১৬ অক্টোবর,২০১৮ উত্তর সম্পাদকীয় বিভাগে শিক্ষক মহম্মদ আবু সাঈদের প্রশ্ন প্রসঙ্গেঃ

তিনি প্রশ্ন করেছেন – শিক্ষাঙ্গন বারবার এত অশান্ত হয়ে উঠছে কেন ? তিনি আরও প্রশ্ন করেছেন – এরা (শিক্ষকরা ) কি কোনও চোর,ডাকাত বা দেশদ্রোহী ?
প্রশ্নের উত্তরও তিনি দিয়েছেন । যথাযথ কিছু বলার চেষ্ঠা করেছেন । আমি আরও কিছু সংযোজন করতে চাই । তিনি বলেছেন – সমাজ আজ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত । আমার প্রশ্ন – এই অবস্থায় পৌঁছাল কেন ? কেন আজ শিক্ষকদের উপর জনরোষ তৈরি হচ্ছে ? কেন বারবার যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠছে  ?
 শিক্ষকতা জীবনের এক মহান ব্রত । শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর । সেই মানুষ সমাজ,সভ্যতা গড়ে,উন্নত রুচি-সংস্কৃতির জন্ম দেয় । আমরা অতীতের অনেক মাস্টেমশায়ের নাম শুনেছি যারা স্নেহ-মমতা-ভালবাসার বাঁধনে বেঁধে শিক্ষা দিতেন,শিক্ষার্থীদের দেশাত্মবোধের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতেন । আমরা আমাদের শিশুবেলায়ও দেখেছি কত যত্ন সহকারে,কত আন্তরিকতার সাথে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ শিক্ষা দিতেন,আমাদের সন্তানের চোখে দেখতেন । শাস্তিও দিতেন যা আমাদের কাছে আর্শীবাদ হয়ে উঠত । আমাদের মা-বাবাও মনে করত শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ যা করছেন তাদের সন্তানদের মঙ্গলের জন্যই করছেন । তাইতো সেদিনের সমাজ রামমোহন,বিদ্যাসাগর,বিবেকানন্দের মতো বড় মানুষদের জন্ম দিতে পেরেছে,বঙ্গভূমি কত বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে । আজ সেই বঙ্গভূমি বন্ধ্যা কেন ?
আজ তো সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে,বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে,লন্ঠনের বদলে বিজলী বাতি এসেছে । তবে কীসের অভাব ? নমস্য শিক্ষাদাতা-দাত্রীগণ কেন তাদের যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ? একজন শিক্ষক হিসাবে আমি প্রথমে শিক্ষকদের কিছু সমালোচনা করছি । হ্যাঁ,ভালো শিক্ষক এখনও আছেন,তবে সেই সংখ্যাটা অতি নগণ্য । মহম্মদ বাবু সাইদ বাবু যথার্থই বলেছেন – আজও ছাত্র-ছাত্রীরা ঘিরে ধরে তাদের প্রিয় শিক্ষিকাকে বাচায়,প্রিয় শিক্ষক বদলি হতে গেলে তাঁকে ঘিরে ধরে যেতে না দেওয়ার পণ করে । কিন্তু বিপরীত চিত্রটা মারাত্মক,বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে অতি মারাত্মক ।
একঃ বৃহৎ অংশের শিক্ষক-শিক্ষিকা আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করেন না,তাঁরা আসেন চাকরি করতে,সময় পুজাতে ।
দুইঃ সময়মতো বিদ্যালয়ে আসেন না,নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে যান নানা অজুহাতে ।
তিনঃ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দু-তিন জন একসাথে বসে গল্পে মজে ওঠেন । মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি । গল্পে ওঠে পরিবার,রান্নাবান্না,বাড়ির সাজসজ্জা,পোশাক-আশাক ইত্যাদি ইত্যাদি ।
চারঃ পাঠদানে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি থাকে না,লেশনপ্লান থাকে না,ফলে পাঠদান হয় দায়সারা ।
পাঁচঃ কোন এক শিক্ষক জরুরী প্রয়োজনে আজ টিফিনে চলে গেলে কাল থেকে শুরু হয় অপ্রয়োজনে বাকিদেরও একে একে টিফিনে যাবার পালা ।
ছয়ঃ ক্লাসে বসে মোবাইল ফোনের ব্যবহার এবং তা বিনোদনের জন্য ।
সাতঃ কোনো শিক্ষার্থী শিশু কাছে এসে স্পর্শ করলে অথবা জড়িয়ে ধরলে কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়াঃ ছি!ছি! তোর গায়ে কী নোংরা ! ভালো শাড়িখানায় নোংরা লাগিয়ে দিলি ? সেই শিশুটি মুখ কালো করে ঘৃণা,অপমানে চুপসে যায় ।
আটঃ শিক্ষক তাঁর নিজের ছেলেটিকে বা মেয়েটিকে নিজের স্কুলে পড়ান না কিন্তু ভর্তি করে রেখেছেন,পড়ে সে প্রাইভেট স্কুলে । আবার কোনদিন তাকে বেড়ানোর ছলে নিজের স্কুলে নিয়ে এলেও সে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বসে না,বসে মায়ের (শিক্ষিকার ) পাশে অন্য চেয়ারে । মা কিন্তু সেদিন নিজের ছেলেটিকে যত্ন নিয়ে পড়ান,অন্য ছেলে মেয়েরা হা করে তাকিয়ে থাকে । সব থেকে দৃষ্টি কটু লাগে যে,সরকারী সাহায্য যা আসে যেমন পোশাক,জুতো-মোজা ইত্যাদি সেগুলো নিজের ছেলের জন্য বেছে বেছে আগেই ব্যাগে ভরে নেন ।
নয়ঃ বাসে-ট্রেনে যে শিক্ষকগণ (ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের বেশির ভাগই শিক্ষক ) যারা যাতায়াত করেন তাদের জন্য অন্য যাত্রীরা বসার সীট পায়না, চেন সিস্টেমে আগেই বুক হয়ে যায় । আবার অসুস্থ বা বয়স্ক যাত্রীকেও সীট ছাড়তে নারাজ । সাধারণ যাত্রীরা এই নিয়ে প্রায়ই ক্ষোভ উগরে দেয় ।
দশঃ মিড-ডে-মিল,অনুদান,ড্রেস,নানা ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ-এর ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিনিয়ত । লোভ অতিলোভে পরিণত হয়েছে । এর সাথে শৃঙ্খলে যুক্ত হয়ে আছে নানা স্তরের কর্মকর্তারাও । সাধারণ মানুষ তাই আজ আর শিক্ষকদের ভালো চোখে দেখেন না,সামান্য ঘটনাও সহ্যের বাইরে চলে যায় । শিক্ষকদের ব্যক্তিগত জীবন এখন একটা বড় ঈর্ষার কারণ । বর্তমানে প্রায় নিরানব্বই দশমিক নয় জন শিক্ষকদের স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকুরিরত । আজ কোনো বেকার ছেলে শিক্ষক হয়ে গেলে তিনি চাকুরিরত পাত্রী খোঁজেন,একই ভাবে শিক্ষিকা চাকরিরত পাত্র খোঁজেন । এর উপর প্রাইভেট টিউশনতো আছেই । টাকা,চাই আরও টাকা । এখন বিষয়টা হল-এর কোন প্রতিকার নেই । স্রোতের অনুকূলে চলতে পারলেই সাতখুন মাপ ।
এগারঃ বয়েস অল্প । এধার-ওধার করে কিংবা মেধার জোরেই মাস্টারিটা পেয়ে গেছেন । এখন আবার বড় চাকরি পাবার জন্য ক্লাসে বসেও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন । ছাত্ররাও নিজেদের খেলা আর হৈ হট্টগোলে ব্যস্ত । ওরা গোল্লায় যাক,নিজেদের হলেই হল ।
 এবার একটু গোড়ায় গলদটা দেখে নিই ।
 একঃ আজকের বেকারত্বের যুগে একটা চাকরি পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর ।যার টিচিং ভাল লাগে না সে ভাগ্যবরাত টেট পাশ করে টিচার হয়ে গেছে/যাচ্ছে ।
 দুইঃ অনেক যুবক-যুবতী (অধিকাংশ স্বচ্ছল ঘরের) টাকার জোরে বি.এড./ডি.এড/পি.টি.টি আই ইত্যাদি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে (মূলত সার্টিফিকেট কিনে) শিক্ষকের গুণাবলি না থাকলেও শিক্ষক হয়ে গেছে ।
তিনঃ একটু গল্পের ছলে বলি,এভাবেও চাকরি হয়েছে – গৃহবধু,দশ/বারো বছর ধরে বইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই । স্বামী H.S টিচার । মনে সাধ জাগল – স্ত্রীকে দিয়ে চাকুরি করাবে । প্রাইমারী টিচার নিয়োগের বিঞ্জপ্তি বেরোল । ব্যাঙ্কে গিয়ে ৩টি ফর্ম তুলে নিয়ে এল । ফর্মের নাম্বারই রোল নাম্বার (কিছু কাল আগের কথা) । প্রথমটি স্বামীর,২য়টি স্ত্রীর,৩য়টি স্বামীর বন্ধুর নামে (H.S Teacher) । পূরন করা ফর্ম জমা পড়ে গেল । মাঝে বসবে স্ত্রী । স্বামী আর বন্ধুটি তাকে সাহায়্য করবে । টেট পাস করে স্ত্রী চাকরিও  পেয়ে গেল । গল্প হলেও সত্যি,প্রমান করা যাবে না ।
চারঃ দলতন্ত্র,সজন পোষণ,Give and take policy, যেদিন থেকে এই সুবিধা বা কামিয়ে নেবার রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করেছে সেদিন থেকে আদর্শবান শিক্ষকেরও অভাব সৃষ্টি হয়েছে ।
ভোট সর্বস্ব রাজনীতি কীভাবে শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছেঃ- (মহম্মদ আবু সাইদ বাবু কিছুটা তুলে ধরেছেন) 
একঃ পরিদর্শকগণ এখন নানান কাজের চাপে পড়ে বিদ্যালয়ে কমই আসার সুযোগ পান । যদিও বা আসেন স্থানীয় কোন নেতাকে সঙ্গী হিসাবে দেখা যায় । 
দুইঃ কখনও কোনো শিক্ষক টার্গেট হলে নেতার হুকুমে পরিদর্শক তাকে শো-কজ করেন ।
তিনঃ পরিদর্শক দেখেন শুধু শিক্ষকদের উপস্থিতি,চালেরস্টক,ছাত্র উপস্থিতি,মিড-ডে-মিল সংক্রান্ত তথ্য ।
চারঃ পরিদর্শনের কাজটি এখন শিক্ষাবন্ধুরাই সেরে নেন স্বশরীরে বা ফোনে ফোনে ।
পাঁচঃ এস.আই সাহেব (Sub.Inspec) স্থানীয় নেতাদের আজ্ঞ বহ দাসে পরিণত হয়েছেন,এমনকি তিনি তাঁর অফিসের প্রভাবশালী করণিকের নির্দেশ মেনেও চলেন । ফলে শিক্ষকের ছুটি,ম্যানেজ (আজ স্কুলে না এলে কাল এসে সই করা),অন্যান্য সুবিধা নেওয়া অত্যন্ত সহজ । তবে শিক্ষকদেরও নেতার আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হয় । এর ফলে পঠন-পাঠনের মানটা গৌন হয়ে দাঁড়ায় । 
ছয়ঃ ছাত্র উপস্থিতি কমে গেলে আধিকারিকরা পরামর্শ দেন (আসলে উপরের নির্দেশ) খাতায় উপস্থিতি বাড়িয়ে দেখতে,কেননা-ড্রপ আউট দেখানো যাবে না । 
পাঁচঃ রেজাল্টে কাউকে ‘০’ পাওয়া দেখানো যাবে না । উত্তর পত্র কারেকশান করে একটা সন্তোষজনক নাম্বার পাইয়ে দিন,প্রয়োজনে নাম্বার বা উপস্থিতি বাড়িয়ে দিন ইত্যাদি ইত্যাদি । ফলস্বরূপ অভিভাবকগণ খুশি হচ্ছে কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে । আবার এক শ্রেণির শিক্ষকও এর ফলে ফাঁকিবাজ তৈরি হচ্ছে ।
ছয়ঃ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রটা আরও ভয়াবহ । সারাবছর ধরে বিভিন্ন ফর্মাট পূরণ,মিটিং,ভোটের তালিকায় নাম তোলা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকার ফলে পাঠদানটা শিকেয় তোলা থাকে । যদিও জনরোষটা এসে পড়ে শিক্ষকদের উপরই ।
বাস্তব পরিণতিটা তাহলে কী ?

একঃ এমনিতেই পাঠ্য বইগুলো আজগুবি গল্প আর অন্ধবিশ্বাসে পরিপূর্ণ । তার উপর গরিবের ছেলেমেয়েদের ক্ষুধার অন্ন ছাড়া পড়াশুনা বলতে কিছু হয় না । ফলে একটা শ্রেণি বিভাজন তৈরী হয়েছে । একদিকে স্বচ্ছলতা,শিক্ষা,চাকুরি,সমস্ত সুযোগ বিদ্যমান । আরেক দিকে ঘন অন্ধকার,অবহেলা,শুধু একটু দয়া-দাক্ষিন্য তাও হীন স্বার্থের বিনিময়ে । সর্বোপরি রুচিহীন,অপসংস্কৃতিময় ক্ষমতালোভী রাজনীতির অনুপ্রবেশ যেন আগুনে ঘি ঢালা । আর তাতেই শিক্ষাঙ্গন বারবার অশান্ত হয়ে উঠেছে । 
দুইঃ সরকারি স্কুলে শিক্ষা হচ্ছেনা এই অজুহাতে গজিয়ে উঠেছে আনাচে-কানাচে প্রাইভেট স্কুল । কিছু স্বার্থান্বেষী হীন-মানসিকতার মানুষ শিক্ষা বেচে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে । তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে আছেন উপর মহলের প্রভাবশালীরা,তাঁরা চান চাষার ছেলে চাষাই হোক,মজুরের ছেলে মজুর,বরং ওদের ঘর থেকে মেঘনাদ সাহারা জন্ম না নিলেই ভালো । এভাবে সুকৌশলে শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে দেশের মালিকদের হাতে তুলে দেবার রাস্তাটাও প্রশস্ত হচ্ছে ।
তিনঃ যৌনতাকে শিশু বয়স থেকেই গা-সাওয়া করে তোলা হচ্ছে,এই পণ্য বেচে ভালোই মুনাফা আসবে। এখন বিদ্যালয়ে ন্যাপকিন দিচ্ছে । আস্তে আস্তে গর্ভনিরোধক বড়ি ও কনডোম দেওয়া হবে,সেই দিন হয়তো সামনেই আসছে ।