Bedonar Sindhu Pareh – বেদনার সিন্ধু-পাড়ে

Bedonar Sindhu Pareh - বেদনার সিন্ধু-পাড়ে
Bedonar Sindhu Pareh – বেদনার সিন্ধু-পাড়ে
গল্প- (কল্পনার অঙ্গনে বাস্তব)

 

বেদনার সিন্ধু-পাড়ে
– হরবিলাস সরকার

স্বপ্নদ্বীপের অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হয়েছে। বাবা শ্মশান থেকে চোখের জলে যখন বাড়ি ফিরে এলো, তখন ভোর হয়ে আসছে। ঘুম ভাঙানো পাখিরা আজ গান ধরেনি। ওরা মৌনব্রত পালন করছে। শ্রাবণের মেঘমালা এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। দিগন্তজুড়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। নদীয়ার বগুলা গ্রাম আর তার অধিবাসীরা এখন শোকে বিহ্বল।

কোলহারা মা চৈতন্য হারিয়েছে, বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরে পড়ে আছে। ডাক্তার ডাকা হয়েছে। সতেরোটা বছর ধরে কত যে স্মৃতি হৃদয়ে গাঁথা আছে, একে একে সব ভেসে উঠছে চোখের সামনে। সেই ছেলের মরণ দেখতে হল। মায়ের পরানে এ ব্যথা সইবে কেমন করে! বারবার তাই জ্ঞান ফিরতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।
বাবার মনেও বড় ব্যথা। সে যে নিজেকে বড়ই অপরাধী বলে ভাবছে। হৃদয়তন্ত্রীর তারে তাই বুঝি বেঁধেছে করুন সুর। “চির বিদায়ের এ ব্যথা সই কেমনে! অরুনিমা, আমি জানি – তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না কোনোদিন। কালই তো ছেলেকে দেখতে গিয়েছিলাম। বলেছিল – ‘বাবা, বড় আশা করে ভর্তি হলাম এখানে। মেইন হোস্টেলে জায়গাও পেলাম। কিন্তু এখানে আমার ভয় করছে বাবা।’ বারবার শুধু ভয়ের কথাই বলছিল। কীসের ভয়, বলেনি কখনও। ছাত্রদের এক সিনিয়র দাদা ‘সৌরভ’কে ডেকে বলেছিলাম – বাবুরে, তুমি আমার স্বপ্নদীপের দাদা। ওকে একটু দেখো। সৌরভ অভয় দিয়েছিল। সেই সৌরভই যে ঘাতকের একজন হবে, বুঝতে পারিনি। তাই আজ নিজেকেও ছেলের ঘাতক বলে মনে হচ্ছে। হায়রে! কেন আমি ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম না! তবে তো আজ এই দৃশ্য দেখতে হতো না।”
চোখের জল মুছতে মুছতে দরজা পেরিয়ে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে যায় বিশ্বদীপ। এইমাত্র আবার জ্ঞান ফিরেছে। অসীম শোক হৃদয়কে পাথরে পরিণত করেছে। ছেলের মৃত্যু তার কাছে অবিশ্বাস্য। তবু শাবক হারানো পাখির মতো কাতর চোখে তাকায় অরুনিমা। জানতে চায়, “কোথায় আমার ছেলে? ওগো, কেন তাকে ফেলে চলে এলে?……..?” বিশ্বদীপ অসহনীয় যন্ত্রণায় বলে ওঠে, “আমি ওকে মৃত্যুর কোলে সঁপে দিয়ে এসেছি। ও আর কোনোদিন ফিরবে না।” তবুও পাথর-হৃদয় কাঁদলো না।
দু’হাতে বুক চেপে ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে বিশ্বদীপ। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকে-লোকারণ্য হয়ে উঠল বাড়িটা। সবার বুকেই ব্যথা, চোখে জল। সবারই একই কথা, “এত ভালো ছেলে, মেধাবী ছাত্র, গ্রামে আর দু’টি নেই। ও যে ছিল সব ছেলেদের প্রেরণার উৎস। ওকে দেখে কতজন স্বপ্ন দেখতো। এমন পরিণতি হবে, কে জানতো !”
বিশ্বদীপ এবার মাটির উঠোনে লুটিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। “ওরা আমার শান্ত ছেলেটাকে তিন তলার বারান্দা থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে নয়তো ঝাঁপ দিতে বাধ্য করেছে। না জানি কত নির্যাতনের শিকার হয়েছিল! সইতে পারেনি। বলেছিল, ‘বাবা, তুমি যাও। চিন্তা ক’রোনা। দু’দিন পরে আমি বাড়ি যাবো।’ আজই তো সেই শুক্রবার। ছেলে আমার বাড়ি এলোনা। আর কোনোদিন আসবে না। ……….।”
দুপুরে পুলিশের পদস্থ কর্তারা এলো বাড়িতে। ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল স্বপ্নদ্বীপের। হোস্টেলের যে কক্ষে ছিল, সেখানে একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। বড়কর্তা সেটিকে বাবার হাতে দিয়ে বললেন, “দেখুন তো, চিনতে পারছেন কিনা, আর এটার ভেতরের লেখা স্বপ্নদ্বীপের কিনা।”
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে দেখছে বাবা। একে একে পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে। হ্যাঁ, এ যে সেই ডায়েরি, সুন্দর হাতের লেখা। কত কালের চেনা এই ডায়েরি, এই হাতের লেখা! অশান্ত মনকে কিছুটা শান্ত করে এবার কী লেখা আছে, সেদিকে মন দিল বাবা। “১২ ই আগস্ট, ২০২৩, রাত বারোটা। এ সময় প্রতিদিনই তো কিছু না কিছু লিখি। আজ লিখছি জীবনের বিভীষিকাময় প্রহরে ঘটে যাওয়া কিছু তিক্ততার কথা। এখানে সিনিয়র দাদারা নবীনদের বরণ করে। তবে কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে এই বরণ নয়। এই বরণ অত্যন্ত পৈশাচিক। সারাটা বছর ধরেই চলে। নবীনরা যখন দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হবে, তারাও আবার তখন সিনিয়র দাদাদের সঙ্গে মিলেমিশে নবাগতদের একইভাবে বরণ করবে। কী অদ্ভুত নিয়ম! এটাই নাকি এখানকার ঐতিহ্য। আমার মতোই একজন গোবেচারা ছাত্রের মুখে শুনলাম – বরণের ধরন অনেক। বলে শেষ হবেনা। হোস্টেলে আজ আমার তৃতীয় দিন। একটা ঘরে আমাকে ডাকা হয়েছিল। সেখানে দাদারা আমাকে জোর করে বিড়ি, সিগারেট খাইয়েছে। মুখে মদ ঢেলে দিয়েছে। আর তারপর গালাগালি দিতে বলল। আমি গাল দিতে জানিনা বলায় একজন পেছন থেকে নমুনা বলে দিচ্ছিল। অকথ্য সে ভাষা, ভীষণ বিশ্রী, মুখে আনা যায় না। কান ধরে ওঠ-বস করলাম। তাতেও মুক্তি দিল না। মাতলামির অভিনয় করতে বলল নয়তো গাঁজার কল্কেয় টান মেরে রাজা-উজির হবার স্বপ্ন দেখতে বলল। শেষ পর্যন্ত পা জড়িয়ে ধরে মুক্তি পেলাম।
১৩ আগস্ট, ২০২৩, চতুর্থ দিন। সন্ধ্যায় আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল গতকালের জায়গায়। লাইটগুলো নিভিয়ে দেওয়া হল। জ্বালানো হলো মোমবাতি। পাশের ঘরে তখন উদ্দাম নাচ-গান চলছে। সিনিয়রদের দু’জন দাদা তখন আমার সামনে। ওরা হলো সৌরভ আর অরিত্র দাদা। গতকালও ওরাই নেতৃত্ব দিচ্ছিল। ওদের নির্দেশে আমাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করা হলো। তারপর নাচতে বলা হল। নিরুপায় হয়ে নাচতেই হলো। হিংস্রতার সামনে প্রতিবাদ যে নিরর্থক, অরণ্যে রোদনও বলা যায়। ভাবলাম – নির্দেশ যখন পালন করলাম, আজ এখানেই মুক্তি পাবো। না। একজনকে আফিম আনতে বলা হলো। চট করে নিয়েও এলো। জোর করে খাওয়াতে গেলে আমার বমি হয়ে গেল। আফিম যখন সহ্য হলো না, হেরোইন আনা হলো। আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল। লুটিয়ে পড়ে গেলাম মেঝের উপরে। বেগতিক দেখে ওরা তখন চলে যেতে উদ্যত হলো। যাবার সময় অবশ্য বলে গেল – কাল ভোরবেলা অর্থাৎ সূর্য ওঠার আগে আবার আসবে, আর আমাকে তিনতলার রেলিং এর উপর দিয়ে হাঁটতে হবে। কোনো অজুহাত দেখালে বা অক্ষমতা প্রকাশ করলে অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। জানিনা, কী হবে! ভীষণ ভয় করছে।
আমি যে এতক্ষণ ধরে এসব লিখেছি, তাতেও পাপ বোধ করছি। কেননা,উচিত তো ছিল – জ্ঞানের কথা, ভালো ভালো কথা লেখা। একেবারে নিরুপায় হয়ে, বাধ্য হয়েই লিখেছি। নালিশ করবো কাকে? আবার তাতেও তো বিপদ। মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। কিন্তু আমার মত নিরীহ, শান্ত ছেলেরা কি এসব সহ্য করতে পারে? মাঝে মাঝে ভীষণ অতিষ্ঠ বলে মনে হয়। আমি শুধু নিজেকে প্রশ্ন করি, এ কেমন শিক্ষা? আদিম প্রবৃত্তিটুকু বাদ দিলে এর চেয়ে তো জঙ্গলের জীবনও ভালো। মানুষ তো সুন্দরের পূজারি, সভ্যতার রূপকার। তবে এ কেমন আধুনিক, সভ্য সমাজ? একই মস্তিষ্কে মেধার বিকাশ, আবার পৈচাশিক মানসিকতা বিরাজমান। বড়ই বেমানানসই। যাইহোক, মনকে বোঝালাম – কালকের ভোরবেলাটা পার করতে পারলে কয়েকটা দিনের জন্য বাড়ি যাবো। উন্মুক্ত, সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কাটিয়ে আসবো। সেই আশা নিয়েই পথ চেয়ে রইলাম। রাত এখন অনেকটাই। রাতের কলকাতাকে এই অবসরে একটু উপভোগ করে নিচ্ছি। কী সুন্দর!”
বাবা নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে অনন্ত আকাশের দিকে। পুলিশের লোকেরা ডায়েরি নিয়ে ফিরে গেছে। বাড়িতে তখনও লোক আসার ক্ষান্ত নেই। নেতা আসছেন, মন্ত্রী আসছেন। ঝরে পড়ে তাদেরও চোখের জল। “আপনাদের ব্যথা আমরা বুঝি। কিন্তু নিদারুণ দুঃখ নিয়েই বলছি – ছেলেকে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারবো না। তবে দোষীরা উপযুক্ত শাস্তি পাবে। আপনারা সুবিচার পাবেন।” বিগলিত হৃদয়ের সান্ত্বনার বাণীটুকুই তবুও এখন সন্তানহারাদের মনে বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে সফল হলো কিনা, জানা গেল না।
তদন্ত, অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। টিভির পর্দায় বিদ্বজ্জনেরা দুঃখ প্রকাশ করেন। বইতে থাকে র‍্যাগিং নিয়ে নিন্দার ঝড়। নালিশ ওঠে আদালতে।
দিন শেষ হয়, রাত নামে। লোকেরা চলে গেছে। বাড়িটা এখন নিস্তব্ধ। মায়ের অবস্থা আগের মতোই। বাবাও মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠছে। আত্মীয়-স্বজন যারা এসেছে, তাদের বিনিদ্র রাত কাটে।
সময় থেমে থাকে না। শোকের আবহেই একটা একটা করে দশটা দিন পেরিয়ে গেল।
খবরে শোনা গেছে – কয়েকজন ছাত্রকে জেল হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য তাদের পক্ষের আইনজীবী আদালতে নিকৃষ্টতম অপরাধকে লঘু হিসেবে উপস্থাপিত করে সওয়াল করছেন। জনা কয়েক নেতা-মন্ত্রীও দোষীদের নির্দোষ প্রমাণিত করবার লক্ষ্যে বিচারকে দীর্ঘ প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছেন।
কালের নিয়মে একদিন সব আলোড়নই থিতিয়ে যায়, অতীত হয়ে যায়। বৈশাখী ঝড়ে নীড়ভাঙ্গা, শাবক হারানো পাখিরা আবার নতুন করে বাসা বাঁধে। কিন্তু মানুষের জীবন তো আলাদা। সব ব্যথা হৃদয়ের অন্তঃস্থলে সংগোপনে রেখে সে জীবন নতুন করে বাঁচতে চায় ঠিকই, কিন্তু ভুলতে পারে না দুঃখের স্মৃতি। সেই স্মৃতি তাকে বারবার পীড়া দেয়। আর তা যদি বড় নির্মম, দুঃখের হয়, সে জীবন বেঁচেও জড়ে পরিণত হয়।
অরুনিমা, বিশ্বদেবের জীবনও এখন জড়ে পরিণত। কাল সকালে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। আজ সন্ধ্যায় পুরোহিত এসে বিশ্বদীপকে ঘোর শোক-তন্দ্রা থেকে জাগিয়ে তুললেন। জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলের উদ্দেশে পিণ্ডদান করবে, তার কি ব্যবস্থা হয়েছে?” “হ্যাঁ ঠাকুরমশাই, আপনি সকাল-সকাল চলে আসবেন।” “দেখ, তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি। তাই আজ আর বিরক্ত করবো না। তুমি চিন্তা ক’রোনা। যদি ব্যবস্থাপনায় কোন ত্রুটি থেকে যায়, আমি সব সামলে নেব। তোমার প্রতিবেশী আমি, অন্ততঃ তোমার ছেলের কথা ভেবে এইটুকু আমি করব। আমি তাহলে আসি এখন। ওঃ হো, তোমার স্ত্রীর কথা জানা হলো না। কেমন আছে এখন?” “ভালো নেই। ছেলের মৃত্যুকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না, ঠাকুরমশাই। আমিইবা পারছি কই?” “কী আর করবে বলো! তবু তো মেনে নিতেই হবে,” বলে চলে গেলেন পুরোহিত।

বেদনার সিন্ধু-পাড়ে

রাত পেরিয়ে সকাল হল। যথাসময়ে পুরোহিত এলেন। বাড়ির পিছনে এক চিলতে উঠোনে পিণ্ডদান হচ্ছে। অরুনিমাকে রাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে সে এখন স্বপ্নে বিভোর। দেখতে পাচ্ছে – ছেলে হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরেছে। মহানন্দে মা ছেলের মুখপানে চেয়ে আছে। ছেলেও এগিয়ে এসে মায়ের বুকে মাথা রেখে বলছে, “মা, সকাল সকাল বাড়ি চলে এলাম।” “ভালো করেছিস্ সোনা। এবার বল্ – বিশ্ববিদ্যালয়, হোস্টেল তোর কেমন লাগছে?” “খুব ভালো মা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা। ওখানকার ছাত্ররা যেমনি মেধাবী তেমনি স্বভাবেও খুব ভালো। দাদারা, ভাইয়েরা আমরা সবাই বন্ধুর মতো মিলেমিশে থাকি।” মায়ের মনে তখন অপার সুখ। মুখে নির্মল হাসি। মুহূর্ত পরেই ভ্রূ কুঁচকে শুধোয়, “হ্যাঁ রে,শুনেছি – শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে, হোস্টেলে আজকাল র‍্যাগিং হয়, তো তোদের ওখানে ওসব হয় না?” “ না মা। র‍্যাগিং কী, ওখানকার ছেলেরা জানেই না। জানার চেষ্টাও করে না। ওই খারাপ জিনিসটাকে সবাই ঘৃণা করে।” স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে মায়ের। “যাক্, বাপ আমার, লক্ষ্মী ছেলে আমার, ভালো থেকো, মন দিয়ে পড়াশোনা ক’রো। আশীর্বাদ করি – জীবনে বড় হও, মানুষের মতো মানুষ হও।” “তোমার আশীর্বাদ আমার মাথার উপরে এমনিকরেই চিরদিন থাকে যেন মা। শোনো,এবার বলি অন্য কথা। সুশিক্ষা মানুষকে চরিত্র দান করে। বিনয়ী, নম্র, ভদ্র করে তোলে। আমাদের ছাত্র-বন্ধুরা সকলেই সেই সুশিক্ষায় শিক্ষিত।” “সেটাই তো আমি চাই। সব বাবা-মায়েরাই চায়। ভালো মানুষ না হয়ে শুধু ডিগ্রী লাভ করে শিক্ষিত হওয়াকেই মানুষ হওয়া বলে না।” “হ্যাঁ মা, এই কথা আমাদের সিনিয়র দাদারাও বলে। ওরা নতুন ছাত্রদের কাছে ডেকে নেয়, ভালোবাসে। জানো মা, সৌরভ আর অরিত্র দাদা তোমার কথা শুনেছে। তোমাকে দেখতে চেয়েছে। ওরা বলে – তোর মা, সে তো আমাদেরও মা। পরেরবার যখন আসবো, ওদের নিয়ে আসবো। ওরাও অবশ্য ওদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। ওদের মায়েরাও খুব ভালো।” নিবিড় শান্তির ছায়াতলে বসে মা নিজেকে ধন্য মনে করছে, আর হেয়ালি করে বলছে, “হ্যাঁ রে, ওদের মা যদি আমার থেকেও ভালো হয়, আমাকে ভুলে যাবি না তো?” “মা, তুমি এমন কথা ব’লোনা তো! জগতের সব মায়েরাই ভালো।” “ক’টা দিন মাত্র হোস্টেলে থেকেই তোর মুখ থেকে এত ভালো ভালো কথা বের হচ্ছে। আমি নিশ্চিত – ওখানে দাদাদের সান্নিধ্যে তোর আরও ভালো হবে।”
এমন সময় বাবার ডাক শুনতে পায় স্বপ্নদ্বীপ। মাকে বলে, “মা, বাবা আমাকে ডাকছে। তুমি বসো, আমি দেখা করে আসি।” ছুটে যায় স্বপ্নদ্বীপ। ঘুম ভেঙ্গে যায় মায়ের। ‘স্বপ্নদ্বীপ’, ‘স্বপ্নদ্বীপ’ বলে বেরিয়ে আসে দরজার বাইরে। “আমার সোনা বাড়ির পেছনদিকে ছুটে গেল কেন? কোথায় গেলি স্বপ্নদ্বীপ? কোথায় তোর বাবা?” ঊর্ধ্বশ্বাসে এগিয়ে যায় মা।
তখন অদূরে ঠাকুরমশাই মন্ত্রপাঠ করে চলেছেন, আর সেই মন্ত্র উচ্চারণ করে ছেলের উদ্দেশে পিণ্ডদান করছে বাবা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মা। “কী করছে বিশ্বদীপ? ওর মাথাটা মুণ্ডিত কেন? কাকে পিণ্ডদান করছে?” এমন বিস্ময়ের মাঝে আবার ছেলেকে ডাকে, “কোথায় তুই? স্বপ্নদ্বীপ, ওরে আমার সোনা, আয় বাবা।” পিণ্ডদানের স্থান থেকে ভেসে আসে অতি চেনা কণ্ঠস্বর। “মা, এইতো আমি।” মায়ের দু’চোখ খুঁজে বেড়ায়, শুধুই খুঁজে বেড়ায়। আর দেখা দিল না স্বপ্নদ্বীপ। মা চেয়ে থাকে পলকহীন দৃষ্টিতে। বিস্ময় কেটে যায়। নিমেষে প্লাবিত হয় বেদনার শত-সিন্ধু-পাড়।
……………………………………………………….