Proshna Ek Uttar Anek – প্রশ্ন এক উত্তর অনেক

 

প্রশ্ন এক
            উত্তর অনেক

                     
           –  হরবিলাস সরকার

             প্রশ্নোত্তর 
(কল্পনার আঙিনায় বাস্তব) 


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ‘হরিশঙ্করবাবু’ গভীর মনোযোগ সহকারে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ সামনের সারিতে বসা ‘মৃণাল’ উঠে দাঁড়ালো। অধ্যাপকের মনোযোগ এবং পাঠদানে বাধা পড়ল। জিজ্ঞেস করলেন, “মৃণাল, কী হল, উঠে দাঁড়ালে যে?”  “একটা প্রশ্ন ছিল স্যার।” “প্রশ্ন! কী প্রশ্ন, বলো।”  “শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সমাজ এখন তোলপাড়। দুর্নীতি যে হয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল – ছলে-বলে-কৌশলে দুর্নীতির কারবারিরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণিত করতে মরিয়া। তারা এ কাজে সফল হলে সমাজে কীরূপ প্রভাব পড়বে?”


অধ্যাপক চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বললেন, “বাবুরে, তোমার প্রশ্ন যে আমাকে বেকায়দায় ফেলে দিল। এক কথায় বা সংক্ষেপে উত্তর দেওয়া যাবে না। কারণ, উত্তর অনেক।” “স্যার, বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নাহয় আজ এটাকেই পাঠ্য বিষয় করে নিন।”


উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদের সকলেরই জানবার অধীর আগ্রহ। অধ্যাপকের দৃষ্টি আরোপিত হল জ্ঞানজগতের উপর। তাঁর কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ। বুঝি একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে দেখতে লাগলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, “শোনো তাহলে। নাম্বার ওয়ানঃ বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ হবে। নাম্বার টুঃ সমাজে দুর্নীতি স্বীকৃতি পাবে। নাম্বার থ্রিঃ শিক্ষা দপ্তর, পর্ষদ, সার্ভিস কমিশনগুলো দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। নাম্বার ফোরঃ মেধা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে। নাম্বার ফাইভঃ অর্থই হবে শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হবার মাপকাঠি। নাম্বার সিক্সঃ শিক্ষার মান ক্রমে নিম্নমুখী হবে। কেননা, অযোগ্যরা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পাঠদান করবে। নাম্বার সেভেনঃ রুচি, সংস্কৃতির মান অধঃপতিত হবে। নাম্বার এইটঃ উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র সমাজ তৈরি হবে। নাম্বার নাইনঃ সমাজ উচ্ছৃঙ্খলতায় পরিপূর্ণ হবে। নাম্বার টেনঃ বিবেক,মনুষ্যত্ব, 

মূল্যবোধহীন সমাজে যেন-তেন প্রকারে অর্থ উপার্জনই হবে জীবনের মূল লক্ষ্য। শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাবে। ফলস্বরূপ একটা দুর্নীতি আরো বহু দুর্নীতির জন্ম দেবে।


কমলিকা বলে উঠলো, “স্যার, অর্থ আর ভোগের লিপ্সায় মানুষ অমানুষ হয়ে উঠবে। জ্ঞানচর্চা, মনীষীদের স্মরণ, সত্যানুসন্ধানে বাধা পড়বে।” “একদম ঠিক। ‘নাম্বার ইলেভেন’ তুমি বলেই দিলে। এবার নাম্বার টুয়েলভঃ এই যে দেখছো দুর্নীতি কারবারিদের এত দৌরাত্ম্য, আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করা, এত ছল, এত কৌশল, তার মানে ওরা পূর্ব পরিকল্পনামাফিক সংঘবদ্ধ। এই সঙ্গবদ্ধতাই ওদের কারবারে সমৃদ্ধি এনেছে। ওরা ব্যাপ্তি ঘটিয়ে সংঘটিত হয়েছে। আগামী দিন ওদের ব্যাপ্তি, পসার আরও বহুগুণ বাড়বে।”


সুলোচনা উত্তরটাকে আরেকটু জোরালো করলো। “যথার্থই বলেছেন স্যার। মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, বড় নেতা, ছোট নেতা, দলের কর্মী, প্রশাসন, আমলাদের বড় অংশ এই কারবারে শৃঙ্খল আকারে যুক্ত। তার প্রমাণ মিলেছে। তবুও শাসক তাদের বীরের সম্মান প্রদান করছে, সত্যকে মিথ্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে জোর গলায় বলছে –  এসব ষড়যন্ত্র। এর ফলে রাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়ছে। ‘রাজনীতি উচ্চ সংস্কৃতির আঁধার’, মানুষ তা এক সময় ভুলে যাবে। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা ইতিমধ্যেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সেখানে অবাধে প্রবেশ করছে অপরাধ জগতের লোকেরা। ভবিষ্যতে তাদেরই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে।”


সিরাজুল বলতে লাগলো, “স্যার, ছোটবেলায় ভাবতাম – আমাদের সমাজের মাথাওয়ালা মানুষগুলো না জানি কত মহৎ, উদার। নিঃস্বার্থভাবে দেশের ও দশের হয়ে কাজ করে যাওয়া – মানবতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে ? কিন্তু এখন যেন উল্টো দেখছি। এখন দেশ সেবকদের ভিড় জমে। হই-হুল্লোর শুরু হয়ে যায়। ভাবি – কেন মানুষগুলো ভোটের টিকিট পাওয়ার জন্য নিজেরা মারামারি করে, গুলি খেয়ে মরে। দিন এখন বদলেছে। এখন ভেতরের এক রূপ, বাইরে আরেক রূপ। মানুষগুলো যেন মুখোশ পরা। রং-বেরঙের কত মুখোশ। মুখে এক কথা, কাজে অন্য কথা। ভোটের আগে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, নিঃস্ব, ফকির। ভোটে জয়ী হলেই বেরিয়ে পড়ে তার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার বহর। ভোগ-বিলাসের গাড়ি, বাড়ি, মণি-মানিক্য কতকিছু ! জনকল্যাণের নামে জনতাকে বলি দিয়ে নিজের আখের গুছানো, এ কারবার আরও বাড়বে।”


হরিশঙ্করবাবু বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। আজকের মতো ছুটি ঘোষণা করলেন এই কথাটা বলে যে, “দেখো ছেলেরা, মেয়েরা, অনেকগুলো উত্তর তো তোমরাই আমার হয়ে দিয়ে দিলে। এখন আমি ইচ্ছে করেই আর কোনো নাম্বার বাড়াতে চাই না। ভয় হচ্ছে, এ আমরা কোথায় এসে পৌঁছালাম! হয়তো সামনে আরও ঘোর অমানিশা অপেক্ষা করে আছে।” 

……………………………………………………….