Bak Juddha – বাক্ যুদ্ধ

Bak Juddha - বাক্ যুদ্ধ
(ছোটগল্প) 

 বাক্ যুদ্ধ

             – হরবিলাস সরকার

বসন্ত প্রায় বিদায় লগ্নে। শহর থেকে একটু দূরে এক গ্রামের উপকণ্ঠে পেল্লায় এক রাইস মিল। অদূরে মালিকের সবুজে ঘেরা বাগানবাড়ি। সেসময় একদিন ঐ বাগানের এক নারকেল গাছে বড্ড ঝগড়া বেঁধে গেল। একদিকে পুরুষ ও স্ত্রী কাক, অন্যদিকে কোকিল, কোকিলা। ঝগড়ার কারণ হলো –  সুযোগ পেলেই কোকিলা কাকের বাসায় ডিম পেড়ে চলে যাবে। কাকেরা তা বুঝতে পেরেছে।
বিকেলের পড়ন্ত বেলা তখন। চারতলার বৈঠকখানায় বাগানের মালিক কারবারের হিসেব নিয়ে মগ্ন ছিলেন। পাশে ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত এক ধনী গৃহস্থ বন্ধু। তিনিও আয়-ব্যয়ের হিসেব কষায় ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু আপাতত ব্যবসায়িক পাট চুকিয়ে দুই বন্ধুই কৌতুহলে কাক, কোকিলের ঝগড়া শুনতে লাগলেন। না শুনে উপায় কী? জানালার ধারেই যে নারকেল গাছটা।

প্রথমে স্ত্রী কাক চেঁচিয়ে উঠল, “ওরে হতশ্রী, তুই আমার বাসায় ডিম পাড়তে এসেছিস? ভেবেছিস – আমরা খাবার খুঁজতে যাবো, আর সেই ফাঁকে আমার ডিমগুলো ফেলে দিয়ে তুই ডিম পেড়ে চলে যাবি। তারপর আমি তা দিয়ে ডিম ফুটাবো। একদিন সেই বাচ্চারা বড় হয়ে উড়তে শিখবে। অমনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাচ্চাদের নিয়ে পালাবি। আমি একটুও টের পাবোনা, তাই না?” কোকিলও কম যায় না। কোকিলাকে চুপ থাকতে বলে সুরেলা বাঁশির সুরে সে বলে উঠল, “ওরে ও ঝাড়ুদার মেয়ে, আমার প্রিয় সঙ্গিনীকে হতশ্রী ব’লোনা। নিচু প্রাণীদের মুখে এমন ভাষা বাঞ্ছনীয় নয়। সম্মান দিয়ে কথা বলো। আমি হলাম কণ্ঠশিল্পী কোকিল, কোকিলা আমার রূপবতী স্ত্রী।” “তাই নাকি? তো এতই যখন সম্মানীয়, উঁচুস্তরের, উঁচুদরের প্রাণী, তা নিজেদের বাসা নিজেরা বাঁধিস্ না কেন? তা না করে এই নিচু প্রাণীদের পায়ে এসে পড়েছিস্ কেন?”  “আরে মূর্খ, ঘর বানানো তো ঘরামির কাজ। আমরা কি মুনিশ যে ঐ কাজ করবো?” “তোদের একটা বদনাম আছে। তোরা অলস প্রাণী।”

কোকিল বেশ সমস্যায় পড়ে গেল। ভাবল – এই রে,আমাদের দুর্বলতা কাকেরা জেনে গেছে। বড় লজ্জার। এটাকে এখন কথার মার-প্যাচে ঢাকতে হবে। তাই বুক ফুলিয়ে বলল,“বাজে-কথা ব’লো না। এ তোমাদের মনগড়া ধারণা। আসলে ছোট কাজ আমরা করি না। এসব তোমরা করবে। এটাই তো সমাজের চিরাচরিত নিয়ম। নিচু স্তরের প্রানীরা উঁচু স্তরের প্রাণীদের সেবা করবে, আজও করছে। এভাবেই তো সভ্যতা সেই কোন্ আদি কাল থেকে এগিয়ে চলেছে।” “তা এই নিয়ম কারা তৈরি করেছে, শুনি?” “ঐ যে খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো – কারা বসে বসে আমাদের ঝগড়া শুনছে। ওদের পূর্ব পুরুষেরা এই নিয়মের জনক। ওরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী গো। থুড়ি, অসম্পূর্ণ বলা হলো। শ্রেষ্ঠ প্রাণীদের মধ্যে ওরাই আবার শ্রেষ্ঠ গো। পাখিদের মধ্যে আমরা যেমন উঁচু শ্রেণির, তেমনি মানুষের মধ্যে ওরাও উঁচু শ্রেণির। বিশ্বাস না হয় জিজ্ঞেস করো না একবার!” “জিজ্ঞেস করতে বয়েই গেছে। সব জানি রে সব জানি। শ্রেণীবিভাজনের সমাজে একটা শ্রেণী আরেকটা শ্রেণীকে দমন-পীড়ন করেই নিজেদের হীন-স্বার্থ চরিতার্থ করে। ‘রাজ-সিংহাসন তৈরি করে শ্রমিক, বসে রাজা। সোনার ফসল ফলায় চাষি, মালিক দেশের কর্তা।’ শোন্ তাহলে – ওই যে ধনীবাবুটা,  রাইস মিলের মালিক, ওর মিলের শ্রমিকগুলোর কীই না দুর্দশা! আট ঘন্টার জায়গায় বারো ঘন্টা খাটতে হয়। খাটতে খাটতে, ভালো-মন্দ না খেতে পেয়ে, অস্বাস্থ্যকর জীর্ণ ঘরে বাস করে, রোদে পুড়ে, ঝড়-জলে ভিজে চেহারায় একেবারেই জৌলুস নেই। অথচ বাবুটির যত বৈভব ওই শ্রমিকগুলোর জন্যই। পাশে বসে আছে ঐ যে ওর ধনী গৃহস্থ বন্ধুটা, ওরও সম্পত্তি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। লোকটার নামে-বেনামে কম করেও শত বিঘা চাষের জমি, গোটা পাঁচেক ছোট-বড় মাছ চাষের পুকুর, একটা দিঘী, এছাড়া আরও কত কী আছে! সব কি আর বলার সময় আছে? একটা দিন মাছের ঝোল-ভাত ছাড়া খায় না। আর ওর জমিতে খেটে খাওয়া দিনমজুরগুলোর কী হাল! দেখে ভারী কষ্ট হয়। কঙ্কালসার চেহারা। ভোরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে বের হয়। বিকেলে উপোস দেয়। রাতে রেশনের চালের ভাত আর আলু সেদ্ধ, এর বেশি কিছু জোটে না। এত কথা কেন বললাম, জানিস্?” “বাঃ রে! জানবো না? উপরমহলের প্রাণীদের স্বাচ্ছন্দ্য দেখে তোমাদের নিচ মহলের সব প্রাণীদের হিংসা হয়, তাই।” “একেবারেই ভুল কথা। হিংসা হয় না রে, দুঃখ হয়। সেই দুঃখেই তো আমরা দুর্ভাগা প্রাণীগুলো মাঝে-মধ্যে বিক্ষোভে ফেটে পড়ি। এই যে ধর্, আমরা পচা-গলা খেয়ে বেঁচে থাকি, কষ্ট করে একটা ভাঙাচোরা বাসা বানিয়েছি। পরোক্ষে সেই বাসাটাও তোরা ভোগ করতে চাইছিস্। এ তো গেল একদিক, অন্যদিকে তোরা কত নিষ্ঠুর, নির্মম। কেননা, আমাদের ভাবী বংশধরকে হত্যা করে তোরা তোদের বংশধরকে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে চাইছিস্, তা আবার আমাদের দিয়ে। এতে আমাদের রাগ হবে না? একে তোরা হিংসা বলবি?” কোকিল এবার মনে মনে ভাবল – নাঃ,এভাবে তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। এইরূপ ভেবে কিছুটা বিনয়ের সুরে বলল, “ওগো কাক, বন্ধু, মেনে নিলাম তোমার কথা। তবে একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলতো – সমাজে কাদের কদর বেশি, তোমাদের না আমাদের? তোমাদের  বিশ্রী, কর্কশ গলা কে ভালোবাসে? আর আমাদের কত মিষ্টি, শ্রুতিমধুর গলা। আমাদের গানে মুগ্ধ হয় ভুবন।” “কোকিল, তুই আমাকে ‘বন্ধু’ বলে বিনীতভাবে সম্বোধন করলি,এ তোর ছলনা ছাড়া আর কী?  তবে শোন্, তোর ছলনায় আমরা পা দেবো না। কী হবে ওই সুমধুর গান শুনে? অট্টালিকায় যাঁরা সুখে, ভোগ-বিলাসে দিন কাটায়, বসন্ত কাননে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়, তাঁদের জন্য ওই গান। আমরা হতভাগা শ্রমিক। চারপাশের নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার করে সমাজকে শুদ্ধতায় ভরিয়ে তুলি। তা আমাদের যতই কষ্ট হোক, যতই নগণ্যের স্বীকৃতি পাই না কেন, আমরা আমাদের কর্ম থেকে কখনো পিছপা হইনা। তোদের তো দেখা মেলে বসন্ত এলে। আর আমাদের কর্মে বিরতি নেই, যতদিন বাঁচি ততদিন, বংশপরম্পরায়। জগতে আমাদের মতো যত অবহেলিত, অসহায় প্রজাতির প্রাণী আছে, সবাই বলে – ‘কর্মই জীবনের ধর্ম।’ মনে রাখিস – এই পৃথিবীর এত সৌন্দর্য, সব আমাদের মেহনতের ফলেই। তবু আমরা অহংকার করে বলি না – পৃথিবীটা আমাদের। বলি – পৃথিবীটা সবার। শেষে বলি – তোদের মতো আরামে আমরা থাকি না। সারাটা বছর আমাদের চিৎকার করতে হয়, তাই গলাটা কর্কশ হয়েই থাকে। ওরে, কষ্ট আমাদের যতই হোক না কেন, উচ্ছিষ্ট-অখাদ্য যা-ই খেতে পাই না কেন, তোরা যতই ঘৃণা করিস না কেন, তাতে আমাদের দুঃখ নেই। দুঃখ হয় তোদের মিথ্যা অহংকার দেখে। ওরে কোকিল, একবার যদি তোদের হৃদয়ে অনুভব হতো – আমাদের জীবন কত দুঃখময়, যন্ত্রণাময়! বিবেকের তাড়নায় সেই যন্ত্রনা যদি তোদের কণ্ঠে কলি হয়ে ফুটে উঠতো, তবে দুঃখ-সুখের মিলনে গড়ে উঠতো এক নতুন পৃথিবী।”
ধনীবাবু আর তাঁর বন্ধু চোখ টিপে মুচকি হাসলো। কোকিল-কোকিলা উড়ে গিয়ে বসলো অন্য গাছে। ছলনার কথা মাথায় রেখে পুরুষ কাক একরাশ আতঙ্কের মধ্যেও তার সঙ্গিনীকে বাসায় রেখে একাই চলে গেল খাবারের সন্ধানে। সূর্য তখন অস্ত রেখায়।

……………………………………………………