Asahay Bicharer banee – অসহায় বিচারের বাণী

ছোট গল্প 

(কল্পনাপ্রসূত )

(বাস্তবে এমন না ঘটুক)    

পূর্ব আকাশে তখনও আলোর রেখা ফুটে ওঠেনি। তবু ভোর হতে বেশি দেরী নেই। পাখিরা এসময় ঘুম-ভাঙানো গান ধরে। আজ তারা শোকে বিহ্বল। ভাগীরথীর পাড়ে বৃক্ষরাজি নীরবে দাঁড়িয়ে। অদূরে খুপড়ি ঘর থেকে ভেসে আসছে এক অসহায় মায়ের করুন আর্তনাদ। তার যুবতী মেয়েকে চার যুবক নিশুতির প্রহর থেকে বলপূর্বক নির্যাতন করে জীবনটাও কেড়ে নিয়েছে। তারপর নিথর দেহটাকে নিভৃত নদীর পাড়ে টেনে এনে চিতা সাজিয়ে উল্লাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।


খুপড়ির ভিতরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মা। তার আর্তনাদ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্রাতঃভ্রমণকারী পথিকেরা যখন ছুটে এলো তখন আধপোড়া মৃতদেহটাকে ফেলে রেখে যুবকেরা চম্পট দিল। এমন সময় রাতের টহলদারী পুলিশের গাড়িটা ডিউটি শেষে পাশের রাস্তা ধরে ফেরার পথে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তারপর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেল।


ভোরের সূর্য উঠলো এক দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে। মা থানায় গেল। পুলিশের লোকেরা উল্টে অভব্য গালাগালি দিয়ে দোষারোপ করে তাড়িয়ে দিল। জনপ্রতিনিধিদের দুয়ারে গেল। তারাও গুরুত্ব দিলো না। যদিও তড়িঘড়ি পুলিশ এল। আধপোড়া দেহটাকে নিয়ে চলে গেল।


অভাগিনী যেদিকে যায়, বিপদ পিছু পিছু ধায়। ওত পেতে থাকা ওই চার যুবক তার পথ আটকে দাঁড়ালো। “ফল ভালো হবে না, তোকেও মেয়ের মতোই জ্বালিয়ে দেবো”, এই বলে শাসিয়ে চলে গেল।


দিন শেষ হয়ে নেমে এলো রাত। রাতের পরে আবার দিন। চোখের জলে মা আবার উঠে দাঁড়ায়। মরা শরীরে মরণের ভয় কী? বিচার চাইতে শেষে গেল আদালতে। এগিয়ে এলেন এক সহৃদয় আইনজীবী। কাঠগড়ায় দাঁড়ালো মা। “হুজুর, আমি বড় অসুস্থ, অসহায়, সন্তানহারা এক বিধবা মা। একটাই মেয়ে ছিল। মেয়ে আমার লোকের বাসায় কাজ করে আহার জুটাতো।…… ” বাকিটা আর বলতে পারলোনা। বাঁধভাঙা প্লাবনের মতো অশ্রু নেমে এলো দু’গাল বেয়ে। আইনজীবী বাকিটা বলে দিলেন। বিচারক শিউরে উঠে শোকে বিহ্বল অসহায় মায়ের মুখের দিকে কোমল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর পুলিশের কর্তাকে ডেকে অভিযুক্ত যুবকদের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন।


গ্রেফতার হল চার যুবকই। পরদিন কোর্টে তোলা হলো। মা ‘গীতা’ ছুঁয়ে শপথ করল, “যা বলবো সত্য বলবো, মিথ্যা বলবো না।” এরপর তার আইনজীবী জিজ্ঞেস করলেন, “মা, এই যুবকদের চিনতে পারছেন? এরাই কি আপনার মেয়ের নির্যাতনকারী এবং হত্যাকারী?” “ হ্যাঁ বাবা, চিনতে পারছি। এরাই আমার মেয়ের নির্যাতনকারী এবং হত্যাকারী।” বিপক্ষের আইনজীবী প্রশ্ন করলেন, “ আপনি নিশুতির অন্ধকারে কীভাবে চিনলেন – এরাই সেই যুবক যারা আপনার মেয়েকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে?” “ বাবাজী, এরা সকলেই আমার চেনা মুখ। মেয়ের মুখ থেকে এদের নামও শুনেছি। ভোলা, পরেশ, বাবলু আর জাফর। প্রায়ই রাস্তাঘাটে আমার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতো। নানা অছিলায় আমার বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ত। দুদিন আগে ওরা গভীর রাতে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। দুজন আমার মেয়েকে ধরে ওর মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে। আর দুজন আমার মুখ, হাত-পা বেঁধে ফেলে। ওদের গলার আওয়াজ আমার চেনা ছিল। তাছাড়া ভাঙ্গা টালির চালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় ওদের মুখ গুলো বেশ বোঝা যাচ্ছিল।” “ আপনার মুখ তো বাঁধা ছিলো, চিৎকার করলেন কী করে?” “ চোখের সামনে মেয়ের নির্যাতন হচ্ছে, সহ্য করা যায়? ছটফট করতে করতে একসময় বাঁধনটা একটু আলগা হয়ে গেল, অবশ্য মেয়ে আমার ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে। নির্যাতন করেও ওরা ক্ষান্ত হলো না। গলা টিপে মেয়েটাকে মেরে দিল। তারপর টানতে টানতে নিয়ে গেল। তখনই আমি চিৎকার করি।”এবার বিচারকের দিকে তাকিয়ে মা বলল, “ হুজুর,আর একটা কথা আমি বলতে চাই।” বিচারক অনুমতি দিলেন। “ঘটনার পরের দিন আমি যখন একটু সাহায্যের জন্য রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরছিলাম,ওরা আমার পথ আটকে ধরে আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিল।”


মায়ের আইনজীবী বিচারকের উদ্দেশ্যে বললেন, “ মহামান্য আদালত,এই চার যুবক অর্থাৎ ভোলা,পরেশ ,বাবলু ,জাফরই যে এই নিকৃষ্টতম অপরাধ সংঘটিত করেছে তা প্রমাণিত। অতএব , এদের দোষী সাব্যস্ত করে উপযুক্ত শাস্তি ঘোষণা করা হোক। ”


বিপক্ষের আইনজীবী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “মেলট, আমার প্রতিপক্ষ আইনজীবী বন্ধু যে চার যুবককে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির দাবী জানালেন ,তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা, এখনও চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক বাকি। মেলট,ওই চার যুবককে চিনতে মায়ের ভুল হয়েছে। এখন ভেতরের অসহনীয় যন্ত্রণা জুড়াতে তিনি হৃদয়মর্মস্পর্শী কাহিনী তৈরি করে এই যুবকদেরই উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন।” বিচারক প্রশ্ন করলেন , “আপনার এমনটা মনে হল কেন ?” “কেননা, এই চার যুবক ঘটনার অনেকদিন আগে থেকেই এক কন্ট্রাক্টরের অধীনে একটি ব্রীজ তৈরীর কাজে বাইরে ছিল। কর্মস্থলটি এখান থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে। এবং যে রাতে ঘটনাটি ঘটে তার পরদিন ছুটি পেয়ে দূপুরে এরা বাড়ি ফেরে। তার উপযুক্ত প্রমাণ আমার কাছে আছে। এই নিন,এখানকার বিধায়কের স্বামীর চিঠি।” বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, “এই চিঠিতে কী প্রমাণিত হবে ?” “মেলট,মাননীয়া বিধায়ক সুজাতা রায় চৌধুরীর স্বামী কৃষ্ণগোপাল রায়চৌধুরী, একজন নামী কন্ট্রাক্টর। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন যে ,এই চার যুবক ঘটনার সময়ে ব্রীজ তৈরীর ডিউটি পালন করছিল।” “কৃষ্ণগোপাল রায়চৌধুরী এজলাসে হাজির আছেন ?” না মেলট,তিনি ব্যস্ত মানুষ। তাঁর সাক্ষ্যর প্রয়োজন হলে তাঁকে আগে থেকে জানাতে হবে।”


বিচারক পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য্য করে আজকের মতো বিচারসভা মুলতুবি ঘোষণা করলেন।


ঠিক দু’দিন পর কৃষ্ণগোপাল গভীর রাতে তাঁর একান্ত অনুগত অন্য দুই যুবক কর্মচারীকে নিয়ে তাঁর বাগানবাড়ির অন্দরে মদের আসর বসালেন। বিধবা মায়ের চার কাঠা ভিটেমাটির প্রতি তাঁর বহুদিনের লোভ। কিন্তু মা যে তা হাতছাড়া করবেনা। কৃষ্ণগোপালও তাঁর ইচ্ছা পূরণে মরীয়া। তাইতো যুবতী মেয়েটার দিকে কর্মচারীদের লেলিয়ে দিয়েছেন যাতে বাধ্য হয়ে বিধবা জলের দামে মাটিটা দিয়ে দেয়। সবকিছু সুকৌশলেই চলছিল বিধবাকে বুঝতে না দিয়ে। কিন্তু এভাবে কর্মচারীরা যে ধরা পড়ে যাবে তা ভাবতে পারেননি কৃষ্ণগোপাল। মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে মেজাজে বলেই ফেললেন, “ বোকা-হাঁদার দল, ওদের দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। পারলোনা ডেডবডিটাকে গায়েব করে দিতে? এখন ওটাকে নিয়ে ময়নাতদন্ত, কতকিছু হবে। নিশ্চিত ওরা দোষী প্রমাণিত হবে।” উপস্থিত দুই যুবকের একজন বলে উঠল, “ স্যার, “ আপনার তো অনেক ক্ষমতা, কেসটা যাতে অতদূর না গড়ায় পারেন না তার ব্যবস্থা করতে ?” কৃষ্ণগোপাল মনে মনে বললেন – আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য সেতো করবই । কোথায়, কার উপর ময়নাতদন্তের ভার পড়ে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। পরক্ষণেই যুবকদের বললেন, “ শোন্ , ওরা যে সেদিন রাতের অন্ধকারে এসে কাজ সেরে ফিরে গিয়েছিল সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ,তা আদালতে প্রমাণ হবে না। কেননা, আমার কর্মী-হাজিরা খাতায় ওদের সই আছে। ………..। এখন তোদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই ঘোষণা – কেউ যেন বেফাঁস কথা বলে না ফেলে ,এই কথাটা তোরা কাল পুলিশ কাস্টোডিতে গিয়ে ওদেরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে আসবি। আর বলবি – ভয় নেই, কৃষ্ণগোপাল স্যার তোদের পেছনে আছেন।” তিনি আরও বললেন, “ ফেরার সময় বিধবাকে একটু চমকে দিয়ে আসবি। ”


ঊনত্রিশ সেপ্টেম্বর ,2022 ,এই মামলার ফের শুনানি শুরু হল। মা প্রথমেই হাত জোড় করে জলভরা চোখে বিচারককে বলল, “ হুজুর, ওদের লোকজন এসে আবারও আমাকে ভয় দেখিয়ে গেছে । আমাকে প্রানে মেরে ফেলতে চাইছে। কিন্তু আমি মরতে ভয় পাই না। আমি মরে গেলেও শান্তি পাবো যদি আমার মেয়ের খুনিরা উপযুক্ত শাস্তি পায়।” আজ উপস্থিত হয়েছেন কৃষ্ণগোপাল রাযচৌধুরী। তিনি বললেন, “ মহামান্য আদালত, আমি কয়েকটি বিষয় আপনাকে বলবো। প্রথমত: যে নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার জন্য আমি অত্যন্ত ব্যথিত। দ্বিতীয়ত: যারা অসহায় বিধবা মাকে মৃত্যুভয় দেখাচ্ছে ,তাদের অপরাধ অমার্জনীয়। আদালত নিশ্চয় সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করবেন। তৃতীয়তঃ যে চার যুবককে ধরা হয়েছে তারা আমার কর্মচারী এবং ঘটনার দিন বেলা ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা,পুনরায় সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ওরা কাজ করছিল। হাজিরা-খাতায় ওদের প্রত্যেকের সই আছে। এই দেখুন সেই হাজিরা-খাতা।” হাজিরা-খাতাটা বিচারকের কাছে এগিয়ে দিলেন।


বিচারক তা খতিয়ে দেখলেন। তবুও যুবকদের জামিনের আর্জি খারিজ করে পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য্য করলেন এবং একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের হাতে মৃতদেহের ফরেন্সিক পরীক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করলেন ।


ফরেন্সিক পরীক্ষা হল। নির্ধারিত দিনে রিপোর্ট যখন আদালতে পেশ করা হল, বিচারক তার উপর মনোযোগ দিলেন এবং কিছুক্ষণ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি প্রকাশিত হলো তাঁর চোখে-মুখে। আজ শুনানির পর্বও শেষ হলো।


দু’দিন পর এলো চূড়ান্ত রায়দানের দিন। বিধবা মা সুবিচারের আশায় বিচারকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওপ্রান্তে ভরা শীতেও সেই মহামহিমের মুখমন্ডল ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর ঠোঁটদুটো কাঁপতে লাগল। অসীম বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।তবু জড়তার বাঁধ ভেঙে ঘোষণা করলেন , “ এই মামলায় উভয়পক্ষের সাক্ষ্য,তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ন্যায় বিচারে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে,ধৃত চার যুবক অর্থাৎ ভোলা ,পরেশ,বাবলু, জাফর সম্পূর্ণ নির্দোষ। অতএব, তাদের মুক্তি দেওয়া হল।


দূরের কোনো এক মন্ডপ হতে আগমনীর সুর ভেসে আসছে। বিচারক রুমালে চোখ মুছে কক্ষ ত্যাগ করলেন। প্রতিপক্ষের সকলে বিজয়োল্লাসে প্রস্থান করল। বাইরে বেরিয়ে চলতে থাকলো অসুরের আস্ফালন। ভেতরে মা তখনও তার আসনে বসে, যেন এক পাথর-প্রতিমা। তার আইনজীবী একেবারে কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, “ মা, পারলাম না তোমার চোখের জল মোছাতে। এমনি করেই তোমার মতো কত মা কাঁদে। হৃদয়ের যন্ত্রণা আদালত বোঝেনা। সে শুধুই প্রমাণ চায় – আসল হোক আর নকল হোক। কাল দেবীর বোধন। জানি, তোমার ভেতরে শুধুই বিসর্জনের ব্যথা, তবু যাও মা এবার ঘরে ফিরে।”