‘পাতে ইলিশ ভাতে সই’

১৯/০৭/২০১৮
-হরবিলাস সরকার  (8900383592) 


সুপ্রিয় সন্ধ্যা,
           ভোজনপ্রিয় বাঙালির খাদ্যের তালিকায় প্রথমেই আছে ভাত আর মাছ । সেই মাছ যদি ইলিশ হয় – স্বাদে,গন্ধে আঃ কী যে অতুলনীয় !
           কিন্তু বর্তমানে অগ্নিমূল্যের বাজারে যেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত এমন কি মধ্যবিত্তরাও ইলিশকে পাতে তুলতে হিমশিম খায়,সেখানে গরিব,দীন-দঃখীদের পাতে ইলিশ উঠবে কেমন করে ?
           ওগো সন্ধ্যা,আমি নাহয় সেই দীন-দুঃখীদের কথাই বলি ।
           অনেক স্বপ্ন নিয়ে জীর্ণ কুঁড়েঘরের ছায়াতলে দিন কাটে মানিকগঞ্জের বছর বারোর মেয়ে পার্বতী আর তার ভাই বীরুর । বর্ষার ইলিশের কথা ওরা শুনেছে । তাই বুঝি খেতে বসে প্রায়ই মাকে বলে – মা,ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাব । খু-উ-ব ইচ্ছে করে । রোজ রোজ সেদ্ধ,ভাজা-পোড়া আর ভালো লাগে না । বাক্ রুদ্ধ হয়ে আসে মায়ের,অসহায়-অবলার মতো ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । নিজের মনকে ধিক্কার জানায় – হায়রে ! বিধি,আমি এক নিষ্ঠুর মা,এক খন্ড ডিমও মুখে তুলে দিতে পারি না,ইলিশ ! আমার সাধ্যের অতীত । মায়ের দুঃখ বোঝে পার্বতী আর ছোট্ট বীরু ।
           বাংলার বুকে বন্যার আতঙ্ক নিয়ে মুশলধারে বৃষ্টি নামল । ওদিকে ইটভাটির মালিক তথা পঞ্চায়েত প্রধান অঘোর নন্দীর একমাত্র নাতির ঘটা করে অন্নপ্রাশন । বাস-মতী চালের ভাত আর ইলিশ মাছ হবে,বাঃ বাঙালি-অভিজাত্যের ঐতিহ্যের এক অমোঘ মেলবন্ধন । অপ্রত্যাশিতভাবে মায়ের সেখানে এঁটো ফেলার কাজটা জুটে গেল ।
           তারপর নির্ধারিত দিনে যথাসময়ে মা সেখানে পৌঁছে গেল । রাত নেমে এল যখন পৃথিবীর পরে , মায়ের অনুমতি ছাড়াই,বিনা নিমন্ত্রনে বীরু-পার্বতীও হাত ধরাধরি করে সেই বাড়ির কানাচে গিয়ে হাজির হল । সংগীতের মূর্ছনা আর আলোর রোশনাইয়ে ভরে উঠেছে সুশোভিত গোটা বাড়িটা । সাহস হচ্ছিল না ভেতরে ঢোকার,তাই আলো-আঁধারি ছায়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল দুজনে । কে একজন এসে ভিখারি ভেবে ধমক দিয়ে চলে গেল । একটু পরে মা ডাস্টবিনে এঁটো ফেলতে এসে দেখল – ভিখারি নয়,ওরা তাঁরই ছেলেমেয়ে । বুকের ব্যাথা পাথরচাপা দিয়ে সে তাঁর কাজে মন দিল ।
           রাত ক্রমে গভীর হল । অনুষ্ঠান বাড়ী সুনসান হয়ে এল । মা নিজের খাবারটা শালপাতায় করে নিয়ে এসে ডাক দিল – কইরে মানিক,মা আমার,আয়,নে,খেয়ে নে ।
           অদূরে ডাস্টবিনে সারমেয়দের দল তখনও ঝগড়া,কাড়াকাড়ি করে উপাদেয় ইলিশের উচ্ছিষ্ট উদরসাৎ করতে ব্যস্ত । যে খুবই দুর্বল,সে বঞ্চিত হচ্ছে বারবার,তবু চেষ্টা করছে প্রাণপণ ।
           বীরু খিদের যন্ত্রনা সহ্য করেও এক দৃষ্টে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল । পার্বতী ভাইকে টেনে নিয়ে এসে বসে পড়ল খোলা আকাশের নীচে । কিন্তু খাবার মুখে তুলতে পারল না । তাঁর অন্তর্যামী তাকে বলে দিল – ওরে হতভাগিনী মেয়ে,তোর মা-ও-যে উপবাসী । ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে পার্বতী, ‘মা,মাগো,তুমি খাওনি,জানি আমি । বসো মা,এই খাবারেই হয়ে যাবে ।’
           বীরু ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে । ইলিশের রকমারি পদ আর দামী চালের ভাত এই প্রথম চোখে দেখা । কত তৃপ্তির খাওয়া ! মনের সাধ পূরণ হয়েছে ।
           মায়ের অশ্রু ঝরে পড়ে পথের ধুলায় । ফেলে আসা স্মৃতিগুলো এই বেলায় নির্মম হয়ে ভেসে উঠেছে । ছেলেমেয়েদেরে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিল । স্কুলের খাতায় ওদের নামটা শুধু লেখা আছে । কত আশা ফিরে ফিরে এসে জমে নিরাশার গৃহে । ওদের বাবাও কাছে নেই,দিনমজুরির কাজে রাজস্থানে গিয়েছে । কবে ফিরবে,জানে না মা । জীবনটা তাঁর দুঃখময়, তবু থাকনা সব দুঃখ পর্বতচাপা ; আজ যে পরম সুখ ! পরম শান্তি !