Khichuri Class – খিচুড়ি ক্লাস

Khichuri Class - খিচুড়ি ক্লাস
(অণুগল্প)

Khichuri Class – খিচুড়ি ক্লাস

“ও মা, ভাই-আমার কী বলছে? শোনো, বাংলার স্কুলে নাকি এখন খিচুড়ি ক্লাস হয়। এ তো আমি বাপের জন্মেও শুনিনি। এ ভাই, ভাই, বল্ না, খিচুড়ি ক্লাস কী?” “না, আমি বলবো না। তোকেই আবিষ্কার করতে হবে। মা-ও চেষ্টা করুক।”

মেয়ের মতো মা-ও যে মুশকিলে পড়েছে। ভাবছে, “খিচুড়ি ক্লাস আবার কী?” ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে ভূষণ, তোদের প্রাইমারিতে না হাইস্কুলে এই ক্লাস চালু হয়েছে?” “মাগো, তোমার ছেলে প্রাইমারির পার্শ্ব শিক্ষক। হাইস্কুলের কথা জানবে কী করে, বলতেই বা যাবে কেন?” “কিন্তু তোদের প্রাইমারিতে তো ‘শিশুশ্রেণি, ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর’ – এই পাঁচটা ক্লাসই এতদিন ছিল। এটা আবার কবে থেকে চালু হলো, ক্লাসটাই বা কেমন?” “না মা, নতুন কোনো ক্লাস নয়। তবে সেটা অদ্ভুত এক ক্লাস।” ”তোর কথার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

দিদি বলল, “মা, এটা কোন ধাঁধা হবে।” ভূষণ হেসে উঠল। “না রে দিদি, ধাঁধা ঠিক নয়। একটু বুদ্ধি খাটা, উত্তরটা পেয়ে যাবি।”

মা, দিদি বড় মুশকিলে পড়ে গেল। দুজনেই উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত, “কী হতে পারে?” আপন মনে মা বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “আই.সি.ডি.এস হলে নাহয় বলতাম – ওখানে পড়াশোনা কিছুই হয় না, শুধু খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। কিন্তু ভূষণ তো বলছে প্রাইমারির কথা।”

Khichuri Class - খিচুড়ি ক্লাস

দিদিও মায়ের মতই মনে মনে বলছে, “ইদানীংকালে প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনার হাল অত্যন্ত খারাপ, একথা ঠিকই। খাওয়া-দাওয়াটাই হয়। তবে খিচুড়ি তো আর রোজ হয় না। এক এক দিনের মেনু তো এক এক রকম। তবে ……….।”

ভুষণ এবার দুজনকেই আশ্বস্ত করে বলল, “নামটা খিচুড়ি হলেও আসল খিচুড়ি নয়। কিন্তু খিচুড়ির সাথে সাদৃশ্যযুক্ত।”

“আরও তো কঠিন হয়ে গেল। আসল খিচুড়ি হলে তাও খানিকটা ভাবনা-চিন্তা করা যাচ্ছিল। এখন তো সব অন্ধকারে তলিয়ে গেল।” ভাবতে ভাবতে মা মেয়েকে শুধোয়, “হ্যাঁরে সোমা, পারলি কিছু উদ্ধার করতে?” “না মা, তোমার মত আমারও বেহাল অবস্থা।”

এমতাবস্থায় মা, দিদি যখন হাল ছেড়ে দেবে, ঠিক তখনই ভূষণ একটা ছড়া বললো, “ধরো যদি কষে হাল, তীরে পৌঁছে দেবে তরীর পাল।”

“এটা কোনো সূত্র নাকি রে ভাই?” “সূত্র নয়। এই ছড়া তোর আর মায়ের দু’জনের মনে প্রেরণা জোগাবে। এবার সংকেত দিচ্ছি, মন দিয়ে শোন্। ধর্ বর্ষামুখর দিন। বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না। ঘরে সবজিও নেই। আছে শুধু চাল। বাড়ির কাছে একটা মুদির দোকান আছে। মা বলল, ‘ভূষণ, দোকান থেকে কিছু নিয়ে আয়।’ আমি ছাতা মাথায় চলে গেলাম মুদির দোকানে। ডাল, আলু, লবণ, লঙ্কা, মশলাপাতি ছাড়া আর কীইবা আছে? আমি ওগুলো পরিমাণ মতো নিয়ে এলাম। এরপর মা তোকে বলল, ‘সোমা, এবার তুই রান্না কর্।’ বল্, কী রান্না করবি তুই?” “সহজ উত্তর, খিচুড়ি। ও ভাই, সেই খিচুড়িতেই তো চলে এলাম।” “আসবেই তো, বলেছিলাম না, সাদৃশ্য আছে। আর একটা সংকেত দিচ্ছি। শোন্, বলছি। ধর্, ওই বর্ষার দিন আমি স্কুলে গেলাম না। ছেলেমেয়েরা ছাতা মাথায় দিয়ে, কেউ কেউ পলিথিন মাথায় দিয়ে চলে এলো। কী হবে? স্কুল তো আর ছুটি দিয়ে দেওয়া যাবে না।”

দাঁড়া, একটু চিন্তা করতে দে। মা, তুমিও ভাবো। এবার মনে হয় চিন্তার তরী সত্যিই তীরে পৌঁছাবে।”

ক্ষনিক পরেই দিদি আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। “পেয়েছি, পেয়েছি। শোন্ ভাই, রাজ্যের বেশিরভাগ স্কুলে এখন ছাত্র অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা কম। তোদের স্কুলে যেমন। তার উপর কেউ অনুপস্থিত থাকলে তো কথাই নেই। পাঁচটা ক্লাস সামলাতে দুটো-তিনটে ক্লাসকে একসাথে বসাতেই হবে। আর এই মিশ্রিত ক্লাসের নামই হলো খিচুড়ি ক্লাস।”

ভূষণ অট্টহাসি হেসে উঠল। “একেবারে ঠিক উত্তর। এই না হলে আমার দিদি!”

কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও মায়ের মুখের হাসি নিমেষে মিলিয়ে গেল। বলল, “বড় দুরাবস্থা রে। দুঃখ হয়। খিচুড়ি ক্লাসে কি লেখাপড়া হয়? শিক্ষার মান নামতে নামতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।” দিদিও দুঃখ করে বলল, “হতভাগ্য ছেলেমেয়েগুলোর শিক্ষার মান থাকলো বা নাইবা থাকলো, আমাদের দুঃসহ মাথাব্যথা হলেও, তাতে উপরওয়ালাদের কীবা আসে যায়? এক শ্রেণির মানুষের ঘরে প্রচুর টাকা। তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক টাকা দিয়ে বেসরকারি স্কুলে পড়ে। তাদের জন্য শিক্ষা আছে, শিক্ষার মান আছে। প্রদীপের যত আলো উপরের মানুষগুলোর জন্যই। আমাদের চারপাশে অগণিত গরিব মানুষ। ওরা শ্রমিক। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সম্পদ সৃষ্টি করে। অথচ ওরাই অনাহারে থাকে। ওরাই অবহেলিত, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ওদের জন্ম বুঝি চিরকাল উপরের মানুষদের সেবা করার জন্যই। মুখে অনেকে সাম্যের কথা বলে, গরিব-দরদের কথা বলে। শুনতে ভালো লাগে। প্রতিশ্রুতি আর সান্ত্বনার কথাগুলো শোনার জন্য আমরাও উদগ্রীব হয়ে থাকি।”

……………………………………………………