Bhorer Dui Aakash – ভোরের দুই আকাশ

ভোরের দুই আকাশ
(গল্প ) ভোরের দুই আকাশ – হরবিলাস সরকার

“তোরে আজ মেরেই ফেলবো, একেবারে মেরেই ফেলবো,” এই বলে আকাশের মা ছেলের পিঠে একের পর এক লাঠির ঘা মারতে লাগলো। ছেলেও সমানে চিৎকার করতে লাগলো, “মা রে, মারিস্ না। আর আর মারিস্ না আমারে।” “তাহলে বল্ – ইস্কুলে যাবি?” “যাবো তো, তার আগে তুই আমারে খাতা, কলম কিনে দে। খাতা, কলম না নিয়ে গেলে স্যার যে বকে।” 

অনুশোচনার একটা তির এসে মায়ের বুকে বিঁধে গেল। লাঠিটা হাত থেকে পড়ে গেল। দু’হাতে বুকে টেনে নিল ছেলেকে। মায়ের শীতল স্পর্শে ছেলে আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মা সান্ত্বনা দেয়, “কাঁদিস্ না বাপ। খুব লেগেছে, না? ঠিক আছে, আর মারবো না। কাল তোরে খাতা, কলম কিনে দেবো। সত্যি সত্যিই বলছি – কিনে দেবো। সোনা আমার, আজ তবে যা স্কুলে।”

 এমনসময় ঝন্টু মুদির স্ত্রী বাড়ির ভেতর ঢুকে লম্ফ-ঝম্প করতে লাগলো। “কী হলো গো রামের বউ? কাল সকালে দোকান থেকে মাল নিয়ে এলে, আর বলে এলে – বিকেলে এসে টাকা দিয়ে যাবো। তা বিকেল গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে আবার সকাল হলো। বলি,তোমার কি বিকেল হয়নি এখনো? আগের হাজার টাকা বাকি। কাল আবার একশো টাকার মাল এনেছো। শোনো রামের বউ, টাকা যদি এখন না দাও, আমি আর তোমাকে ধারে মাল দিতে পারব না। এভাবে মাল দিলে ব্যবসা আমার লাটে উঠবে। এখন সত্যি করে বলো, টাকা কখন দেবে, আর আগের টাকাইবা শোধ দেবে কীভাবে?” 

“দিদি, ক’টা দিন সময় দাও। তোমাদের টাকা আমি দিয়ে দেবো।” “টাকা দিতে পারবে না, তো মিথ্যা কথা বলেছিলে কেন?ছল-চাতুরী ধরা পড়ে যাবে,জানতে না? এখন কী করবে?” “দিদি, উপায় ছিল না। দু’দিন পর কাল দুটো ভাত রান্না করেছিলাম। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা কথাটা বলেছিলাম।” দোকানদারের স্ত্রী আকাশকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বকবক করতে করতে চলে গেল। 

আকাশের চোখের জল তখনও শুকায়নি। প্রতিবেশিনী ‘সুফিয়া’ তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসে ঢুকলো আকাশদের বাড়িতে। আকাশের মা আঁচলে চোখের জল মুছছিল। সুফিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী রে আরতী, ছেলেকে মেরে এখন নিজে কাঁদছিস্? বুঝেছি, তো আকাশ আজ যাবে না স্কুলে?” 

দুঃখের কথা বলতে লাগলো আরতী, “দেখো না দিদি, খাতা-কলম কিনে দিতে পারিনি বলে স্কুলে যাবে না। ঘরে এক মুঠও খাবার নাই। স্কুলে গেলে তো দুটো অন্ততঃ খেতে পাবে। আকাশের বাপ এ মাসে কোনো টাকা পাঠায়নি। দিল্লিতে কী সব জ্বর হচ্ছে। ওর বাপও জ্বরে পড়েছিল। কাজ-কাম সেভাবে করতে পারেনি। এখন কেমন আছে, কী খায়, কিছুই জানিনা। আমি দুশ্চিন্তা করবো বলে ফোনেও কিছু বলে না।”

 “বোহিন, আমি বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থা। আমার মনের অবস্থাও ভালো নয় রে। আজাদের আব্বু তো এখানে কাজ-কাম নেই বলে ঠিক করে ফেলেছে – বাইরে চলে যাবে। আমার বিড়ি বাঁধার পয়সাতেই সংসারটা কোনরকমে চলছে। সেকি আর চলছে বলা চলে? আধপেট খেয়ে কোনরকমে বেঁচে থাকা। ছেলের খাতা, কলম আমিও কিনে দিতে পারিনি। তোর ছেলের মতই বায়না ধরেছিল। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে এলাম। ভাবলাম – আকাশ যদি স্কুলে যায়, ওর সঙ্গে চলে যাবে।” 

আকাশ সুফিয়া মাসির কাছে জানতে চাইলো, “খাতা-কলম কিনতে কত টাকা লাগবে গো?” “টাকা তো অনেকই লাগবে। কিন্তু বাপ, সে নিয়ে তুই ভাবিস্ না। তবে তুই যখন আমাকে মাসি বলে ডাকিস্, তোকে বলতেই পারি – মাকে দুঃখ দিস্ না। কত দুঃখে তোর মায়ের চোখের জল ঝরছে, আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝতে পারবি।”

 আরতী বলে, “দিদি,ক’দিন ধরে আমারও কাজ নাই। আজ সকালে অবশ্য একটা কাজের খোঁজ পেয়েছি। ভাবছি – ছেলেটাকে স্কুলে পাঠিয়ে যাবো।” 

 মায়ের একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে যায় আকাশ। চোখের জল মুছে দেয়, আর বলে, “মা, তুই তাহলে কাজে চলে যা। আমি আজাদকে নিয়ে স্কুলে চলে যাচ্ছি।” মা ছেলের মাথায় হাত বুলায়, বলে, “তাই যা। আজ তো ঘরে দুটো বিস্কুটও নাই যে, তোর মুখে দেবো।” “তুই আমার জন্য ভাবিস্ না মা। স্কুলে তো রান্না হবে। আজ আমাদের ডিম দেবে রে। মা,তোর জন্য ডিমটা আমি নিয়ে আসবো। কতদিন তুই ডিম খাস্ নি।” 

 মায়ের প্রাণে বড় আঘাত এসে লাগে। আবার আনন্দে বুকটা ভরেও উঠেছে। সেই আনন্দ নিয়েই মা বোঝায়, “না ব্যাটা, ডিম তুই নিয়ে আসবি না। খেয়ে আসবি। তুই খেলেই আমার খাওয়া হবে।”

  সুফিয়ার ভেতরেও এখন আনন্দের প্রবাহ। তা গতিময় হয়ে ওঠে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো। “ওরে আরতী, দেখেছিস্ বোহিন, বেটা তার মায়ের জন্য কত ভাবে! একটু আগেও আমি কতইনা ভুল বুঝেছিলাম।” 

মায়ের এই উচ্ছ্বাসের মধ্যে আজাদও বলে, “আম্মিজান, আমিও তোমার জন্য ডিম নিয়ে আসবো।” মা ছেলেকে আদর করে আর বোঝায়, “না সোনা, ডিম তুমি স্কুলেই খেয়ে আসবে।”

 আরতী সুফিয়াকে বলে, “দিদি, আমাদের ব্যাটাদের পেটে শিক্ষা নাই। কত দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তবুও অমানুষ হয়ে যায়নি। জানিনা, কতদিন ভেতরে এই সুবুদ্ধি থাকবে।” সুফিয়ার মনে আতঙ্ক জেগে ওঠে। “আরতী রে, কচি রক্ত-মাংসের শরীরে এখনো বিষ ঢোকেনি। দেখছিতো চারদিকে, সাবালক হতে না হতেই কেমন করে উচ্ছন্নে চলে যায়। যত কু-শিক্ষা ভেতরে এসে ঢোকে। মা-বাবাকে পর করে দেয়।” “হ্যাঁ দিদি,আসল শিক্ষা হয় না। কু-শিক্ষাটা খুব সহজেই হয়,” বলতে বলতে আরতী ছেলেকে কাছে টেনে নেয়, আর বলে, “বাপ, তুই তোর মা-বাবাকে কোনদিন দূরে ঠেলে দিস্ না।” ছেলে দু’হাতে মাকে শক্ত করে ধরে, বলে, “মা, জামা-প্যান্ট খুব ময়লা হয়ে গেছে। ম্যাম বলেছেন – গরম জলে সোডা দিয়ে কাঁচতে। খরচ নাকি অনেক কম। আরও বলেছেন – ছেঁড়া হোক, লজ্জার কিছু নেই। জামা-প্যান্ট যেন পরিষ্কার থাকে। আজ তাহলে কাজ থেকে ফেরার পথে একটু সোডা কিনে নিয়ে আসিস্ মা।” মা মাথা নাড়ে। ছেলে স্কুলের ছেঁড়া ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে প্রস্তুত হয়। 

আজাদও এবার তার আম্মিজানকে বলে, “তুমিও একটু সোডা কিনে নিও। আর বিড়ি বাঁধার পয়সা পেলে খাতা-কলম কিনে নিও। আজ নাহয় রাতের খাবারটা খাবো না। বুঝেছো আম্মিজান? আমি আসছি। চল্ আকাশ।”  

ছেলেরা রওনা হয়ে যায় স্কুলের পথে। সুফিয়া নিঃশব্দে কাঁদে। “বোহিন রে, আজ ছেলে আমার রাতের খাবার খাবে না। ঐ পয়সা দিয়ে খাতা-কলম কিনতে বলল। এমন কথাও ছেলের মুখে শুনতে হল। এই দুঃখ সই কেমনে! চল্, তুই তো কাজে যাবি। আমিও বাড়ি যাই, বিড়ি বাঁধি গিয়ে।”

 চোখের জল মুছতে মুছতে হেঁটে চলে মায়েরা। 

গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহমান ভাগীরথী। তাঁর ওপাড়ে উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর বিস্তৃত শহর। শহরের মধ্য কেন্দ্রে ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে সুবিশাল কলেবরে দন্ডায়মান বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “আলোর দিশারী শিক্ষা নিকেতন”। শহরে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবশ্য একটা নয়, বিভিন্ন নামে বেশ কয়েকটি আছে। আভিজাত্য, বড়লোক ঘরের ছেলেমেয়েরা সেখানে শিক্ষা লাভ করে অর্থের বিনিময়ে। আশে-পাশের গ্রাম থেকেও আসে বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা। দুর্ভাগ্যপুর থেকে আসে চারজন – দিশারী, কুশল, সাবিনা, শামীম। 

প্রতিদিন স্কুলের গাড়িতে করে ওরা যাওয়া-আসা করে। ওরাও বায়না ধরে, তবে খাতা-কলমের জন্য নয়। ওদের বায়নাটা অন্যরকম। স্কুলের সময় হতেই দিশারী কোনদিন মাকে বলে, “মামণি, আমার টিফিনটা তৈরি করে দাও। আজ ডিম-টোস্ট দিও না। আজ আমাকে ফল কেটে দাও। তার সাথে দু’পিস মাখন-রুটি দিও। একটা মিষ্টিও দিও।” কোনদিন বলে, “বেকারির বিস্কুট দাও, আর একটা ডিম সেদ্ধ।” নয়তো বলে, “জেলি মাখানো রুটি, সাথে কিসমিস আর কাজু দাও।” “দিচ্ছি, সব খেয়ে আসবি কিন্তু।” “হ্যাঁ, খাবো তো। আমি তো তোমার সোনা-মেয়ে। কোনদিন কি কিছু ফেলে এসেছি? তবে ‘অঞ্জলি ম্যাম’ আমার ক্লাস টিচার, তাকে তো একটু কিছু না দিয়ে আমি খাবো না।” “বেশ, তাই দিস্।” 

 দিশারীর সহপাঠী ‘কুশলে’র স্বভাবটা আবার অন্যরকম। ওর নতুন জিনিসের প্রতি ঝোঁক বেশি। মায়ের কাছে আজ হয়তো দাবি করল, “আমার জুতো জোড়া পুরানো হয়ে গেছে, নতুন একজোড়া কিনে দাও।” কাল আবার দাবি করবে, “একটা স্কুল ব্যাগ কিনে দাও, এটা ভালো লাগছে না।” অথবা “অমুক বন্ধুকে দেখলাম – কোমরে কী সুন্দর একটা বেল্ট পরে আসছে, আমাকে ওইরকম একটা কিনে দাও।” বাবা রেশন ডিলার, মা তেল-কলের মালিক। ছেলের আবদার, ইচ্ছা পূরণে দুজনই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। 

 সাবিনা, শামীম – ওরা বোন আর দাদা। ওদের বাবা ইটভাটার মালিক। তিনি আবার বছর বছর মক্কা-মদিনা যান হজ করতে। লোকে ওনাকে দুর্ভাগ্যপুরের বাদশাও বলে। আর বাদশার ছেলেমেয়েরা একেবারে বাদশার মতই। কোথাও যখনই যায় দামী পোশাক-আসকে, তাতে আতর মাখাবেই। গন্ধে সবাই বুঝতে পারে – বাদশার ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে। 

যে পথ ধরে দিশারী,কুশল,সাবিনা, 
শামীমদের স্কুলের গাড়ি ছুটে চলে হর্ণ বাজিয়ে, আকাশ, আজাদ, আশা, আফসানারা পায়ে হেঁটে স্কুলে যায় সেই পথেই। ওরা একপাশে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে। চোখের অদৃশ্য হলে আবার হাঁটা ধরে। গ্রামের মধ্যিখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে পৌঁছে ছাত্র-ছাত্রীরা পালা করে স্কুল-বাড়ি ঝাঁট দেয়, বাথরুম-টয়লেট পরিষ্কার করে। ক্লাস শুরুর সময়ও হয়ে যায়। প্রধান শিক্ষিকা তড়িঘড়ি প্রার্থনা করিয়ে সকলকে নিয়ে এসে একটা বড় ঘরে বসান। বছর বছর এভাবেই চলছে। এছাড়া উপায়ইবা কী আছে ? শিক্ষক-শিক্ষিকা বলতে দু’জন। প্রধান শিক্ষিকা নিজে, আর একজন আংশিক সময়ের শিক্ষক। 

নতুন বছরে তিন-তিনটে মাস এমন করেই কেটে গেল। প্রথম মূল্যায়ন পর্ব দোরগোড়ায়। ২রা এপ্রিল প্রার্থনার পরে উদ্বিগ্ন মনে ছাত্র-হাজিরা-খাতা হাতে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে প্রধান শিক্ষিকা প্রথমে এই কথাটাই বললেন। এরপর নাম ডাকার পর তিনি আন্তরিকতার সুরে বললেন, “তোমরা সবাই চুপটি করে বসো। কেউ গন্ডগোল করবে না।” ছাত্র-ছাত্রীদের দুজন জিজ্ঞাসা করল, “ম্যাম,’পরান স্যার’ আসবে না?” “না, পরানবাবুর আজ বি.ডি.ও অফিসে ট্রেনিং আছে। কাল থেকে দশ-বারো দিন আসবেন না। ওনাকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে একটা কাজ করতে হবে। কাজ শেষ হলে কয়েকদিন আসবেন। তারপর আবার ওনাকে চাইল্ড রেজিস্টারের কাজ করতে হবে।” আশা জিজ্ঞেস করে, “ম্যাম, এখন তাহলে আমরা কী বই পড়বো?” আফসানা জিজ্ঞেস করে, “কিছু লেখাবেন ম্যাম?” “হ্যাঁ, তোমরা সবাই খাতা বের কর। আর মন দিয়ে শোনো, যারা লিখতে পারো, তারা দেখে দেখে একপাতা বাংলা হাতের লেখা লেখ। যারা লিখতে পারো না, তারা ইচ্ছামত একটা ছবি আঁকো। আর যারা কিছুই পারো না, তারা কথা না বলে গোল হয়ে বসে খেলা করো। আমি রাঁধনি মাসিদের রান্নার জিনিসগুলো দিয়ে আসি।” ছাত্র-ছাত্রীরা নির্দেশ মতো যে যার কাজ করতে উদ্যত হয়। প্রস্থান করেন প্রধান শিক্ষিকা। 

কিছুক্ষণ বাদেই প্রধান শিক্ষিকার অবর্তমানে ছাত্রছাত্রীরা বই-খাতা ফেলে হইচই শুরু করে। আজাদ প্রস্তাব দেয়, “এই আশা, আফসানা, মালা, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’খেলবি?” সবাই উৎফুল্ল হয়ে বলে, “হ্যাঁ, খেলবো।” আজাদ দ্বিগুণ উৎফুল্ল হয়ে বলে, “তাহলে শুরু করছি, প্রথমে আমিই কানামাছি।”  

চোখ বেঁধে শুরু হয় খেলা। “কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে খুশি তাকে ছোঁ। কানামাছি …………।” এভাবে চলতে থাকে খেলা। একে একে আশা, আফসানা, আকাশ,মালা, ফরিদা কানামাছি হয়। খেলতে খেলতে ওরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এমন সময় প্রধান শিক্ষিকা এসে ঢুকলেন ঘরে। উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে ধমক দিলেন। “কী ব্যাপার, তোমরা লেখাপড়া না করে খেলা করছো, আর হইচই করছো? এসব করলে তোমাদের পড়াশোনা হবে?” মুহূর্তে একশোর অধিক কচিকাঁচার মুখগুলো নিশ্চুপ হয়ে গেল। সকলে আপন আপন জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। দিদিমণি এবার শান্ত গলায় বললেন, “বেশ, ঠিক আছে। তোমরা এবার সবাই ছবি আঁকো। আমি মিড.ডে.মিলের হিসেবটা একটু সেরে নিই, কেমন? রিপোর্টটা সময়মতো পাঠাতে হবে তো।”

 সুবোধ ছেলেমেয়ের মতো ছাত্রছাত্রীরা ছবি আঁকতে শুরু করল। আর হিসেবের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দিদিমণি। মেনু তো আর কম নয়। যোগ-বিয়োগের ব্যাপারটাও কম কিছু নয়। হিসেবে ভুল থাকলে চলবে না। অতএব, ঠান্ডা মাথায় গভীর মনোনিবেশ করলেন তিনি। 

অনেকক্ষণ দৌড়ঝাঁপের পর ক্লান্ত শরীরে ছেলেমেয়েদের অনেকেই ছবি আঁকার বদলে আঁকিবুকি কাটছিল। কারও কারও চোখ বুজে আসছিল। আশা উঠে দাঁড়িয়ে নালিশ করল, “ম্যাম, আকাশ ঘুমোচ্ছে।” সঙ্গে সঙ্গে আফসানাও নালিশ করলো, “ম্যাম, আজাদও ঘুমোচ্ছে।”

 বিরক্তির সুরে দিদিমণি বলে উঠলেন, “কী করবো, বলো? ওরা তো রোজই ঘুমায়।” রেগেও গেলেন। হিসাবের কাজ থামিয়ে উচ্চস্বরে হাঁক দিলেন, “আকাশ, আজাদ!” চিৎকারে চমকে উঠল দু’জন, ঘুম ভেঙে গেল। কড়া আদেশ, “দু’জনেই উঠে দাঁড়াও।” আকাশ ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “ম্যাম, খুব খিদে পেয়েছে।” একইভাবে আজাদও বললো, “আমারও খুব খিদে পেয়েছে।”

 দিদিমণি নিমেষে তাঁর কোমল মাতৃ-হৃদয়ে অপরিসীম যন্ত্রণা অনুভব করলেন। তার বহিঃপ্রকাশও ঘটে গেল। “ইস!রে, বাছাদের খিদেয় ঘুম পেয়ে গেছে।” আকাশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে, “সকালে আমাদের রান্না হয় না ম্যাম। মা সকালে না খেয়ে কাজে চলে যায়।” আজাদও চোখ মোছে আর বলে, “সকালে আমাদেরও রান্না হয় না, ম্যাম।” “সে তো আমি জানি। ঠিক আছে। তোমাদের খিদের কষ্ট এখনই দূর হয়ে যাবে। স্কুলের রান্না এতক্ষণে বোধহয় হয়ে গেছে। আজ তোমাদের ডিম খাওয়াবো, পায়েস খাওয়াবো।” ছেলেমেয়েরা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। “কী মজা! কী মজা! আজ আমরা ডিম খাবো, পায়েস খাবো।” 

কিন্তু এমন খুশিভাব দিদিমণিকে বেশিক্ষণ স্বস্তি দিলো না। উষ্ণ বাতাসের একটা ঝাপটায় খুশির দরজাগুলোয় খিল এঁটে গেল। আশা বলে উঠলো, “ম্যাম, আজ তো আমাদের লেখাপড়া কিছুই হলো না।” পরক্ষণেই আফসানা তার প্রিয় বান্ধবী আশার কাঁধ ধরে চোখে চোখ রেখে বলল, “শুধু আজ কেন রে আশা, কোনদিনই তো ভালোভাবে লেখাপড়া হয় না।” দিদিমণিও এই দুঃখের সমান অংশীদার। বলেন, “দেখো, বলছো বটে। আমি তো চেষ্টা করি। পারি কই? যন্ত্রণায় আমিও বিদ্ধ হচ্ছি। আমি নিরুপায়। তোমাদের এই দুর্ভাগ্য, এ যে দুর্ভাগ্যপুরের দুর্ভাগ্য। শুধু কি তাই? এমন দুর্ভাগ্য গোটা রাজ্য জুড়েই। এখানে আলো নিভে গেছে। এখানে হতভাগ্যরা শুধু দু’মুঠো খেতেই পায়। থাক্ এসব কথা। চলো সোনামণিরা, সবাই খেতে চলো।” থালা হাতে নিয়ে সবাই এগিয়ে যায় খাবার কক্ষের দিকে। 

খাওয়া-দাওয়ার পর স্কুল আজ ছুটি হয়ে গেল। দিদিমণি যাবেন আলোর দিশারী শিক্ষা নিকেতনে। তার একমাত্র ছেলে ‘শুভম’ সেখানে পড়ে। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। সেখানে আজ ছুটির পরে মাতৃ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। 

শহরে ছেলের স্কুলের কাছাকাছিই দিদিমণির বাসস্থান। তিনি যখন এসে পৌঁছালেন তখন শেষ পিরিয়ড চলছে। চতুর্থ শ্রেণীর চারটি বিভাগ। ‘বিবেকানন্দ’ বিভাগে শুভম পড়ে। দুর্ভাগ্যপুরের দিশারী, কুশল, শামীমও ওর সাথে পড়ে। শ্রেণীতে তখন পাঠ দিচ্ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক ‘ধ্রুবজ্যোতিবাবু’। তিনি শুভমকে প্রশ্ন করলেন, “মাই ডিয়ার চাইল্ড, প্লীজ টেল মি, ‘হোয়াট ইজ সায়েন্স’?” “ডিয়ার স্যার, স্যাল আই অ্যানসার দ্য কোয়েশ্চেন ইন ইংলিশ অর বেঙ্গলি?” “ইউ মে সে ইন ইওর মাদার টাং।” “থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। স্যার, বিজ্ঞান হলো ‘বিশেষ জ্ঞান’, যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সত্যকে উদঘাটন করে।” “ঠিক বলেছো। এবার বল, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?” “আমি বিজ্ঞানী হয়ে মানবকল্যাণকর ভূমিকা পালন করতে চাই।” “বাঃ, অপূর্ব তোমার ইচ্ছা। এবার দিশারী, তোমার পালা। আমি জানি, তোমার বাবা জেলা সভাধিপতি। তো তুমি কী হতে চাও?” “স্যার, বিজ্ঞান আমার প্রিয় বিষয়। কিন্তু বিজ্ঞানী হবার ইচ্ছে আমার নেই। আমার ইচ্ছে – আমি সমাজের একজন রূপকার হব।” “তার মানে – তুমি গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী হতে চাও।” “ঠিক ধরেছেন স্যার।” “বেশ, আমিও আশীর্বাদ করি – তোমার ইচ্ছে পূর্ণ হোক।” “নাউ কুশল, প্লীজ টেল মি, হোয়াট আর ইউ গোয়িং টু বি?” “স্যার, আই উইশ টু বি অ্যান এফিসিয়েন্ট ডক্টর লাইক বিধানচন্দ্র রয়।” “ফাইন। আই হোপ, ইওর ড্রিম উইল সিওরলি সাকসীড।” “শামীম, তোমার ইচ্ছার কথা আমি জানি। এখন তোমাকে জিজ্ঞেস করছি – তুমি স্যার আইজ্যাক নিউটনের জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলতে পারো?” “হ্যাঁ স্যার, পারি। নিউটন একদিন বসে আছেন তাঁর আপেল বাগানে। তিনি তাঁর গবেষণা নিয়ে ভাবছেন। হঠাৎ একটি আপেল বোটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটির দিকে নেমে এলো। নিউটন ভাবলেন – আপেলটি কেন উপরে উঠে গেল না? এই ভাবনাই তাঁকে ‘মাধ্যাকর্ষণ বল’ আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছিল।” “বেশ, বাকিদের ইচ্ছের কথা আমি অন্যদিন জানব। আজ আমি মাধ্যাকর্ষণ বল নিয়েই আলোচনা করব। ‘পৃথিবী তাঁর উপরের কোন বস্তুকে লম্বভাবে নিজের কেন্দ্রের দিকে যে বলে টানে, তাই হলো মাধ্যাকর্ষণ বল’। …………..।” 

বাইরে এতক্ষণে মায়েদের ভীড় জমে গেছে। টি.ভি চ্যানেলের সাংবাদিকগণও হাজির। প্রশ্ন করলেন জেলা সভাধিপতির স্ত্রীকে, “ম্যাডাম, শুনেছি – আপনার মেয়ে এখানে পড়ে। ওর প্রোগ্রেস সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।” “আমার মেয়ে এ বছর চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। ওর প্রোগ্রেসের ব্যাপারে আমি অত্যন্ত খুশি। বাংলা, ইংরেজির যে কোন পাঠ দুইই সমানতালে গড়গড় করে পড়তে পারে। গণিত, বিজ্ঞানসহ যে কোন বিষয়েই যথেষ্ট পারদর্শী।” “স্কুল, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ব্যাপারে যদি কিছু বলেন।” “দেখুন, এখানে মোটা অংকের ফি দিয়ে পড়াতে হয়। একথা সত্য, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, একটা বিজনেসের সম্পর্ক থাকেই। কিন্তু আমাদের চাহিদার কোন খামতি থাকে না। এখানে এডুকেশনের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকা যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই অভিজ্ঞ এবং হাইলি কোয়ালিফায়েড। তাঁরা কেয়ারফুলি এবং অ্যাটেনটিভলি পাঠ দান করেন। আমার বিশ্বাস, এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন কারও বৃথা যাবে না।” “এবার একটু ব্যক্তিগত স্তরে প্রশ্ন করছি এবং শেষ প্রশ্ন। আপনার বাড়ি দুর্ভাগ্যপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। বাড়ির পাঁচিলের গায়েই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মেয়েকে সেখানে ভর্তি করেননি কেন? বলুন ম্যাডাম।” “আপনার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি ইচ্ছুক নই।” সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন শুভমের মা। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, “ম্যাডাম, আপনি তো দুর্ভাগ্যপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। আপনার নিবাস অবশ্য এই বিক্রমপুর শহরে। শহর থেকে আপনার স্কুল বেশি দূরে নয়। আপনার কাছে জানতে চাই – আপনি নিজেই মানুষ গড়ার কারিগর। তো আপনার স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করে সেই মহতী কাজটি করলেন না কেন?” “সরকারি পদে থেকে এরকম প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা বোধহয় একটু অপ্রীতিকর হবে। তবু সত্যকে অস্বীকার করব না। দেখুন, এই আলোর দিশারী শিক্ষা নিকেতনে ২৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এঁনারা যা পরিষেবা দিতে পারেন, আমরা তা পারি না। এখানে যে অনুকূল পরিবেশ, আমরা চাইলেও তা তৈরি করতে পারি না। যদি বলেন কেন? তার উত্তর আমি দিতে পারবো না।” “ধন্যবাদ ম্যাডাম।” এসময় চার চাকার একটি দামি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। নামলেন জেলাশাসকের স্ত্রী। তাঁর পুত্র ‘সৌরিশ’তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। সাংবাদিকরা চলে গেলেন ম্যাডামের কাছাকাছি, তাদের প্রশ্নের উত্তর জানতে। “ম্যাডাম, আমরা জেনেছি – আপনারা নন বেঙ্গলি হলেও বাংলা বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন। বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেও ফেলেছেন। সে কারণেই কি ছেলেকে এখানে ভর্তি করেছেন?” “হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। সত্যিই বাংলা অত্যন্ত মিষ্টি ভাষা। তবে একথা ঠিক যে আধুনিক পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সভ্যতার গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইংরেজি ভাষাকে আমাদের প্রাধান্য দিতেই হবে। আমরা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাও ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু এই বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি দুটো ভাষাতেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যত্ন সহকারে শিক্ষা দেওয়া হয়। বলতে গেলে দুটো মাধ্যমের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।” “ম্যাডাম, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির সাথে এই সমস্ত বিদ্যালয়ের বিস্তর তফাৎ ।এ ব্যাপারে কী বলবেন?” “দেখুন, তফাৎ বলুন আর বৈষম্য বলুন, সমাজটা গোড়া থেকেই এভাবে গড়ে উঠেছে। সভ্যতা এভাবেই এগিয়েছে। চিরকালই একদল মানুষ যুগের বিচারে এগিয়ে থেকেছে, একদল পিছিয়ে পড়েছে। এই পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র আর বঞ্চনা। দারিদ্র্যের পেছনে আছে অর্থনৈতিক অসাম্য। এই অর্থনৈতিক অসাম্যের নিরসন কীভাবে সম্ভব,তার জন্য পথ খুঁজতে হবে। মহান দার্শনিকগণ তো সে পথ দেখিয়েছেন অনেক আগেই। আর বঞ্চনার নিরসনে সরকারকে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করতে হবে। বর্তমানে সুযোগ-সুবিধা অনেকের বেশি, অনেকের অনেকটাই কম। অনেক মানুষ আবার নিঃস্ব। যাদের সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত কম, তাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। সেখানে শিক্ষার পরিবেশ অনুকূল না থাকায় ওইসব ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার দিক থেকে প্রচন্ড দুর্বল। আবার ওদের বাড়ির পরিবেশও উপযুক্ত নয়। এসব কারণেই একটা বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে।” “ম্যাডাম,আপনার সুচিন্তিত মতামতের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।” 

নিখিল এতক্ষণ ধরে অধ্যাপক তথা সমাজকর্মী চৈতন্যবাবুকে গল্পটা বলতে বলতে এবার প্রশ্ন করল, “স্যার, শিশুদের একই দেশ অর্থাৎ একই বাগিচা। কোনো বাগিচায় কুঁড়িদের ফুটে ওঠার কত উৎসাহ, আবার কোথাও কুঁড়িরা না ফুটেই অনাদরে নীরবে ঝরে যায়। কী বলবেন?”

 চৈতন্যবাবু দুঃখ করে বললেন, “বণিকের সাম্রাজ্যে শিক্ষা বিক্রি হয়। যার টাকা আছে, সে-ই শিক্ষা কিনতে পারে। যার নেই, সে বড়ই অধম, দুর্ভাগা।” 

নিখিল আবারও বলতে শুরু করেঃ –  

এলো ২৫ শে বৈশাখ। সকালের সূর্য উঠেছে পূব আকাশে। সমারোহে বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে আলোর দিশারী শিক্ষা নিকেতনে। অতিথিবরণ, প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের পর শুরু হল মূল অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী সংগীত গাইল দিশারী। কবিতা আবৃত্তি করল শুভম, আরও অনেকে। কবি রচিত গানের তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করলো অনেক ছাত্র-ছাত্রী। এরপর ২৫শে বৈশাখ দিনটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শামীম বলল, “উপস্থিত অতিথিবৃন্দ, আমাদের বাবা-মায়েরা, বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বন্ধুরা এবং শ্রদ্ধেয়/শ্রদ্ধেয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ, আজ আমাদের জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। কেননা, রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন আমাদের সকলের মনে-প্রাণে। এই দিনটি এলেই আমরা আবেগে মোহিত হই। তিনি আমাদের প্রেরণা, পাথেয়। …………….।” 

চতুর্থ শ্রেণীর একজন বালকের এমন বক্তৃতায় অভিভাবক/অভিভাবিকামন্ডলী অত্যন্ত আপ্লুত। অনুষ্ঠান শেষে এক পিতা সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “আলোর দিশারী শিক্ষা নিকেতন আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবন আলোময় করে তুলেছে। সত্যিই আমরা বিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গর্বিত। এখানে শিখরে পৌঁছানোর সমস্ত শিক্ষাই আমাদের সন্তানেরা পায়। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে ওরা প্রতিদিন অঙ্গীকার করে, “জীবন মোদের ধন্য হোক, স্বপ্ন মোদের সফল হোক, চলবো আলোর পথে পথে। আপন কীর্তি-বলে, এই পৃথিবীর শিখর চূড়ায় উঠতে যেন পারি, বিজয় রথে চড়ে।” 

রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠান চলছে সমস্ত সরকারি বিদ্যালয়েও। দুর্ভাগ্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান কক্ষ সাজানো হয়েছে ফুল-মালায়। শ্বেতবস্ত্রের উপর শোভা পাচ্ছে কবির প্রতিকৃতি। পাশে সারিবদ্ধ ভাবে বসে আছে ছেলেমেয়েরা, সাথে আছেন প্রধান শিক্ষিকা। ছেলে-মেয়েদের অনেকের বাবা-মায়েরা এসেছেন, বসে আছেন সামনে দর্শকাসনে। 

বেজে চলছিল রবীন্দ্র সংগীত। তা বন্ধ হয়ে শুরু হলো প্রতিকৃতিতে ফুল-মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। এরপর সকলের উদ্দেশ্যে প্রধান শিক্ষিকা বলতে লাগলেন, “আজ পঁচিশে বৈশাখ, বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন।” এমনসময় কৌতুহলবশতঃ ‘আকাশ’ ছেলেটি প্রশ্ন করে বসল, “ম্যাম, রবীন্দ্রনাথকে আমরা প্রত্যেক বছর ফুল,মালা দিই কেন, মারা গেছে বলে?” একইভাবে আজাদও প্রশ্ন করল, “আমরা ওনার জন্মদিন পালন করি কেন?” দর্শকাসন থেকে এক মা উঠে এসে বলল, “দিদিমণি, আমি আকাশের মা। সত্যিকারে বলতে কী, আমি চিনিনা, জানিনা – এই মানুষটা কে ছিলেন। পাড়াগাঁয়ের মানুষ, পাড়াগাঁয়েই বড় হয়েছি। লেখাপড়া জানিনা, চিনবো কী করে?” আরও এক মা উঠে এসে বলল, “ম্যাডাম, আজাদ আমার ছেলে। লেখাপড়া করার সুযোগ আমারও হয়নি। খাটতে খাটতে বড় হয়েছি, আজও খেটে খাই। দেশ দুনিয়ার খবর আমরা জানবো কী করে? এমন মানুষ আমাদের দেশে জন্মেছিল, সেকথা আমিও জানতাম না। চার বছর ধরে ছেলে স্কুলে পড়ছে। এই বছরই অনুষ্ঠান দেখতে এলাম, তাই জানতে পারলাম।” 

প্রধান শিক্ষিকা বড় অস্বস্তিতে পড়লেন। মনোবেদনা ভেতরে চেপে রাখতে পারলেন না। তাঁর হৃদয়তন্ত্রীর তারে বেজে উঠল বিষাদময় সুর। “হে আমার ভারতবর্ষ, দুর্ভাগ্যপুরের এমন দুর্দশা কেন, আমার জানা নেই। হে বিশ্ববরেণ্য কবি, জগতসভায় তুমি এই দেশের নাম উজ্জ্বল করেছো, বাংলা ভাষাকে উচ্চাসনে বসিয়েছো। তবুও এই দুর্ভাগ্যপুরের নীল আকাশের নিচে অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়নি।” 

আকাশের মা আবারও দুঃখ করে বলতে লাগলো, “যে মানুষটা বাংলাদেশের নাম এত বড় করেছে, সেই বাংলায় আমার ছেলেটাও জন্মেছে। চার ক্লাসে পড়ে। বড়ই দুর্ভাগ্য! আজও ছেলেটা অক্ষর চেনেনা, নিজের নামটা লিখতে পারেনা, বাংলা বই পড়তে পারে না। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে!” দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে আসে চোখের জল। 

আকাশের মায়ের কাছে এগিয়ে আসে আজাদের মা। দুঃখিনীর দুঃখ দুঃখিনীই বোঝে। সে দুঃখ যে কত যন্ত্রণাময়! শুধু প্রকাশ করে বুকটা খালি করতে চাইল। “আকাশের মা, তোর-আমার, আর আমাদের ছেলেদের ভাগ্য এক সুতায় গাঁথা। আমার আজাদ না খেয়ে স্কুলে আসে। খিদের জ্বালায় পড়তে ভালো লাগে না, ঘুমিয়ে পড়ে। খাবারটা পায় ঠিকই কিন্তু লেখাপড়া কিছুই শিখতে পারেনি।। এ দুঃখ সই কেমন করে?”

অশ্রুসাগরে ডুব দেয় দুই মায়ের সাথে দর্শকাসনের বাকি সকলেই। প্রধান শিক্ষিকা ক্ষোভে-বিক্ষোভে নিজের অন্তর্যামীকে নালিশ জানায়, “কবি, তুমি বলে গেছো, ‘অন্ধ জনে দেহ আলো’। সেই আলো আমি জ্বালাতে পারিনি। আমি অন্তর থেকে চেয়েছিলাম, তবু পারিনি। সবাই বলে – মানুষ গড়ার শিল্পী আমি। কাদামাটির ঢেলা দিয়ে শুধুই নিথর প্রতিমা গড়েছি, প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। মায়েরা, আর যারা আছো দুর্ভাগ্যপুরের মানুষ, যদি পারো, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আজ নাহয় তোমাদের অশ্রুজলেই অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে যাও এই মহামানবকে।” 

সমাপ্তি সংগীত গাইলেন প্রধান শিক্ষিকা, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, ………।” 

এরপর বিকেলবেলা। প্রতিদিনের মতো আজও দুর্ভাগ্যপুরের ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলা করছিল। তবে দিশারী, কুশল, সাবিনা, শামীম – ওরা এভাবে মাঠে খেলে না। অবকাশ পেলে কম্পিউটারে গেম খেলে। কিন্তু আজ ওদের অবকাশ নেই। শহরে যাচ্ছে কেউ নাচ শিখতে,কেউ আবৃত্তি। তারপর সবার গানের ক্লাস। বাড়ি ফেরার পর রাতে আবার গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া। ঘড়ি ধরে সময় একেবারে মাপা। একটুও দেরি হবার জো নেই। ওদের মায়েরাও সঙ্গে ছিল। হঠাৎ মাঠের বলটা সজোরে এসে তিন চাকার চলমান গাড়িটায় এমনভাবে আঘাত করল যে, না থেমে উপায় ছিল না। আকাশ, আজাদ ছুটে আসছিল বলটা কুঁড়িয়ে নিতে। বলটা ছিটকে গিয়ে রাস্তার ধারে একটা ঝোপের মধ্যে আটকে ছিল। ওটা লাথি মেরে দূরে পাঠানোর জন্য কুশল আর শামীম এক লাফে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। ওদের মায়েরা কি আর স্থির থাকতে পারে? তারাও এক ঝটকায় নেমে পড়ল।

 লাথি মারার আগেই আকাশ, আজাদ এসে বলটা ধরে ফেলল যখন, তখন কুশল অনুরোধ করে বলল, “এই আকাশ, দে না, একটা কিক মারি।” শামীমও একই অনুরোধ করল। আকাশ বলটা মাঠের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আগন্তুক দুই বন্ধুর একজনের কাঁধে হাত রেখে বলল, “খেলবি তো মাঠে চল্, কোনোদিন তো আমাদের সাথে খেলিস্ না।” আজাদও অন্য বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে খেলতে অনুরোধ করল। 

ঘটনাটা বন্ধুসুলভ হলেও আভিজাত্যের দম্ভের কাছে তা ঘৃণায় পর্যবসিত হলো। এক মা সুর চড়ালেন, “ছি!ছি! নোংরা হাতে তুই আমাদের ছেলেদের ধরে নিলি?” আর এক মাও ভীষণ বকতে লাগলেন, “কোথাকার কীসব বিশ্রী ছেলে, আমাদের ছেলেরা তোদের বন্ধু? এরা তোদের সমকক্ষ?” এরপর নিজের ছেলেদেরকেও শিক্ষা দিলেন, “কেন, কেন কাঁধ ধরতে দিলি? ওদের কোন মান আছে? তোরা নামি-দামি স্কুলে পড়িস্, কত কী শিখিস্। তোরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নেতা-মন্ত্রী হবি, গাড়িতে চড়বি। ওরা ছাগল চড়াবে, বড় হয়ে মুনিশ খাটবে।” 

ছেলেরা বকুনি খেয়ে জামার ধুলো ঝেরে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল মায়েদের হাত ধরে। দেরি হওয়ায় গাড়িও জোরে ছুটতে লাগলো গন্তব্যের দিকে। 

“এ কেমন আধুনিক সভ্যতা?,” নিজেকে প্রশ্নটা করে গল্পের ইতি টেনে নিখিল রুমালে চোখ মুছতে লাগলো। বিন্দু বিন্দু ব্যথার কণা এসে জমছিল চৈতন্যবাবুর চোখের কোনেও। “নিখিল তুমি কাঁদছো?” “স্যার, আপনার চোখেও তো জল। কী ভাবছেন?” “ভাবছি, একই আকাশতলে ভোর হয়, ভোরের আলোয় কোথাও ঝলমলিয়ে ওঠে ফুলের বাগিচা। কুঁড়িরা মাথা তুলে হাসে। আবার কোথাও ঘন কালো মেঘে ঢাকা, রাতের অন্ধকার দূর হয়নি। সেখানে আলোহীন বাগিচায় কুঁড়িরা বড় অসহায়, ম্রিয়মাণ।” এখানেই শেষ করলেন না। এবার নিখিলকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি আমার চোখের কোনে জল দেখেছো। আসলে কেন, জানো?” নিখিল উৎসুক হয়ে কারণ খুঁজে বেড়ায় কল্পনার চোখে। চৈতন্যবাবু বলতে শুরু করেন। “আমার চোখের কোনে জল – ঐ আলোময় আর আলোহীন বাগিচা, দুটোর জন্যই। যেখানে আলো নেই তার জন্য তো কষ্ট হচ্ছেই। আর যেখানে আলো দেখছো, সেখানে আসলে জীবন বিকাশের আলো নেই। আছে সীমাহীন ভোগের আকাঙ্ক্ষা, দাম্ভিকতা আর স্বার্থপরতা। শিখর ছোঁয়ার স্বপ্ন আছে। দুর্নিবার গতি আছে। পণ্ডিত হবার প্রতিযোগিতা আছে। নেই শুধু হৃদয়। কেউ বলে না, ‘মহাজ্ঞানী, মহাজন, যে পথে করেছেন গমন, হয়েছেন প্রাতঃসরণীয়। সেই পথ লক্ষ্য করে, স্বীয় কীর্তি-ধ্বজা ধরে আমরাও হব বরণীয়।’ ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, পরের জন্য তোমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও’।” 
………………………………………………………