Mobile Master – মোবাইল মাস্টার

Mobile Master - মোবাইল মাস্টার
Mobile Master – মোবাইল মাস্টার

মোবাইল মাস্টার

                    – হরবিলাস সরকার

(ছোট গল্প)

নীলাদ্রি আজ বাড়ি ফিরেই তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে সোজা রওনা হল গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে। পাশের গ্রাম ‘টিকটিকি পাড়া’, পায়ে হেঁটে যেতে খুব জোর মিনিট দশেক লাগে। মফিজুল স্যার তখনও পড়াতে বসেনি। সালমা আর বাদশাও আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। ফাইভ, সিক্স – এর  ছেলেমেয়েরা একসাথেই পড়ে। নীলাদ্রি এবছর ফাইভ-এ উঠেছে। সালমা আর বাদশা সিক্স-এ। ওদের স্কুল অবশ্য আলাদা।

 

অন্যরা আসার আগে পড়ার ঘরে জমিয়ে চলছে আড্ডা। “জানিস্ – সালমা, বাদশা, আমাদের স্কুলে একজন নতুন স্যার এসেছেন। বিশাল জ্ঞান স্যারের। বাংলা, ইংরেজিতে অগাধ পাণ্ডিত্য। যেকোনো শব্দের মানে নিমেষে বলে দিতে পারেন। সন্ধি, বানান, বর্ণ বিশ্লেষণ স্যারের কাছে জলভাত।” সালমা একটু অবাক হয়ে বললো, “তাই নাকি রে! স্যারের বাড়ি কোথায় নীলাদ্রি?”  বাদশা সালমাকে শুধোয়, “কেন রে, ওই স্যারের কাছে পড়তে যাবি নাকি?” “ভালো পড়ালে তো যেতেই হবে।” নীলাদ্রিও সালমার কথার তালে তাল দিল, “আমিও ভেবেছি, ওই স্যারের কথা বাড়িতে বলবো। মা নিশ্চয়ই রাজি হয়ে যাবে।” বাদশা একটু ভেবে নিয়ে ঢোক গিলে বললো, “যাই বলিস্ তোরা, আগে আমি খোঁজ নেবো। সত্যিই যদি ভালো পড়ান, তবে …………।”

Mobile Master - মোবাইল মাস্টার

গৃহশিক্ষক মফিজুল পাশের ঘর থেকে সব কথাই শুনছিল। বাদশার কথা শেষ না হতেই দরজা ঠেলে ঢুকে সে জানতে চাইলো, “তোমরা কি তাহলে ওই স্যারের কাছে চলে যাবে? আচ্ছা, কী নাম ওনার?” নীলাদ্রি বললো, “দাঁড়ান স্যার, মনে করছি। হ্যাঁ মনে পড়ছে। ‘কৃষ্ণকান্ত দালাল’। জানেন স্যার, নামটা ভালো। টাইটেলটা একটু বিশ্রী বিশ্রী মনে হয়। বংশে কেউ দালালি-টালালি করত বোধ হয়। শুনেছি, অতীতে কর্ম অনুযায়ী পদবি হত।”

 

মফিজুল স্যার চাকরি পাওয়ার খবরটা জানতো না। তাই প্রথমে একটুখানি হকচকিয়ে উঠেছিল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধমক দিয়ে বললো, “ওভাবে বলতে নেই নীলাদ্রি। পদবিটা তো আমার কাছে বেশ মনে হয়। তাছাড়া মানুষকে নাম, পদবি দিয়ে বিচার করা যায় না। মাছ ধরলেই জেলে হয় না। চুল কাটলেই নাপিত হয় না। তবে মনে রেখো, কোনো পেশাই ছোট নয়। আজকাল ব্রাহ্মণ হয়েও কেউ কেউ ছুতোরের কাজ করে। ইচ্ছে এবং দক্ষতার বলে চা বিক্রেতার ছেলেও একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। তার উদাহরণ তো আমাদের সামনেই আছে। আসল কথা হলো – মানুষকে বিচার করতে হয় তার ভেতরের ‘গুণ’ দিয়ে। একটু আগে তুমিই তো স্যারের পাণ্ডিত্যের কথা বলেছিলে। যাইহোক, কৃষ্ণকান্তকে আমি চিনি। মধুপুরে ওর বাড়ি। তোমাদের লক্ষ্মণপুর থেকে কাছেই।

 

নীলাদ্রি এবার গম্ভীর গলায় বললো, “একটা কথা স্যার না বলে থাকতে পারছি না। আপনি যদি অনুমতি দেন, তো বলি। মনের কৌতূহল প্রকাশ করাই ভালো।” “বেশ, বলে ফেলো।” “স্যার, স্কুলে কৃষ্ণকান্ত স্যারের  একটা নতুন নাম হয়েছে। ছাত্ররা সবাই এখন সেই নামেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।” বাদশা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী নাম রে নীলাদ্রি?” সালমাও অনুরোধ করে, “এই নীলাদ্রি, তাড়াতাড়ি বলে ফেলনা নামটা।” নীলাদ্রি গর্ব করে বললো, “মোবাইল মাস্টার”।

 

মফিজুল জানতে চাইলো, “নীলাদ্রি, এমন নামকরণের কারণটা কী?” “শুনবেন? বলছি তাহলে। কৃষ্ণকান্ত স্যারের হাতে সব সময় একটা স্মার্ট মোবাইল থাকে। খুটখুট করেন। বিশেষকরে ক্লাস চলাকালীন খুটখুট করতেই থাকেন। ব্ল্যাকবোর্ডে কোন প্রশ্নের উত্তর লেখানোর আগে খুটখুট করে নেন। আবার কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে খুটখুট করে নিয়ে উত্তর দেন। একদিন কী হলো, মোবাইলে চার্জ ছিল না। আবার বাড়ি থেকে চার্জার আনতেও ভুলে গেছিলেন স্যার। উনি তো তখন পাগলের মতো করতে লাগলেন। কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখালেন না। কোনো প্রশ্নের উত্তরও দিলেন না। শেষমেশ অবশ্য একটা চার্জার পাওয়া গেল। মোবাইলটা চার্জে বসালেন। কিন্তু আমাদের বাংলা ক্লাসটা মাটি হয়ে গেল। চতুর্থ পিরিয়ডে ইংরেজি স্যার না আসায় মোবাইল স্যারই আবার আমাদের ক্লাসে এলেন ইংরেজি পড়াতে।  মোবাইলেও এরই মধ্যে চার্জ ফুল হয়ে গেছে। ওটা হাতে করেই এলেন। স্যারের মনে এবার আনন্দ। একটা গল্প পড়াবেন। বই ছাড়াই গল্পটা পড়াতে শুরু করলেন। মোবাইলে খুটখুট করছেন, আর ঝড়ের মত ইংরেজি বাক্য বলছেন। খুটখুট করছেন, বলছেন। খুটখুট করছেন, বলছেন। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছি। একইসাথে অবাক হয়ে ভাবছি, এত বড় গল্পটা স্যারের মুখস্থ! পড়ানোর শেষে অবশ্য স্যার নিজে থেকেই আমাদের কৌতূহল নিরসন করবার জন্য বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা, তোমরা অবাক হয়ে ভাবছিলে, কী করে এত বড় গল্প আমি বই না দেখে বলতে পারলাম। আসলে বর্তমান যুগে মোবাইল তো সবার পকেটেই থাকে। মোবাইল থেকে কতকিছু শেখে। কিন্তু এই মোবাইলটা আমার হাতে থাকলে, আর একটু খুটখুট করলে জ্ঞানের দরজাটা আমার আপনা-আপনিই খুলে যায়।’ আমরা বুঝলাম – ‘এই জ্ঞান ঈশ্বর প্রদত্ত। যেমন করে মেঘেদের রাজ্য থেকে বৃষ্টি-বিন্দু আপন বেগে ঝরে পড়ে, তেমনি করেই স্যারের মস্তিষ্ক অর্থাৎ জ্ঞান-রাজ্য থেকে আপন মহিমায় এই জ্ঞান ঝরে পড়ে।’ সেই থেকেই স্যারের নাম হয়ে গেল ‘মোবাইল মাস্টার’।”

মফিজুল মনে মনে কত কিছু ভাবতে লাগলো। ভাবনার অবকাশে একে একে ছাত্রছাত্রীরা এসে ভিড় জমাতে লাগলো। ঘরটা ভর্তি হয়ে গেল। স্যার জানালার ফাঁক দিয়ে দূরে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তারপর শুরু করল পাঠদান।

 

এরপর নতুন মাস পড়লো। দিনে দিনে মফিজুল স্যারের ছাত্র-ছাত্রী কমতে লাগল। ওদিকে নতুন চাকরি পেয়ে কৃষ্ণকান্ত স্যার ইতিমধ্যে টিউশনি শুরু করে দিয়েছেন। স্কুল-শিক্ষক হবার সুবাদে এবং সুবিধা পাবার আশায় তার বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় বাড়তে লাগলো। এভাবে অল্প দিনেই স্যারের নাম, খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।

 

মফিজুল দিশেহারা হয়ে পড়ল। সংসারে বাবা-মা, অবিবাহিতা বোন আছে। রোজগেরে বলতে সে আর বাবা। বাবার বিঘে দু’য়েক চাষের জমি আছে। আবাদ করে ফসল যা ঘরে ওঠে, তার বেশিরভাগটাই লোনের কিস্তি শোধ দিতে ফুরিয়ে যায়। তার উপর খরা, বন্যা হলে তো দুর্ভোগের সীমা থাকে না। বোন কলেজে পড়ে। বড়ো দাদা হিসেবে ইচ্ছে ছিল – বোনের স্নাতক হবার পর বি.এডটা করিয়ে নেবে। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হবে কিনা, তার চেয়েও মফিজুলের এখন বেশি চিন্তা ‘সংসার কী করে চলবে!’

 

জনা কয়েক ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে সকালের জলখাবারও হয় না। তাই বাধ্য হয়ে দিন হিসেবে ‘টোটো’ ভাড়া নিয়ে চালাতে লাগলো মফিজুল। তাতেও খরা। রাস্তায় এত টোটো, যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। তবুও প্রতিদিন আশা নিয়ে পথে নামে হতভাগা। গৃহ-শিক্ষক কথাটা মানুষের মনে ক্রমে আবছা হয়ে এখন টোটো চালক কথাটাই রপ্ত হয়ে গেছে। যদিও মফিজুলের মনে এ নিয়ে কোনো ব্যথা নেই।

 

শ্রাবণের শেষে নিম্নচাপের দরুণ ঘন-বর্ষা শুরু হয়েছে, সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। মফিজুলকে তো বের হতেই হবে। দু’দিন বৃষ্টিতে ভেজার পর তৃতীয় দিন। আজ রাস্তাঘাট নির্জন। কোনো টোটো পথে নামেনি। স্কুলে দ্বিতীয় পর্বের মূল্যায়ন আজ থেকে শুরু। দুর্যোগের সুযোগে দু’দিন কামাই করার পর আজও সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী নিষেধ করেছিল স্কুলে যেতে। কিন্তু বাধ্য হয়েই মোবাইল মাস্টারকে বেরোতে হলো। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাইক নয়, টোটোই উপযুক্ত, এমন মনে করে ছাতা মাথায় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালেন মাস্টার। সুবিধার বদলে বিপদেই পড়ে গেলেন। একটাও যে টোটো নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে দেখলেন – বাঁশি বাজাতে বাজাতে একটা টোটো এগিয়ে আসছে। মাস্টারও হাঁক দিলেন, “এই টোটো, যাবে, লক্ষ্মণপুর হাইস্কুল?” টোটোটা কাছে এসে দাঁড়াতেই মোবাইল মাস্টার চেপে বসলেন।

 

প্রচন্ড ঠান্ডা আর বৃষ্টির ঝাপট থেকে রক্ষা পেতে টোটো চালক গামছা দিয়ে মাথা, মুখমণ্ডল ভালো করে বেঁধে নিয়েছিল। মুখ থেকে গামছাটা একটু সরিয়ে সহসা জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছিস্ কৃষ্ণকান্ত?” টোটো চালকের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে মোবাইল মাস্টার প্রথমে থ হয়ে গেলেন। পরক্ষণে ভাবতে লাগলেন, “ও ব্যাটা এত দুঃসাহস পেল কী করে? একজন শিক্ষকের সাথে সম্মান জানিয়ে কথা বলতে শেখেনি?” আবারও প্রশ্নঃ “ভালো আছিস?” মাস্টার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠল। “কে তুই?”  “চিনতে পারছিস্ না? আমি মফিজুল।” “ওঃ হো,মফিজুল তুই? তা কী করে হলো, তোর এই পরিণতি?” “ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে।” “মফিজুল, তোকে ক’টা কথা বলি, শোন্। প্রথম কথা হল, ভাগ্য নিজেকে গড়তে হয়। তুই বরাবরই ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্র ছিলি,আর আমি ছিলাম পেছনের বেঞ্চের ছাত্র। অথচ তুই রয়ে গেলি পেছনে, আমি এগিয়ে গেলাম। এ তো আর এমনি এমনি হয়নি। স্কুলেও আমার বেশ নাম হয়েছে। বাড়িতে টিউশনিও শুরু করেছি। প্রচুর ছেলেমেয়ে পড়তে আসছে। ভেতরটা আমার অন্তসারশূন্য, একেবারে ঠিক কথা। অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমি একজন বিদ্বান ব্যক্তি। কিরে, প্রশ্ন করছিস্ না, কেমন করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলাম?”

 

মফিজুল নিশ্চুপ থাকে। আবারও বলতে শুরু করেন কৃষ্ণকান্ত। এবার হেসে হেসে বললেন, “পরীক্ষার খাতায় তোর যত জ্ঞান ঝরে পড়তো মগজ থেকে, আর আমার ঝড়ে পড়তো জামা-প্যান্টের পকেট থেকে। নম্বর কি আমি কম কিছু পেতাম? শেষবার জীবনের সাফল্যের পরীক্ষায় তোকে তো হারিয়েই দিলাম। আরে শোন্, আজকের দুনিয়ায় আমার মতো ছেলেরাই প্রতিষ্ঠা পায়। তোর মতো ছেলেরা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে হতাশার সাগরে ডুবে মরে। ঠিক আমাদের গ্রামের হরিহর ডাক্তারের মতো। পাস করা ডাক্তার হওয়া সত্বেও মাছি তাড়ায়। তার পাশেই চারবার মাধ্যমিক ফেল করা বনবিহারী কয়েকটা দালাল ফিট করে শুধু নাক্স ভমিকা, আর্নিকা, বেলেডোনা দিয়েই কেমন ভেল্কি দেখাচ্ছে! এইতো,  আমার কথাটাও বলি, ভালো মাস্টার হলাম কী করে? মাথাটা তো ফাঁকা। মোবাইল থেকে বের করি, আর ছাত্রদের দিকে ছুঁড়ে দিই। ছাত্ররাও লুফে নেয়। যাইহোক, মফিজুল, এসব কথা কাউকে বলিস্ না। স্কুল-কলেজ জীবনে তুই ছিলি আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরাণের পরাণ। আমার ব্যাপারে সবকিছুই তোর জানা, তাই কোনোকিছুই লুকালাম না। তোর এমন দৈন্যদশা আমাকে যে আজ দুর্বল করে তুলেছে। তবে আসল কথা হলো, এর থেকে তোকে শিক্ষা নিতে হবে।

 

এমন সময় টোটোটা এসে থেমে গেলো স্কুলের দরজায়। মফিজুল শত দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যেও মুচকি হেসে বলল, “কুড়িটা টাকা দে কৃষ্ণকান্ত। তুই এখন উচ্চ বিদ্যালয়ের উঁচু দরের শিক্ষক। মোটা বেতন পাচ্ছিস। তাই চেয়ে নিলাম। এছাড়া তোকে ধন্যবাদ, আমাকে অনেক উপদেশ দেবার জন্য। এসব কথা সবই ভাঙা হৃদয়-কুটিরে  সুরক্ষিত থাকবে। সুন্দর এই ভুবনে আমি বাঁচতে চাই ঠিকই, তবে রত্নাকর হয়ে নয়, বাল্মীকি হয়েই বাঁচতে চাই।”

……………………………………………………….