Goyendar Rahasyabhed – গোয়েন্দার রহস্যভেদ

গল্প
(কল্পনা আলোকে বাস্তব)

গোয়েন্দার রহস্যভেদ

          – হরবিলাস সরকার

“অম্বিকা কানুনগো, আপনি দুর্নীতি-বৃক্ষের প্রধান মূল, শাখামূল, প্রশাখামূল – এরকম অনেক মূলই খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু রহস্যমূলের সন্ধান পেয়েছেন কি?” এ প্রশ্ন সিবিআই অফিসারকে বিচারপতির। পাল্টা প্রশ্ন অফিসারের, “কথাটা বোধগম্য হল না, মহামান্য।” “সেকি মশায়, সত্যি করে বলুনতো – আপনার গাফিলতি না নির্বুদ্ধিতা?”

ধমক খেয়ে লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল অফিসারের। ঐ অবস্থাতেই উত্তর দিলেন, “নির্বুদ্ধিতাই ধরে নিতে পারেন।” বিচারপতি আশ্বস্ত হলেন। বুঝলেন – অফিসারটি সৎ, কাটমানি নামক কালো মুদ্রা পকেটস্ত করেন নি, বোধ হয় করবেনও না। অন্যায়ের সাথে আপোশহীন লড়াই করার মানসিকতা আছে বলেই মনে হয়। অতএব, একটু উৎসাহ যুগিয়ে, কিছু পাঠ দিয়ে দায়িত্বভারটা দিলে এঁনাকে দিয়েই রহস্যমূলের সন্ধান পাওয়া যাবে।
অফিসার অন্তর-দৃষ্টি দিয়ে বিচারককে খুশি দেখে মাথা তুললেন। বিচারক পাঠ দিতে লাগলেন। “শুনুন তবে। জীবন বিজ্ঞান পুস্তকে একটা বৃক্ষের তিন রকমের মূল  সম্পর্কে উল্লেখ আছে, একথা লেখাপড়া করা মানুষ মাত্রই জানেন। কিন্তু গোয়েন্দা-শাস্ত্রে দুর্নীতি-বৃক্ষের মূল সম্পর্কে কী বিশ্লেষণ আছে, আপনাদের মতো লোকেরাই ভালো জানবেন। তবে রহস্যমূল সম্পর্কে এত দিনের অভিজ্ঞতায় আমি কিছু ধারণা দিতেই পারি। সেই সম্পর্কেই আলোকপাত করছি। কিছু কিছু দুর্নীতি বা অপকর্ম লুকিয়ে থাকে রহস্যময় কুহেলিকার ইন্দ্রজালের মধ্যে, যা সহজে ধরা-ছোঁয়া যায় না। আবার বাইরে থেকেও বোঝা যায় না। ওগুলোই হলো রহস্যমূল। তেমনই একটি রহস্যমূলের সন্ধান আপনাকে করতে হবে।”
“আমি প্রস্তুত মহামান্য।” “অফিসার,  বিধায়ক বানী সেনের অফিস তল্লাশি করে  একটি ডায়েরির মধ্যে বহু চাকরি প্রার্থীর যে লম্বা তালিকা পেয়েছিলেন, আদালতে তা জমা দিয়েছিলেন, তালিকার সকলেই চাকরি পেয়েছেন, কিন্তু দু’জন ছাড়া  সকলের চাকরি অবৈধ প্রমাণিত হওয়ায় বাতিল হয়েছে, এসব তো আপনার জানা। বাকি ঐ দুজনের মধ্যে একজন তলবের ভয়ে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে এক মাসের স্থগিতাদেশ পেয়েছেন। অন্যজন বিনীতা দাশগুপ্ত। পর্ষদ সভাপতি হলফনামায় জানিয়েছেন, ‘এই প্রার্থীর চাকরি বৈধ। তিনি প্রশিক্ষিত। টেট পাস করে ইন্টারভিউ দিয়ে সফল হয়েছিলেন। টেট পাসের সার্টিফিকেটের নকল কপিও জমা দিয়েছেন।’ প্রাথমিকভাবে তদন্ত আপনিই একবার করেছেন। কিন্তু সন্দেহের নিস্পত্তি ঘটানো যাচ্ছে না। ভাবছি – তাহলে কেন বিধায়কের ডায়েরিতে নাম থাকবে, কেনইবা নামের পাশে বড়সড় টাকার অঙ্ক লেখা থাকবে? অফিসার, তাহলে নিশ্চয় বুঝেছেন – এই রহস্যমূলের সন্ধান পাওয়া বেশ কঠিন এবং একটা শ্রমসাধ্য কাজ। তার জন্য চাই গভীর মনোযোগ, অধ্যাবসায় এবং ক্ষুরধার বুদ্ধি। জানি, এ সব গুণই আপনার মধ্যে আছে, আর তাতেই আসবে সফলতা। ”
গোয়েন্দা অফিসার বললেন, “তাই যদি হয়, এই যে বেশ কয়েক হাজার চাকরি বাতিলের রায়টা দিলেন, তাতে সংখ্যাটা বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সেটা শুধরে নিতে হবে।” আরও বললেন “শিক্ষিকা প্রশিক্ষিত। দুর্নীতি প্রমাণিত হলে প্রশিক্ষিত সকল শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তদন্তের আওতায় আসবে।”
বিচারক একটু গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন,  “নিশ্চয়ই।” পরক্ষণেই মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস করলেন যে, এই অফিসার শুধুই সৎ নন,  অদম্য উৎসাহী, প্রকৃত সত্য উদঘাটনে অত্যন্ত আগ্রহী। ইনিই নিশ্চিত পারবেন রহস্যমূলের সন্ধান করতে। আশাকরি ব্যর্থ হবেন না। এরপর বললেন, “অফিসার, ঈগলের চোখ অনেক দূর থেকেই তার শিকার দেখতে পায়। গোয়েন্দার দৃষ্টি হতে হবে তার চেয়েও প্রখর। তবেই পাওয়া যাবে রহস্যমূলের সন্ধান। এ আমি বিশ্বাস করি।”
অফিসার হাসলেন। বিচারক দু’সপ্তাহ সময় দিয়ে বললেন, অভিযোগ সত্য হলে প্রার্থীকেও এজলাসে হাজির করাবেন,” এই বলে আজকের মতো বিদায় নিলেন।
গোয়েন্দা ছুটলেন তথ্য এবং সত্য অনুসন্ধানে। সঙ্গে দু’জন সহকারী এবং দু’জন কেন্দ্রীয় বাহিনী। কাজের পদ্ধতিটা ছকে নিলেন। নিখুঁত পরিকল্পনা।
অভিযান সর্বপ্রথমে জেলার চক্র অফিস। বেলা ১১ টা। মাননীয়া এস.আই মহাশয়া নিজ আসনে বসে কর্মে ব্যস্ত। গোয়েন্দা অফিসার সহকারীদেরকে নিয়ে প্রবেশ করলেন। পরিচয় দিতেই এস.আই সাদর অভ্যর্থনা জানালেন কিন্তু তার হৃদস্পন্দন ভেতরে ভেতরে বাড়তে লাগলো। অফিসার অভিযুক্ত প্রার্থীর নথি দেখতে চাইলেন। “স্যার, বিনীতা দাশগুপ্ত’র নথিপত্র আগেও একবার দেখেছেন।” “ম্যাডাম, প্রয়োজনে হাজারবার দেখতে পারি।” “একটু অপেক্ষা করুন, দেখাচ্ছি।” “এপয়েন্টমেন্ট লেটার, যোগদানের আবেদনপত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র, বয়স, প্রশিক্ষণের শংসাপত্র, সবকিছুই।” “ঠিক আছে,” বলে এস.আই করণিককে ডাকলেন।
করণিক আলমারি থেকে ফাইল খুঁজে বের করে এস.আইকে দিলেন। তিনি তৎপরতার সাথে একে একে সব নথি বের করে সামনে রাখলেন। অফিসারও খুঁটিয়ে দেখতে তৎপর। সহকারীদেরও পলকহীন দৃষ্টি। অফিসার মনে মনে বলছেন – সব নথিপত্রই তো ঠিক আছে, তাহলে কী সেই রহস্যমূল? এস.আই জানতে চাইলেন,  “স্যার, বেনিয়ম কিছু পেলেন?” অফিসার বললেন, “না। তবে একটা তো কিছু আছেই, যা আমাকে জানতেই হবে। শুনুন, প্রত্যেকটি নথির একটি করে জেরক্স কপি আমাকে দিন।” “হ্যাঁ স্যার, একটু অপেক্ষা করুন।” এস.আই নথিপত্রগুলো নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। এই অবকাশে গোয়েন্দা অফিসার সহকারীদের সাথে কিছু গোপনীয় আলোচনা সেরে নিলেন।
এরপর ডি.পি.এস.সি অফিস। ডি.আই সাহেব এবং চেয়ারম্যানকে একসাথে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ। গোয়েন্দার কঠিন প্রশ্ন – শিক্ষিকা বিনীতা দাশগুপ্ত’র নিয়োগের ক্ষেত্রে অবৈধতার সূত্র আগেই পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে তার নিষ্পত্তি হয়নি। সন্দেহের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সেই সূত্রের কিনারার সন্ধানে আপনারা কতটুকু সহযোগিতা করতে পারেন?” ডি.আই সাহেব বললেন, “স্যার, অবৈধতার কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই, আগেও বলেছি।” চেয়ারম্যানেরও একই কথা, “শিক্ষিকার সম্পর্কে কোনরূপ অস্বচ্ছতা আমাদের চোখে পড়েনি।” “অদূর ভবিষ্যতে যদি কোনরূপ অস্বচ্ছতা ধরা পড়ে, তার দায় আপনারাও এড়াতে পারবেন না। প্রয়োজনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে, কী করবেন তখন?” চেয়ারম্যান নিরুত্তর রইলেন। গোয়েন্দা বিদায় নিলেন।
পরদিন মধ্যাহ্নে স্কুল সার্ভিস কমিশনের অফিস। দরজা ঠেলে ঢুকলেন গোয়েন্দা। সর্বময় অধিকর্তাকে ২০১৬-এর মেধা তালিকা দেখাতে বললেন। অধিকর্তা বিলম্ব করলেন না। তালিকা দেখে একটু যেন হতাশ হয়ে পড়লেন গোয়েন্দা। “নাঃ, বিনীতা দাশগুপ্ত তো ভালো নাম্বার পেয়েই পাস করেছিলেন।” পরক্ষণেই ভাবলেন, “হতাশা পরাজয়ের লক্ষণ। গোয়েন্দাকে হাল ছাড়লে চলবে কেন?” আবার সহকারীদের নিয়ে বসলেন। দীর্ঘ আলোচনা, পর্যালোচনা।
দু’দিন পর পর্ষদ অফিস। সোজা সভাপতির কক্ষ। হঠাৎ এভাবে প্রবেশ দেখে সভাপতি কিছুটা হকচকিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “স্যার, আজ আবার কোন্ প্রয়োজনে?” যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর। “গোয়েন্দা কোনো প্রয়োজন ছাড়া আসে না মশায়। ২০১৬ সালের প্যানেলটা আবার একটু দেখান।” “দিচ্ছি, ফাইলটা সামনেই আছে। এই নিন।” ধন্যবাদ জানিয়ে অফিসার প্যানেলের প্রতিটি নাম মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলেন। বিনীতা দাশগুপ্ত’র নাম পাওয়া গেল। ধীর-স্থিরভাবে অনেক কিছু চিন্তা করতে লাগলেন। গোয়েন্দার মন তো, ব্যাগ থেকে নিয়োগপত্রসহ অন্যান্য কয়েকটি নথিপত্রের নকল কপি বের করে একবার মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ যেন একটা সন্দেহের তীর এসে  বিঁধে গেল। পর্ষদ সভাপতিকে কৌতুহলে প্রশ্নটা করেই ফেললেন, “মিসেস বিনীতা দাশগুপ্ত নিয়োগপত্র পান ২০২১ সালে, পাঁচ বছর পরে কেন? প্রশিক্ষণের ডিগ্রিলাভ প্যানেল তৈরির অনেক পরে, তবু কেন প্যানেলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেখানো হয়েছে?” সভাপতি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন, সদুত্তর দিতে পারলেন না। আর এতেই রহস্যের বন্ধ দরজাটা কিছুটা যেন খুলে গেল। এক মুহূর্তও দেরি নয়। গোয়েন্দা সোজা ছুটলেন এবার ৬/২ হরিশ মুখার্জী রোডের দিকে। সেখানেই তো ক’দিন আগে বিধায়ক সেনের দ্বিতীয় ফ্লাটের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল। 
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি গিয়ে থামল ফ্লাটের মূল গেটের সামনে। চারতলায় উঠে বাঁ দিকের দেওয়ালে একটি নেম-প্লেট। বোঝা গেল – এটাই সেনের কক্ষ। “বাঃ! বেশ রাজকীয় তো,” এই বলেই অফিসার কলিং বেলের সুইচ টিপলেন। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মাঝ-বয়সী এক পুরুষ। পরিচয়ে জানা গেল – ইনি কেয়ার-টেকার। গোয়েন্দা বললেন, “ফ্লাট তল্লাশি হবে। আদালতের পারমিশন আছে।” ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। শুরু হল খোঁজ, দুর্নীতি সংক্রান্ত কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় কিনা। টানা পাঁচ ঘণ্টার উপর তল্লাশি। একেবারে শেষ মুহূর্তে লোহার এক বাক্স থেকে মিলল এক বাণ্ডিল ওএমআর শীট। আর সেগুলোর ভেতর থেকে পাওয়া গেল বিনীতা দাশগুপ্ত’র নাম লেখা ফাঁকা ওএমআর শীট। অফিসার অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন – এ কী করে সম্ভব! টেটে ভালো নাম্বার পেয়ে মেধা তালিকায় নাম উঠেছে, অথচ …….। সেনের ফ্লাটে এতগুলো ওএমআর শীট কেনইবা এল? পর্ষদ তো আদালতে হলফনামায় জানিয়েছে – সমস্ত ওএমআর শীট তারা নষ্ট করে ফেলেছে। সেই অপরাধে তো মন্ত্রীকে জেলে পোড়া হয়েছে। এখন থাক্ সেসব কথা। চিন্তা এখন শুধু একটাই –  সেনের ঘরে বিনীতার  ওএমআর শীট কেন? তা আবার ফাঁকা। তাহলে স্কুল সার্ভিস কমিশন কোন্ শীট দেখে নাম্বার দিল? ভাবতে ভাবতে তদন্তের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল।
পরদিন অতি ভোরেই যাত্রা শুরু গাজিয়াবাদের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য নাইসার  অফিস। সেখানে হার্ডডিক্স থেকে  ওএমআর শীটের কার্বন কপি উদ্ধার করতে হবে। হার্ডডিস্ক থেকে সব তথ্য একেবারে মুছে ফেলা যায় না। উন্নত প্রযুক্তি-বলে হুবহু অবিকৃত আকারে উদ্ধার সম্ভব। কয়েক দিনের মধ্যেই হ’লোও তাই। পঁচাত্তর হাজার ওএমআর শীটের কার্বন কপির মধ্যে বিনীতার কপিটাও পাওয়া গেল। গোয়েন্দার এখানেও বিষ্ময়ের শেষ নেই। ওএমআর শীট ভর্তি, একটা প্রশ্নের উত্তরও বাদ নেই !কিন্তু একজন প্রার্থীর জন্য দুই-দুটো ওএমআর শীট, কী রহস্য? গোয়েন্দার ভেতরে অনন্ত জিজ্ঞাসা। বইছে আনন্দের ফল্গুধারাও। “বুঝি কিনারার অতি কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি,” এই আশা নিয়েই দ্রুত ফিরে আসার উদ্যোগ নিলেন।
এরপর যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে আদালতে বিচারসভা বসলো। বিচারক প্রবেশ করলেন এজলাসে। অভিযুক্ত প্রার্থীও হাজির হয়েছেন। বাদী, বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরাও উপস্থিত। কিন্তু গোয়েন্দা অফিসার কোথায়? বিচারক অস্বস্তি প্রকাশ করতে লাগলেন। “তবে কি রহস্যের কিনারা করতে পারেননি?” বিবাদী পক্ষের আইনজীবী বললেন, “হুজুর, শিক্ষিকা বিনীতার ব্যাপারে যে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, তার কোনো সারবত্তা নেই। উনি নির্দোষ। অবিলম্বে ওনাকে সসম্মানে মুক্তি দিন।” বিনীতাও হাতজোড় করে বলল, “মহামান্য, আমি যোগ্য এবং নিষ্কলঙ্ক। মেধা-বলেই চাকরিটা পেয়েছি। কোনো অসৎ উপায় আমি অবলম্বন করিনি। অযথা আমাকে আদালতে হাজির করানো হল। সমাজ আমাকে নিন্দার চোখে দেখছে। এর ফলে আমি অত্যন্ত অসম্মানিত বোধ করছি।”
বিচারক বিনীতার উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনাকে এখনই আমি দোষী বা নির্দোষ কোনোটাই বলতে পারছিনা। আপনাকে আর একটু সময় ধৈর্য ধরতে বলছি।” বিনীতার আইনজীবী উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ-স্বরে বললেন, “হুজুর, আদালতে আমার মক্কেল যথেষ্ট অপমানিত বোধ করছেন। আপনার বিচার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। মক্কেল যদি চান, সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে নালিশ জানাতে পারেন এবং সুবিচারের জন্য বিচারপতির বদলও চাইতে পারেন।” বিনীতা আইনজীবীর মতকে পূর্ণ সমর্থন জানালেন।
বিচারক লজ্জিত হলেন। বললেন, “এমন দিন কখনও আসেনি। এ যেন আমার মৃত্যু দিন।” তাঁর অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে গেল। মূল্যবান সময় অযথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে আইনজীবীর পরামর্শ মতোই রায় দিতে যাচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় গোয়েন্দা অফিসার ফাইল হাতে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে ঢুকলেন, এই বলতে বলতে যে, “হুজুর,  রহস্যমূলের সন্ধান আমি পেয়েছি।”
এজলাস কক্ষে ক্ষণকালের গভীর নীরবতা।  গোয়েন্দারও ক্লান্তির নিঃশ্বসন পর্ব চলছে। তারপর একটু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেই তিনি বলতে শুরু করলেন, “মহামান্য, অত্যন্ত চমকপ্রদ সেই রহস্য। অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ, যা অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব এবং সত্যি-সত্যিই আমার ক্ষেত্রেও তা ঘটেছিল। আমি আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। অবশেষে আমার দিব্য চোখ খুলে গেল। রহস্য উদঘাটনও হয়ে গেল। একটা জটিল অঙ্ক কষতে কষতে কিছুক্ষণ আগে ট্রেন থেকে নেমেছি। একারণেই আসতে আমার দেরি হয়ে গেল। নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় ফোন করে জানাতে পারিনি। আদালতের কাছে তার জন্য আমি মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। এবার আসি কাজের কথায়। আমার বিশ্বাস – বিনীতা দাশগুপ্ত এই কাজ সজ্ঞানেই করেছেন। তিনি অসৎ উপায় অবলম্বন করেই নিজ-স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন। হুজুর, এই নিন প্রার্থীর  গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র এবং রহস্যের বিবরণ। আর এই নিন খাম-বন্দি আর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি।”
বিচারক মনোযোগ সহকারে রহস্যময় বিবরণ পড়লেন, সমস্ত নথি দেখলেন। তারপর বিস্ময় প্রকাশ করে মিসেস বিনীতাকে কাঠগড়ায় আসতে বললেন। বিনীতা কাঠগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালে বিচারক নিজেই প্রশ্ন করলেন, “আপনি ২০১৪ সালে এইচ.এস পাস করেন, ঐ বছরই প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরির আবেদনপত্র পূরণ করেন। পরীক্ষাটা হয় পরের বছর। ফল প্রকাশ ২০১৬ সালে। আপনি সফল হন। প্যানেল তৈরি হয় ২০১৬ তেই। আপনি মেধা তালিকাভুক্ত হন। কী, ঠিক বলছি তো?” “হ্যাঁ, সবই ঠিক।” “আপনি নিয়োগপত্র পান ২০২১ সালে অর্থাৎ পাঁচ বছর পরে।  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রার্থী হিসেবে যোগদান করেন। ঠিক বলছি?” “হ্যাঁ হুজুর, সম্পূর্ণ ঠিক বলেছেন।” বিবাদী পক্ষের আইনজীবী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “মহামান্য, গোয়েন্দা অফিসার বুঝি এত পরিশ্রম,লড়াই করে এই তথ্যই তুলে এনেছেন। অতএব, আমার মনে হয় বিনীতাদেবীকে  এরপর আর জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন নেই এবং ওনার মুক্তির ব্যাপারে আর কোনো বাধা থাকার কথা নয়।” বাদী পক্ষের আইনজীবী বিরোধিতা করলেন, “মাই লর্ড, আমার লার্নেড ফ্রেন্ড বোধ হয় ভুলে গেছেন যে, গোয়েন্দা অফিসার একটু আগেই ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিলেন – তিনি রহস্যের সন্ধান পেয়েছেন। সেই রহস্যের কথা না শুনেই উনি বড্ড বিচলিত হয়ে পড়েছেন। মাই লর্ড, আপনি অফিসারকে এবার রহস্য উন্মোচনের জন্য নির্দেশ দিন।”

বিচারক গোয়েন্দাকে বললেন, “মিস্টার কানুনগো, আপনি রহস্য উন্মোচন করুন।” “আমাকে এই অনুমতি দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, মহামান্য।” প্রার্থীকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা বিনীতাদেবী, বিধায়ক বানী সেনকে আপনি টাকা দিয়েছিলেন কেন?”  “না স্যার, মিথ্যে কথা। আমি কাউকে টাকা দিইনি। দেবোইবা কেন?” “কিন্তু সেনের ডায়েরি তো অন্য কথা বলে।” মহামান্যের টেবিল থেকে ডায়েরিটা তুলে নিয়ে দেখিয়ে বলেন, “এই সেই ডায়েরি। আপনি ২০১৪ সালের ১লা নভেম্বর বিধায়ক সেনকে নগদ আট লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। টাকার পাশে নগদ কথাটা লেখা আছে।  আপনার সই আছে। তারিখও উল্লেখ আছে। দেখুন তো,চিনতে পারছেন কিনা।” “কিন্তু আমি টাকা দিতে যাবো কেন? আমার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না।” তৃতীয় প্রশ্নঃ “আপনার নাম বিনীতা দাশগুপ্ত। ১৮, পূর্ণ চন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহঃ শিক্ষিকা। ঠিক বললাম তো?” “হ্যাঁ, এসব তো ঠিকই।”  “এই নামেই ঐ টাকা জমা করা আছে। কী বলবেন?” “বুঝতে পারছি না, এসব কী করে হল।” বিনীতাদেবীর আইনজীবী জোরালো প্রতিবাদ করে বললেন, “হুজুর, এসব ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার মক্কেল টেট উত্তীর্ণ, মেধা তালিকাভুক্ত। প্যানেলে প্রথম পাঁচশো জনের মধ্যে নাম আছে। তিনি টাকা দিতে যাবেন কেন?” বাদী পক্ষের আইনজীবী বিচারকের অনুমতি নিয়ে মিসেস বিনীতাকে জিজ্ঞেস করলেন,”টাকার পাশে বিনীতা দাশগুপ্ত নামে একজনের সই আছে। আপনার নামও বিনীতা দাশগুপ্ত। অথচ আপনি বলছেন – ওটা আপনার সই নয়। তাহলে সইটা আমরা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠাই। সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে – সইটা আপনার না অন্য কারও হাতের। কী,আপনি রাজি তো?” রাজি কথাটা বলার আর সাহস হল না। মাথাটা নিচু হয়ে গেল।
বিচারক নিজেই এবার বিনীতাদেবীকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কী উদ্দেশ্যে ঐ বিধায়ককে টাকা দিয়েছিলেন?” “হুজুর, মনে পড়ছে, বলছি। আমার বাবা ব্যবসা করেন। হয়তো সেই ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো লেনদেন হয়ে থাকতে পারে।” “তাহলে তো তালিকায় আপনার বাবার নাম থাকবে, আপনার নাম কেন?” “হতে পারে টাকাটা আমার হাত দিয়েই দেওয়া হয়েছিল।” “তাহলেও আপনার বাবার নাম থাকবে। কিন্তু ৩৫৯ ক্রমিক নাম্বারে বিনীতা দাশগুপ্তই লেখা আছে, পাশে স্কুলের নাম এবং ডেজিগনেশন। তাছাড়া ঐ তালিকার অন্য সমস্ত নামই অভিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, তা প্রমানিত হয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন –  আপনি সত্যিটা কি স্বীকার করবেন?”  “হুজুর, আমার বাবা হার্ডওয়ার এবং বালি, পাথরের ব্যবসা করেন। হয়তো বিধায়ক সেন কোনো কাজের জন্য ঐ টাকার জিনিস কিনেছিলেন। ওটা ব্যবসায়িক লেনদেন ছাড়া অন্য কিছু নয়।” বিবাদী পক্ষের আইনজীবী এবার অভিযোগ করলেন, “হুজুর, আমার মক্কেলকে অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করার চক্রান্ত চলছে।”
বিচারপতি উত্তর দিলেন, “আদালত ন্যায্য বিচার করে। অন্যায়ভাবে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করে না। আমার কাছে গোয়েন্দা অফিসার এমন প্রমাণ এনে দিয়েছেন যা শুনলে আপনার মক্কেলের সমস্ত জারিজুরি এক লহমায় কর্পুরের মতো উড়ে যাবে। আমি চেয়েছিলাম – সত্যিটা উনি নিজের মুখেই স্বীকার করুক।” গোয়েন্দা এবার হাতে অনেকগুলো কাগজপত্র নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। যেন যুদ্ধ জয়ের দৃঢ় অঙ্গীকৃত এক সৈনিক। অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “মিসেস বিনীতা, তাকিয়ে দেখুন, আমার হাতে আপনারই দু’টি ওএমআর শীট। হুবহু এক। একই হাতের লেখা এবং তা আপনারই, আর তা ফরেন্সিক রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রমাণিত। পার্থক্য – একটিতে শুধু নাম লেখা, আর অন্যটি একেবারে পরিপূর্ণ।  পরিপূর্ণ ওএমআর শীটটি সংগ্রহ করা হয়েছে নাইসার অফিসের হার্ডডিস্ক থেকে, আর ফাঁকা ওএমআর শীটটি উদ্ধার হয়েছে বিধায়ক বানী সেনের ফ্লাট থেকে। এখনও কি বলবেন – ঐ ৮ লক্ষ টাকাটা ব্যবসায়িক লেনদেন? পরবর্তী জিজ্ঞাসাঃ ২০১৪ সালে এইচ.এস পাস করার পর ঐ বছরই আপনি চাকরির আবেদন পত্র পূরণ করেন, জন্ম-শংসাপত্র অনুযায়ী তখন আপনার বয়স ১৮ পূর্ণ হয়নি অর্থাৎ আপনি ছিলেন নাবালিকা। অর্থাৎ আপনি চাকরির আবেদনপত্র পূরণের যোগ্য হয়ে ওঠেননি তখনও। আর এই একটিমাত্র কারণই আপনার চাকরি বাতিলের পক্ষে যথেষ্ট। এমন একটি কারণ থাকতে পারে,যা আমাদের প্রথম দিকে ধারণার বাইরেই ছিল। এটা কোনো ছোট ভুল নয়। এখন বলুন, কার আশীর্বাদ পেয়ে পরীক্ষা দিতে পেরেছিলেন? শেষ জিজ্ঞাসাঃ আপনি নিয়োগপত্র পান প্যানেল তৈরির পাঁচ বছর পরে। এই অবকাশে ডি.এল.এড ডিগ্রিটা করে ফেলেন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন। ততদিনে আপনি নাবালিকা পরিচয় ঘুচিয়ে ফেলেছেন। কারও ছত্রছায়া মাথার উপর না থাকলে এসব লুকানো কি সম্ভব ছিল? উত্তর দিন আদালতে।”
মিথ্যাকে আর আশ্রয় করে বাঁচা গেল না। বিপাকে পড়ে প্রার্থী কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিচারকের দিকে হাত জোড় করে বলতে লাগলেন, “হুজুর, আমি অপরাধী। আমাকে বড় শাস্তি দেবেন না। সব বলছি আপনাকে। বিধায়ক সেনকে আমি প্রথমে ৮ লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। টাকাটা উনি উপর মহলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তবে কাকে দিয়েছিলেন, আমি জানিনা। টেট পরীক্ষার আগে একদিন উনি আমাকে ডেকে নিলেন। বললেন – একটা ব্লাঙ্ক ওএমআর শীট আপনাকে দিচ্ছি। এটা পূরণ করে আমাকে দেবেন। পরীক্ষার হলে যেটা দেবে, তাতে শুধু নাম লিখে জমা দিয়ে আসবেন। যথাসময়ে আমি বদল করে নেবো। এর জন্য আরও দু’লক্ষ টাকা লাগবে। আর বললেন – যেহেতু আপনার বয়স কম, নিয়োগটা ২১-এ করাবো, এর মধ্যে আপনাকে ডি.এল.এড শংসাপত্রও ব্যবস্থা করে দেবো। ওটার জন্য দু’লক্ষ টাকা লাগবে। ওনার কথা মতো আরও চার লক্ষ টাকা দিই। চাকরিটা আমার হয়েছিল।”
বিচারক ধমক দিলেন, “থাক্, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। চাকরি খারিজ করে দিলাম। আদালতের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। তবু তার জন্য কোন শাস্তি দিলাম না। বলেছিলেন – সুপ্রিম কোর্টে যাবেন, দরজা খোলাই আছে। আপনি চলে যান।”
বিনীতা আর তার সঙ্গে আসা লোকেরা চলে গেল। মামলাকারীদের পক্ষের আইনজীবী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “মাই লার্ড, আপনাকে ধন্যবাদ। একটা ক্রিটিক্যাল কেসের ফয়সালা হল।”  বিচারক বললেন, “প্রশংসা পাওয়ার মতো আমি এমন কিছুই করিনি। আমি শুধু আমার কর্তব্য পালন করেছি। সমস্ত কৃতিত্ব গোয়েন্দা অফিসারের।” তাঁকে বললেন, “মিস্টার কানুনগো, আপনার প্রতি আমার ভরসা আছে। আপনি যেভাবে এই রহস্য সন্ধান করেছেন তার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
কানুনগো কি এবার চুপ থাকতে পারেন? বললেন, “মহামান্য, কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য আমি একা নই ,আপনিও। দুর্নীতির এই বিস্তৃত রহস্যময় কুহেলিকার ইন্দ্রজালের সন্ধান আমি পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু আপনার পরামর্শ, ভূমিকা আমাকে সাবলীল করেছে, প্রেরণা  যুগিয়েছে, দুর্লভ শিক্ষা দিয়েছে।” “অফিসার, আমাদের কাজই হল সত্যকে উদঘাটন করা, মানুষকে সুবিচার দেওয়া। মনে রাখবেন, অপরাধীর চোখের জল, ছলনা কখনও ন্যায় বিচারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু আমাদের তাতে বিচলিত হয়ে পথভ্রষ্ট হলে সমাজে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য প্রতিষ্ঠা পায়। অন্তর আমাদের কোমল থাকে – একথা সত্য, কিন্তু প্রয়োজনে কঠিন ও কঠোর হতে হয়। তাতে  সত্যের জয় হয়”,এই বলে বিচারক এজলাস থেকে প্রস্থান করলেন। প্রস্থান করলেন  আইনজীবী ও গোয়েন্দা অফিসার।
…………………………………………………….