঠে। কেমন যেন দুশ্চিন্তায় ডুব দিয়ে কোন্ একটা অবলম্বন আঁকড়ে ধরতে চায়। বাড়ি ফিরে সারারাত ঘুম ধরেনি চোখে।


সকাল হয়। ফেলি কাজে বেরিয়ে যায়। দুশ্চিন্তায় দিন কাটে মায়ের। আর দিনের পর দিন পথ চেয়ে বসে থাকে ভবতোষ আর ওর মায়ের জন্য।


সত্যিকারেই একদিন বাড়িতে পায়ের ধুলো পড়লো মা-বেটার। অঘ্রানে শুভ পরিণয়ের দিনক্ষণও স্থির হয়ে গেল। ফেলির মা মনে মনে আশ্বিন মাসের কথা ভেবেছিল। পাত্রপক্ষ যখন মুখ ফুটে সময়টা বলেই দিয়েছে, তখন আর জোর করতে পারল না।


দেখতে দেখতে আশ্বিন মাস চলে এলো। দুর্গাপুজোর দিনগুলোয় কবিতা আর গল্পের বই পড়ে ভালোই কাটলো ফেলি আর ভবতোষের। বিসর্জনের সন্ধ্যায় ভবতোষ এলো হবু শাশুড়ি মায়ের আশীর্বাদ নিতে। প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে এলো ফেলি। “আমি কিন্তু একা খাবো না ফুল, তোমাকেও খেতে হবে।” “না গো,আমি অনেক খেয়েছি। এ ক’টা তোমাকেই খেতে হবে।” “ঠিক আছে, একটা খাও,” এই বলে ভাবতোষ নিজের হাতে খাইয়ে দিল ফুলকে। ফুলও নিজের হাতে একটা মিষ্টি তুলে খাইয়ে দিয়ে বললো, “আমরা এখন মিলন-মোহনার অনেক কাছাকাছি ভব।” “ঠিক , কিন্তু আমি বলব – আমরা এখন  নতুন জীবনের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছি।” “সমার্থক। সে তো তুমি ফুলকে ‘কুসুম’ও বলতে পারো, ভ্রমরকে ‘মধুকর’।”  “বাঃ ভ্রমরও এসে গেল উদাহরণে? ফুল যদি বিলায় মধুরস, ভ্রমর কি না এসে পারে?” “ভ্রমর যে করে গুঞ্জন, ফোটা ফুল দেখে। চুপি চুপি এসে পাপড়ির উপর বসে, ফুলের মধু খাবে বলে।” “বেশ তো, আজ আসি তবে, মধু নাইবা জুটলো কপালে। নিমন্ত্রণ যদি পাই, যদি ডাকো আপনার করে, নাহয় আবার আসবো পরে।” “এই দাঁড়াও, মা চা নিয়ে আসছে।”  চা পানের কিছুটা সময়, তারপর ফেলির আবার একাকীত্বের সঙ্গী সেই কবিতার বই।


ত্রয়োদোশীর দিন কাজে যোগ দিলো ফেলি। আজ অফিসের ছাদে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠান। ললিতবাবু জনসভার কাজে ব্যস্ত। প্রতিবছর তিনিই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এবার রোহিতের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তার ইচ্ছাতেই নৃত্য প্রদর্শনকারীদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। বিকেল তিনটে। চটুল নাচ শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে পরিবেশিত হচ্ছে ঠান্ডা পানীয় আর মদ। অস্বস্তিকর দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও ফেলি অনুমতি পেল না। রোহিত আজ অবশ্য হাত জোড় করে বিশেষভাবে অনুরোধ করলো, “অনুষ্ঠান শেষে খাবারের বন্দোবস্ত আছে। ফুল, না খেয়ে তুমি যেতে পারবে না। বলো,আমাকে কথা দাও।” এমন বিনম্র ব্যবহার আর মনোভাবে ফেলি কথা দিয়ে দিল। অতএব, আরো বেশ কিছুটা সময় থাকতেই হবে। একটু পরে কে একজন ঠান্ডা পানীয়ের একটা গ্লাস এনে ফেলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। পিপাসাও পেয়েছিল। অন্যদের মতোই ফেলিও মেটালো তার পিপাসা। তারপর কী হয়েছিল সে জানে না। চেতনা ফিরল যখন, দেখল –  নীচে একটি বদ্ধ ঘরের মধ্যে সোফার উপর সে আর রোহিত। ছাদের উপরে তখনও চলছে উন্মাদনা।


বাড়ি যখন ফিরে এলো, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। মা একরাশ উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞেস করল, “কীরে মা, এত দেরি হইল কেন? তরে যেন কেমন লাগছে, তুই ঠিক আছিস তো?” “মা,জীবনভর উচ্ছিষ্ট খেতে খেতে নিজেও আজ উচ্ছিষ্ট হয়ে গেলাম ,” একথা বলতে পারল না।  কিছুটা আড়ষ্ট গলায় অভয় দিয়ে বলল, “মা, তুমি চিন্তা ক’রো না। আমি ঠিক আছি। অফিসে অনুষ্ঠান ছিল। খেয়ে এসেছি। যাও,তুমি শুয়ে পড়।” “সারাটা দিনের খাটাখাটনি, তুইও এখন শুইয়া পড়্।” নিরাপদ জেনে মা শুইতে যায় বিছানায়। মা চলে গেলে ফেলি আপন মনে বলে, “মাগো, তুমি ক্ষমা করে দিও।” ক্লান্ত,যন্ত্রণাক্লীষ্ট,উচ্ছিষ্ট শরীরটাকে এলিয়ে দেয় বিছানায়। পাশ ফিরে একটা সাদা কাগজে কী সব লিখতে লাগল আর অবিরত চোখের জল ঝরতে লাগল। ঘুমের ওষুধ আসার পথে চেনা-জানা এক দোকান থেকে কিনে এনেছিল। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। সে আজ সবচেয়ে কঠিন এবং কঠোরতম সিদ্ধান্ত নিয়েছে – এ দেহ সে নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক ভবতোষকে উপহার দেবে না। ভবতোষ ঠিক বুঝে নেবে – ফুল ওর জন্য ফোটেনি।


পরদিন সকাল হল । সোনালী রোদ এসে  খেলা করছে কুঁড়েঘরের চালে। ফুল  ততক্ষণে চলে গেছে দূর চিরনিদ্রার দেশে। দুঃখের খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কত লোক ছুটে আসছে! কত অশ্রু ঝরে! উন্মাদের বেশে ভবতোষ আকুল হয়ে খুঁজে বেড়ায় হৃদয়ের বড় প্রিয়জনকে।

……………………………………………………….