শিক্ষার মুমূর্ষুকাল

          শিক্ষাঙ্গন বারবার এত অশান্ত হয়ে উঠছে কেন ?  শিক্ষকরা কি কোনও চোর,ডাকাত বা দেশদ্রোহী ?

 সমাজ আজ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আমার প্রশ্ন এই অবস্থায় পৌঁছাল কেন ? কেন আজ শিক্ষকদের উপর জনরোষ তৈরি হচ্ছে ? কেন বারবার যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠছে  ?

     শিক্ষকতা জীবনের এক মহান ব্রত শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর সেই মানুষ সমাজ,সভ্যতা গড়ে,উন্নত রুচিসংস্কৃতির জন্ম দেয় আমরা অতীতের অনেক মাস্টেমশায়ের নাম শুনেছি যারা স্নেহমমতাভালবাসার বাঁধনে বেঁধে শিক্ষা দিতেন,শিক্ষার্থীদের দেশাত্মবোধের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতেন আমরা আমাদের শিশুবেলায়ও দেখেছি কত যত্ন সহকারে,কত আন্তরিকতার সাথে শিক্ষকশিক্ষিকাগণ শিক্ষা দিতেন,আমাদের সন্তানের চোখে দেখতেন শাস্তিও দিতেন যা আমাদের কাছে আর্শীবাদ হয়ে উঠত আমাদের মাবাবাও মনে করত শিক্ষকশিক্ষিকাগণ যা করছেন তাদের সন্তানদের মঙ্গলের জন্যই করছেন তাইতো সেদিনের সমাজ রামমোহন,বিদ্যাসাগর,বিবেকানন্দের মতো বড় মানুষদের জন্ম দিতে পেরেছে,বঙ্গভূমি কত বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে আজ সেই বঙ্গভূমি বন্ধ্যা কেন ?

আজ তো সুযোগসুবিধা বেড়েছে,বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে,লন্ঠনের বদলে বিজলী বাতি এসেছে তবে কীসের অভাব ? নমস্য শিক্ষাদাতাদাত্রীগণ কেন তাদের যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ? একজন শিক্ষক হিসাবে আমি প্রথমে শিক্ষকদের কিছু সমালোচনা করছি হ্যাঁ,ভালো শিক্ষক এখনও আছেন,তবে সেই সংখ্যাটা অতি নগণ্য আজও ছাত্রছাত্রীরা ঘিরে ধরে তাদের প্রিয় শিক্ষিকাকে বাচায়,প্রিয় শিক্ষক বদলি হতে গেলে তাঁকে ঘিরে ধরে যেতে না দেওয়ার পণ করে কিন্তু বিপরীত চিত্রটা মারাত্মক,বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে অতি মারাত্মক একঃ বৃহৎ অংশের শিক্ষকশিক্ষিকা আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করেন না,তাঁরা আসেন চাকরি করতে,সময় কাটাতে দুইঃ সময়মতো বিদ্যালয়ে আসেন না,নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে যান নানা অজুহাতে তিনঃ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দুতিন জন একসাথে বসে গল্পে মজে ওঠেন মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি গল্পে ওঠে পরিবার,রান্নাবান্না,বাড়ির সাজসজ্জা,পোশাকআশাক ইত্যাদি ইত্যাদি চারঃ পাঠদানে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি থাকে না,লেশনপ্লান থাকে না,ফলে পাঠদান হয় দায়সারা পাঁচঃ কোন এক শিক্ষক জরুরী প্রয়োজনে আজ টিফিনে চলে গেলে কাল থেকে শুরু হয় অপ্রয়োজনে বাকিদেরও একে একে টিফিনে যাবার পালা ছয়ঃ ক্লাসে বসে মোবাইল ফোনের ব্যবহার এবং তা বিনোদনের জন্য সাতঃ কোনো শিক্ষার্থী শিশু কাছে এসে স্পর্শ করলে অথবা জড়িয়ে ধরলে কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়াঃ ছি!ছি! তোর গায়ে কী নোংরা ! ভালো শাড়িখানায় নোংরা লাগিয়ে দিলি ? সেই শিশুটি মুখ কালো করে ঘৃণা,অপমানে চুপসে যায় আটঃ শিক্ষক তাঁর নিজের ছেলেটিকে বা মেয়েটিকে নিজের স্কুলে পড়ান না কিন্তু ভর্তি করে রেখেছেন,পড়ে সে প্রাইভেট স্কুলে আবার কোনদিন তাকে বেড়ানোর ছলে নিজের স্কুলে নিয়ে এলেও সে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসে না,বসে মায়ের (শিক্ষিকার ) পাশে অন্য চেয়ারে মা কিন্তু সেদিন নিজের ছেলেটিকে যত্ন নিয়ে পড়ান,অন্য ছেলে মেয়েরা হা করে তাকিয়ে থাকে সব থেকে দৃষ্টি কটু লাগে যে,সরকারী সাহায্য যা আসে যেমন পোশাক,জুতোমোজা ইত্যাদি সেগুলো নিজের ছেলের জন্য বেছে বেছে আগেই ব্যাগে ভরে নেন নয়ঃ বাসেট্রেনে যে শিক্ষকগণ (ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের বেশির ভাগই শিক্ষক ) যারা যাতায়াত করেন তাদের জন্য অন্য যাত্রীরা বসার সীট পায়না, চেন সিস্টেমে আগেই বুক হয়ে যায় আবার অসুস্থ বা বয়স্ক যাত্রীকেও সীট ছাড়তে নারাজ সাধারণ যাত্রীরা এই নিয়ে প্রায়ই ক্ষোভ উগরে দেয় দশঃ মিডডেমিল,অনুদান,ড্রেস,নানা ফান্ডের টাকা আত্মসাৎএর ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিনিয়ত লোভ অতিলোভে পরিণত হয়েছে এর সাথে শৃঙ্খলে যুক্ত হয়ে আছে নানা স্তরের কর্মকর্তারাও সাধারণ মানুষ তাই আজ আর শিক্ষকদের ভালো চোখে দেখেন না,সামান্য ঘটনাও সহ্যের বাইরে চলে যায় শিক্ষকদের ব্যক্তিগত জীবন এখন একটা বড় ঈর্ষার কারণ বর্তমানে প্রায় নিরানব্বই দশমিক নয় জন শিক্ষকদের স্বামীস্ত্রী দুজনই চাকুরিরত আজ কোনো বেকার ছেলে শিক্ষক হয়ে গেলে তিনি চাকুরিরত পাত্রী খোঁজেন,একই ভাবে শিক্ষিকা চাকরিরত পাত্র খোঁজেন এর উপর প্রাইভেট টিউশনতো আছেই টাকা,চাই আরও টাকা এখন বিষয়টা হলএর কোন প্রতিকার নেই স্রোতের অনুকূলে চলতে পারলেই সাতখুন মাপ এগারঃ বয়েস অল্প এধারওধার করে কিংবা মেধার জোরেই মাস্টারিটা পেয়ে গেছেন এখন আবার বড় চাকরি পাবার জন্য ক্লাসে বসেও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন ছাত্ররাও নিজেদের খেলা আর হৈ হট্টগোলে ব্যস্ত ওরা গোল্লায় যাক,নিজেদের হলেই হল এবার একটু গোড়ায় গলদটা দেখে নিই একঃ আজকের বেকারত্বের যুগে একটা চাকরি পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর যার টিচিং ভাল লাগে না সে ভাগ্যবরাত টেট পাশ করে টিচার হয়ে গেছে/যাচ্ছে দুইঃ অনেক যুবকযুবতী (অধিকাংশ স্বচ্ছল ঘরের) টাকার জোরে বি.এড./ডি.এড/পি.টি.টি আই ইত্যাদি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে (মূলত সার্টিফিকেট কিনে) শিক্ষকের গুণাবলি না থাকলেও শিক্ষক হয়ে গেছে তিনঃ একটু গল্পের ছলে বলি,এভাবেও চাকরি হয়েছেগৃহবধু,দশ/বারো বছর ধরে বইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই স্বামী H.S টিচার মনে সাধ জাগল স্ত্রীকে দিয়ে চাকুরি করাবে প্রাইমারী টিচার নিয়োগের বিঞ্জপ্তি বেরোল ব্যাঙ্কে গিয়ে ৩টি ফর্ম তুলে নিয়ে এল ফর্মের নাম্বারই রোল নাম্বার (কিছু কাল আগের কথা) প্রথমটি স্বামীর,২য়টি স্ত্রীর,৩য়টি স্বামীর বন্ধুর নামে (H.S Teacher)  পূরন করা ফর্ম জমা পড়ে গেল মাঝে বসবে স্ত্রী স্বামী আর বন্ধুটি তাকে সাহায়্য করবে টেট পাস করে স্ত্রী চাকরিও  পেয়ে গেল গল্প হলেও সত্যি,প্রমান করা যাবে না চারঃ দলতন্ত্র,সজন পোষণ,Give and take policy, যেদিন থেকে এই সুবিধা বা কামিয়ে নেবার রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করেছে সেদিন থেকে আদর্শবান শিক্ষকেরও অভাব সৃষ্টি হয়েছে

ভোট সর্বস্ব রাজনীতি কীভাবে শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছেঃএকঃ পরিদর্শকগণ এখন নানান কাজের চাপে পড়ে বিদ্যালয়ে কমই আসার সুযোগ পান যদিও বা আসেন স্থানীয় কোন নেতাকে সঙ্গী হিসাবে দেখা যায় দুইঃ কখনও কোনো শিক্ষক টার্গেট হলে নেতার হুকুমে পরিদর্শক তাকে শোকজ করেন তিনঃ পরিদর্শক দেখেন শুধু শিক্ষকদের উপস্থিতি,চালেরস্টক,ছাত্র উপস্থিতি,মিডডেমিল সংক্রান্ত তথ্য চারঃ পরিদর্শনের কাজটি এখন শিক্ষাবন্ধুরাই সেরে নেন স্বশরীরে বা ফোনে ফোনে পাঁচঃ এস.আই সাহেব (Sub.Inspec) স্থানীয় নেতাদের আজ্ঞ বহ দাসে পরিণত হয়েছেন,এমনকি তিনি তাঁর অফিসের প্রভাবশালী করণিকের নির্দেশ মেনেও চলেন ফলে শিক্ষকের ছুটি,ম্যানেজ (আজ স্কুলে না এলে কাল এসে সই করা),অন্যান্য সুবিধা নেওয়া অত্যন্ত সহজ তবে শিক্ষকদেরও নেতার আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হয় এর ফলে পঠনপাঠনের মানটা গৌন হয়ে দাঁড়ায় ছয়ঃ ছাত্র উপস্থিতি কমে গেলে আধিকারিকরা পরামর্শ দেন (আসলে উপরের নির্দেশ) খাতায় উপস্থিতি বাড়িয়ে দেখতে,কেননাড্রপ আউট দেখানো যাবে না পাঁচঃ রেজাল্টে কাউকে পাওয়া দেখানো যাবে না উত্তর পত্র কারেকশান করে একটা সন্তোষজনক নাম্বার পাইয়ে দিন,প্রয়োজনে নাম্বার বা উপস্থিতি বাড়িয়ে দিন ইত্যাদি ইত্যাদি ফলস্বরূপ অভিভাবকগণ খুশি হচ্ছে কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে আবার এক শ্রেণির শিক্ষকও এর ফলে ফাঁকিবাজ তৈরি হচ্ছে ছয়ঃ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রটা আরও ভয়াবহ সারাবছর ধরে বিভিন্ন ফর্মাট পূরণ,মিটিং,ভোটের তালিকায় নাম তোলা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকার ফলে পাঠদানটা শিকেয় তোলা থাকে যদিও জনরোষটা এসে পড়ে শিক্ষকদের উপরই

বাস্তব পরিণতিটা তাহলে কী ?

একঃ এমনিতেই পাঠ্য বইগুলো আজগুবি গল্প আর অন্ধবিশ্বাসে পরিপূর্ণ তার উপর গরিবের ছেলেমেয়েদের ক্ষুধার অন্ন ছাড়া পড়াশুনা বলতে কিছু হয় না ফলে একটা শ্রেণি বিভাজন তৈরী হয়েছে একদিকে স্বচ্ছলতা,শিক্ষা,চাকুরি,সমস্ত সুযোগ বিদ্যমান আরেক দিকে ঘন অন্ধকার,অবহেলা,শুধু একটু দয়াদাক্ষিন্য তাও হীন স্বার্থের বিনিময়ে সর্বোপরি রুচিহীন,অপসংস্কৃতিময় ক্ষমতালোভী রাজনীতির অনুপ্রবেশ যেন আগুনে ঘি ঢালা আর তাতেই শিক্ষাঙ্গন বারবার অশান্ত হয়ে উঠেছে দুইঃ সরকারি স্কুলে শিক্ষা হচ্ছেনা এই অজুহাতে গজিয়ে উঠেছে আনাচেকানাচে প্রাইভেট স্কুল কিছু স্বার্থান্বেষী হীনমানসিকতার মানুষ শিক্ষা বেচে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে আছেন উপর মহলের প্রভাবশালীরা,তাঁরা চান চাষার ছেলে চাষাই হোক,মজুরের ছেলে মজুর,বরং ওদের ঘর থেকে মেঘনাদ সাহারা জন্ম না নিলেই ভালো এভাবে সুকৌশলে শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে দেশের মালিকদের হাতে তুলে দেবার রাস্তাটাও প্রশস্ত হচ্ছে তিনঃ যৌনতাকে শিশু বয়স থেকেই গাসাওয়া করে তোলা হচ্ছে,এই পণ্য বেচে ভালোই মুনাফা আসবে। এখন বিদ্যালয়ে ন্যাপকিন দিচ্ছে আস্তে আস্তে গর্ভনিরোধক বড়ি কনডোম দেওয়া হবে,সেই দিন হয়তো সামনেই আসছে