রেনেসাঁর ঊষাবেলা

রেনেসাঁর ঊষাবেলা

– হরবিলাস সরকার
    অষ্টাদশ শতাব্দীর তখন পড়ন্তবেলা। বিদেশি ইংরেজ কোম্পানির চরমতম অত্যাচার, দেশীয় জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণ আর ভয়ঙ্কর মড়কের হাহাকারে ছেয়ে গিয়েছিল বাংলা, বিহার তথা গোটা দেশ। ছিল নানা ধর্মের গোঁড়ামি। ছিল হিন্দু ধর্মের নানান ভাগাভাগি, অস্পৃশ্যতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা আর কালের স্রোতে দীর্ঘ পথ বেয়ে চলে আসা সহস্র কুপ্রথা, কুসংস্কার , অন্ধবিশ্বাস।
     অমানিশার গাঢ় অন্ধকারে, যেন এক অন্ধকূপে মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। স্বামীর চিতার পাশে দাঁড়িয়ে বলপূর্বক ধরে আনা অসহায়া স্ত্রীর বাঁচার আকুতি, করুণ চিৎকার রক্ষণশীল পন্ডিত, শাস্ত্রবিদ, পুরোহিত, মানুষের উল্লাস আর শত ঢাক-ঢোল-করতালের আওয়াজ ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে তুলেছিল।
     ইতিহাস তাঁর স্মৃতির পাতায় সবকিছু লিখে রেখেছিল। প্রকৃতি নিদারুণ যন্ত্রণায় অপারগ হয়ে উঠেছিল। সব অন্যায়-অধর্মকে বদলে ফেলার জন্য দিক-বিদিকে ওলট-পালট হাওয়া বইতে লাগল। সব অন্ধকার মুছে ফেলে পুবের আকাশটা ক্রমে রক্তিম আভায় রঞ্জিত হয়ে উঠল। কুজ্ঝটিকাজালে সূর্যকিরণ চিরদিন আচ্ছন্ন হয়ে থাকতে পারে না। মিথ্যার রাজবেশ ছিন্ন করে দীন-সত্য একদিন আপন মহিমাবলে রাজমুকুট পরিধান করে। ব্রুনো, গ্যালিলিও, সক্রেটিস তাইতো আজও মরিয়াও মরেনি।
   বঙ্গভূমিতে এক নতুন ঊষার পদধ্বনি অনুরণিত হল। ইংরেজি ১৭৭২ সাল তখন। জন্ম হল রামমোহনের এক নতুন সূর্য রূপে।
     রক্ষণশীল সমাজ, ক্ষত-বিক্ষত দেশ, তাঁর দীন-দুখী মানুষজন, আর তাদের মধ্য থেকে জেগে ওঠা সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের পরিবেশ রামমোহনের শিশুবেলাকে দৃঢ়-কঠিন ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেদিনই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছিল – এই শিশু একদিন বড় হয়ে জগতের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, যুক্তির কষ্টিপাথরে সে সবকিছু যাচাই করে নেবে।
    মাত্র ৯ বছর বয়সেই তাঁকে আরবি ও ফারসি শিক্ষার জন্য পাটনায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। তখন সরকারী কাজকর্মে এই দুটো ভাষারই বেশি প্রাধান্য ছিল। পাটনায় গিয়ে মুসলিম সুফি সাধকদের ধর্মমত তাঁর খুব ভালো লেগে গেল। এই ভাল লাগার কারণেই পরবর্তীতে তাঁর ধর্মভাবনা, পোশাক-আশাক এমনকি খাওয়া-দাওয়াকেও প্রভাবিত করেছিল। এই ভাবনাই তাঁর ভেতরে বোধের উন্মেষ ঘটিয়েছিল যে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।
  মাত্র ১২ বছর বয়স যখন, তিনি কাশীতে চলে গেলেন ধর্ম শিক্ষার জন্য। ফিরে এলেন এক নতুন মানুষ হয়ে। নিজের ধর্ম বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে সোচ্চার হলেন পুতুল পূজোর বিরুদ্ধে। এতেই ক্ষান্ত হলেন না, একটা বইও লিখে ফেললেন এর উপর। আর এরই জেরে পিতা রামকান্ত তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
    ঋজু মেরুদণ্ড ভেঙে পড়লো না, নুয়েও পড়লো না। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছলেন তিব্বতে। সেখানে দেখলেন – ‘লামা’ নামে একজন মানুষকে মানুষেরা দেবতা বলে পুজো করছে। শুনলেন – ‘লামা’ নাকি পৃথিবী চালাচ্ছেন, সূর্য-চন্দ্র ওঠানো-নামানো করছেন। রামমোহন এর তীব্র বিরোধিতা করলে তিব্বতীরা মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে। শেষে এক মহিলার সাহায্যে তিনি প্রাণে বাঁচলেন। সেই থেকে মহিলাদের প্রতি তাঁর খুব উচ্চ ধারণা গড়ে উঠেছিল। এই ধারণাই পরবর্তীতে তাঁকে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল হতে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ করেছিল।
   এই দৃঢ় চিত্তের মানুষটির চাকরি জীবনের শুরুতে একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেছিল। ইংরেজ সাহেবরা এদেশীয় কর্মচারীদের সঙ্গে যতই তাদের গুণ থাকুক, সম্মানের সাথে ব্যবহার করতেন না। রামমোহন ডিগবি সাহেবের অফিসে কেরানীর চাকরি নিতে গিয়ে শর্ত আরোপ করলেন – ‘সামান্য কর্মচারীদের যখন-তখন যেভাবে হুকুম করা হয় তাঁকে সেভাবে করা যাবে না। সাহেবের কাছে তিনি এলে তাঁকেও সম্মান করে চেয়ার দিতে হবে, রীতি মেনে অন্যান্য এদেশীয় কর্মচারীদের মতো তিনি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না।’ কিন্তু ডিগবি গুণীর কদর করতে জানতেন। তিনি রামমোহনের যোগ্যতা এবং সৎসাহস দেখে সানন্দে তাঁর দাবি মেনে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর কাজে ও যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অল্প দিনের মধ্যেই নায়েবের পদ দিয়েছিলেন। এখন থেকে আর মনিব নয়, রামমোহন ডিগবির খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন।
   ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ, চাকরি থেকে অবসর, কলিকাতায় আসেন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে। কতিপয় বন্ধুর সাহচর্যে ‘আত্মীয়সভা’ স্থাপন করেন। শুরু হয় জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রাম। লক্ষ্য স্থির, সহমরণ প্রথা নিবারণ করতেই হবে। নিরলস প্রচেষ্টা চলতে থাকল। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর এবং তাঁর বন্ধু ডেভিড হেয়ারের চেষ্টাতে এদেশীয়দের মধ্যে একদিকে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলিত হয়, আরেকদিকে তিনি বাংলা ব্যাকরণ, ভূগোল প্রভৃতি রচনা করে বাংলা সাহিত্যের উন্নতিবিধানে মনোযোগী হন। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ‘কৌমুদী’ নামে বাংলা সংবাদপত্র বের করে সংবাদপত্র প্রকাশের পথ প্রদর্শন করেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করেন ‘ব্রাহ্মসমাজ’। তিনি সব ধর্মের সংকীর্ণতা দূর করবার পথ দেখালেন। সময় তিনি নষ্ট করেননি। শিখেছিলেন বাংলা, ইংরেজি, পারসি,আরবি,ফ্রেন্স,হিব্রু ও গ্রিক ভাষা। মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা লাভ করবার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
      অশেষ প্রচেষ্টার ফল বিফলে যায়নি। অবশেষে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সহায়তায় রাজবিধির বলে ‘সহমরণ’ প্রথা নিবারণ হল।
      এখানেই শেষ নয়। দেশের গরিব প্রজাদের দুঃখে রামমোহনের বিশাল হৃদয় সর্বদাই কেঁদে উঠত। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস, ভারতবাসীর মধ্যে তিনিই প্রথম, এদেশের দুঃখী প্রজাদের কথা ইংল্যান্ডের পার্লিয়ামেন্ট সভায় জানাতে ইংল্যান্ডে রওনা হন। তাঁর আর ফেরা হয়নি। গুরুতর মানসিক পরিশ্রম করে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টম্বর মস্তিষ্কপ্রদাহ রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাগত হলেন। ২৭ সেপ্টম্বর রাত ২.৩০ মিনিটে ব্রিস্টল শহরে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হলেন। ইংল্যান্ডবাসী বন্ধুগণ কাঁদলেন। কেননা, তিনি তো তাদেরও আপনজন হয়ে উঠেছিলেন।
     বহুমুখী কর্মকাণ্ডের এই মানুষটির সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন শুধু নিজের দেশেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারেও। তিনি দেশকে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন, সমকালের প্রবাহে অতীতকে পরিশ্রুত করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন অমানিশার অন্ধকার দূর করে নতুন ভোরের আলো প্রস্ফুটিত করতে।
    শপথ করি, আসুক যতই বাধা, তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে, তাঁর উত্তরসূরীদের পাথেয় করে আমরা আমাদের লক্ষ্যে এগিয়ে চলব। তাঁর ২৫০ তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের এইটুকুই শ্রদ্ধার্ঘ্য ।