Khad-Nikhad (খাদ-নিখাদ)

 

ছোট গল্প

             
                                     

নির্ঝরা এসে জিজ্ঞেস করল, “ দাদা, নির্ভেজাল বলে কোনো কিছু হয়?” হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে অপূর্ব’র কলমটা থেমে গেল। গল্পের শেষ লাইনটা লিখছিল। চায়ের কাপটা রেখে নির্ঝরা বলে গেল,  “খেয়ে নে। একটু পরে আসছি।” ভোরের সূর্যোদয় দেখতে দেখতে অপূর্ব ভাবছে, “ কেন এমন প্রশ্ন করল নির্ঝরা?

  কিছুক্ষণ পরে একটা জবা ফুল হাতে করে নিয়ে এসে নির্ঝরা এবার জিজ্ঞেস করল, “এটা সম্পূর্ণ ফুল। কিন্তু সত্যিই কি তাই?” অপূর্ব হাসলো। বললো, “না।” “কেন?” “ জবা ফুলের চারটি অংশ রয়েছে ঠিকই, সৌন্দর্যও আছে। কিন্তু সুগন্ধ নেই।” “তাহলে তোর ব্যাখ্যা অনুযায়ী এমন কোনো সম্পূর্ণ ফুল আছে কি?” “ নিশ্চয়ই আছে। খুঁজে নিতে হবে।”


নির্ঝরা যথার্থ উত্তর পেল না। তবুও অনুসন্ধিৎসু মন আবারও জানতে চায়,  “দাদা, আমরা বলি – আদর্শ পুরুষ, আদর্শ চরিত্র। এই আদর্শের মধ্যেও তো অপূর্ণতা থাকে, যা অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয়।”  “বোন, ভালো-মন্দ নিয়েই মানুষ। ভালো গুণগুলো ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকলে মন্দ ঢাকা পড়ে যায়, অর্থাৎ মন্দ ক্রমাগত ম্লান হতে থাকে। “ দাদা, তার মানে তো মন্দের দিকগুলো পুনরায় জাগরিত হতে পারে।” “ হ্যাঁ পারে তো। এই যে এখন সূর্য উঠেছে, অন্ধকার মুছে গেছে। সূর্য অস্ত গেলে আবার অন্ধকারে ভরে যাবে। অন্ধকার কখনো দূর করা যায় না, নির্মূল করা যায় না। শুধু আলোর বেড়াজালে ঢেকে দেওয়া যায়। জীবনের অন্ধকার দূর করতে হলে জীবনের পথে পথে আলো জ্বেলে রাখতে হয়। এ নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফল। এমন করেই কোন ব্যক্তির জীবন মহান হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের কাছে আদর্শ।”


“এমন নিরবচ্ছিন্ন কষ্টসাধ্য সংগ্রাম মানুষের জীবনে সত্যিই কি সম্ভব?” “ সম্ভব।”  “চোখের সামনে তেমন কোনো উদাহরণ আছে?” “আছে। দেখার মতো করে দেখতে  হবে।”


অপূর্ব গল্পটা এতক্ষণে শেষ করল। নির্ঝরা আবার প্রশ্ন করে, “ আমরা সকলেই জানি, খাদ ছাড়া সোনার অলঙ্কার তৈরি হয় না। অর্থাৎ সোনার অলঙ্কারে ভেজাল থাকে। তাহলে আমরা সোনার ছেলে, সোনার মেয়ে বলি কেন?”  “এক্ষেত্রে বিচারের দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু অন্যরকম হবে। সোনায় যখন বিশেষ অনুপাতে অন্য ধাতু মিশিয়ে অলঙ্কার তৈরি হয়, তখনই তা সৌন্দর্যে পূর্ণতা পায়। তবে অসৎ উদ্দেশ্যে অন্য ধাতুর পরিমাণ মাত্রাছাড়া মেশালে অবশ্যই তখন ভেজাল। একইভাবে জীবন যখন সৌন্দর্যে পূর্ণতা পায়, তখনই কেউ হয়ে ওঠে সোনার ছেলে বা সোনার মেয়ে।” “ এবার আমার শেষ প্রশ্ন দাদা,  ‘স্বজনপোষণ কোন্ দলে নেই? আছে কি নির্ভেজাল কোনো দল?” “আপাতদৃষ্টিতে নেই , জ্ঞানের দৃষ্টিতে আছে। পরীক্ষা করে নিতে হয় কষ্টিপাথরে।”


নির্ঝরা জ্ঞানের দৃষ্টি মেলে খোঁজার চেষ্টা করে। অপূর্ব বলল, “ কেবলই শেষ করলাম গল্পটা, মন দিয়ে শোন্।” নির্ঝরা মনোযোগ দেয়।


“দুটো দলের দুজন নেতা। দুজনেই পরিবর্তনপন্থী। একজন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশ, সমাজ, সর্বোপরি মানুষের কল্যাণ করতে চান। পরিবর্তনের এটিই তার কাছে একমাত্র পথ। অন্যজন সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন সমাজ গড়তে চান। মানুষের সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে এটিই তার কাছে একমাত্র পথ।


নির্বাচনপন্থী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায়  এলেন। মন্ত্রী হলেন। তাঁর এখন অসীম ক্ষমতা। নির্বাচনের সময় যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এখন তাঁকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। বিশেষ করে কোটি কোটি বেকারকে চাকরি দিতে হবে। কিন্তু সমাজ তো মুনাফা কেন্দ্রিক, পুঁজিপতিদের অঙ্গুলিহেলনে চলে। তার উপর মুমূর্ষু পুঁজিবাদ সমস্ত বেকারকে চাকরি দিতে অপারগ। তাহলে মন্ত্রী এখন কী করবেন? উপায় একটাই আছে – স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ।  কোটি কোটি না হলেও কয়েক লক্ষ বেকারকে সমাজ গড়ার কারিগর হিসেবে চাকরি দেওয়া যেতে পারে। সেই মতোই নিয়োগের  তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তুমুল প্রতিযোগিতা। দলের যুবক-যুবতীরা মন্ত্রীর আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে লাগল। মন্ত্রীর মাথায় হঠাৎ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবলেন – দলকে টিকিয়ে রাখতে গেলে, আবার আগামী নির্বাচন-বৈতরনী পেরোতে হলে দলের ছেলেমেয়েগুলোকে আগে চাকরি দিতে হবে। সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল।

“দাদা, রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় এটাই তো স্বজনপোষণ, তাই না ?”


হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস্। শোন্,  অন্যদিকে আমূল পরিবর্তনের কান্ডারি, তাঁর দলের একজন নিতান্ত গরিব কর্মীকে বেসরকারি একটি সংস্থায় কাজ পাইয়ে দিলেন। “দাদা, এটাও স্বজনপোষণ। তাহলে তো আমি ঠিকই বলেছি। স্বজনপোষণ ছাড়া দল চলতে পারে না।”


গল্প কিন্তু আমার শেষ হয়নি বোন। তাই সিদ্ধান্তটা শেষে জানানোই সমীচীন হবে। এবার শোন্, ওদিকে মন্ত্রীতো স্বজনদের চাকরি দেবেন। কিন্তু সমস্যা একটা দেখা দিল। দলের বহু ছেলেমেয়েরাই প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি, অথচ চাকরি তাদেরকে দিতেই হবে। তারা জোরালো দাবিও করছে। কেউ কেউ গোপনে দেখা করে দলের তহবিলে অনুদান দিতে চাইছে। মন্ত্রীর মাথায় এবার দুর্বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবল – একটা বিরাট অঙ্কের অর্থ হাতে আসবে। তার একটা অংশ দলের তহবিলে দিয়ে বাকিটা পকেটস্থ করলে মন্দ হবে না। বিগত নির্বাচনে অনেক টাকা খরচ করেছি। সামনের নির্বাচনেও জিততে অনেক টাকা লাগবে। এমনটা ভেবে প্রথমে দলের কয়েকজন অযোগ্য ছেলেমেয়েদের লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি দিলেন।  এরপর তিনি ওই ছেলেমেয়েদেরকে কাজে লাগালেন। ওরা এবার হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী অর্থাৎ খদ্দের ধরে আনতে লাগলো। এভাবে প্রায় একশো ভাগ অযোগ্যরাই চাকরি পেল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। “সে কি দাদা, অযোগ্যরা হয়ে গেল সমাজ গড়ার কারিগর? সমাজ রসাতলে যাবে, মন্ত্রী তা ভাবলেন না?”  না রে, এই মন্ত্রী তো আসলে যবনিকার আড়ালে অন্য এক মানুষ। নিজের গাড়ি, বাড়ি,সুখ-সমৃদ্ধি,  বৃদ্ধি বিদেশ ভ্রমণ এসব নিয়েই সর্বক্ষণ ভাবেন। সবচেয়ে মজার কথা কি জানিস্? “কী?” এই মন্ত্রী জনপ্রিয়তার তকমাও পেয়েছেন,বীরের আখ্যা পেয়েছেন। কেউ কেউ আবার কলির কেষ্টও বলছেন। থাক্ এসব কথা। এবার ওই যে গরিব কর্মীটি, সমাজ পরিবর্তনের কান্ডারি যাকে সামান্য মাইনেয় কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন, তার কথা একটু বলি।


নির্ঝরা আরও মনোযোগ দিয়ে শোনে।


একদিন ঐ ছেলেটির সাথে পথে এক অচেনা,অসহায়,শোকার্ত মায়ের দেখা হলো। সে ভিক্ষা চাইছিল। ভিখারিনির মুখের দিকে তাকাতেই ছেলেটির নিজের মায়ের মুখ ভেসে উঠলো। সে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করল,  “তুমি কোথায় থাকো? কে আছে তোমার?” “কোথায় থাকবো বাবা! পথই আমার বাড়ি। একটা ছেলে থেকেও নেই । ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে সে এখন জেলে।” কর্মী ছেলেটি পকেট থেকে একটি দশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলল, “মা, দুঃখ ক’রো না। কোনো ছেলেই ডাকাত হয়ে জন্মায় না।”  মা ছেলেটির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করল আর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, “ঐ যে দেখছো না – রেল-গুমটি, ওটার পাশেই আমার কুঁড়েঘর বাবা। কেউ আমাকে দেখার নেই।” সেদিনের পর থেকে ছেলেটি ভিখারিনি মায়ের সাথে দেখা হলেই টাকা দিত।


কয়েকবছর পর ডাকাত যুবক জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যেদিন তার কুড়েঁঘরে ফিরল, ঘটনাক্রমে কর্মী ছেলেটিও সেদিন সেখানে গিয়ে হাজির হলো। ডাকাত যুবককে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলের অফিসে নিয়ে এল সে। কান্ডারি তাকে কাছে টেনে নিলেন। তার যন্ত্রণার কথা শুনলেন। সামান্য রোজগারের একটা উপায়ও করে দিলেন। যুবকও নিয়মিত অফিসে আসতে লাগল। দিনে দিনে সে অদ্ভুতভাবে পাল্টে যেতে থাকলো। তার মা-ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্তি পেল। সে-ও এখন ছেলের সাথে অফিসে আসে। দলের কর্মকাণ্ডে যোগদান করে। আর এভাবেই একে একে নিত্য নতুন লোক, যুবক, যুবতী, মায়েরা এসে অফিস ভরিয়ে তুলতে লাগল।


“আচ্ছা দাদা, এই যে এরা একে একে আসছে, সবাই কি কাজের আশায় আসছে?”  না বোন, এরা আসে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে। আসে জীবনকে জানতে।কেন এত দুঃখ-কষ্ট, সুজলা-সুফলা পৃথিবী এত অন্ন দেয়, তবু কেন অগণিত নিরীহ মানুষ অনাহারে মরে, এ সবকিছু ওরা জানতে চায়। সুন্দর এই পৃথিবীকে জীবনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবে –  এ ওদের দৃঢ় অঙ্গীকার। সেই তাগিদ নিয়েই ওরা নিয়মিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠ নেয়, জীবনকে নতুন করে গড়ে তুলেছে।  নির্ঝরা বলে, “তাহলে বুঝলাম – এ দলের চিন্তাধারা, উদ্দেশ্য অতি মহৎ, ওই মন্ত্রীর দল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।”


শুধু আলাদাই নয়। ওই মন্ত্রী তো নরকের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। ওনার আশীর্বাদে অযোগ্যরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা ভুল শিখছে। টুকে পাশ করছে। অনেকে টাকা দিয়ে ডিগ্রী কিনছে। ওদের মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চরিত্রের অধঃপতন ঘটতে ঘটতে মনুষ্যেতর স্তরে নেমে গেছে। মন্ত্রী এদেরকেই কাজে লাগান একের পর এক নির্বাচনে জিততে। ………।


অপূর্বকে থামিয়ে নির্ঝরা বলে উঠলো, “ওই জঘন্য মন্ত্রীর কথা আর বলিস্ না। তবে স্বস্তিও পাচ্ছি, আর ক্ষতি করতে পারবেনা। চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষেরা তা হতে দেবে না দাদা। গভীর অন্ধকারেও আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি। পূর্ব আকাশে আবার উদয় হবে নতুন সূর্য। তারই তো আয়োজন চলছে।  মহান কান্ডারি ওই আয়োজনের সর্বাধিনায়ক।” হ্যাঁ বোন।  একথা ধ্রুবসত্য।


এক যুগ পরের কথা। ডাকাত যুবক আর যে তাকে দলে এনেছিল সেই কর্মী ছেলেটি দুজনেই এখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। দল আর ওদের ব্যক্তিজীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ব্যক্তিজীবনে একজনের শুধু আছে সেই রেল-গুমটির কাছে জীর্ণ কুঁড়েঘর, আরেক জনের পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া এক চিলতে মাটির উপর টালির ঘরের ভগ্নাবশেষ। এবার আমি বলতে অবাক হচ্ছি যে, ওই দূর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রীর সম্পত্তি বাড়তে বাড়তে এখন হাজার কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে, আর সর্বাধিনায়ক কান্ডারি সবকিছুর মোহ কাটিয়ে গৃহহীন, নিঃস্ব। তাঁর শুধু আছে পৃথিবী আর মানুষের প্রতি অশেষ ভালোবাসা। আর আছে হৃদয়ে অপূরিত স্বপ্ন  পূরণের আকাঙ্ক্ষা। তাঁর আকাঙ্ক্ষা শেষ নেই।


নির্ঝরা কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গেল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “এত বড় নিঃস্বার্থ, পরিপূর্ণ মানুষও হতে পারে! দাদা, আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।”

………………………………………………………..