Aadhar Periye – আঁধার পেরিয়ে

সুনীলবাবু এলাকায় রায়বাবু নামেই পরিচিত । নিষ্ঠাবান ধার্মিক । সংসার ধর্মকেও অবহেলা করেননি। সংস্কৃতে ডবল এম. এ। যোগ্যতা সত্ত্বেও কোনো পেশা গ্রহণ করেননি । জীবনে ব্রত নিয়েছেন মানবসেবার। স্ত্রীও তাঁর মতকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

সাতপুরুষের বাগান বাড়ি, মাঝখানে আছে রাধাগোবিন্দের মন্দির। তার পাশে একটি পুকুর। স্নানের জন্য একটি শানবাঁধানো ঘাটও আছে। বাগানে আছে বিচিত্র বৃক্ষ আর ফলের গাছ। নানা রকম শাক-সবজিও চাষ হয়। এছাড়াও আছে বিঘা পঞ্চাশেক তিন ফসলী জমি।

বাগান ,জমি দেখাশোনার জন্য দুজন লোক রাখা আছে। যদিও চাষাবাদের কাজে দেখভাল এতদিন মূলত: রায়বাবু নিজেই করেছেন। বয়সের কারণে এখন আর পেরে ওঠেন না। বিশেষ সময়ও পান না। তিনি তাঁর বাগানবাড়িতে একটি আশ্রমিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন- “ অনাথ সেবা আশ্রম” । পনেরো-কুড়ি জন দুস্থ ছেলে সেখানে প্রতিপালিত হয়। তারা প্রত্যহ সকালে কঠোর অনুশাসনে লেখাপড়া শেখে।পাশাপাশি চাষাবাদ এবং নানাবিধ গৃহকাজ করে। সন্ধ্যায় রায়বাবু ফের ওদের নিয়ে বসেন। চলে গীতা, উপনিষদ এবং নানা পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থ পাঠ । ছেলেদের দেখভাল এবং রান্নার জন্য একজন মাশীও আছে ।

রায়বাবুর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। জীবন এখন সার্থক। আর বৈশাখের প্রথম দিনটি তাঁর জীবনের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আশ্রম। দেখতে দেখতে প্রায় একটা বছর পূর্ণ হতে চলেছে।

চৈত্র বিদায় নিয়েছে। চিরাচরিত নিয়মে প্রকৃতিতে বসন্তের শুভ সূচনা হলো। বৃক্ষরাজি ,ফসলের জমি সবুজে ভরে উঠল। এমন সৌন্দর্যময় দিনে এক বিকেলে বাড়ির একমাত্র মেয়ে পূর্ণিমা হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে এসে বাবা-মাকে খুশির খবর দিল- তোমাদের মেয়ে এম. এ পাস করেছে। ‘কাছে আয় মা’ বলে মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ।

প্রাণের উচ্ছ্বাসে পূর্ণিমা বলে উঠলো , “বাবা, আশ্রমে বসন্ত উৎসব করলে কেমন হয় ?” হ্যাঁ মা, তাই হবে – বাবা অবলীলায় বলে উঠলেন। খুশির খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অতিথিরা আমন্ত্রিত হলেন ।

নির্ধারিত দিনে গোটা বাগানবাড়ি সেজে উঠল। সারাদিন ব্যাপী উৎসব। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় সংগীত, আবৃত্তি ,নৃত্যে মুখরিত হয়ে উঠলো আশ্রম প্রাঙ্গণ।

সেদিন রাতে পূর্ণিমা বললো – বাবা ,আশ্রমটাকে বড় করলে কেমন হয় ? ছেলেদের পাশাপাশি দুস্থ মেয়েদেরকেও পড়ানো হবে। আমি ওদের পড়াবো। শুধু লিখতে-পড়তে পারা,সাধারণ গণিত চর্চা ,ধর্মগ্রন্থপাঠ নয়। ওদের ইতিহাস, বিজ্ঞান,উন্নত গণিত শেখানো হবে। সম্মতি জানিয়ে বাবা বললেন – প্রস্তাবটা মন্দ নয় । সামাজিক একটা বড় কাজ। তবে কী মা,অন্তত: আরও একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার প্রয়োজন হবে। তাকে কিছু সাম্মানিকও দিতে হবে।

অবশ্য স্বপ্ন পূরণ হতে দেরী হল না । এলো ১লা বৈশাখের দিন। সন্ধ্যায় মেয়েদের পড়াশোনার শুভ সূচনা হল । আশ্রমের নাম বদলে হল – দুঃস্থ সেবা আশ্রম। একজন যুবকও এলো শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে। সে জানালো , “আমি দর্শনে এম.এ পাস করেছি বছর খানেক আগে। পি. এইচ. ডি করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় হয়নি। এখন টিউশন করি। ” পূর্ণিমা তাকে চোখের দেখা চেনে ,তার সম্বন্ধে জানে ,যদিও সামনাসামনি কখনও আলাপ হয়নি।

ছেলেটি যুক্তি-তর্কে বেশ পরিণত। গরিব কিন্তু মেধাবী। যুক্তির বাইরে কোনো কিছু বিশ্বাস করে না,জীবনে গ্রহণও করে না। তাই বলে কারও প্রতি তার অশ্রদ্ধাও নেই। সে বিনয়ী ,ভদ্র ।তার পোশাক-আশাক অতিসাধারণ কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন । মার্জিত ব্যবহার ,মিষ্টভাষী ।কথা গুছিয়ে বলে। আশ্রমের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে অত্যন্ত আপন এবং প্রিয় হয়ে উঠেছে। আবার নামটাও তার বেশ চমৎকার, প্রিয়তোষ সরকার । তাই সে এখন সবার প্রিয় স্যার। গ্রীষ্ম ,বর্ষা ,শীত গেল ,একটা দিনও কামাই করেনি। আশ্রমে না এসেও থাকতে পারে না।

একটা বছর হয়ে গেল আসা। এরই মধ্যে আশ্রমের অনেক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। প্রিয়তোষও আশ্রমকে নিয়ে আরও অনেক স্বপ্ন দেখে। পূর্ণিমাও প্রেরণা পায় তাকে দেখে। এত যার গুন সে যে এখন মনের মানুষ। তাকে কি ভালো না লেগে পারে? ইতিহাসের না জানা কত প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসের ছাত্র না হয়েও সে সাবলীলভাবে বলে দিতে পারে । দিনের-পর-দিন পূর্ণিমারও কত কিছু জানার আগ্রহ বাড়ে। একটু একটু করে সে আরও কাছে আসে।

ইতিমধ্যে দুস্থ সেবা আশ্রমের কথা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরের ছাত্র-ছাত্রীরাও আশ্রমে এসে লেখাপড়া করতে চাইছে। প্রিয়তোষের অনুরোধে আর পূর্ণিমার ঐকান্তিক ইচ্ছাতেই দুস্থ সেবা আশ্রম রূপান্তরিত হল ‘আবাসিক দুস্থ আশ্রমে ।’

ফোনের পর ফোন । দামি দামি গাড়িও আসে। একদিন ‘জননী জন্মভূমি’ দলের এক মন্ত্রী এসে হাজির হলেন,সঙ্গে অন্যান্য লোকজন। রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল রায়বাবুকে মধ্যমনি করে। এই তাঁর রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ । বৈঠক শেষে জানা গেল – শ্রদ্ধেয় সুনীল রায় দলের জেলা সভাপতি পদে মনোনীত হয়েছেন। পরদিন রায়বাবুর নাম খবরের শিরোনামে উঠে এল।

বাগান,বাড়ি আর আবাসিক দুস্থ সেবা আশ্রমের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন থেকে পূর্ণিমা তোর উপর – একথা রায়বাবু সবার সামনে জানিয়ে দিলেন। প্রিয়তোষকেও বললেন – তুমি ওকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে। তাতে তোমার সাম্মানিক কিছুটা বেড়ে যাবে এ মাস থেকেই। প্রিয়তোষ মৃদু হাসল।

২৮শে শ্রাবণ পূর্ণিমার জন্মদিন। এবার ঘটা করে পালিত হচ্ছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। প্রিয়তোষও এসেছে। এক কোণের একটা চেয়ারে বসে। নামী-দামী, আভিজাত্যপূর্ণ লোকের মাঝে এটাই উপযুক্ত জায়গা বলে সে মনে করেছে। কিন্তু পূর্ণীমার চোখে এই সাধারণ ছেলেটিই আজ অসাধারণ। তার কাছে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল – ইনি আমাদের আশ্রমের শিক্ষক। এনার গুণ আর পাণ্ডিত্যে আশ্রম আজ বিকশিত। এত বড় বড় বিশেষণে নিজেকে খানিকটা লজ্জিত মনে করলো প্রিয়তোষ। তবু সহাস্যে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে নমস্কার জানিয়ে পুনরায় বসে পড়ল। অতিথিদের মাঝে রায়বাবু এসে পড়েছিলেন। পূর্ণিমার কথার সাথে তিনি প্রিয়তোষের আরও একটা পরিচয় যোগ করে বললেন – ও তপশীলি সম্প্রদায়ের ছেলে। বস্তিতে থাকে। তবে পড়ায় ভালো। প্রিয়তোষের মুখের হাসি নিমেষে মিলিয়ে গেল। পূর্ণিমার ভেতরেও প্রচণ্ড আঘাত এসে লাগলো। বাবার মূখের দিকে তাকিয়ে অন্তঃস্থলে নীরব প্রতিবাদ ধ্বনিত হল -তুমি জাতপাতের কথা তুলতে গেলে কেন?



ইতিমধ্যে রায়গিন্নী এসে ডাক দিলেন- আপনারা সকলে ভোজন কক্ষে আসুন। সকলে সেদিকে চলে গেলে প্রিয়তোষ তখনও বসে। পূর্ণিমার হৃদয় আকাশে ঝড় বইছে। আবার আনন্দেরও উচ্ছাস। তথাপি অজানা কোন্ এক দুর্বলতা এসে ঘিরে ধরে। মনের অত্যন্ত গোপন কথাটা বলতে চায়,বলতে পারেনা ।এরই মধ্যে প্রিয়তোষ বলে উঠল – বসুন ম্যাডাম। পূর্ণিমা বসে। মৃদু স্বরে প্রতিবাদ জানায় – ‘বসুন ম্যাডাম’ কেন? ‘বসো পূর্ণিমা’ বললেই আজ ভালো লাগতো। সেটা আমার পক্ষে বেমানান। আপনি বরং আমাকেই নাম ধরে ডাকতে পারেন। “বেশ,তাই ডাকবো। তবে তুমিও আমাকে নাম ধরে ডাকবে,বলো। এ মা, ‘তুমি’ বলে ফেললাম ।” না না, ঠিক আছে । আপনি আমাকে ‘তুমি’ই বলবেন। “শুধু আমি বলবো ,আর তুমি বলবে না কেন? না ,তা হয় না। বলোতো, আমরা কি পরস্পরের বন্ধু হতে পারি না? ” আমার মনে হয়, সেই যোগ্যতা আমার নেই। সরকারী পতিত জমিতে বাস করা চালচুলোহীন একটি ছেলে ,যার বাবা মুনিষ খাটে। সে কী করে আপনার বন্ধু হতে পারে? ম্যাডাম ,লোকে আমাদের ছোট জাত বলে। আপনারা ব্রাহ্মণ ,সমাজের বিচারে আপনারা নমস্য। তার উপর এত বড় আভিজাত্য ,না না ,তা হয় না। “কেন হয় না?” তাহলে আপনাকে যদি বলি – অতীতের সেই বৈদিক সমাজের ঋষিগণ নিজেদের হীনস্বার্থে নিজেদের তৈরি নিষ্ঠুর নিয়মের বলে অগণিত অসহায় ,নিঃস্ব মানুষকে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ঘৃণায় ভরিয়ে গাঢ় অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিলেন। তা শুধু ভুলই ছিল না , ছিল অন্যায়। এই সত্য নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন কি? “আমি প্রস্তুত। প্রিয়তোষ ,আমি ইতিহাসের ছাত্রী। প্রকৃত ইতিহাসটাও আমি জেনেছি। তাছাড়া তুমি যে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য সেখানে মাঝে-মধ্যে আমিও যাতায়াত করি।” প্রিয়তোষ কেমন যেন একটু চমকে ওঠে ,আর কোন কথা বলে না। পূর্ণিমা এবার বলে – “পি. এইচ. ডি টা করবে প্রিয়তোষ ? আমিও করবো ভাবছি ,নেতাজী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। না, টাকার জন্য ভেবোনা। তুমি যদি চাও ,আমি ব্যবস্থা করতে পারি। ” ম্যাডাম, পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন? তাছাড়া কারো দয়া বা দান আমি নিই না। “তাহলে ধার হিসেবে নাও ।” না তাও নেব না। আমার কাছে মনে হবে – সেটাও ‘দয়া’ । বলতে আমার লজ্জা নেই,কখনও আমি জমিতে মুনিষও খাটি। সেদ্ধ ভাত খেয়ে দিন কাটাই। যাইহোক, টিউশনের টাকা থেকে কিছু জমিয়েছি ।বাকিটাও জোগাড় হয়ে যাবে । “স্কুল সার্ভিসে বসোনি?” আমার তো বি. এড নেই। অবশ্য বি. এড থাকলেও হতো না। লক্ষ লক্ষ টাকা ডোনেশন। সেওতো অন্যায়। পূর্ণিমা আর কথা না বাড়িয়ে ভোজন কক্ষে নিয়ে যায় প্রিয়তোষকে।

তিন মাস পর পূর্ণিমা ভর্তি হল পি.এইচ.ডি তে। প্রিয়তোষও কষ্ট করে ভর্তি হয়েছে। এদিকে আশ্রমে একটা সমস্যাও তৈরি হয়েছে। রায়বাবু ইদানিং লক্ষ্য করেছেন – প্রিয়তোষের পাঠদান কৌশল অত্যন্ত ভালো, কিন্তু পাঠের কিছু কিছু বিষয়বস্তুর উপর ব্যাখ্যা বেশ আপত্তিকর ।

গ্রীষ্মের শেষ। প্রকৃতি বর্ষাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এমন সময় একদিন ছুটির দিনে রায়বাবু প্রিয়তোষকে ডাকলেন। ধূসর কালো মেঘেদের নিচে চাতকেরা আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। হয়তো একটু পরে রিমঝিম বৃষ্টি নামবে। এমন পরিবেশে বৃক্ষরাজির ছায়াতলে খোলা জায়গায় বসলেন গোটা চারেক চেয়ার পেতে। সামনে একটি টেবিল, তাতে কিছু বই আর কাগজপত্র। পূর্ণিমাও আছে। রায়বাবু বললেন – প্রিয়তোষ ,একটা বিষয়ের উপর তুমি ইতিপূর্বে ছাত্রছাত্রীদেরকে ব্যাখ্যা দিয়েছো ,কিন্তু আমি তা পুনরায় একবার জানবার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। বিষয়টা হল – ‘মানুষ ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে না ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন?’

প্রিয়তোষ মনে মনে ভাবছে – সামান্য চাকরিটা বোধহয় এবার খোয়া যাবে। তা যদি যায় যাক্ ,সত্য বলে যা জেনেছি তাই বলব। এমন সময় রায়গিন্নীও এলেন চা নিয়ে। চা খেতে খেতে প্রিয়তোষ বলল – এই বিষয়ের উপর যে ব্যাখ্যা আমি দিয়েছি ,আমার দৃঢ় বিশ্বাস , আপনি আড়াল থেকে সবই শুনেছেন। ভুলটা কী, এখন আপনার কাছ থেকে শুনলেই ভালো হয়। কিছু বলার থাকলে আমি না হয় পরেই বলবো।

রায়গিন্নী প্রিয়তোষের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে একটু মেজাজে বললেন – “তোমার সাহস হয় কী করে , তুমি এভাবে তর্ক করছো? জানো, ওনার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী? এখন আবার দলের জেলা সভাপতি।” পূর্ণিমা ধমক দিল- ‘মা ,কী হচ্ছে, এসব কথা কেন ?’ রায়বাবু বললেন – ঠিক আছে, আমিই বলছি। দেখ ,আমি ঈশ্বরকে অনাদি-অনন্ত ,চিরন্তন বলে বিশ্বাস করে এসেছি। প্রতিদিন চন্দ্র-সূর্য ওঠে, দিনরাত হয় ,ঋতু বদলায় ,গাছে গাছে কত বিচিত্র রঙের ফুল ফোটে। এই মাটিতে কত পাপী-তাপী ,নরাধম অনুভব করে স্বর্গসুখ। ভক্তের প্রার্থনায় মৃতের দেহে প্রাণের সঞ্চার হয়। তোমরা বিজ্ঞানের যতই দোহাই দাওনা কেন ,কারও মহিমা না থাকলে এসব ঘটা সম্ভব নয়। তিনি সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর , বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বময় কর্তা। সকল জীবের তিনিই সৃষ্টিকর্তা। এবার বলো তুমি কী বলবে।

“কাকাবাবু কোনো কিছুই চিরন্তন নয়।

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও একদিন সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতির নিয়মে- সে তো বিজ্ঞানেরই নিয়ম। আবার এখানে যা কিছু ঘটছে সবই প্রকৃতির নিয়মে। পৃথিবীতে ধর্ম ,স্বর্গ ,নরক ,ঈশ্বর চিন্তা একদিন ছিল না। সমাজ বিকাশের এক বিশেষ স্তরে উৎপাদন এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণি-সংগ্রামের বিশেষ প্রয়োজনকে ভিত্তি করেই সেগুলি বিশেষ রূপ নিয়ে এসেছে। এবার ঈশ্বর ধারণা কী করে জন্ম নিল? আদিম গোষ্ঠী সমাজগুলি স্থায়ী সম্পত্তি সৃষ্টি হওয়ার পর কৃষি বা পশুপালনকে কেন্দ্র করে ভেঙে গেল। সম্পত্তির দখলকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে লড়াই হল। পরাজিতরা দাসে পরিণত হল। সমাজ এই প্রথম দাসপ্রভু এবং দাসে বিভক্ত হয়ে গেল। দাস ব্যবস্থার অভ্যন্তরে নির্মম যাতনা থেকে রেহাই পেতে দাসেদের মুক্তি সংগ্রামের প্রয়োজন দেখা দিল। দাস বিদ্রোহ হল। দাস মালিকরাও দাসেদের বোঝাতে লাগলো – মালিক বা প্রভুদের মেনে চলাই তোমাদের কর্তব্য। অত্যাচারিত দাসেরাও দেখল – তাদের মালিক সুশৃঙ্খলায় এই জনপদ বা নগর রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন ,তবেই সমাজে শৃঙ্খলা থাকছে , দাসেদের মধ্যেও শৃঙ্খলা থাকছে। অতএব ,মালিক বা প্রভুদের মেনে চলাটাই নৈতিকতা। এই নৈতিকতার ধারণা থেকেই দাসেদের মনে ভাবনার উদয় হলো – এই বিশ্বেরও অলক্ষ্যে এরকম কেউ মালিক বা প্রভু আছেন ,যিনি বিশ্বের সমস্ত কাজকে সুশৃংখল এবং সুষ্ঠভাবে চালাচ্ছেন ,তিনি সর্বশক্তিমান। এইভাবে সেদিন সমাজে ঈশ্বরের ধারণা এসেছিল। ”

‘এসব ব্যাখ্যা তুমি কোথায় পেয়েছো?’ রায়বাবুর প্রশ্নের জবাবে প্রিয়তোষ বলল – আমার ধৃষ্টতা মাফ করবেন। জীবনে যা সত্য বলে জেনেছি ,ছাত্রদের তাই শিখিয়েছি। আমার আর কিছুই বলার নেই, এই বলে উঠে চলে গেল। পূর্ণিমা মনে মনে হাসল। রায়বাবুর দিকে তাকিয়ে গিন্নীমা বলে উঠলেন ‘দেখলে, ছেলেটার কী দম্ভ? তোমাকে অসম্মান করল ! আর পূর্ণিমা, তুই চুপ কেন ? তোর আত্মসম্মানে……?’ “না মা ,এতে আমাদের কারও সম্মানহানি হয় নি। আমার তো মনে হয়- বস্তির ছেলে বলে ওকে তোমরাই সম্মান জানাতে পারছো না।” রায়বাবু রেগে গেলেন – ‘চুপ কর্ ,আজকাল দেখছি – ছেলেটাকে নিয়ে তুই একটু বেশি মাতামাতি করছিস। মেয়েকে সামলাও পূর্ণিমার মা।’ পূর্ণিমা এবার মূখ ফুটে হেসে উঠে বলল – “বাবা ,আজকাল আশ্রমের এত নাম ডাক হচ্ছে ,তার বেশির ভাগটা ওর জন্যই। তাই এসবে মাথা না ঘামিয়ে সামনে আশ্রমের তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পূর্ণ হতে চলেছে। বরং বড় করে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করো।” রায়বাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন – বেশ ,তুই-ই তাহলে ব্যবস্থা কর্ ।

দুদিন পর, রবিবারের সন্ধ্যা। দলের চার-পাঁচজন মাথাওয়ালা লোক এলেন বাড়িতে। বৈঠক বসল। আলোচনার বিষয়বস্তু -এলাকায় দলের একটা অফিস তৈরি। উত্তম প্রস্তাব । পাসও হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা একটা দেখা দিল জায়গা নিয়ে। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর জেলা সম্পাদক মতামত দিলেন – ‘গুমটি ঘরের পিছনে সরকারের বিঘা খানিক পতিত জমি আছে। ওটাই উপযুক্ত জায়গা।’ রায়বাবু বললেন – ‘কিন্তু ওখানে যে বস্তি গড়ে উঠেছে। দশ – বারোটা পরিবার আছে। ওদের কী হবে?’ সবার এক বাক্যে উত্তর – “সে হবে, এখন আপনি শুধু অনুমতি দিলে হয়। ” রায়বাবু সম্মতি জানিয়ে দিলেন।

পরদিন সকালে পূর্ণিমা বাগানে পায়চারি করছিল। বাবুর অবর্তমানে ষষ্টি,দূর্গাচরণ দুজনেই এসে চুপ করে খবরটা দিদিভাইয়ের কানে তুলে দিল। মনেও করিয়ে দিল – ওই বস্তিতেই আমাদের মাস্টারবাবু থাকেন।

পূর্ণিমা প্রতিজ্ঞা করল – এই উদ্দেশ্য সে কিছুতেই সফল হতে দেবে না। তবে বাবাকে এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলবে না। এখন সে ব্যস্ত আশ্রমের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের জন্য। এও প্রতিজ্ঞা করল যে ,অনুষ্ঠানের দিন সে তার মনের কথাটা মনের মানুষকে জানাবেই।

প্রস্তুতি চলতে চলতেই এসে গেল ১লা বৈশাখ। এবারের অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক বেশি। নানা জায়গা থেকে নামী-দামী ,জ্ঞানীগুণী লোকেরা এসেছেন। এসেছেন খ্যাতিমান শিল্পীরা। প্রিয়তোষ এক ফাঁকে পূর্ণিমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল – ‘অনুষ্ঠান সূচিতে কী কী রেখেছেন ? পপ গানের সাথে কোনো চটুল নাচ নেই তো? আর শিল্পীদের রুচিশীল পোশাক থাকবে তো?’ পূর্ণিমা তার শাড়ির আঁচলে মুখের হাসি লুকিয়ে বলল – আমাকে তোমার কী মনে হয়? এই জানো ,এক সময় আমি ঐ সমস্ত নাচ-গানই ভালোবাসতাম,করতামও । আর এখন,শুনলেও ঘেন্না হয়। সেদিন জীবনটাকে বুঝিনি। এখন কত কদর্য মনে হয়। “বেশ ,ছাড়ুন। সময় হয়ে গেল, শুরু করে দিন। ” ‘দাঁড়াও না ,একটু দাঁড়াও ।’ বড় প্রিয় ,একান্ত আপন জনকে মনের কথাটা বলতে মুখখানা তার ঘামে ভিজে গেল ,কন্ঠনালী সরু হয়ে গেল। অনেক কষ্টে বেরিয়ে এলো মুখ থেকে – ‘প্রিয়, আমি শুধু তোমার বন্ধু নই, তোমার জীবনসঙ্গিনী হতে চাই, এই আমি কথা দিলাম। আর আজ থেকে তোমাকে এই ছোট্ট নাম ধরেই ডাকবো।’ প্রিয়তোষ নিরুত্তরে পূর্ণিমার চোখে চোখ রেখে ক্ষনিক পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তারপর অনুষ্ঠান মঞ্চে ঢুকে গেল।

পূর্ণিমার সঞ্চালনায় দু’ঘন্টার অনুষ্ঠান। সমাপ্তি সঙ্গীত গাইল প্রিয়তোষ। সেই সংগীতের মূর্ছনা এমন যে , সে বুঝিয়ে দিল – ঐশ্বর্যের নিবিড় ছায়াতলে বসে সে স্বর্গসুখ চায় না, দুঃখের মাঝেই তার জীবনের পরম সুখ।



আজকের দুজনের এই এত কাছাকাছি আসা রায়বাবুর চোখে যেন শেল হয়ে বিঁধল। রাত পোহালে গিন্নীও তাকে এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের কথা বললেন – ‘ওগো আমার যে ভয় করছে। ভোরের স্বপ্ন মিথ্যা হয় না। দেখলাম ,আমাদের মামনির সাথে ওই ছেলেটার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি কিছু একটা বিহিত করো। ওকে আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দাও। সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

রায়বাবুও তাঁর সন্দেহের কথাটা বললেন। গিন্নীর এবার দু’চোখের জল প্লাবন হয়ে বয়ে যেতে লাগলো। ‘ওগো ,তাহলে এখন কী করবে?’ “উপায় একটা বের করেছি। আশ্রমে খুব শীঘ্রই শিক্ষামূলক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। ছাত্রছাত্রী ,আমরা সকলেই থাকবো। শিবিরে মধ্যমনি হয়ে উপস্থিত থাকবে আমার বিশ্বস্ত বন্ধু বঙ্গবাসী কলেজের সংস্কৃতের বিশিষ্ট অধ্যাপক ডক্টর মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্য। ছাত্রছাত্রীরা নিশ্চয়ই অজানা কোন বিষয়ের উপর প্রশ্ন রাখবে। উত্তর দেবে প্রিয়তোষ। তা ভুল প্রমাণিত করবে মৃত্যুঞ্জয়। দুদিন আগে প্রিয়তোষ নতুন একটা বিষয় নিয়ে শ্রেণীকক্ষে আলোচনা করেছে। দু’জন ব্রাহ্মণ ছাত্র তা নিয়ে আমার কাছে ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। সময় এসে গেছে। মোক্ষম অস্ত্রটা প্রয়োগ করে অযোগ্য শিক্ষকের কালিমা লেপে দিয়ে এবার নমঃশূদ্র ছোকরাটাকে তাড়িয়ে দেবো। ”

৮ই বৈশাখ ঠিক বিকেল ৫টায় পূর্ব সিদ্ধান্ত মতোই সভা বসল। প্রথমে সকলের সামনে রায়বাবু এই সভার গুরুত্ব নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলেন। এরপর প্রশ্নোত্তর পালা। এক ব্রাহ্মণ ছাত্র জানতে চাইল- সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথা সৃষ্টির কারণ কি? ভট্টাচার্য মশাই ভেবে নিলেন – প্রশ্নটা তাঁরই জন্য ,তাই উত্তরটাও দিলেন , “ জগতের মঙ্গলময় কর্তা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অপার মহিমায় ছোট-বড় ,উঁচু-নীচু বিভিন্ন জাতির মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজে বিভিন্ন রকমের কাজ বিভিন্ন জনের। কে কোন্ কাজ করবে , কে কোন্ কাজের যোগ্য ,তা স্থির করবার জন্যই বর্ণাশ্রম প্রথা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ” রায়বাবু সমর্থন করলেন। গিন্নীমাও পক্ষে সায় দিলেন। পূর্ণিমার ভেতরটা অসন্তোষের উত্তাপে ছটফট করতে লাগলো। প্রিয়তোষ উঠে দাঁড়াল । ভট্টাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বলল – ‘যদি অনুমতি দেন ,আমার কিছু বলার আছে।’ ভট্টাচার্য তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “ আপনি তো আশ্রমের শিক্ষক ,যদি এরপরও কিছু বলার থাকে নিশ্চয়ই বলতে পারেন।” ‘ধন্যবাদ আপনাকে । সকলকে সম্মান জানিয়েই বলছি, মানুষের এই শ্রেণী বিভাজন অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র – এই চার বর্ণের সৃষ্টি মানুষেরই। বৈদিক সভ্যতার যজুর্বেদের যুগে ধর্মশাস্ত্রের রচয়িতাগণ অর্থাৎ পুরোহিতগণ এই বিভাজন প্রথা সৃষ্টি করেছিলেন। এর পাঁচ-ছ’শ বছর আগে অর্থাৎ ঋকবেদের যুগে সমাজে কোনো সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল না।’

এ সময় ভট্টাচার্য রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলেন , “তাহলে আপনি বলতে চাইছেন – জাত-পাত মানুষের সৃষ্টি ?”

হ্যাঁ , ইতিহাস সেকথাই বলে। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে ,ঈশ্বরই উঁচু-নীচু ,ছোট-বড় জাতের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাহলে আপনারাই মিথ্যা বলেন কেন – ‘ঈশ্বরের কাছে তাঁর সব সন্তানই সমান’? এবার বলুন তো – এক পিতা হয়েও তাঁর সব সন্তান সমান নয় কেন? “সমান হবে কী করে? ঋকবেদের অর্বাচীন দশম মণ্ডলে ৯০তম পুরুষ সূক্তে বলা হয়েছে – এক পরম পুরুষ হতে সৃষ্টির সূচনা। যার আকৃতি দশ আংগুল পরিমিত, যার সহস্র মস্তক ,সহস্র চক্ষু, সহস্র চরণ অথচ যিনি সমস্ত পৃথিবীব্যাপী বিরাজমান। যজ্ঞান্তে এই পরমপুরুষকে খণ্ড খণ্ড করে হত্যা করা হলো। তখন তাঁর মুখ হতে ব্রাহ্মণ , বাহু হতে ক্ষত্রিয় ,উরু হতে বৈশ্য এবং চরণ হতে শূদ্রের জন্ম। এদের গুণ ও কর্ম ভিন্ন ভিন্ন। পরবর্তীকালে গীতায়ও সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে – ‘চতুর্বর্ণাং ময়া সৃষ্টং গুণ কর্ম বিভাগশ’ অর্থাৎ আমিই চার বর্ণের সৃষ্টি করিয়াছি। এ তো ঈশ্বরের কথা। এ সত্য কী অস্বীকার করার উপায় আছে?”

থামলেন কেন? বলুন। মনুস্মৃতির বিধানে আরও তো অনেক কিছু আছে। আমি বলছি শুনুন। ‘শূদ্রের জন্মই হয়েছে দাস হবার জন্য। যেহেতু ঈশ্বর তাকে দাস করে সৃষ্টি করেছেন ,অতএব তার কখনো দাসত্ব থেকে মুক্তি হতে পারেনা। শূদ্রের বেদ পাঠের অধিকার নেই, তাই শুধু নয়, শূদ্রের সামনে বেদ পাঠ বা উচ্চারণ করাও অবৈধ। শূদ্রের ধন সঞ্চয়ের অধিকার থাকবে না। কারণ, তাতে ব্রাহ্মণের মনঃকষ্ট হয়। শূদ্রের ধন থাকলে ব্রাহ্মণের তা কেড়ে নেবার অধিকার আছে। আর ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্টই হবে শূদ্রের আহার। শূদ্র হত্যা বা নারী উপপাতক মাত্র অর্থাৎ বেড়াল ,কুকুর ,ব্যাঙ ,প্যাঁচা ,কাক মারার মতো সামান্য অপরাধ। তবে কোনো শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে গালি দেয় তার জিহ্বা কেটে ফেলা হবে ,অথবা যে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছেদন করা হবে।’ এখানেই শেষ নয়। ধর্মশাস্ত্রের যুগে চার বর্ণের নিচে ‘অতিশূদ্র’ নামে আরেক শ্রেণীর সৃষ্টি করা হয়েছিল। এরা ছিলেন বর্তমান দলিত বা মেথর সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষ । ‘এরা গ্রামের বাইরে বাস করবে, মৃতের জামা-কাপড় পরবে ,অনার্যদের হাত থেকে পাওয়া খাবার ভাঙা থালায় খাবে ,নিজেদের মধ্যে বিবাহাদি আদান-প্রদান করবে। ‘ তাহলে বলুন তো – যে পরমপুরুষের চরণ থেকে শূদ্রের জন্ম, তাঁর চরণ কি এতই ঘৃণার ছিল, এতই অস্পৃশ্য ছিল? তাই যদি হয় তবে ব্রাহ্মণেরা তাঁর চরণে পুষ্প দেন কেন ,নৈবেদ্য সাজান কেন?

ভট্টাচার্য্য মনে মনে ভাবছেন – এখন কী উত্তর দেবেন? কথা তাঁর জড়িয়ে যাচ্ছে। বললেন, “ঈশ্বরের লীলা আমরা কি বুঝতে পারি? তাঁর নিয়ম আমরা লঙ্ঘন করতেও পারিনা। ”

‘আপনাকে তবে এখন একটা প্রশ্ন করি। বলুনতো- পরমপুরুষকে কারা হত্যা করেছিল? শাস্ত্রের কথা অনুযায়ী হত্যার আগে নিশ্চয়ই পৃথিবীতে মানুষের উপস্থিতি ছিল। ওই মানুষ কে বা কারা? তাদের তো পরমপুরুষ সৃষ্টি করেননি। তবে তো বলা যায় – পরমপুরুষ বা ঈশ্বরের সৃষ্টির আগেই মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল। কী বলবেন এ বিষয়ে ?’

ভট্টাচার্য্য যেন দিশেহারা হয়ে পড়লেন। প্রিয়তোষ মৃদু হেসে বলতে লাগল, ‘ডারউইনের বিবর্তনবাদ পরীক্ষিত সত্য। ওই পরম পুরুষের কাহিনীটা মনগড়া ,নিছক কল্পনা।’ যাইহোক এবার যে আপনাকে স্বীকার করতেই হয় – জাত-পাত,উঁচু-নীচু এই বিভাজন মানুষেরই সৃষ্টি। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল – জনসাধারনের বিপুল গরিষ্ঠ অংশকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে ধর্মশাস্ত্রের অমানবিক বিধানের সাহায্যে শাসন-শোষণ বজায় রাখা এবং দ্বিজ শ্রেণীর মানুষগুলোকে পরিচর্যা করা। আর তার জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুলসংখ্যক মানুষের অর্থাৎ শূদ্রের। এই শূদ্র কারা ছিল জানেন ? আর্য-অনার্য লড়াইয়ে প্রধানত পরাজিত এবং দাস শ্রেণীতে রূপান্তরিত ভূমিপুত্র অনার্য , বিত্তহীন এবং জীবিকাহীন নিঃস্ব কিছু সংখ্যক আর্য,এছাড়া আদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের অভ্যন্তরে যজ্ঞকর্ম পরিত্যাগ করা এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করা আদি ক্ষত্রিয় শ্রেণীর অনেক উপজাতি। কথাগুলো আমার নয়, প্রাচীন ভারত বিশেষজ্ঞদের। এছাড়া এই কথাটাও মনে রাখবেন – পরবর্তীকালে অত্যাচারিত এই মানুষগুলোর অনেকেই খ্রিস্টান এবং মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

রায়গিন্নি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলেন। পূর্ণিমা মাথা উঁচু করে প্রিয়তোষের মুখপানে তাকিয়ে আছে ,মনে মনে ভাবছে- এই বলিষ্ঠ যুক্তির কাছে সবাই হারতে বাধ্য।



কিন্তু রায়বাবু বলে বসলেন , “দেখো বাপু ,ওসব শাস্ত্র-টাস্ত্র বুঝিনা। ইতিহাসে একদা কী ঘটেছিল তাও জানতে চাই না। আমি শুধু বলব- বর্ণে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ,তাঁদের সাথে তুমি শূদ্রের তুলনা করতে পারো না। জ্ঞানে-গুণে-পাণ্ডিত্যে ব্রাহ্মণ চিরকালেই শ্রেষ্ঠ।

প্রিয়তোষের দৃষ্টি এবার ঊর্ধ্বপানে। উত্তর দিলো- ব্রাহ্মণ যদি বর্ণে শ্রেষ্ঠ হয়েই থাকে তবে গিন্নীমা তো শ্যামল বর্ণের ,ভট্টাচার্য মশাইয়ের গায়ের রং কালো, এঁনারা বুঝি ব্রাহ্মণ নন ? আমাদের সমাজের একজন বড় মানুষ ভগবান রূপে পূজিত হন যাঁর মুখনিঃসৃত বাণীই হলো ‘গীতা’ ,সেই শ্রীকৃষ্ণও শ্যামল বর্ণের ছিলেন। তাহলে গায়ের রং দিয়ে কি শ্রেষ্ঠ ,নিকৃষ্টের বিচার হতে পারে ? শারীর বিদ্যায় তো প্রমাণিত – গায়ের বর্ণ ভৌগোলিক স্থান, জলবায়ু , খাদ্য এবং রাসায়নিকের উপরও নির্ভর করে। আর জ্ঞান, গুণ, পাণ্ডিত্যের কথা বলছেন, ভাবুনতো, যাদের আপনারা শূদ্র বলেন ,কত হাজার বছর যাবত তাদের শিক্ষালাভ করতে দেওয়া হয়নি। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আজকে দেখুন – ওই বঞ্চিত ,অবহেলিত মানুষগুলো কোথাও ,কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই।

ভট্টাচার্য ভাবতে লাগলেন – ‘কী অসাধারণ জ্ঞান ! বিজ্ঞান ,শাস্ত্র সব গুলে খেয়েছে ।’ রায়বাবু মনে মনে গাল দিচ্ছেন আর ভাবছেন – পাজি, হতচ্ছাড়াটাকে কোনভাবেই জব্দ করতে পারছিনা। পরক্ষণেই বলে উঠলেন – ‘সে তুমি যা-ই বলো, বংশের একটা মর্যাদা আছে ।’ প্রিয়তোষ এবার একটু ব্যঙ্গ করেই উত্তরটা দিতে বাধ্য হল – আচ্ছা, ব্রাহ্মণের ঘরে কুলাঙ্গার ,নির্বোধ জন্ম নিলেও সে ব্রাহ্মণ? আর শূদ্রের ঘরে একজন বড় মানুষ জন্মালেও সে নীচু ,ঘৃণার পাত্র হবে ?

গিন্নিমার এতক্ষণে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। তিক্ত-বিরক্ত হয়ে রায়বাবুর দিকে রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আপন মনে বলে বসলেন – এদেরকে লেখাপড়া শিখতে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। এরপর উঠে গর্জাতে গর্জাতে চলে গেলেন। পূর্ণিমা বাবাকে কানে কানে বললো – ভট্টাচার্যকে ডেকে এনে তুমি ভুল করেছো। ভেবেছিলে প্রিয়তোষকে সবার সামনে ছোট করবে, তা আর পারলে না। উল্টে তোমরাই ছোট হয়ে গেলে। তোমাদের কীসের এত অহংকার আমি জানি না। ওর বড়ত্বকে প্রথমেই স্বীকার করে নিলে পারতে। “কিছুতেই না, আমি কোনদিনই স্বীকার করবো না। ব্রাহ্মণ হয়ে শূদ্রের কাছে মাথা নত ? এ তো রায় পরিবারের কাছে মর্যাদার প্রশ্ন। মর্যাদা হানি হয় তুই এমন কিছু করতে আমাকে বাধ্য করতে পারিস্ না। এ ব্যাপারে আমাকে পরামর্শ দিতে তোর সাহস হয় কী করে ?”

ভট্টাচার্যের মাথা নিচু দেখে প্রিয়তোষ বলল- স্যার, আপনি বোধ হয় এখনও দ্বন্দ্বে ভুগছেন। সব মানুষকে এক সারিতে কী করে দাঁড় করাবেন, ভাবছেন। যা সত্য তা মেনে নিতেই হয়। তার সামনে কোন সংস্কার অনন্তকাল প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মনে রাখবেন – মানুষ চিরদিনই যাযাবর। আজ অবধি পৃথিবীর সকল মানুষই প্রায় পঁচাত্তর হাজার বছর আগে মধ্য আফ্রিকা থেকে স্থানান্তরিত মানুষের বংশধর। তারা ক্রমাগত এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। মানুষে মানুষে সংমিশ্রণ হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব সতেরোশো সাল নাগাদ সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে প্রায় তিন হাজার সাড়ে সাতশো বছর আগে এদেশে আসে । তখন এখানে নিগ্রো ,দ্রাবিড় ,অস্ট্রিক,মোঙ্গোলয়েড প্রভৃতি প্রাচীন জাতিভুক্ত মানুষের বসবাস ছিল। প্রকৃতপক্ষে আর্যরা কোনো জাতি ছিল না। তারা ছিল একটা ভাষা গোষ্ঠী, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী। এই শব্দের জন্ম ঋকবেদে। স্তোত্র রচয়িতাগণ নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতেন। আর্যরা তাদের যাত্রাপথে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং এদেশের প্রাচীন জাতির মানুষের সাথে মিশেছে , তাদের মধ্যে সংমিশ্রণ হয়েছে। তাই আজ আর বিশুদ্ধ জাতি বলেও কিছু নেই ,বিশুদ্ধ আর্য রক্ত বলেও কিছু নেই।

ভট্টাচার্য উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “সবই ঠিক। কিন্তু মুশকিল হল – মানুষের সংস্কার বড় বাধা। হয়তো চিরকাল এমনটা থাকবে না। তবে সেইদিন আসতে এখনও অনেক দেরী ,”এই বলে রায়বাবুর সাথে পা মেলাতে শুরু করলেন। রায়বাবু বললেন – ভটচায্ তুমি মেনে নিলেও আমি কিন্তু……….। “না,রায় ,এ গোঁড়ামি, দম্ভ, অভিজাত্যের অহংকার। সবই একদিন সত্যের কাছে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।”

ছাত্রছাত্রীরাও তাদের প্রিয় স্যারকে ধন্যবাদ জানিয়ে একে একে চলে গেল। চারদিকে বিদ্যুতের বাতিগুলো ঝলকানি দিয়ে জ্বলে উঠলো। প্রিয়তোষ চলে যেতে উদ্যত হলে পূর্ণিমা পিছন থেকে ডাক দিল- একটু দাঁড়াও না। কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর অন্ধকার আকাশজুড়ে তখন তারাদের মেলা। আশ্রমের সামনে উদ্যানটা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। জুঁই ,করবী ,কামিনীর সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। ‘প্রিয় ,এসো না বাগান দেখবে।’ পূর্ণিমার এ আমন্ত্রণ আজ জানি না কেন ফেরাতে পারল না ,গ্রহণ করলো প্রিয়তোষ। বললো – কতজন কত সুন্দর করে উদ্যান সাজায় ,কত ফুল ফোটে ,ফল ধরে ,মৌমাছি-প্রজাপতিরা আসে, সুবাস ছড়ায় চারদিকে । কিন্তু জীবনের উদ্যান ক’জন সাজায় ! “বেশ তো ,তুমি সাজাবে ।” “কী করে সাজাবো ? আমার আকাশ যে ঘন অন্ধকারে ঢাকা।” “সেই অন্ধকার আকাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়তে চায়। তোমার মন কি এতই অবুঝ যে ,তার ঈশারাটুকু বোঝে না ?” হয়তো বুঝেও বোঝে না ,হয়তো বা কোনদিনই বুঝবে না। কেননা , এ সমাজ তার চারপাশে গণ্ডী এঁকে দিয়েছে। সেই সীমা উত্তরনের সাহস সে করে না। ” “সে কি এতই কাপুরুষ যে, সমাজের তৈরি মিথ্যা নিয়ম সে মেনে নেবে ?” “না, তা নয় । আসলে সেই সীমা উত্তরণের স্বপ্ন সে দেখেনা। যদি তপ্ত মরুবুকে বালির ঝরে স্বপ্ন তার চাপা পড়ে যায় অথবা দুহাত বাড়িয়ে সেই স্বপ্নকে ছোঁবার আগেই মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে যায়। ” “এই কি তোমার শেষ কথা ? তাহলে মনে রেখো যদি দু’হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতে না পারো ,যে পূর্ণিমা একদিন মেয়ে হয়েও শক্ত হাতে বুক চেপে ধরে মুখ ফুটে বলেছিল -আমি তোমার জীবনসঙ্গিনী হতে চাই ,তার আলো চিরকালের জন্য নিভে যাবে , মিলিয়ে যাবে অমাবস্যার অন্ধকারে ।” “ম্যাডাম ,আপনি আমাকে এত ভালবাসেন ! তাই যদি হয় তাহলে আমিও স্বপ্ন দেখতে রাজি আছি ।” “তাহলে ‘ম্যাডাম’ নয় ,আজ থেকে পূর্ণিমা , ‘আপনি’ নয় , আজ থেকে ‘তুমি’ বলো, শুধু এইটুকুই তোমার কাছে আমার চাওয়া ,আর কিছু নয়।” “বেশ তো, এইটুকু না হয় আমি আপনার কাছে ঋণী থাকলাম ।যদি কোন একদিন সেই শুভক্ষণ আসে, সব ঋণ মিটিয়ে দেবো। ” “বেশ, তাই দিও।” এমন সময় দুর্গাচরণ পিছন থেকে ডাক দিল – মাস্টারবাবু,বাবু আপনাকে ডাকছেন।

প্রিয়তোষ ভেতরে গেল। গিন্নীমাও আছেন। রায়বাবু বললেন , “তোমার জ্ঞান-গরিমা নিয়ে আমাদের কোন প্রশ্ন নেই। ইতিহাসের যে সত্য তুমি উদঘাটন করেছো ,তাতেও আমাদের দ্বিমত নেই । তবুও বংশমর্যাদা এবং আমার একমাত্র মেয়ের কথা ভেবে তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, তুমি এই আশ্রম ছেড়ে চলে যাও। শুধু তাই নয়, ঐ বস্তি ছেড়ে সপরিবারে দূরে কোথাও চলে যাও। দশ লক্ষ টাকার একটা চেক দিচ্ছি, ভাঙ্গিয়ে নিও । আশাকরি এতে কোথাও একটা বাসস্থান বানিয়ে নিতে পারবে। আর হ্যাঁ ,ক’দিন পরেই তো পি.এইচ.ডি টা হয়ে যাবে । যদি চাও ,কলেজের লেকচারার পদে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। এই পদের জন্য কুড়ি-পঁচিশ লাখ টাকা ডোনেশন লাগে, কিন্তু তোমাকে এক পয়সাও দিতে হবে না ।” গিন্নীমাও বললেন – চাকরিটা তুমি নিয়ে নাও , সুখে থাকবে ।

প্রিয়তোষ উঠে দাঁড়াল। বলল – ‘আপনার এতগুলো শর্তের মধ্যে আমি দুটো মেনে নিচ্ছি । আশ্রম আমি এই মুহূর্তেই ছেড়ে দিলাম। আপনার বংশ মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কাজও আমি জীবনে করব না। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে বা কারো দয়ায় আমি চাকরি করতে চাই না। কেননা ,আমি মনে করি – তাতে জীবনের কোনো গৌরব নেই। আর যে বস্তিতে আমি বড় হয়েছি, যেখানে জীর্ণ কুটিরের ছায়াতলে কত দুঃখের স্মৃতি নিত্য প্রতি মুহূর্তে আমাকে প্রেরণা দেয়, সেই বস্তি আমি ছেড়ে চলে যেতে পারবোনা । তবে এই আমি কথা দিলাম – আপনার কোন ক্ষতি বা অসম্মান হবে না।’ “তাহলে তুমি বস্তি ছেড়ে যাবে না ?” ‘না’। দরজা পেরিয়ে গেল প্রিয়তোষ ,মিলিয়ে গেল অন্ধকারে ।

সেই রাতেই রায়বাবু দলের বিশ্বস্ত লোকজনকে দিয়ে বস্তির বাড়ীঘরগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। পরদিন ভোর না হতেই নির্মম খবরটা দূরদর্শন চ্যানেলে সম্প্রচার হতে লাগলো। কীভাবে আগুন লেগেছে কারও জানা নেই। বারবার ফোন আসতে লাগল রায়বাবুর কাছে। দলের লোকজনের আনাগোনা বাড়তে লাগল। সাহায্যের উদারহস্ত নিয়ে হাজির হলেন সশরীরে রায়বাবু। শোক-তাপ , দুঃখপ্রকাশ কোন কিছুই তিনি বাকি রাখলেন না।

বাড়িতে পূর্ণিমা ব্যাকুল হয়ে দুর্ভাবনার প্রহর গুনছে । শতবার ফোন করতে লাগল প্রিয়তোষকে। বারবার একই উত্তর – ‘আপনার ডায়াল করা নম্বরটি পরিষেবা সীমার বাইরে’। অচেনা একরাশ ভয় এসে ঘিরে ধরলো পূর্ণিমাকে।

সূর্য মাথার উপরে। ফিরে এলেন রায়বাবু। পাশের ঘরে শুরু হয়েছে স্ত্রীর সংগে চুপিসারে কথা কাটাকাটি। “কাজটা করে মোটেই ঠিক করোনি। পছন্দ করি না, মেনে নিতে পারি না, তাই বলে আগুন লাগাতে হবে ? মৃত্যুর কোন খবর নেই তো ?” “না ,তবে মরলেও এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এক ঢিলে অনেকগুলো পাখিও মরল। দলের গায়ে কলঙ্ক লাগলো না। ওখানে পার্টি-অফিস হবে। ছোকরাটাকে আশ্রম ছাড়া করতে পারলাম। মামনিকে এবার ভালো জায়গায় পাত্রস্থ করতে পারবো। ”

পূর্ণিমা আকুল হয়ে ছুটে এসেছিল বাবার কাছে খবরটা জানতে। এখন জানালার এপাশ থেকে নিজের কানে সব শুনতে পেয়ে জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল। তার বুক ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে বড় অপরাধী মনে করছে , “বস্তি উচ্ছেদের কথা জানতে পেরেও কিছু করতে পারিনি। এমন নির্মম ঘটনা ঘটানো হবে তাও আবার হঠাৎ করে, বুঝতে পারিনি ঘুর্ণাক্ষরেও।” সেই যন্ত্রণা সইতে না পেরে সোজা গিয়ে দাঁড়াল বাবা মায়ের সামনে। দুচোখের জল প্লাবন হয়ে বইতে লাগলো। “বাবা এত নিষ্ঠুর তুমি!কী করে পারলে এতটা নীচে নামতে ?” “সবকিছু তোর মঙ্গলের জন্যই। তোর জন্য আমি ব্রাহ্মণ আই.এ.এস পাত্র ঠিক করে রেখেছি । শীঘ্রই আমি তোর বিয়ে দেবো।”

“না বাবা, বিয়ে আমি করবো না। মনে রেখো – বড় জাত,বড় পদ নয় , মানুষের আসল পরিচয় তার আদর্শ আর সংস্কৃতির মধ্যে। আজ তোমাকে আমি আরও কয়েকটা কথা বলতে চাই। একজন পরহিতব্রতী, সৎ ব্রাহ্মণ হয়েও আজ কী করে নাম-যশ-খ্যাতি-সম্পদের লোভে নিজের বিবেক মনুষত্বকে চূড়ান্ত অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিতে পারলে! যে রাজনীতি আর ক্ষমতা তোমাকে এমন নির্মম পাষণ্ড করে তুলেছে তার প্রতি আমার সহস্র ধিক। ছি! তুমি আমার বাবা? যে অন্যায়, অপরাধ তুমি করেছো তা ক্ষমাহীন। হয়তো কোনদিন তা আমি কাউকে বলতে পারব না ,তোমার স্নেহ-মমতা-ভালোবাসায় মানুষ হয়েছি বলে। অশ্রুসাগরপারে যতদিন বাঁচবো হৃদয়ের এক কোণে এই যন্ত্রণা জমিয়ে রাখবো। আজ আমি আমার জীবনের সর্বস্ব তিস্তার জলে বিসর্জন দিলাম। তুমি মনে ক’রো তোমার আদরের পূর্ণিমা মরে গেছে।”

এরপর বারোটা বছর ধরে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলো তবু পূর্ণিমার আলো বিহীন ছিল রায়বাবুর ঘর। এরই মাঝে গিন্নীমা জীবনের বন্ধন কাটিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। ষষ্ঠী কাজ ছেড়ে চলে গেছে। রায়বাবু বড় একা। স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। সঙ্গী এখন একমাত্র দুর্গাচরন। আশ্রমটাও নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। শয্যাগত পূর্ণিমা দিনরাত মৃত্যু কামনা করে। বাবা এসে পাশে বসে সান্তনা দেন। একদিন বললেন – ‘মা ,আমি তাকে অনেক খুঁজেছি, কোথাও সন্ধান পাইনি । সে যদি একটিবার আমার সামনে আসত, আমি তাকে বলতাম – বাবাগো ,আমার সব অহংকার ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।’ “সে আর কোনদিন ফিরবেনা বাবা । হয়তো বা বেঁচে নেই,”বলতে বলতে জ্ঞান হারায় পূর্ণিমা। ডাক্তার আসেন বাড়িতে। রুগী দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে বললেন – আপাতত বিপদমুক্ত।

পৌষের এক সকালে দুর্গাচরণ এসে খবর দিল – ‘দিদিমণি ,মাস্টারবাবুর খোঁজ পাওয়া গেছে। এই দেখো কাগজে তার কথা লিখেছে।’ পূর্ণিমা কাগজটা হাতে নিয়ে লেখাগুলো পড়ে । “ দিনমজুরের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রিয়তোষ সরকার বস্তিবাসীর জন্য একটি অবৈতনিক বেসরকারি বিদ্যালয় স্থাপন করে কীর্তি স্থাপন করেছেন ।………. ।” পূর্ণিমা বিশ্বাস করে – এ-ই সেই প্রিয়তোষ ,তার ‘প্রিয়’ ।

অনেকদিন পরে সে আজ নিজে থেকে বিছানায় উঠে বসল। নিভু নিভু প্রাণটা অদৃশ্য কোন্ মহাশক্তিবলে যেন একটু প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার প্রেরণা পেল।

তবুও তো মেঘে ঢাকা পূর্ণিমার নিস্প্রভ আলো ঘরজুড়ে। এই আলো আমি একদিন নিজের হাতে নিভিয়ে দিয়েছিলাম , ভাবতে ভাবতে এবার বিছানায় পড়লেন রায়বাবু। মেয়েকে শুধোলেন , “কোনো সন্ধান পাওয়া গেল ? সে কি ফিরে আসবে মা ?” ‘না বাবা, আমি কিছুই জানিনা । তার সন্ধান নেবার আমার কি আর অধিকার আছে বাবা ?’ “হ্যাঁ মা ,তার জন্য আমিই দায়ী ।” ‘থাক্ না বাবা , এসব ভাবলে তোমার শরীর যে আরও খারাপ হবে।’

একদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হল – “রায়পুরের অনাথ আশ্রমের (বর্তমানে নিশ্চল) প্রতিষ্ঠাতা সুনীল রায় (রায়বাবু) গুরুতর অসুস্থ। ……। ” খবরটা চোখে পড়ল প্রিয়তোষের। স্মৃতির পাতাগুলো ওল্টাতে থাকল আপনা থেকেই। মন তার একদিকে যেমন অতীতের পাথরচাপা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল, অন্যদিকে বাবুকে অন্তিম লগ্নে একটিবার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল।

মাঘের প্রথম সপ্তাহে এক পড়ন্ত বেলায় উত্তরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ঠেলে প্রিয়তোষ এসে পা রাখল রায়বাবুর বাড়ির দরজায়। দুর্গাচরণ তাকে ভেতরে নিয়ে এসে আনন্দে চীৎকার করে উঠল – ‘বাবু, দেখুন কে এসেছে ?’ “কে এসেছে ?” ‘আমাদের মাস্টারবাবু গো ।’ বাবু পাশ ফিরে তাকাতেই প্রিয়তোষ জিজ্ঞেস করল – ‘কেমন আছেন কাকাবাবু ?’ “প্রিয়তোষ ,তুমি এসেছো বাবা ! এতদিন কোথায় হারিয়ে গেছিলে ? না না, ভুল বললাম। তুমি হারিয়ে যাবে কেন ? আমিই তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।” চোখের কোণে তাঁর বিন্দু বিন্দু জল এসে জমে।

থাকনা কাকাবাবু ,পেছনের কথা আজ নাইবা মনে করলেন। যে অতীত দুঃখ দেয় তা না হয় পাথরচাপাই থাক্ । আমরা বরং অন্য কথায় আসি। আপনার শরীর খারাপ শুনে ছুটে এলাম।……..।

পাশের ঘরে আজ হালকা জ্বর নিয়ে পূর্ণিমা শুয়েছিল। বড় চেনা গলার আওয়াজ শোনা মাত্র জ্বর ছেড়ে গেল। ক্ষণিক পরে এক হাতে প্লেট ভর্তি মিষ্টি ,অন্য হাতে জলের গ্লাস নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। প্রিয়তোষ তার মুখপানে মুহূর্তকাল তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এত কাছাকাছি তবু যেন আজ একে অন্যের থেকে সহস্র যোজন দূরে। পূর্ণিমাও ‘প্রিয়’ বলে সম্বোধন করল না। মিষ্টির প্লেট আর জল সামনের টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করল – ‘কেমন আছেন দাদা ?’ চেনা হয়েও কত অচেনা মুখের এমন জিজ্ঞাসায় প্রিয়তোষকে আজ আর কোনো কিছুই ভাবিয়ে তুলল না। ‘ ভালোই আছি, ‘ বলেই পাল্টা জিজ্ঞাসা – ‘আপনি ভালো আছেন ?’ পূর্ণিমা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলল না। “আপনি খেয়ে নিন ”, শুধু এইটুকু বলে চলে গেল।

কিছুক্ষণ বাদে দুর্গাচরণ এসে সামনে দাঁড়ালো। প্রিয়তোষ শুধোল – ‘ফুলের বাগানটা কি আগের মতই আছে ?’ ‘মাস্টারবাবু, কী আর বলবো , চলুন না, নিজের চোখেই একবার দেখবেন।’

প্রিয়তোষ বাগানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল- পূর্ণিমা একটা জীর্ণ বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ‘ম্যাডাম ,সব তো শেষ হয়ে গেছে।’ বাগানটাকে চেয়ে চেয়ে দেখে পূর্ণিমা। ‘আপনি বুঝি এখন বাপের বাড়িতেই থাকছেন ? অবশ্য কাকাবাবুর এই অবস্থায় ……. । তা শ্বশুরবাড়ি ……..?’ মুহূর্তে মৃতপ্রায় শিরা-উপশিরাগুলোর রক্ত বেগে বইতে লাগল। চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এসে বিঁধল প্রিয়তোষের চোখে। “ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কি আমাকে দেখে এইটুকুও বুঝতে পারে না ?” ‘কী বলুনতো ?’ প্রিয়তোষ তার মুখের দিকে তাকায়।পূর্ণিমা বলে ,“না থাক্ , সেই জ্যোৎস্নার আলো আর যে নেই ,সব অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আমার কথা না হয় আজ আর নাই ভাবলেন ,আপনার সংসার জীবন ভালো কাটুক, এইটুকুই কামনা করি।” ‘না সেই সৌভাগ্য আমার জীবনে আসেনি। আর তা আশাও করিনা।’ “আপনার বাবা – মা বেঁচে আছেন ?” ‘না’, একটা দীর্ঘশ্বাসে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল । ‘বেশ চলি ,ভালো থাকুন’ , এই বলে প্রিয়তোষ গমনোদ্যত হতেই পূর্ণিমা মাথাঘুরে মাটিতে পড়ে গেল। পারলোনা প্রিয়তোষ চলে যেতে। ফিরে এসে দুহাত বাড়িয়ে বুকে তুলে নিল যখন ,ওপ্রান্তে মরা স্রোতোস্মিনীর বুকে তখন উদ্যাম জোয়ার ,জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে সে মনের কথা উজাড় করে বলে উঠলো – “পারোনা , যে অন্ধকারে চাঁদের জোছনা ম্লান হয়ে গেছে , সেই অন্ধকার সরিয়ে আবার জোছনায় ভরিয়ে তুলতে ?” ‘পূর্ণিমা , তা হয়তো পারি , কিন্তু মর্যাদা হারিয়ে তোমাকে কখনো পেতে চাই নি ,আজও চাই না । সমাজ আজও সত্যকে মেনে নেয় না, স্বীকৃতি দেয় না।’ “স্বীকৃতি! চেয়ে দেখো, ঐ দরজার ওপারে রুগ্ন শরীরে দাঁড়িয়ে যিনি আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন, একদিন তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় বাধা। তিনি আজ প্রাণভরে আমাদের আশীর্বাদ করছেন। এর চেয়ে আর বড় স্বীকৃতি কী হতে পারে ?”


গোধূলির সূর্য অস্ত গেলে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল আকাশে। সুন্দর পৃথিবী আরও সৌন্দর্যে ভরে উঠলো। সেই সৌন্দর্যময় উদ্যানে বসে প্রিয়তোষ হৃদয়-জমিনে সদ্য অঙ্কুরিত এক মহতী ইচ্ছা প্রকাশ করল – “পূর্ণিমা ,এই মৃত আশ্রমটাকে আমরা আবার নতুন জীবন দেবো। তবে তা আর আশ্রম থাকবে না ,তা হবে আলোর দিশারী ‘আবাসিক দুস্থ বিদ্যানিকেতন’ , কথা দাও। “কথা দিলাম ।”

……………………………………………………

1 thought on “Aadhar Periye – আঁধার পেরিয়ে”

Comments are closed.