Achal Sabhyata – অচল সভ্যতা

অচল সভ্যতা

বাগানে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে । লাল নিশান টাঙানো হয়েছে। ঢুকতে মানা । জোর করে ঢুকলেও বিপদ । বাগানের ধার ঘেষে চলে গেছে জাতীয় সড়ক । বোজানো নয়নজলীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মরা গাছ । তার ডালে এক ঝাঁক পাখি বসে দুঃখের কথা বলাবলি করছে। “বৈশাখের এই খরতপ্ত রোদে আমরা কোথায় যাবো ?” “কী আর করবি বল ? বাগান যে এখন মালিকের দখলে ?” “তাই বলে মালিকের লোকেরা আমাদের বাসাগুলো ভেঙে দেবে ?” “ওদের আর দোষ কী ? ওরা যে মালিকের সেবাদাস, গোলাম । হুকুম না মানলে বেচারাদের কাজ ছাড়া যাবে,না খেয়ে মরবে ।” “ইস্ ! আমরা বুঝি না খেয়ে মরছি না। তার উপর বাসা হারিয়ে কী সুখে এই শুকনো ডালে বসে আছি । ……।”

পাখিদের আর্তনাদ শুনে ব্যাং,সাপ আরও নানাবিধ পোকামাকড় মরা গাছটার গোড়ায় এসে জড়ো হল ।

দুর্বিপাকে পড়ে তাদেরও আর কোন গতি নেই। ব্যাং চোখের জলে হাত জোড় করে সাপকে বলল, “ভাই, তুমি আমাদের খেও না।” সাপ উত্তর দিল, “নির্ভয়ে থাকো। তোমাদের মতো আমরাও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি । তাই এই দুঃসময়ে আমরা একে অপরের বন্ধু গো ।”

দুটো সারস উড়ে এসে বসল খাবারের আশায়। জলফড়িং করুন সুরে বলে উঠল, “সারস ,সারসী , তোমরা আজ আমাদের খেও না। আমরা বড় অসহায়। সারসের চোখে-মুখে বিস্ময় । “কিন্তু জলফড়িং, তোমাদের এই দশা হল কেন ?” “পুকুর,ডোবা,জলাশয় একে একে বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে । বাকি ছিল এই নয়নজলী, তাও ……।” শিয়াল হাসতে হাসতে এসে সারসের কথার তালে তাল মিলিয়ে বলল, “তাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন জানো ?” সারস মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, “না।” “এখানে দোকানপাট হবে। আর ঐ যে দেখছো – জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওখানে আবাসন তৈরি হবে।” সারসী এবার জানতে চাইল, “কিন্তু তুমি এ সব জানলে কী করে?” শিয়াল অট্টহাসি হেসে উঠল, “বা বা! সবাই আমাকে পন্ডিত বলে । উপাধিটা কি এমনি এমনি পেয়েছি?”

কালো এক দুগ্ধবতী গাভী এসে হাজির। সারস,সারসী তার লেজের দিকে এগিয়ে চলল। শিয়াল এবার আরও মজা করে বলে উঠল, “যাও,যাও। ভেবেছ লেজের চুলে উকুন পাবে, তাই না? কিচ্ছু পাবে না। শোনো, যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব বা জীবাণু আছে তারা সব লোকালয়ে চলে গেছে। শ্রেষ্ঠ জীবেদের গৃহে গিয়ে হানা দিচ্ছে।”

এমন সময় একটা বিকট আওয়াজ শোনা গেল। পাখি,ব্যাং,সাপ,গাভী সকলে ভয়ে কেঁপে উঠল। শিয়াল বলল, “ভয় পেও না, আমার মামা আসছে । বাঘ গো বাঘ । আমি আছি যখন, তোমাদের কাউকে ছোঁবেনা।”

বাঘ এসে হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “এ কি ভাগ্নে তুমি এখানে?” “না এসে আর উপায় কী? জানতাম তুমি এখানে আসবে। তাই একটু আগেভাগেই চলে এসেছি। যাইহোক, শোনো মামা, তুমি কিন্তু এদের কাউকে খাবে না।” “না রে বোকা, পেট আমার ভর্তি। যদিও পেট ভর্তি থাকলেও আমি খাই। তবে বুঝেছি – এরা মহাবিপদে পড়েছে। তাছাড়া আমিও এখন এদের মতোই দুর্ভাগা । সুন্দরবন এখন মনুষ্যজাতির পর্যটন কেন্দ্র। স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে পারছি না। খাবারেও টান পড়েছে। তাই বাধ্য হয়েই লোকালয়ে ঢুকে পড়ছি।”

উপর থেকে শালিক এবার বলে উঠল, “তাহলে চিড়িয়াখানায় চলে যাও না । বসে বসে খাবার পাবে ।” “না শালিক, বন্দী জীবন আমার ভাল লাগে না। এই যে দেখছো না গাভীকে । লোকেরা ওর গলায় বেড়ী পরিয়ে রেখেছে।”

শিয়াল এবার মুখ উঁচু করে বলে উঠল, “রাখবে না তো কী ? এক বিজ্ঞানীতো বলেছেন – “গরুর দুধে সোনা আছে।” বাঘ ভ্রু কুচকে, মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠল, “সোনা না, ছাই। ওটা বিজ্ঞানী নয়, আস্ত একটা নির্বোধ, খণ্ডমূর্খ ।”

একদল বানর আর হনুমান বাগানের দিক থেকে লাফাতে লাফাতে চলে এলো। বাঘ, শিয়ালকে দেখে থমকে দাঁড়াল। শিয়াল বললো, “মামা, মানুষের পূর্বপুরুষ। দেখো, কেমন তাড়া খেয়ে ছুটে এলো।” বাঘ একগাল হেসে বলল, “এই মানবজাতিটার বড় বিচিত্র ইতিহাস আছে। হ্যাঁ, মানছি ওরা জ্ঞানে-গুণে-বুদ্ধিতে বেশ বড়। তাই বলে পূর্বপুরুষদের প্রতি এত অবজ্ঞা ?”

বানর,হনুমানরা এবার গোল হয়ে বসে পড়ল । গাভী,শিয়াল,বাঘ বসে পড়ল। ব্যাং,সাপ,কীটপতঙ্গরা চুপ করে রইল। পাখিরা মনোযোগে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হনুমানদের মধ্যে যে বুদ্ধিমান, সে গোলের মাঝে এসে বসল। রীতিমতো এক সভা। সেই সভায় সে বলতে লাগলো, “রয়েল বেঙ্গল মহাশয় মন্দ বলেননি। মানুষ সভ্যতার আলো জ্বেলেছে ঠিকই। তবে এই মানুষই মানুষকে দিয়ে দাসত্ববৃত্তি করিয়েছে, মজুরবৃত্তি করাচ্ছে । আবার দেখুন – উঁচু-নীচু, ছোট-বড়, নানান জাতে বিভক্ত করেছে। অথচ গোড়ায় তো সেই সবাই জঙ্গলেই ছিল। সবচেয়ে মজার কথা হল – যে পবন-পুত্র হনুমান,সুগ্রীব বানর সেনারা রামচন্দের সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে এল, তাদেরই আবার দলিত করে রাখা হল। এককথায় বিশ্বাসঘাতকতা । আসলে সভ্যতার চাকাটা প্রথম থেকেই উল্টো পথে চালিত হয়েছে । লোভ আর হীন স্বার্থকে ওরা দমন করতে পারেনি। তাই এক দল আরেক দলকে আজও দমন করে চলেছে, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করছে। একজনকে ঠকিয়ে আরেকজন সুখী হতে চাইছে।”

বাঘ হনুমানের কথা থামিয়ে বলে উঠল, “ঠিক, সব ঠিক। এই যে দেখছো না, নয়নজলীটা যে দখল করেছে, কিছুকাল আগেও সে দিনমজুরি খেটেছে । যেই ভোটে জিতে গণ্যমান্য কর্তা হয়ে বসল, অমনি আলাদীনের আশ্চর্য বাতিটাও হাতে পেয়ে গেল । ঘষা মারে, আর প্রাসাদের পর প্রাসাদ বানিয়ে ফেলে।”


শিয়াল এত কিছু শোনার পর চিন্তিত মনে গম্ভীর হয়ে বললো, “সবই তো বুঝলাম মামা। বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে গেলে সব জীবেরাই তো মারা পড়বে। এ কথাটা কি ওই শ্রেষ্ঠ জীবেরা বোঝে না?” “না রে, বোঝে না। বুঝতেও চায় না।” “তাহলে উপায়?” “উপায় একটাই – এহেন আধুনিক পৃথিবীর সাত পুরু মাটি উপড়ে ফেলে আবার নতুন মানুষের চাষ করতে হবে।”


এমন সময় বুক ভরা ব্যথা নিয়ে কোকিল গেয়ে উঠল হৃদয়মর্মস্পর্শী গানঃ 
ভুল, সবই ভুল, এই সভ্যতার পাতায় পাতায় যা লেখা আছে সবই ভূল ।……।