Pathorchapa Heere – পাথরচাপা হীরে

পাথরচাপা হীরে

(ছোটগল্প ) 

গ্রামের ছেলে অর্কপ্রভ জীবনের দ্বিতীয় বড় পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম হয়েছে। সাংবাদিক প্রশ্ন করেছেন – “তুমি কী হতে চাও?” আদরের দুলাল মায়ের কোলে বসে বাবার হাতের মিষ্টি খেতে খেতে উত্তর দিল- আমি ডাক্তার হতে চাই। “ডাক্তার হতে চাও কেন?” মানুষের সেবা করতে চাই। আমাদের দেশে অগনিত গরিব মানুষ। বিনা চিকিৎসায় তাদের অনেকেই অসময়ে মারা যান। আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

এমন ছাত্রের প্রশংসায় পরের দিন খবরের কাগজের প্রথম পাতা ভরে গেল। রাজ্য জুড়ে তার শুভ কামনা করা হলো। আত্মীয়-স্বজনরা ছুটে এলেন। তাদের আশীর্বাদ নিয়ে অর্কপ্রভ এবার বিদ্যালয়ে গেল শিক্ষকদের পায়ের ধুলো মাথায় নিতে। প্রধান শিক্ষক কমলেশ মজুমদার এই কৃতী ছাত্রকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। পুরস্কৃত করলেন। এরপর উপস্থিত ছাত্রসকল, অভিভাবকমণ্ডলী এবং সহকারী শিক্ষকবৃন্দের সামনে বললেন – “আমাদের মেধাবী ছাত্র অর্কপ্রভ রায়চৌধুরী সুখনগর উচ্চ বিদ্যালয়কে আজ যে সম্মানে সম্মানিত করল তা অত্যন্ত গর্বের। আমি তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। এই দুর্ভাগা দেশ আজ তাকে যে উপহার দিলো,একদিন দেশ তথা দেশবাসীকে সে এর উপযুক্ত প্রতিদান দেবে ,শুধু এইটুকুই আমাদের কামনা। ”

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও তাকে সংবর্ধনা দিয়ে বললেন – “হে কীর্তিমান তোমার আশা পূর্ণ হোক। আর্ত-পীড়িতদের সেবায় তোমার জীবন উৎসর্গ হোক।” অর্কপ্রভও পণ করল- “ধন্য আমার দেশ-মাতা। তোমার কোলে আমি জন্ম নিয়েছি । আমি তোমার কাছে কত ঋণী ,আশীর্বাদ করো মা ,কখনও যেন তা ভুলে না যাই।”

তার সহপাঠী ‘নিধিরাম’, একমাত্র সে-ই এবছর ফেল করেছে , লজ্জায় মার্কশীট নিতে বিদ্যালয়ে যায়নি। মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাস করা ছেলেটা কেন ফেল করল – খবরটা নিতে একদিন কমলেশবাবু তার বাড়িতে এলেন। দেখলেন- নিধির বাবা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাগত। মা চোখের জল ফেলছে। আর নিধি বাবার পাশে বসে মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মাস্টেমশাইকে দেখে নিধি কেঁদে ফেলল। “স্যার ,আমার আর লেখাপড়া হবে না।”

কমলেশবাবু বোঝালেন – “দেখ্, আমাদের গরিব দেশে সবার তো লেখাপড়া হয় না। তার জন্য দুঃখ করিসনা। লেখাপড়া না করেও বড় হওয়া যায় ,ভালো মানুষ হওয়া যায়।” নিধির মুখপানে চেয়ে আফসোসও করলেন ,ফেলে আসা অতীত মনেও করালেন। “ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবার তুই-ই প্রথম হয়েছিস ,অর্ক দ্বিতীয় হতো ।অনেক চেষ্টা করেও ও তোর আগে যেতে পারতো না । কিন্তু দারিদ্র্য যে বড় নির্দয় হয়ে দেখা দিল । তুই পড়ে গেলি ভীষণ দৈন্য-দশায়,আর অর্থের বলে ও এগিয়ে গেল।” শেষে নিধির চোখের জল মুছে দিয়ে,ওর শুভ কামনা করে ফিরে এলেন কমলেশবাবু ।

কয়েকদিনের মধ্যে আবারও সুখবর ছড়িয়ে পড়লো – অর্কপ্রভ সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়ে দেশের সেরা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে।

আনন্দের পাশাপাশি দুঃখের খবরটাও পেলেন কমলেশবাবু। নিধি পিতৃহারা হয়েছে। সে এখন সংসারের হাল ধরেছে। বাবার রেখে যাওয়া টোটোটা চালায়। স্যার আবারও আফসোস করলেন – ঐ জায়গায় তো নিধিরই পৌঁছানোর কথা ছিল।

এরপর দশ-বারোটা বছর ধরে নিধির মরণ-পণ জীবন সংগ্রাম। এতকাল ধরে সুবর্ণরেখার কত যে জল বয়ে গেছে তার শেষ নেই। রাজনৈতিক ভাগ্য বদল হয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু দীন-দরিদ্রের ভাগ্য যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে।

কমলেশবাবু অবসর নিয়েছেন বছর চারেক আগে । কিন্তু ছুটি তিনি নিতে পারেন নি। বিবেকের তাড়নায় জীবনের এই শেষ বেলাতেও দুস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত পাঠ দান করেন বিনা পারিশ্রমিকে । বর্তমানে বেশ কিছুদিন ধরে শরীর তাঁর ভালো যাচ্ছে না। জানা গেছে- মারণ ব্যাধি তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে। জেলার সদর শহর থেকে পঁচিশ কিমি দূরে প্রত্যন্ত গ্রামে একটি রুগ্নদশা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়া আর কোন ভালো চিকিৎসালয় নেই। তাই মাঝে মাঝেই তাঁকে সদর হাসপাতালে যেতে হয়।

একদিন বৃদ্ধ স্যারকে দেখতে নিধি এল। স্যার বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। তথাপি হাত বাড়িয়ে নিধিকে আশীর্বাদ করল। নিধিও মহানন্দে একটা খবর দিল স্যারকে। “অর্ক বিদেশ থেকে বড় ডাক্তার হয়ে দেশে ফিরেছে। সদরে পেল্লাই বাড়ি করেছে। চার চাকার গাড়ি হয়েছে। বাড়ির সাথে চেম্বার তৈরি করেছে। সকাল-সন্ধ্যা রোগীর ভীড়। হাসপাতালের বিরাট বড় ডাক্তারও সে ।

কমলেশবাবুর অসুখ যেন অর্ধেকটা সেরেই গেল। মুখমন্ডলে অনাবিল আনন্দের ঢেউ। তার বহিঃপ্রকাশও ঘটল। “রত্ন,শুধু আমাদের গ্রামের নয় ,দেশেরও গর্ব। কথা দিয়েছিল- দীন-দুখীদের সেবা করবে। নিশ্চয়ই করবে। এবার আমাদের গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটারও উন্নতি হবে।” নিধি বলল- হ্যাঁ স্যার, এবার আপনার অসুখটাও সেরে যাবে।

“হ্যারে নিধি ,তোর সাথে কি কথা হয়েছে? তোকে চিনতে পেরেছে তো?” “ না স্যার ,সেই সুযোগ হয়নি এখনও। দরজায় রীতিমতো পাহারা। যে-কেউ যখন-তখন ঢুকতে পারে না। আমি আমার টোটোতে করে রুগী নিয়ে যাই, এই পর্যন্ত। ভেতরে ঢুকে আলাপ করার সময় হয়ে ওঠেনি।” “তুই কি আবার যাবি এর মধ্যে?” “ হ্যাঁ স্যার ,কালকেই রুগী নিয়ে যাবো। আপনি যাবেন? চলুন ,শরীরটা দেখিয়ে নেবেন।”

নিধির কথামতোই পরদিন তার টোটোয় চেপে কমলেশবাবু সদর শহরে গেলেন। প্রিয় ছাত্রের বাড়ির দরজায় এসে যখন নামলেন তখন তাঁর খুশির সীমা নেই। দারোয়ান জিজ্ঞেস করল – আপনি কি রুগী? কমলেশবাবু রুগীর পরিচয়টাই দিলেন। দারোয়ান হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল – ঐ টেবিলে গিয়ে নামটা লেখান। টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কর্তব্যরত ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে বলল – দিন, পাঁচশো টাকা। কমলেশবাবু খানিকটা হতচকিত হয়ে গেলেন। দিচ্ছি বলে নিধিকে টেনে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে কানে কানে বললেন – এতগুলো টাকা ডাক্তারবাবুর ফী? নিধি বলে উঠলো- স্যার আপনার আসল পরিচয়টা দিলেই ভালো হতো। এমন সময় ভেতর থেকে কমপাউন্ডার মশায় একজন রুগীকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বাইরে নিয়ে এলেন। বড়োসড়ো গণ্ডগোল বেঁধে গেল। কম্পাউন্ডারও সমানে চিৎকার করে বলে উঠলেন – ডাক্তারবাবু কী দানছত্র খুলে বসেছেন যে তোমার অপারেশনটা বিনা পয়সায় করিয়ে দেবেন? “আমি ভীষণ গরীব।” “গরীব, তো হাসপাতালে যাচ্ছো না কেন?” কমলেশবাবু চুপ করে থাকতে পারলেন না। বলেই ফেললেন-তাই বলে গরীব মানুষটাকে ধাক্কা মেরে বের করে দিতে হবে? নিধি বলল- স্যার ,ও আমাদের পাশের গ্রামের হীরু। ভুগতে ভুগতে চেহারাটা কেমন হয়ে গেছে , চেনাই যায় না। কমলেশবাবু হীরুর দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ।

কম্পাউন্ডারকে উদ্দেশ্য করে ভেতর থেকে চড়া গলা শোনা গেল – রুগীর হয়ে কে ওকালতি করছে রে গোবিন্দ? তো ওনাকে বল্,টাকাটা উনিই দিয়ে দিক। বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং ডাঃ অর্কপ্রভ রায়চৌধুরী। হীরুর সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন – ডাক্তার হতে কত খরচ হয়েছে জানো? উত্তরটা নিজেই বলে দিলেন। “পঞ্চাশ লক্ষ টাকা।” আর কে সেই সহৃদয় ব্যক্তি ,যিনি একটু আগে গরীবের হয়ে সওয়াল করছিলেন? কমলেশবাবু সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন – আমি ,চিনতে পারছো আমাকে? “আপনি? কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। আচ্ছা ঠিক আছে ”,এই বলে ডাঃ অর্কপ্রভ ভেতরে চলে যাচ্ছিলেন। নিধি পেছন থেকে ডাক দিল – অর্ক। অর্কপ্রভর গতি থেমে গেল। পেছন ঘুরে জিজ্ঞেস করল – কে ডাকল আমার নাম ধরে? নিধি এবার এগিয়ে এসে বলল – তুই আমাকে চিনতে পারলি না? আমি নিধি ,তোর ক্লাসমেট ছিলাম। এত লোকের মাঝে অর্কপ্রভ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। নিধিও বলে উঠল – “ঠিক আছে ,আমাকে না হয় না চিনলি ,ওনাকে তো চিনবি। কমলেশবাবু ,আমাদের হেডস্যার ছিলেন।” কমলেশবাবু ততক্ষণে দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। “না না ,আমি কাউকে চিনি না”,বলে অর্কপ্রভ ভেতরে ঢুকে গেলেন। কম্পাউন্ডার ধমক দিল – “এই তুই কাকে কী বলছিস? তুই টোটো চালাস না? ডাক্তারবাবু তোর বন্ধু? চালাকি করছিস। ভাবছিস এসব বলে ডাক্তারবাবুকে বিনা পয়সায় দেখিয়ে নিবি, তাই তো? ওটি আর হবে না। চল্ , চল্ এখান থেকে।”

নিধি মন খারাপ করে ফিরে এল তার টোটোর কাছে। দুঃখে আপন মনে বলতে লাগল – মানুষ লেখাপড়া শিখে অনেক বড়ো হয়। অনেক টাকা-পয়সা হয়। তখন গরীব ,অশিক্ষিত মানুষগুলো চেনা-জানা হলেও তাদেরকে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করে। ভাবে – তাঁর সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু স্যার , আমাকে না হয় নাইবা চিনল ,আপনার নাম শুনেও তো বলল- চিনি না। স্যার বললেন – “তোকেই বা চিনল না কেন? আমার সেকথা আজও মনে আছে- একদিন অর্ক টিফিন ছাড়া স্কুলে এসেছিল। তুই একটা ছোট্ট বাটিতে করে মুড়ি এনেছিলি। সেই মুড়ি ক’টা দুজনে ভাগ করে খেয়েছিলি।” নিধিকে এবার বোঝালেন স্যার – “ অধিক অর্থ ,সম্পদের সামনে থাকে অমানুষ হবার হাতছানি। মানুষ যখন আদর্শহীন হয়ে সেই অমানুষের পথে যাত্রা করে ,আর সেই হীন প্রবৃত্তি যখন ধরা পড়ে যায় ,তখন এমনই আচরণ করে।”

নিধি মন খারাপ করে বলতে লাগলো- তবে কি ও ভুলে গেল ওর শপথের কথা! আজকের আধুনিক সভ্য সমাজে মানুষ কেমন করে বদলে যায় ! আমরা দুটো পয়সার জন্য দিনরাত খাটি। তাতেই খুশি। ওর অনেক আছে , অনেক হয়েছে, তাতেও খুশি হতে পারে নি !

কমলেশবাবুর শরীরটা হঠাৎ খারাপ করতে লাগল। বেরিয়ে এলো দীর্ঘনিঃশ্বাস। নিজেকে দোষ দিলো – আমরা তাঁকে ডাক্তার তৈরি করেছি, মানুষ করতে পারিনি। আরও অনেককেই পারিনি। চৌত্রিশ বছর শিক্ষকতা-জীবনে এমন অভিজ্ঞতা ছাড়া ভালো আর কিছুই সঞ্চিত হয়ে থাকল না রে । মিথ্যা শপথের বানীগুলো বোঝা হয়ে থেকে গেল। বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মূখস্থ করিয়েছি । ঢেলে নাম্বার দিয়েছি। সব ভুল ,ভুল করেছি।এতকাল ধরে সভ্যতার নামে আমরা কলঙ্কের ইতিহাস রচনা করেছি । আপন স্বার্থপরতার গ্লানিগুলো নিঃস্বার্থপরতার মোড়কে কত নিখুঁতভাবে ঢাকা পড়ে যায়। বাইরে তার জৌলুস ,ভিতরে অন্তসারশূন্য।

এরপর বছর দুয়েকের মধ্যে সুখনগরের রূপ পাল্টে গেল । গ্রামের লাল মাটির রাস্তা পাকা হল । পঞ্চায়েত প্রধানের টালির চালার বাড়ি তিনতলা প্রাসাদে পরিনত হল । তাঁর পাশে পাশে যারা ছায়াসঙ্গী হয়ে সর্বদা ঘুরে বেড়াত ,তাদেরও লক্ষ্মী লাভ হয়েছে । তবে নিধি কখনও সেদিকে পা বাড়ায়নি। দারিদ্র সীমার নীচের মানুষগুলো রুজি-রোজগার হারিয়ে আরও নীচে নেমে গেছে। দয়ার দানটুকুই তাদের একমাত্র ভরসা। নিধি অবশ্য তা থেকেও বঞ্চিত। আবাস যোজনার ঘরটাও পায়নি। খসে পড়া মাটির দেয়াল ,ভাঙা টালির চালের নীচেই সে ঘর বেঁধেছে। একটা মেয়েও হয়েছে। সংসার কোন রকমে চলে যায়।

ডাঃ অর্কপ্রভর পৈত্রিক ভিটেমাটির উপর তৈরি হয়েছে পেল্লাই এক নার্সিংহোম। বৈশাখের মাঝামাঝি এক সকালে তার সামনে রঙিন কাঁচ লাগানো একটা সুন্দর গাড়ী এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামলেন সস্ত্রীক ডাঃ অর্কপ্রভ। স্ত্রীও ডাক্তার। আজ নার্সিংহোমের উদ্বোধন। ভেতরে-বাইরে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।


খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। এক এক করে গ্রামের লোকজন নার্সিংহোমের সামনে এসে হাজির হতে লাগলো। নিধি আজ সকালে টোটো নিয়ে বেরোয়নি। সকলের মতোই সেও এসে হাজির হল। সংগীতের সুরে মুখরিত চারপাশের আকাশ-বাতাস। কিন্তু নিধির হৃদয়-আকাশে সে সুর বুক-ফাটা কান্না হয়ে বেজে উঠল। তাকিয়ে থাকল মাত্র দুশো মিটার দূরে সুখনগরের রুগ্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রটার দিকে, যা এখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। অসুস্থ শরীরে লাঠি ভর দিয়ে বকুল পিসিও এসে দাঁড়িয়েছিল। পিসির মনের কথা বুঝতে পেরে নিধি দুঃখ করে বলল – “পিসি ,এখানে তোমার চিকিৎসা হবে না। গরীবের তো ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রটাই ভরসা ছিল। সেকথা কে ভাবে? এখানে চিকিৎসা টাকা দিয়ে কিনতে হবে। ব্যবসা পিসি ,সব কিছুতেই ব্যবসা। দু’পয়সা সাহায্য দেয় বটে ,সরকারও তেমনটাই চায়।” পিসি বলল – “বাপুরে ,আমরা মুখ্খ-সুখ্খ গরীব মানুষ , ওসব ছলাকলা বুঝি না। তা হ্যারে , আমাদের গায়ের ছেইলা অর্ক বড়ো ডাক্তার হয়িছে। এত বড় নার্সিংহোম করিছে । ছোইট্টোবেলা থেকে সকলের চেনা-জানা। হ্যাঁ মানছি ,অনেক দিন ধরি সে শহরে থাকে। তাই বলে কি সে আমাদের কথা ভাববি না?” কী যে বলবে নিধি ,চেনা মানুষও যে অচেনা হয়ে যায়। তাই “জানিনা”,বলে মনের দুঃখে সে চলে যাচ্ছিল ,আবার ঘুরে এসে বলল – পিসি ,কেউ না থাকুক , এই নিধি তোমার পাশে আছে। হাসপাতালে যেতে হলে ব’লো, আমার টোটোয় করে পৌঁছে দেবো। পিসি দুঃখ করে বলল – তোর কষ্টের সীমা নেই। একটা দিন না খাটলে দু’মুঠ খাবার জোটে না ,তবু তুই লোকের জন্য এত ভাবিস ,এত কিছু করিস। ওরে ,ক’জন তা পারে? তোর মঙ্গল হোক। “আশীর্বাদ করো পিসি ,যতদিন বাঁচি ,এমন করেই যেন দুখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি।”

এমন সময় বিমলা মাশী এসে খবর দিল – “ওরে নিধি ,বাপ্ আমার ,শুনেছিস- কমলেশবাবু মাথাঘুরে পরে গেছেন।” নিধি ছুটল তাঁর বাড়ির দিকে । গিয়ে দেখল তার অবস্থা ভালো নয়। বাড়ির লোকজন পাশে বসে। নিধিও স্যারের কাছে এসে বসল। জিজ্ঞেস করল- কেমন আছেন? “ভালো নেই”, বলে তিনি ছাত্রের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর অতিকষ্টে একটা হাত বাড়িয়ে নিধির মাথার উপর রাখলেন। আড়ষ্ট গলায় কত কথা বলতে চাইলেন – “লে খা প ড়া শি খি স নি , তা তে কী হ য়ে ছে? তু ই যে প্র কৃ ত মা নু ষ হ য়ে ছি স। ”   আর একটা কথাও বলতে পারলেন না। নিধি চোখের জল মুছতে মুছতে বললো স্যার আমি টোটো নিয়ে আসি। আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।

তখন বেলা প্রায় মাথার উপর । নিধির টোটো কমলেশবাবুকে নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটল।
……………………………………………………..