Jeeban Marur Pathe Pathe – জীবন-মরুর পথে পথে

Jeeban Marur Pathe Pathe

(গল্প) 

 জীবন-মরুর পথে পথে

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। উত্তরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে প্রকৃতি জবুথবু। দুপুরে একতলা বাড়িটার ছাদে বসে মিঠে রোদে গাটা গরম করে নিচ্ছে সুপ্রকাশ। মাথায় একের পর এক দুশ্চিন্তা এসে জড়ো হতে লাগলো। ভেতরটা কেঁদে উঠলো, “ওরে সুপ্রকাশ ,বয়স তোর চল্লিশ হতে চললো, এবারেই শেষ সুযোগ। এটা যদি হাতছাড়া হয় তবে এতদিনের সব পরিশ্রম বৃথা হয়ে যাবে। এম. এসসি. পাশ করেও তোকে সারাজীবন গৃহশিক্ষকতা করতে হবে, নয়তো মালিকের টোটো নিয়ে চালাতে হবে। মায়ের দূরারোগ্য ক্যান্সার, তার চিকিৎসাইবা কী দিয়ে করবি? বাপের দিনমজুরি খাটতে খাটতে কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে, সেও যদি বিছানা নেয়, তখন কী করবি? আর বড় আশা করে ঘর বাঁধার যে স্বপ্ন দেখেছিস্,তা যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, কী করে সইবি?”


মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠল। সহপাঠী বন্ধু ‘শৈবাল’ ফোন করেছে। “সুপ্রকাশ, টেটের রেজাল্ট বেরিয়েছে। তোর কপাল খুলেছে রে। আমি সেই হতভাগাই রয়ে গেলাম। …….।” সুপ্রকাশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল শান্ত নীল আকাশের দিকে। জীবন-আকাশে তার অনাবিল আনন্দ ঢেউ খেলে যাচ্ছে। স্বপ্নের পাখিরা ঝাঁক বেঁধে মহাকলরবে উড়ে চলেছে এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে। সেই দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই মোবাইলের বোতাম টিপে নিজের চোখেও একবার নামটা দেখে নিল। তারপর মাকে খুশির খবরটা দিতে নিচে নেমে এলো। যন্ত্রণায় মা বিছানায় ছটফট করছিল। খবরটা শোনামাত্রই সব যন্ত্রণা যেন নিমেষে জুড়িয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে কুসুম দৌড়ে এসে বললো – দাদা, বড় ভালো লাগছে। অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তো হতে পারলি। ইস ! এতদিনে ভাগ্যটা তোর ফিরল। সংসারটা বাঁচবে। মায়ের চিকিৎসাটাও হবে।

“ হ্যাঁ, বাবাকেও একটু বিশ্রাম দিতে পারবো। তুই আমার একমাত্র বোন ,ঘটা করে তোর বিয়েও দেবো।” কুসুম দাদার মুখপানে চেয়ে হাসলো। লজ্জাও পেল। মুখখানা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল – আমার বৌদি ,যে তোর মনের মানুষ ,পথ চেয়ে বসে আছে ,আগে তাকে ঘরে নিয়ে আসবি। তারপর না হয় আমার বিয়ের কথা ভাবিস।

এত আনন্দেও মায়ের চোখের জল ঝরে পড়তে লাগলো। “ওরে আমার আদরের দুলাল, কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছিস। কতদিন না খেয়ে কলেজে গিয়েছিস। কোনোদিন একটা ভালো জামা-কাপড়ও পরতে পারিসনি। অনেক দেরিতে হলেও তবু তো একটু সুখের কিনারা হলো। আমরা আর কদিন থাকবো ! তোদের জীবনটা তো ভালো কাটবে। ……….. ।”

সুপ্রকাশ মায়ের চোখ জল মুছে দেয়। “মাগো ,ওকথা ব’লোনা। তোমাদের যে এখনও অনেক দিন বাঁচতে হবে। আমাদের ফাঁকি দিয়ে তোমরা কোথায় চলে যাবে? তবে সেই দুঃখ যে আরও নিদারুণ ভয়ংকর হবে। তাহলে বলবো – যে সুখ আজ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই সুখ জীবনে যেন কখনও না আসে।”

প্রতিদিনের মতো আজও অস্তবেলায় রাজমিস্ত্রীর যোগানদারী করে বাবা বাড়ি ফিরে এলো। কুসুমের তর সইছিল না। বাবাকে আনন্দের খবরটা দিল ,তবেই না শান্তি। একটু আগেও কনকনে ঠাণ্ডায় যে শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছিল, ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়ছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছিল, এখন তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। পশ্চিম আকাশে আধফালি চাঁদ সবে জ্যোৎস্না বিলাতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা তারাটা জ্বলজ্বল করছে। বাবা সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতকাল আরাধ্য দেবতার প্রতি অভিমান হয়েছিল। আজ করজোড়ে তাঁর উদ্দেশ্যে বলে উঠল – হে ঠাকুর, তুমি মঙ্গলময়। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক।

সুপ্রকাশ বাবার কাছে এসে বসল। রুগ্ন চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকল। মনের দুঃখ আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উদগীরন হতে চাইল। কতকাল ধরে কী নিদারুণ যন্ত্রণা সয়ে আসছে মানুষটা,একটু সুখের মুখ দেখেনি।সে দুঃখ মনের গভীরেই চাপা দিয়ে বলে উঠল ,“বাবা, একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। তোমাকে আর এত পরিশ্রম করতে দেবো না।”ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বাবার খালি বুকটা অশেষ তৃপ্তিতে ভরে উঠল। অনুভব করতে লাগল এক পরম শান্তি। স্নান সেরে এসে খাওয়া-দাওয়ার পর গাটা বিছানায় এলিয়ে দিল। চোখ দুটো বোজাতে চাইল। তারই মাঝে দুঃখের কতনা স্মৃতি চোখের সামনে এসে ব্যথা দিতে লাগলো। “পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া বিঘা চারেক চাষের জমি দেনার দায়ে চলে গেছে বিত্তবানের হাতে। সোনা-দানা যেটুকু যা ছিল তিল তিল করে সব শেষ হয়ে গেছে। দিনের আলো নিভে গেছে অনেক আগেই। যেদিকে তাকাই শুধুই অন্ধকার। কতদিন পর তবুও আজ যেন এক চিলতে আলোর ছটা এসে পড়েছে গরিবের কুঁড়েঘরে।” ভাবতে ভাবতে অবশেষে সুখের নিদ্রা এলো।

পরদিন সাদা কুয়াশা ভেদ করে ভোরের রঙিন সূর্য উঠল পূর্ব আকাশে। আজ থেকেই বিদ্যালয়ে যোগদানের চিঠির আশায় প্রহর গুনতে থাকল সুপ্রকাশ। দিন দশেক বাদে খবর পেল – তার কলেজের সহপাঠী বিশিষ্ট জননেতার ছেলে ‘শুভঙ্কর’ চিঠি পেয়ে বিদ্যালয়ে যোগদান করেছে। সেদিনই আবার খবর পেল – শৈবালও যোগদান করেছে। পরদিন আবারও খবর এলো – পাশের গ্রামের সুজিত ও রঞ্জনার চিঠি এসেছে। সুপ্রকাশ বিচলিত হয়ে উঠলো। তার চিঠি যে এখনও এসে পৌঁছালো না। দুশ্চিন্তার পাহাড় জমতে জমতে মনে কতগুলো খটকাও লাগলো। এই তো সেদিন শৈবাল ফোন করে বলেছিল- তালিকায় ওর নাম নেই। অথচ বিদ্যালয়ে যোগ দিল। শুভঙ্কর ইন্টারভিউয়ে ডাক পায় নি। সেও যোগ দিলো। কী করে সম্ভব হল? সে যাইহোক, শৈবাল আমার এতদিনের ঘনিষ্ট বন্ধু , সে অন্তত একবার আমাকে জানালো না? রাগ ,অভিমানে ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল।

দাদার এমন অস্বস্তি দেখে কুসুমের ভালো লাগলো না। জিজ্ঞেস করল – তোর কী হয়েছে দাদা? “ ও কিছু না।” কিছুনা বললেই হল? এত ঠান্ডা পড়েছে , তাও তুই ঘেমে যাচ্ছিস। “না, আসলে মায়ের কথা ভাবছিলাম।” মা এখন ভালই আছে। তাছাড়া টাকাপয়সা হাতে এলেই মায়ের চিকিৎসা করাতে পারবি। “ হ্যাঁ, সে কথা যদিও ঠিক তবুও তো চিন্তা হয়।” কুসুম আশ্বস্ত হলো ।

আজ সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। তাতে শীত আরও জমিয়ে পড়েছে। সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু পাশের ঘরে ঘুম আসেনি সুপ্রকাশের চোখে। রাত সাড়ে দশটা। মোবাইলটা নিয়ে শৈবালকে ফোন করলো। রিং বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। আবারও বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। তৃতীয়বার ফোনটা ধরল। ওপ্রান্ত থেকে গলা শোনা গেল – কীরে সুপ্রকাশ ,এত রাতে ফোন করেছিস !” হ্যাঁরে, একটু জ্বালাতন করলাম। সুখের ঘুম ঘুমাচ্ছিলি বোধ হয়। “ তা বলতে পারিস।” তোর জীবনের এত বড় একটা সুখবর ,একবার না বলে পারলি কী করে? “মনে কিছু করিস না। কাউকেই বলিনি। সব কথা বলতেও নেই। শোন ,একমাত্র তুই বলেই বলছি। কথাটা ফাঁস করা যাবে না। উপরমহলের একজনকে ধরেছিলাম। নগদ বারো লাখ গুনে নিয়েছে। শুভঙ্করের কথা শুনেছিস?” শুনেছি। “ও তো টেটই পাস করেনি। বড়ো নেতার ছেলে বলে কথা। ওর হবে না তো কার হবে ? হরিপুরের সুজিত ,রঞ্জনা, একজন জেলা সভাধিপতীর দেহরক্ষীর ছেলে ,আরেকজন তাঁর গাড়ি চালকের মেয়ে। দুজনেই পেয়ে গেছে।” তাও শুনেছি। “সব একই ঘটনা। হয় ব্যাকিং-এ নয়তো টাকা দিয়ে।পড়াশুনা করে এখন ক’জন চাকরি পায় রে ? তুই রাজি থাকলে বল্ ,ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রয়োজন হলে বাড়িটা বেচে দে। নাহলে কিন্তু চাকরি মাথাকুটেও পাবি না।” না রে ,অনৈতিক পথে শিক্ষক হব ! ছাত্র-ছাত্রীদের কী শেখাব ? ঘৃণায় ফোনটা কেটে দিল সুপ্রকাশ।

রাত বাড়তে থাকলো। ঘুম আসছে না। নিশুতির প্রহরে মা চিৎকার করে উঠলো।তবে কী যন্ত্রণাটা আবার বেড়ে গেল? জানি না ,মায়ের চিকিৎসা করাবো কী করে। এক বিন্দু আশার আলো জ্বলে উঠেছিল ,তাও কি সত্যিই নিভে গেল ! দুদিন পরে মা যখন সত্যিটা জানতে পারবে তখন কী হবে? নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করেও মা আমার মুখপানে চেয়ে হেসে উঠেছিল , সে আবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠবে ,তা আমি সইবো কেমন করে ? বৃদ্ধ বাবা খাটতে খাটতে শেষ হয়ে যাবে ,তা আমি দেখব কেমন করে?ছোট বোনটা কত আশায় বুক বেঁধেছিল ,রাতের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় আর ভোরের নির্মল আলোয় ওর হৃদয়-আঙিনায় ফুলের পাপড়িরা বিকশিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে ম্লান হয়ে গেলে , সে মলিন মুখ আমি চেয়ে দেখবো কেমন করে? তবে কি মৃত্যুই আমার শ্রেয়? এসব আর কিছুই দেখতে হবে না, কিছুই সইতে হবে না। ঘুমের এতগুলো বড়ি খেয়ে নিলেই ঘুম আসবে ,চির সুখের ঘুম।

বিবেক জেগে উঠল। চিৎকার করে বলল-আত্মহত্যা ? সে তো কাপুরুষতা। তুই মরে গেলে এদের কী হবে, ভেবে দেখেছিস?তবুও তো তোর মুখপানে চেয়ে এরা প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকে, স্বপ্ন দেখে। পারবি এদের ছেড়ে তুই চিরতরে চলে যেতে ? সুপ্রকাশ চোখের জল মোছে। রাত শেষ হয়। সূর্য ওঠে দিগন্তপাড়ে । এখনও আশায় প্রহর গোনে, যদি চিঠিটা আসে।

দিন যায় দিন আসে। মা, বাবা, বোন শুধোয় – তোর চিঠি কবে আসবে? “আসবে মা ”, “আসবে বাবা ”, “আসবে বুনু ”, “একে একে সবার চিঠি আসবে ।”

এক মাস, দু’মাস, তিন মাস,শেষে বছর পেরিয়ে গেল। চিঠি আর আসেনি।

দূরারোগ্য ব্যাধি আরও জাঁকিয়ে বসল মায়ের শরীরে। বাবার হাঁপানির টান শুরু হয়েছে, পরিশ্রম আর সহ্য হয়না। শরীর ও মন তার দুই-ই ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় সুপ্রকাশ জীবনের যত দুঃখ-ব্যথা আছে, হৃদয়ের এক কোণে পাথরচাপা দিয়ে নিজেকে ইস্পাতের মত শক্ত করে নিল। জীবন-সংগ্রামের নতুন সংজ্ঞা খোঁজা শুরু হলো তার। টিউশনের চার-পাঁচ হাজার টাকায় সংসার চলবেনা। পাশাপাশি এক মালিকের টোটো নিয়ে চালাতে শুরু করলো।

একদিন পিছন থেকে দুজনের হাক শোনা গেল। “টোটো”, “এই টোটো”। টোটোটা কিছুটা পিছনে এগিয়ে গেলে ওই দু’জন উঠে বসে পড়লো। হঠাৎ একজন হো হো করে হেসে উঠল , “আরে সুপ্রকাশ, তুই!” আরেকজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই টোটো চালাচ্ছিস ?” পিছনে এক ঝলক তাকিয়ে একটু হাসলো সুপ্রকাশ। ওদের কথার উত্তর না দিয়ে সে বরং অন্য কথা বলল । শৈবাল ,শুভঙ্কর ,তোদের সাথে অনেকদিন পর দেখা হল । স্কুলে যাচ্ছিস বুঝি ? শুভঙ্কর মোবাইলে পাত্রী নির্বাচনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। শৈবাল উত্তর দিলো, “হ্যাঁরে”। দুজনের কি একই স্কুল? “ না, আমার বাহাদুরপুরে, শুভঙ্করের হরিশ্চন্দ্রপুরে, পাশাপাশি গ্রাম। এবার শৈবালও চোখ রাখলো মোবাইলের উপর। “হ্যারে শৈবাল ,চলবে নাকি?” “হ্যাঁ, দেখতে ভালই, চাকরিও করে। তোর পছন্দ হল কাউকে?” “ নারে, শুভঙ্করের চয়েসটা একটু আলাদা, বুঝলি? দেখতে ভালো আর চাকরি করলেই হবেনা। মালকড়িও লাগবে।” “ কত টাকা দাবি করবি?” “ টাকা, সোনা-দানা মিলে অন্তত লাখ কুড়ি,সঙ্গে দু’চাকার গাড়ি, আর খুশি হয়ে যা দেবে ,ব্যাস।” “ আমার দাবিটা তোর মতই প্রায়। তবে ভাই নগদ পুরোপুরি বারো লাখ নেবো। শশুড়বাড়ির টাকায় ঋণটা শোধ হয়ে যাবে। যাকে বলে কিনা- মাছের তেলে মাছ ভাজা।” শুভঙ্করও বেশ জোর দিয়ে বললো – “মাছের তেলে মাছ কি তুই একাই ভাজবি ?এখন আর কেউ বোকা নেই রে। ”

সুপ্রকাশ কথাবার্তাগুলো অভক্তিতে হলেও শুনছিল। ভেতরটা তার তিক্ততা আর ঘৃণায় ভরে উঠলো। সমাজ গড়ার দায়িত্ব তো এদেরই উপর। কিন্তু এসব কী শুনতে পেলাম !আজ এদের সাথে বন্ধুর পরিচয় বহন করতেও লজ্জা হয়। তবুও জিজ্ঞেস করল- শিক্ষক জীবন কেমন লাগছে রে?ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে। গরীব ঘর থেকেই আসে। ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে,ওদের সাথে খেলাধুলা করে নিশ্চয় দিন ভালোভাবে কেটে যায়। শুভঙ্কর উত্তর দিল – “ধূর , লেখাপড়া আজকাল কোন্ মাস্টার করায় রে? যে করায় সে একটা বদ্ধ পাগল। একটা ছড়া শোন্ -আসি যাই, মাইনে পাই, আমরা প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার ভাই।” সেই বদ্ধ পাগল তাহলে দু-একজন আছে বলছিস। “থাকবে না ? ওরা শুধু খেটেই মরে,আর নীতিকথা বলে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আরে বাবা ,প্রাইমারী স্কুলে গরীব ,চাষার ছেলেমেয়েরা আসে থালা হাতে দু’হাতা ভাত খেতে। খালিপেটে কি লেখাপড়া হয় ?” কেন রে, বিদ্যাসাগর, মেঘনাদ সাহা তো গরীব ঘরেই জন্মেছিল। শৈবাল বলল – এখন আর সেই যুগ নেই রে। শুভঙ্কর এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল – তুই হাসালি মাইরি। আচ্ছা মেঘনাদ সাহাটা কে ?নামই তো শুনিনি। “শুনবি কী করে ? বড়ো মানুষেরা আজ হারিয়ে গেছেন। আসলে কী জানিস , ঐ যে বললি না – এখন আর সেই যুগ নেই। তার মানে – আমরা কিন্তু যতটা এগিয়েছিলাম সেখান থেকে এক পাও আর এগোয়নি ,বরং অনেক পিছিয়ে গিয়েছি।” সুপ্রকাশের কথাগুলো শুভঙ্কর ভালো মনে নিলো না। তাচ্ছিল্য ,উপহাস করে বলে উঠলো – কী শুনছি রে ! টোটোর ড্রাইভার আমাদের জ্ঞান দিচ্ছে। ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে টোটো থেমে গেল। শুভঙ্কর নেমে চলে গেল। শৈবালও যেতে লেগে দু’পা পিছিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল – সুপ্রকাশ ভাড়া দিতে হবে? সুপ্রকাশ মুচকি হেসে বলল- ভাড়া তো আমি তোদের কাছে চাইনি। তারপর সে অপেক্ষা করতে লাগল পরের যাত্রীর জন্য।

এভাবে সারাদিন টোটো চালিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়। তারপর আবার টিউশন। বিশ্রাম শুধু কয়েকটা ঘণ্টা। ঘুমও ঠিক মতো হয় না। একদিকে মা,বাবা, অন্যদিকে কুসুমকে নিয়ে ভাবনা। “বোনের অনেকটাই বয়স হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হবে। নারায়ণপুরের ‘বিভূতি’ ,ছেলেটা ব্যাবসাদার ,বোন ওকে এতদিন মনে প্রানে চেয়েছে। সেও ভালোবাসে। বেশ সচ্ছল পরিবার, কিন্তু সে কি সত্যই গ্রহণ করবে?” নানা দুশ্চিন্তায় রাত কাটে সুপ্রকাশের।

জুন মাসের মাঝামাঝি,প্রচন্ড গরম পড়েছে। মা ভালো নেই। ডাক্তারবাবু বলেছেন- এক্ষুনি কেমোথেরাপি দিতে হবে। হাসপাতাল ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেখানেও তো অনেক টাকাপয়সা দরকার হবে। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের জন্য দ্বিতীয়বার আবেদন করেও এখনো হাতে পাইনি। এমনটা ভেবে সুপ্রকাশ তড়িঘড়ি এক সকালে পঞ্চায়েত প্রধানের উদ্দেশ্যে রওনা হল। সুবিশাল দরজার কাছে গিয়ে সুশোভিত প্রাসাদ বাড়ি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বছর পাঁচেক আগেও যখন প্রধান হয়ে ওঠেননি, এতসব আড়ম্বর ছিল না। এরই মধ্যে সাধারণ একতলা বাড়িটা যে এমন রূপ ধারণ করবে, কল্পনাও করতে পারে নি। তাই ভেতরে ঢুকতে একটু ভয় ভয় করছে। আবার দ্বাররক্ষীর অনুমতিও নিতে হবে। অনুমতি অবশ্য মিলল। ভেতরে গিয়ে সুপ্রকাশ বৈঠকখানার দামী সোফায় বসল। প্রধান সাহেব এলেন। জিজ্ঞেস করলেন – কী কারনে এসেছো? “প্রধান সাহেব , আপনার একটা সুপারিশপত্র প্রয়োজন। তার সুবাদে আমার মা হাসপাতাল থেকে কেমোথেরাপি নিতে পারবে। আরও কিছুদিন বাঁচতে পারবে। বুঝতেই পারছেন ,সংসারের অবস্থা ভালো নয়। একদিন কাজে না গেলে উপোস দিতে হয়। সেকারনেই একটু সাহায্য নিতে আপনার কাছে এসেছি।” “শোনো, বেসরকারি হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে এর জন্য প্রচুর খরচ। সরকারি হাসপাতালে সেই সুবিধা তুমি বিনা পয়সাতেই পেয়ে যাবে। সুপারিশ পত্র চেয়েছো, দেবো। তবে পাঁচশো টাকা লাগবে।” মায়ের জীবনের প্রশ্ন,তবু সুপ্রকাশ অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করলো না। নীরবতা পালন করতেও পারল না। “আপনি জনপ্রতিনিধি। মানুষের সুখ-দুঃখ ,ভালো-মন্দ দেখাই আপনার কর্তব্য। আপনি সেই কর্তব্য পালনের জন্যই শপথ নিয়েছেন। আপনার এত বৈভব ,ঐশ্বর্য, তবু আরও চাই ? জানি না ,এই বৈভব, ঐশ্বর্যের মধ্যে কত দুঃখী-জনের চোখের জল মিশে আছে !”

প্রধান দ্বাররক্ষী ডেকে সুপ্রকাশকে মনুষ্যেতর আচরণ দেখিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দিল। বাড়ি ফিরে এসে মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারল না সুপ্রকাশ। দূর আড়ালে থেকে চোখের জল মুছতে মুছতে টোটো নিয়ে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতে চিরকালের মতো গেল মা। চোখের কোণে শুধু রেখে গেল অভিমানের অশ্রু।

সেই রাতে শ্মশানে বিভূতি এসেছিল। সুপ্রকাশ তাকে কাছে ডেকে তার ইচ্ছেটা জানতে চাইল। বিভূতি সহানুভূতির সাথে বলল- দাদা, আমরা দুজনেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু সামাজিক নিয়ম তো মানতেই হবে। এখন একটা বছর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর হ্যাঁ,বুঝতেই পারছো ,বনেদি পরিবার, যদিও আমার মা-বাবা তোমাদের অবস্থা জানে ,তথাপি সামান্য হলেও তারা কিছু আশা করে। “বিভূতি,আমার বোন তোমার ঘরে যাবে,এখানে দয়ার প্রশ্ন নয় , আর তোমাদের সামাজিক নিয়ম-নীতিতে আমি আঘাত করতেও চাই না। এবার খুলে বলো ,কী তাদের আশা।” বিভূতি আমতা আমতা করে বললো – ধরে নাও লাখ দুয়েক টাকা ,একটা বাইক,আর খাট ,আলমারি। এটুকু অন্তত দিও। দেখো দাদা, মন খুলে বলে ফেললাম, মনে কিছু করো না। এ আমার ইচ্ছে নয়। একে যৌতুক বলেও ভেবোনা।

সুপ্রকাশ অতি সরল মনে এই ইচ্ছাকে সম্মতি জানিয়ে বাড়ি ফিরে এল। এখন তার একমাত্র চিন্তা- একটা বছরে যে করেই হোক টাকার সংস্থান করতে হবে। কয়েক দিনে মায়ের মৃত্যুশোক সামলে নিয়ে শুরু করলো এবার দিনরাত টোটো চালানো।

বর্ষায় ক’দিন টানা জলে ভিজে সুপ্রকাশের জ্বর এলো। কুসুমের বারণ সত্তেও জ্বর নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে টোটো নিয়ে। সারারাত পর একদিন ভোরে যখন বাড়ি ফিরল তখন মাথা ঘুরে পড়ে গেল। কুসুম কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে দাদাকে ধরল। “ ইস!গাটা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এ তুই কী করছিস দাদা! তোর কিছু হয়ে গেলে আমাদের কী হবে? “নারে বোন ,আমার কিচ্ছু হবে না। ” হবে না বললে আমি শুনবো না। এখন জ্বর না সাড়া পর্যন্ত কাজে বেরোবি না। আর রাতে গাড়ি চালানো একেবারে বন্ধ। সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে একটু বিশ্রাম না নিলে তুই যে শেষ হয়ে যাবি ।

দাদাকে এত কিছু বলে শাসন করলে কী হবে ? মনে মনে কুসুম ভাবে- সব জিনিসের আকাশছোঁয়া দাম। তার উপর বাবার চিকিৎসার খরচ। টিউশনের ক’টা টাকা আর টোটো চালিয়ে দাদা যে অপারগ ,অথচ মুখে সে কথা বলেনা। দুশ্চিন্তার বোঝা আর কারও উপর চাপাতেও চায় না। পরক্ষণেই আবার দাদার দিকে তাকিয়ে বলে- খাটতে খাটতে তোর শরীর ভেঙে পড়েছে। ভাঙেনি শুধু মনের জোরটাই । একটাই জামা,বারবার সেলাই করে পরছিস। বড় খারাপ লাগছে রে। সুপ্রকাশ বোনকে বলে- তোরও একটা শাড়ি দরকার। সেটা আগে কিনবো ,তারপর আমার জামা। শাড়ি ছেড়া অংশটা লুকিয়ে কুসুম বলে – না রে দাদা, আমার শাড়ি এখনো ভালো আছে।

দাদা-বোনের কথা কাটাকাটির মধ্যে বাবার গলার আওয়াজ শোনা গেল। কিন্তু এ আওয়াজ কেমন যেন লাগলো। ভয়ে দুজনে দৌড়ে গেল বাবার কাছে। দুজনেই বাবা, বাবা বলে কতবার ডাকলো, সাড়া পেল না। অবস্থা ভালো নয় দেখে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু দেখে বললেন- হার্ট অ্যাটাক। কিছু সময় পরে এসে এবার বললেন- বিপদ ঘটে যাবার আগেই আনতে পেরেছো বলে এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন । কিন্তু বিপদ আবার যে কোন সময় আসতে পারে।

দুদিন পর বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হলো। সেদিন বিকেলে সুপ্রকাশ পার্বতীর বাড়ি গেল এক কঠিন সিদ্ধান্ত জানাতে। তাকে দেখামাত্রই পার্বতীর মুখখানা খুশিতে ভরে উঠল। ভালোবাসার পাপড়িগুলো বাতাসে দুলে উঠলো। এতদিনের বন্ধন সুপ্রকাশ কেমন করে ছিন্ন করে দেবে ! তবুও মন শক্ত করে বলে দিলো- পার্বতী, আমার জীবন মরুভূমির মতো। তার প্রখর তাপে তোমার জীবন ঢলে যাবে। আমি তা সইতে পারবো না। সেকথা বলতেই আজ এসেছিলাম। আমি নিরুপায়। তোমার জীবন কোন স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় বিকশিত হয়ে উঠুক, এ আমার স্বপ্ন ,বড় সাধ। পার্বতীর দুচোখ জলে ভরে উঠল । প্রতিজ্ঞা করল – সুখ আমি চাই না। দুঃখের মাঝেই অনুভব করেছিলাম স্বর্গ-সুখ ,দুঃখের মাঝেই ফুলশয্যার স্বপ্ন দেখেছিলাম ,দুঃখ নিয়েই জীবনভর তোমার অপেক্ষায় থাকব।………….। সুপ্রকাশ তবুও হৃদয়ের বড়ো আপনজনকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এল।

পরদিন থেকে সব দুঃখ ভুলে কাজে মন দিল। টিউশনগুলো সব ছাড়া গেছে । বেশ কয়েকদিন কামাই হয়েছে কিনা। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছেই পড়তে এখন আগ্রহী। শৈবাল , শুভঙ্কর স্যারের ব্যাচে গিয়ে সবাই ভীড় করেছে। ফলে টোটোই এখন সুপ্রকাশের একমাত্র ভরসা। দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল । বেশি ভয় বাবাকে নিয়ে। কখন আবার কী হয়ে যায়। বোনের বিয়ের টাকাটাও জোগাড় হবে কী করে ! কোনো যে কূলকিনারা নেই। মনে মনে ভাবল – তিন কাঠা ভিটেমাটির এক কাঠা বেচে দেবো।

দাদার দুশ্চিন্তা কুসুমকেও ভাবিয়ে তুলেছে। বাড়ির জায়গা বেছে বিভূতিকে টাকা দেবে, সেকথাও কানে এসেছে। একদিন সকালে বিভূতির বাড়ি গেল কুসুম। হঠাৎ এভাবে না জানিয়ে এসেছে দেখে বিভূতি কিছুটা চমকে গেল। “বসো কুসুম।” “না,কুসুম বসতে আসেনি। এই প্রথম তোমাদের বাড়িতে এলাম। আর এই আমার শেষ আসা।” “একথা কেন বলছো? যদি কোন ভুল করে থাকি, আমাকে বলো, আমি তার প্রতিকার করব।” ভুল তুমি করোনি, করেছি আমি। আর তার প্রতিকার আমিই করব। ভালোবেসে যে গোলাপ একদিন তুমি আমাকে উপহার দিয়েছিলে, তা আমি হৃদয়ের অন্তস্থলে সযত্নে রেখেছিলাম। কখনও বুঝিনি তা ভালোবাসার উপহার নয়,তা জিনিসের মতোই আমাকে দাম দিয়ে কিনতে হবে।” “ওঃ, সামান্য কিছু টাকা আর দুটো জিনিস চেয়েছি বলে ?” “সামান্য হলেও জীবনের বন্ধন টাকা দিয়ে রচনা করতে হবে, আমার জানা ছিল না। অবশ্য ব্যবসাদার ,তারউপর বিত্তবান মানুষ,তার ভাবনা এমন হওয়াই স্বাভাবিক। তাই যদি হয়,আমি তোমার উপহার ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম। জানবো,একটা নদী দীর্ঘ মরুপথে চলতে চলতে একদিন মিলিয়ে গেছে , নাইবা হল তার সাগরের সাথে মেশা। কেননা,সে অপার সুখ চায় না ,দুঃখকে আপন করেই বেঁচে থাকতে চায়।”

রাতে সুপ্রকাশ বাড়ি ফিরল যখন, কুসুম তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো- দাদা, বাড়ির জায়গা বেচে বোনকে পার করতে চাইছিস? আমি তোর মাথার বোঝা হয়ে গেছি, তাইনা? আমি বিয়ে করবো না । ওই টাকার পিশাচের সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এসেছি। “এ তুই কী করলি কুসুম? তুই আমার একমাত্র বোন । আমি ছাড়া তোর আর কে আছে? তোর ভালো-মন্দ সেতো আমাকেই দেখতে হবে।” না থাক, তুই আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে ভেবেছিস – ঘরে বউ নিয়ে আসবি? সুপ্রকাশ আর একটা কথাও বলল না।

গভীর রাতে কুসুম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অনুশোচনায় নিজেকে দোষ দিতে লাগল। এ আমি কী বললাম দাদাকে! যে নিজের সুখের কথা একবারও ভাবে না, খাটতে খাটতে বুকের হাড়গুলো জেগে উঠেছে। তাকে আমি এভাবে কেন দুঃখ দিলাম?………?

কান্নার আওয়াজে অসুস্থ বাবা জেগে উঠলো। সুপ্রকাশ বাতিটা জ্বলে বোনের মাথায় এসে হাত রাখল। “পাগলি মেয়ে, তোর কথায় আমি কিচ্ছু মনে করিনি।” দাদা, তুই বৌদিকে ঘরে নিয়ে আয়। ও অপেক্ষা করে আছে। আমাদের কষ্টের জীবন, নাহয় আরেকটু বেশি কষ্ট হবে। “ তুই ঘুমিয়ে পড়্” বলে গম্ভীর হয়ে সুপ্রকাশ নিজের নিজের ঘরে চলে গেল।

সারারাত ঘুম হয়নি কুসুমের। ওদিকে ভোর না হতেই সুপ্রকাশ টোটো নিয়ে বেরিয়ে গেল। কুসুম আজ আশ্চর্য বোধ করল। দাদা আমাকে না বলে গেল, না খেয়ে গেল? মন খারাপ করে বাবার কাছে গিয়ে বসল। নালিশও জানালো। বাবা বলল- আমাকে বলে গেছে, বাইরে খেয়ে নেবে। “কেন বাবা ?” বালিশের তলায় রাখা প্রেসক্রিপশনটা বের করে দেখিয়ে বললো- কী একটা পরীক্ষা হবে ,অনেক টাকা লাগবে। হয়তো সেই চিন্তাতেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেছে। কুসুম কেঁদে ফেলল। “ কাল রাতে আমি ওকে কত খারাপ কথা বলেছি।” বাবা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল- আমি সেকথা শুনেছি। তুই ঠিক বলিসনি মা। অনেক দিন আগেই সে তার সমস্ত আশা-আকাঙখা ময়ূরাক্ষীর জলে বিসর্জন দিয়ে এসেছে।

কুসুম এত দুঃখ সইবে কেমন করে! “ দাদা এই দুঃখ-কষ্টের অংশীদার একা কেনো হবে? আমি কেন হতে পারি না?” এমনটা ভেবে সকাল সকাল বাবার জলখাবারের ব্যবস্থা করে বেরিয়ে পড়ল প্রধানের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

কুসুম এসে গেলে প্রধান তাকে ভেতরে ডেকে বৈঠকখানায় বসালেন। আপাদমস্তক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। চেনা চেনা মনে হলেও সন্দেহটা দূর করতে কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞেস করলেন – “তুমি সুপ্রকাশের বোন না ?” “হ্যাঁ।” “ কী দরকারে এসেছো ?” জীবন যন্ত্রনায় ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কাকুতি মিনতি। “আমার একটা কাজ দরকার। সম্মানজনক যেকোনো কাজ হলেই হবে। আই.সি.ডি.এস – সুপারভাইজার পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম। ইন্টারভিউও দিয়েছিলাম। চাকরিটা হয়নি।”প্রধান মনে ভাবলেন- ক্ষুধার্ত মাছ ,টোপ ফেললেই গিলবে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বললেনও – “তোমার দুঃখ আমি বুঝেছি। আমার নার্সিংহোমে কাজ করবে ? বেতন ভালোই পাবে।”

কুসুম রাজি হয়ে গেল। এবার নার্সিংহোমে দেখানোর জন্য প্রধান তার গাড়িতে কুসুমকে চাপিয়ে নিয়ে রওনা হলেন। কিছুক্ষণ পর গাড়িটা এসে ঢুকে পড়ল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সদ্য নির্মিত একটা বাগান বাড়ির ভেতরে। গাড়ি থেকে নামতেই কুসুম দেখল – এটা একটা নির্জন বাড়ি। ভয়ে ভেতরটা কাঁপতে লাগল। প্রধান বললেন – “কেবলই তৈরি করেছি। আগামী সপ্তাহে চালু হয়ে যাবে। এসো ভেতরে।”ভেতরে চলে গেল কুসুম। পরের ঘটনা সে জানেনা।

জ্ঞান ফিরল যখন ,সূর্য ততক্ষণে প্রায় মাথার উপর। কুসুম দেখল- সে বিবস্ত্র অবস্থায় কম্বল বিছানো মেঝের উপর পড়ে আছে। সারা শরীরে অব্যক্ত যন্ত্রণা। বুঝতে পারল ,মানুষের পোশাক পরা ইতর প্রাণীটা নির্বিঘ্নে তার খিদে মিটিয়ে নিয়েছে। আর একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে, “কাকপক্ষী জানতে পারলে মৃত্যু নিশ্চিত।”

কোনো রকমে বাড়ি ফিরে এলো কুসুম। চিরকুটটা হাতের মুঠোতেই ছিলো। এ মুখ সে বাবাকে দেখাবে না। তাই নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তারপর সাদা কাগজে লিখল- “দাদা, আমার জীবনের অন্তীম ক্ষণ এভাবে ঘনিয়ে আসবে, আমিও জানতাম না। একটা কাজের খোঁজে গিয়েছিলাম প্রধানের কাছে। কাজের বিনিময়ে যা পেলাম তা ঘৃনায় বলতে পারলাম না। পোস্টমর্টাম রিপোর্টে পাওয়া যাবে। এছাড়া প্রমাণ আমার হাতের মুঠোয়। ভালো থাকিস। চিরবিদায় ! ইতি, তোর হতভাগ্য বোন।”

সুপ্রকাশের মনটা আজ বারবার বাড়ির দিকে টানছিল। সন্ধ্যার অনেক আগেই টোটো নিয়ে ফিরে এলো। খবর পেয়ে একটু আগে পার্বতীও ছুটে এসেছে। শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। বাড়িভর্তি লোকের সমাগম,সবার চোখে জল। তবু নির্জন শ্মশানের মতো নীরবতা। লাঠি ভর দিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা উঠোনে মেয়ের নিথর দেহের কাছে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। সুপ্রকাশ পাশে এসে দাঁড়াতেই সে পাথর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। নীরবতার বাঁধ ভেঙে হাজার কন্ঠের প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো। কয়েক মুহূর্ত মৃত বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে সুপ্রকাশ বুক চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো – হে পৃথিবী, তোমার বুকে এ কোন্ সভ্যতা? হে মানব সমাজ, বলো আমি কী অপরাধ করেছি? এই পরিণতিও আমাকে দেখতে হল !

……………………………………………………..